কাচ্চি বিরিয়ানি
২৭ মে ২০২০ ২০:২২
ঘুমিয়ে ছিলাম, ছিলাম ভালো! জেগে দেখি ঘুম নাই! ঘুম নাই! আরে ঘুম থাকবে কী করে? সারা ঘর আমার কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধে ম ম করছে। মুখে আমার লোল চলে আসলো। দ্রুত রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেলাম।
মনটা আজ আমার বেজায় খুশি। একে তো ছুটির দিন। তার উপর বউ আমার পছন্দের খাবার রান্না করছে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আজ দুপুরে কমপক্ষে তিন প্লেট কাচ্চি বিরিয়ানি কুপিয়ে দিবো! তারপর আয়েশ করে একটা বিরিয়ানি ঘুম দিবো। সবাই ভাত খেয়ে দেবে ভাত ঘুম! আর আমি দিবো বিরিয়ানি ঘুম! এরেই বলে রাজা-বাদশার কপাল!
তাছাড়া ঘুমানোর আগে বিরিয়ানির ছবি ফেসবুকেও পোস্ট করে দিবো। সবাই হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরবে। তা ওরা মরলে মরুক, আমার কী? এযুগের মানুষগুলা সব কেমন যেন। সবার বুক ভরা পেট ভরা শুধুই হিংসা। একজনের ভালো কিছু আরেকজন দেখতে পারে না। অদ্ভুত সব উজবুক চারিদিকে।
বউ রান্না করছিলো। আমি পিছন থেকে গিয়ে খুশি খুশি গলায় বললাম,‘তোমার মত বউ আর হয় না? তুমি বুঝলে কী করে যে, আজ আমার কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে খুব ইচ্ছা করছে?’
আমার কথা শুনে বউ বিরক্ত হয়ে বললো,‘কাচ্চি বিরিয়ানি কোথায় পেলে?’
আমি চুলার উপরে থাকা হাঁড়ি দেখিয়ে বললাম,‘ওই যে রান্না হচ্ছে! কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধে সারা ঘর ম ম করছে!’
বউ আমার মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,‘আমি কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করছি না। কুঁচো চিংড়ি দিয়ে পেঁপে ঘন্ট আর মুগ ডাল রান্না করছি।’
বউয়ের কথা শুনে মনে হলো, ‘আমার মনের মধ্যে কেউ পারমানবিক বোমা ফেলেছে! সবকিছু জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে!’
তবুও মনটাকে বাঁচাতে শেষ ভরসা হিসেবে বললাম,‘আমার সাথে মজা করছো না তো? খাবার টেবিলে কাচ্চি বিরিয়ানি দিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চাও তো? আমি সব বুঝে গেছি!’
বউ এবার আগের চেয়ে মুখটাকে আরো বাঁকিয়ে হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখালো। আমি বিষ্ফোরিত নয়নে দেখলাম, বউয়ের কথাই সত্যি। কুঁচো চিংড়ি ও পেঁপে ঘুটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
একবার মনে হলো ওরা আমাকে দেখে হাসছে আর বলছে,‘কী জামিল সাহেব? কাচ্চি বিরিয়ানি খাবেন? বেড়ে দেই? দিবো?’
আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। কোন আপন বউ এমন করতে পারে আমার বিশ্বাস হয় না। কাচ্চি বিরিয়ানির গন্ধ আরো বেড়েছে। এতক্ষণে আমি খোঁজ পেয়েছি কোথায় কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। আমার উপর তলায় সামাদ সাহেবের বাসায়। খুবই বদ লোক। মাসে দশ থেকে পনেরোবার কাচ্চি বিরিয়ানি খাবেই খাবে! এত বিরিয়ানি খাবার টাকা কোথায় পায় কে জানে। অবৈধ কোন কারবার করে মনে হয়! এসব যখন ভাবছি, তখন রুমে বউয়ের আগমন।
‘ময়লা ফেলে দিয়ে আসো।’
আমি এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলাম। ঘরে আর ভালো লাগছিলো না। ময়লা ফেলার উছিলায় মনটাকে একটু হালকা করা যাবে। একটু আগে মনের মধ্যে পারমাণবিক বোমা মেরে বউ খুব অমানবিক একটা কাজ করেছে! এখন ময়লা ফেলতে গিয়ে মনটায় একটু সতেজ বাতাস ভরে আনতে হবে।
নিচে নামতেই রফিক সাহেবের সাথে দেখা। রফিক সাহেবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম,‘সামাদ সাহেবের তো ঘাপলা আছে?’
রফিক সাহেব অবাক হয়ে বললেন,‘কী ঘাপলা?’
আমি এবারে রফিকের সাহেবের দিকে একটু ঝুঁকে এসে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, ‘আর বলবেন না! প্রতিদিন কাচ্চি বিরিয়ানি খায়!’
রফিক সাহেব হেসে বললেন, ‘এর মধ্যে ঘাপলার কী আছে? বিরিয়ানি হয়তো বেশি ভালো লাগে, তাই খায়!’
‘আরে বুঝেন না ক্যান? করে তো কেরানীর চাকরি। এই চাকরি করে মাসে পনেরো দিন কাচ্চি বিরিয়ানি কিভাবে খায়?’
রফিক সাহেব এবার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘এই ব্যাপারটা তো ভেবে দেখি নাই। আসলেই তো! ঘাপলা একটা আছেই মনে হচ্ছে!’
রফিক সাহেব চিন্তা করছেন। আমি নিশ্চিন্তে ময়লা ফেলতে চলে গেলাম। এখন একটু ভালো লাগছে। মনটার ক্ষতও মনে হয় কিছুটা কমেছে! এখন যা করার রফিক সাহেবই করবেন। ময়লা ফেলে আবার বাসার দিকে আসছি, এমন সময় পাঁচতলার নিলু ভাবীর সাথে দেখা। আমিই নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে বললাম, ‘ভাবী সামাদ সাহেব রেগুলার ঘুষ খান, এ ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন?’
নিলু ভাবী চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘বলেন কী ভাইজান? ঘুষ? আপনি জানলেন কী করে? আপনাকে বলেছে নাকি?’
‘ছিঃ ছিঃ ভাবী এসব কেউ মুখে বলে নাকি? সব বুঝে নিতে হয়!’
‘আপনি কিভাবে বুঝলেন?’
‘তাদের বাসায় প্রতিদিন কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না হয়। জানেন তো কাচ্চি বিরিয়ানি রান্নায় কত খরচ পড়ে? এবার তাহলে হিসেবটা মিলিয়ে নিন।’
‘ঠিক বলেছেন ভাইজান। আমারও আগেই সন্দেহ হয়েছিলো। যাই দুই তলার পশ্চিম পাশের সুলতানা ভাবীকে ব্যাপারটা জানিয়ে আসি।’
এখন আমার বেশ সুখ লাগছে। আমি খুব সফলভাবে একটা প্যাঁচ লাগিয়ে দিতে পেরেছি। এই নিলু ভাবী এখন মিডিয়ার কাজটা করবেন। খবরটা পুরো বিল্ডিংয়ে ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা সময় লাগবে না। নিলু ভাবী দেশের এক নম্বর দৈনিক পত্রিকার থেকেও বেশ এগিয়ে!
বাসায় ফিরে এসে আমি ফেসবুকে বসলাম। এই বিষয়টা নিয়ে একটা স্ট্যাটাস দিতে হবে। দেশবাসী সবাইকে জানাতে হবে।
আমি সামাদ সাহেবের নামে কড়া করে একটা স্ট্যাটাস লিখে ফেসবুকে আপলোড দিলাম। মুহূর্তেই লাইক কমেন্ট এসে ভরে যেতে লাগলো। টপাটপ শেয়ারও হতে লাগলো। এখন আমার বেশ তৃপ্তি লাগছে। এমন তৃপ্তি মনে হয় কাচ্চি বিরিয়ানি খেলেও হতো না।
এত কিছু করার পরও আমার হাতটা নিশপিশ করতে থাকলো। ইচ্ছা করছে রিকশায় ঘুরে ঘুরে মাইক দিয়ে খবরটা সবাইকে জানাতে। কত্তবড় সাহস এই দুর্মূল্যের বাজারে প্রতিদিন বিরিয়ানি খায়। তাও আবার কাচ্চি বিরিয়ানি! ভাবা যায় এগুলা!
বউ এসে ডাকলো,‘খেতে আসো। টেবিলে খাবার দিয়েছি।’
আমার বলতে ইচ্ছা করছিলো কুঁচো চিংড়ি দিয়ে তোমার ওই পেঁপে ঘন্ট তুমিই খাও! কিন্তু বলতে পারলাম না। কারণ আমাকে এই
খেতে হবে। তাছাড়া দেশে এখন লকডাউন চলছে! যদি বাসা থেকে বের করে দেয় তাহলে এই বিপদে যাব কোথায়!’
বউকে বললাম, ‘তুমি যাও, আমি আসছি।’
মনে মনে বললাম, সামাদ সাহেবকে আরো কিভাবে বাঁশ দেয়া যায়। আচ্ছা আমি কী বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলবো? একজন ঘুষখোরের সাথে থাকাটাও মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। কথায় বলে, সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। এই সামাদ সাহেবের সাথে
থাকলে আমাদের সবার সর্বনাশ হবে। আমাকে এখুনি কিছু একটা করা দরকার!
আমি বাড়িওয়ালাকে ফোন দিয়ে সব কিছু খুলে বললাম। বাড়িওয়ালা আশ্বাস দিয়ে বললেন, বিষয়টা আমি দেখছি। আপনি ভাববেন না জামিল সাহেব।’ এখন আমার বেশ ভালো লাগছে। সকালবেলা বউ মনের মধ্যে পারমানবিক বোমা ফেলে যেই অমানবিক কাজটা করেছিলো, সেই জ্বালা এখন আর নেই। আমি সুবোধ বালকের মতন খাবার টেবিলে খেতে চলে আসলাম।
খেতে বসেই চমকে উঠলাম। আরে! কাচ্চি বিরিয়ানি! বউ মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বললো,‘কী কেমন সারপ্রাইজ দিলাম?’
আমি কথা না বলে কাচ্চি বিরিয়ানি প্লেটে নিয়ে দ্রুত খাওয়া শুরু করলাম। খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। আর কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ার সময় তো এই নিয়মটা আরো কড়া করে পালন করা উচিত। বেচারা সামাদ সাহেবের জন্য খারাপ লাগছে। না জেনে, না শুনে, না বুঝে তাকে অনেক বড় বিপদে ফেলে দিয়েছি। তবে কাচ্চি বিরিয়ানিটা সেই খারাপ লাগাটা ভুলিয়ে দিচ্ছে।