Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মানিক মিয়া, সাংবাদিকতার দিকপাল


১ জুন ২০২০ ১৯:২৫

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও সম্পাদক হিসেবে প্রায় তুলনাহীন ছিলেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে আইয়ুবশাহীর ক্ষমতার মসনদ কাঁপত। এ কারণে ইত্তেফাক পত্রিকা বন্ধ হয়েছে একাধিকবার। নিজেও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। কিন্তু সাংবাদিকতার নীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে কখনো আপোষ করেননি। ১৯১১ সালে জন্ম নেওয়া এই মহান সাংবাদিক ১৯৬৯ সালের ১ জুন পশ্চিম পাকিস্তানে মারা যান। ৭১তম মৃত্যু বার্ষিকীতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার এই দিকপালের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

বিজ্ঞাপন

মানিক মিয়া কত বড় মাপের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সাংবাদিক ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোচনামচা এবং অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইতে। আইয়ুবশাহীর স্বৈরতন্ত্রীরা কল্পনা করতো মানিক মিয়া বুদ্ধি দিয়ে গোপনে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবকে প্ররোচিত করেন। কিন্তু এ বিষয়ে বাস্তব তথ্য মেলে ‘কারাগারের রোজনামচা’তে। সেখানে শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘আমার দরকার হলে আমিই তাঁর (মানিক মিয়ার) কাছে যাই পরামর্শের জন্য। তিনি কখনো গায়ে পড়ে কোনোদিন পরামর্শ দেবার চেষ্টা করেন নাই। … ছয় দফার আন্দোলন যে আজ এত তাড়াতাড়ি গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে এখানেও মানিক ভাইয়ের লেখনী না হলে তা সম্ভব হতো কিনা তাতে সন্দেহ!’ (পৃষ্ঠা- ৯৬)। এই ৬ দফা আন্দোলনই শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু বানিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মানিক ভাই (কলকাতা থেকে) ঢাকা এসে পৌঁছেছেন প্রায় নিঃস্ব অবস্থায়’ (পৃষ্ঠা-১২৯)। ‘মানিক ভাই মোগলটুলীতেই আছেন, কি করবেন ঠিক করতে পারছেন না’ (পৃষ্ঠা-১৬৬)। ‘একদিন ভাসনী সাহেব ও আমি কোর্টে যেয়ে দেখি মানিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পরে মানিক ভাই বললেন, নানা অসুবিধায় আছি, আমাদের দিকে খেলায় করার কেউই নাই। আমি কী আর করতে পারব, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কি বলেন। আমি বললাম, মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন? আমাদের দেখবারও কেউ বোধহয় থাকবে না’ (পৃষ্ঠা-১৭৪)।

অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন, ‘আমি জানতাম মানিক ভাই চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছেন। ছেলেমেয়েদের পিরোজপুর রেখে তিনি একলাই ঢাকায় আছেন। মানিক ভাই কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, না, যাব না আপনাদের জেলে রেখে’। … (তখন পত্রিকায়) বিজ্ঞাপন পাওয়া কষ্টকর ছিল, কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য কোথায়? আর সরকারি বিজ্ঞাপন তো আওয়ামী লীগের কাগজে দিত না। তবুও মানিক ভাই কাগজটাকে (ইত্তেফাক) দাঁড় করিয়ে রেখেছেন একমাত্র তাঁর নিজের চেষ্টায়। … মানিক ভাই ইংরেজি লিখতে ভালোবাসতেন। বাংলা লিখতে চাইতেন না। সেই মানিক ভাই বাংলায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলামিস্টে পরিণত হলেন। চমৎকার লিখতে শুরু করলেন’ (পৃষ্ঠা-১৭৫)।

মানিক মিয়া বড় চাকরির লোভে পশ্চিম পাকিস্তানে না গিয়ে মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক ইত্তেফাককে জীবিত করে কাজ শুরু করলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই সেটা পাঠক প্রিয় হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে ইত্তেফাক- দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তর হয়। ৬ দফাসহ এর আগে পরে বাঙালির সব স্বাধিকার আন্দোলনের, তথা বাংলাদেশ হয়ে উঠার মুখপত্র হয়ে উঠে ইত্তেফাক। আমৃত্যু মানিক মিয়া ইত্তেফাকের নেতৃত্বে ছিলেন। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, যার লেখনী বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে রাজপথে প্রাণ সঞ্চারিত করতো, তাঁর মতো গণমাধ্যম নেতা দেশের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেন নি। ৫৮ বছর বয়সে হঠাৎই মারা যান সবার প্রিয় ‘মোসাফির’ মানিক মিয়া।

মানিক মিয়ার অভিভাবক সুলভ ব্যক্তিত্ব শুধু তাঁর ঘনিষ্টজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সংশ্লি­ষ্টদের পরিবারেও মানিক তাঁর কথা বিশেষ মূল্যায়ন পেতো। জেল-জুলুমে শারিরীকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া শেখ মুজিব কিছুদিন বাড়িতে সময় কাটাচ্ছিলেন। তাঁর মন পড়ে ছিল ঢাকার রাজপথে। কিন্তু শেখ মুজিবের পিতা ও তাঁর স্ত্রী সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে মুজিবকে ঢাকায় যেতে দিতে নারাজ। ঠিক এই সময়ে গ্রামের বাড়িতে চিঠি গেল মানিক মিয়ার কাছ থেকে। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘মানিক ভাইয়ের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। তিনি আমাকে অতিসত্বর ঢাকায় যেতে লিখেছেন। চিকিৎসা ঢাকায়ই করা যাবে এবং ঢাকায় বসে থাকলেও কাজ হবে। আমি আব্বাকে চিঠিটা দেখালাম। আব্বা চুপ করে থাকলেন কিছু সময়। তারপর বললেন, যেতে চাও যেতে পার। রেণুও (শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব) কোনো আপত্তি করল না।’ রাজনীতিতে জেল-জুলুম খেটে, নীতিতে অবিচল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন। এদিক দিয়ে চিন্তা করলে মনে হয়, ’৫৪-র নির্বাচনে এবং ষাটের দশকে ইত্তেফাককে নিয়ে মানিক মিয়া যে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন তাতে তাকে সাংবাদিকতা ক্ষেত্রের বঙ্গবন্ধু বললে অত্যুক্তি হবে বলে মনে হয় না। সঠিক নীতির উপর থাকলেও শত্রুরাও মনে মনে শ্রদ্ধা করে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের সাকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আত্মজীবনীতে। এই জঘন্য স্বৈরশাসকের শাসনামলে পত্রিকা বন্ধ ও জেলের ঘানি টানতে হয়েছে মানিক মিয়াকে। আইয়ুব খান তার আত্মজীবনী ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স-এ মানিক মিয়ার লেখনী ও তৎকালীন অবস্থানের প্রসংশা করেছেন।

১৯৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে হঠাৎ মানিক মিয়ার মারা যাওয়া সন্দেহের বাইরে ছিল না। যেমন বিদেশের মাটিতে মারা গিয়েছিলেন বাংলার অন্যতম বন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কর্মপরিধি পূর্বপাকিস্তান ও পাকিস্তানের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল। তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ইনস্টিটিউটের পাকিস্তান শাখার সভাপতি এবং প্রেস কোর্ট অব অনারের সেক্রেটারি ছিলেন। বর্তমান সময়ে আমরা যারা গণমাধ্যম নিয়ে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি, মানিক মিয়া সেখানে বড় প্রেরণা হতে পারেন। কারণ সত্যিই তিনি আমাদের রত্ন-ধন ‘মানিক’।

লেখক- সাংবাদিক, কালের কণ্ঠ

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর