সব নদী একদিকে যায় না
২৮ মে ২০২০ ১৯:১৯
সিঁতারার বয়স সতের ছুঁইছুঁই। দেরিতে আসা শহুরে শীতের কুয়াশার মতো ম্লান মুখখানি তার। ঝলমল করে ওঠা রোদ ছড়ানো খুচরো তাজা কয়েনের মতো দ্যুতি নেই তার চোখে। পৃথিবীর সব চোখেই স্বপ্ন থাকবে, এমন অবশ্য না। কোনো কোনো চোখের গভীরে স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন দেখা যায়। সেখানে আনন্দ অশ্রু থাকে না, ছলছল লবণ জলে দেখা যায় স্বপ্নের উৎস মূলে ফিরে যাবার চিহ্নসমূহ। তবুও কখনো কখনো সামাজিকতার দায় এসে ঘাড়ে চেপে বসে।
সিঁতারা হয়ত পড়ে শহরের পরিচ্ছন্ন এক কলেজে। সেখানে নিয়ম করে ঢোলের বাদ্যি নিয়ে বৈশাখ আসে, হলদে রঙের ফাগুন আসে, সাদাকালোয় আসে নির্জন একুশ, ঝমঝম বর্ষার মতো আসে মার্চ, উঁকি দিয়ে এসে গলি দিয়ে পালিয়ে যায় ভালোবাসার দিন, আর টকটকে লাল আর ঘন সবুজের প্রেম নিয়ে আসে ডিসেম্বর। এইসব দিন আসার সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই সিঁতারার বন্ধুরা যায় বস্ত্রবিতানে, জামার মাপ দিতে যায় দর্জির দোকানে, ফেরার পথে আঁচল মিলিয়ে কেনে চুড়ি, ফিতা আর নেইল পলিশ। সিঁতারা তখন ক্লাস শেষে চলে যায় গান শেখাতে। টিউশনি বলে জানে তার বাড়ির লোকজন। এ তো আর অংক, ইংরেজি বা বিজ্ঞান নয়, যে বড় অংকের সম্মানী মিলবে মাস শেষে। যে টাকা পাওয়া যায়, সেটা দিয়ে বাবার বুকের অসুখের ডাক্তার, মায়ের জন্য একজোড়া স্যান্ডেল আর ছোট ভাইটার স্কুলের ভ্যান ভাড়া। বাড়িভাড়া আর বাজার সদাই এতদিন সামলে নিয়েছেন বাবা নিজেই। মাপা আয়, তার চেয়ে আরও বেশি মাপা খরচ। গত বছরের পাঁচ কেজি পেঁয়াজের টাকায় এ বছর এক কেজিও পাওয়া যায় না, চালের দোকানে যেন হাত দিতে গেলেও তালু পুড়ে যায়। শুক্রবারে নিয়ম করে গরুর মাংসের আলু ঝোল, সেও তালিকা থেকে খসে গেছে।
সিঁতারার বন্ধুরা বিশেষ দিনে শাড়ি কিনতে যায় দোকানে। অন্য রঙ সেখানে বেমানান নয় শুধু, অচল একেবারেই। এক বছরে এরকম দিন অনেকগুলো। সিঁতারার বন্ধুরা এরকম দিনে খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে যায়। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। টুল রেখে বসে। পেছন ফিরে পিঠে চাঁদের ব্যাকরণ নামায় ব্লাউজের উপরের দিকে। সেখানে মসৃণ ত্বকে কতকিছু মাখে। আঁচল কিছুটা সরিয়ে ওরা নেমে যায় রাস্তায়। একা না। অনেকে। সব বন্ধুরা। কী দারুণ খলখলিয়ে দিনের উৎসব শুরু হয়। রোদ আসে, হাওয়া আসে, তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে আসে প্রজাপতি রঙ রিকশা। সেই রিকশা হুট করে পাখি হয়ে যায়। চলে যায় শাহবাগ, ধানমন্ডি অথবা ষাট ফুট আর তিনশ ফুট রাস্তায়। সারা পথ জুড়ে ছড়ায় অন্ধ করে দেয়া ঘ্রাণ। দুপুর সরে যায়। বিকেল নেমে আসে। বন্ধুরা বিচ্ছিন্ন একে একে। হাতের কাছে অন্য হাতের পরশ। নির্ভরতার ঠিকানা। ভালোবাসা যার নাম। অনেক বন্ধু থেকে ওরা তখন দুজন দুজন মোটে। তারপর কপালের চুল সরাবার মতো করে নেমে আসে সন্ধ্যে। ভালোবাসা তখন আরও বেশি জমাটবদ্ধ। ওরা জেনে যায়, পৃথিবীর খাদ্য ভাণ্ডারে চুমুর চেয়ে সুস্বাদু কিছু নেই আর। তারপর বাড়ি ফেরার পালা। একটা বিশেষ দিনে ওরা লিখে ফেলে মহাকাব্য।
এদিকে সিঁতারা? কমদামী ফোনের সুইচ অফ করে বসে থাকে বারান্দায়। কোথাও যাবার নেই। যাবার ছিল। বলেছিল সকলেই। জীবনে কখনো কখনো মিথ্যে এতো অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে, মিথ্যে এতো বেশি গুরুত্ব পেয়ে যায়, সেকথা জানে কেবল সিঁতারা আর তার মতো যারা, তারাই। সিঁতারা শখ করে শাড়ি কিনতে পারে না। সিঁতারা বড়জোর শাড়ির রঙ মিলিয়ে চুড়ি আর ফিতা কিনতে পারে। কয়েকবার কিনেছে তাই। কিন্তু কারো কাছে ওরকম এক শাড়ি চাইতেই পারেনি আর।
সিঁতারার চোখের সামনে দিয়ে অথবা চোখের অন্য পাশ দিয়ে চলে গেছে বছরের গোড়ার দিকের সেই ফাল্গুন, ভ্যালেন্টাইন, একুশ, মার্চ আর বৈশাখ।
আজ সতের ডিসেম্বর। চুপ করে ফেসবুকে এসে তাকাতেই গতকালের বারান্দা থেকে দেখা সেই লাল সবুজ মিছিল। সিঁতারার বন্ধুরা। বিজয়ের মিছিলে। হাতে পতাকা। কপালে অনিন্দ্য টিপ। কী দারুণ সব শাড়ি ওদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সিঁতারা এখনো বারান্দায়। দেয়ালে হেলান দেওয়ার অবস্থা নেই। ঘরে পরার জামা বলতে এই একটাই। দেয়ালে হেলান দিলে চুনের দাগ লেগে যাবে। সিঁতারা তাকায় ফুলের টবের দিকে। সেখানে ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে একটা ছোট রক্তজবা। জীবনের যুদ্ধে বিজয়ের ছবি দেখতে এসে সিঁতারা এই সবুজ পাতার ফাঁকে ছোট রক্তজবায় মিলেমিশে থাকার ভেতরে খুঁজে পায় পতাকার প্রেম, খুঁজে পায় স্বাধীনতার মানে, খুঁজে পায় বাংলাদেশ, যেখানে তবু ভালো আছি বলে ভালো থাকা যায়।