‘নেতাজি’ সিরিয়ালে মিথ্যা ইতিহাস
৮ জুন ২০২০ ১৮:৩৯
জি বাংলার জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘নেতাজি’। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের উপর নির্মিত এই সিরিয়ালে একটা ভয়ংকর মিথ্যাচার করা হয়েছে। নাটকে দেখানো হয় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কলেজের বারান্দায় অধ্যাপক ওটেন সাহেবের বা-গালে প্রচণ্ড এক ঘুসি হাঁকিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলে দিয়েছে। আসলে ঘটনাটা সম্পূর্ণ বানোয়াট। একজনকে মহিমান্বিত করতে প্রকৃত ঘটনাটিই আড়াল করে ফেলা হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯১৬-র ১৫ ফেব্রুয়ারিতে। সরস্বতী পূজার অনুষ্ঠানে ইতিহাসের অধ্যাপক ওটেন সাহেবের বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে। এ বক্তৃতার প্রতিবাদে ছাত্ররা তাকে প্রহার করেছিল। তবে এভাবে প্রকাশ্যে বীরোচিতভাবে নয়। সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে থেকে গুপ্ত আক্রমণ করা হয়েছিল। সুভাষচন্দ্র বসু সে দলে থাকলেও ঘুষিটি মেরেছিলেন সিলেটের মৌলভীবাজারের অনঙ্গমোহন দাস। মজার ব্যাপার নেতাজি পরবর্তীতে এই ঘটনার সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার পর্যন্ত করেছিলেন। সেদিন আসলে কি ঘটেছিল তা জানা যাক সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর লেখা থেকে-
‘সুভাষচন্দ্র যখন ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র হিসাবে হিন্দু- হস্টেলে থাকিতেন, তখন একটা ঘটনা ঘটিল যাহার ফলে তাঁহার জীবন রাজনৈতিক আন্দোলনের পথে গেল। ঘটনাটা তাঁহার কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ওটেন সাহেবকে মারা। তখন মি: এইচ. আর জেমস প্রিন্সিপাল। ব্যাপারটা এইরূপ।
ওটেন-সাহেব কোনও একটা উপলক্ষে- সম্ভবত সরস্বতীপূজা- নিমন্ত্রিত হইয়া হিন্দু হস্টেলে ইউরোপীয় ও ভারতীয় সভ্যতা সম্বন্ধে বক্তৃত্বা করেন। ছাত্রেরা উহাকে হিন্দু-সভ্যতার নিন্দা মনে করিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইল। কিন্তু তখনই কেহই উহার প্রতিবাদ করিল না। প্রিন্সিপালের কাছে অভিযোগ করিয়া কোনও ফল না পাইয়া তাহারা স্থির করিল যে, লুকাইয়া ওটেন-সাহেবকে অতর্কিতে প্রহার দিবে। এই ষড়যন্ত্রের নেতা হইলেন সুভাষচন্দ্র এবং শ্রীহট্টের মৌলবিবাজার শহরের অনঙ্গ দাস।
একদিন যখন ওটন-সাহেব একতলায় নামিতেছিলেন তখন এই দুইজন ও অন্য কয়েকটি ছাত্র সিঁড়ির নীচে লুকাইয়া ছিলেন। তাঁহারা সাহেব নামামাত্র পিছন হইতে তাঁহার উপর পড়িয়া প্রহার দিলেন। কাজটা ছাত্রোচিত বা বীরোচিত মোটেই হয় নাই। আমি তখন অক্সফোর্ড মিশন হস্টেলে থাকি, আই.এ পরীক্ষা দিব। এই হুজুগের সংবাদ অত্যন্ত আগ্রহের সহিত পড়িতে লাগিলাম। আশ্চর্যের কথা এই, ঘটনাটির আলোচনায় কেহই উহাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিল না। একটি চাপরাশি প্রহারের সময় উপস্থিত ছিল, সে সুভাষচন্দ্রকে চিনিল। তিনি rusticated হইতে চলিলেন, কিন্তু career নষ্ট হইবে এই ভয়ে একেবারে অস্বীকার করিলেন যে, তিনি প্রহারের সহিত সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি বাঙালী সমাজের যে-শ্রেণীর সন্তান ছিলেন তাহাতে বড় চাকুরি পাওয়াই জীবনের চরম কাম্য বলিয়া মনে হইত। সুতরাং তাঁহার মিথ্যা কথা বলা কেহই অন্যায় মনে করিল না। তবুও তিনি rusticated হইলেন।’
পরবর্তীতে নেতাজি সুভাষচন্দ্রও এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করে লিখেছেন, ‘মিস্টার ওটেন… ওয়াজ় বিটেন ব্ল্যাক অ্যান্ড ব্লু’। নেতাজির আরেক সহপাঠী প্রমথনাথ সরকার লিখেছেন, ‘তখন তিনটে কি চারটে বাজে, শেষ পিরিয়ডের শেষে ওটেন সাহেব সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন তখন হিন্দু হস্টেলের কয়েকজন বাছা বাছা ছেলে যারা পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছিল তারাই মেরেছিল।’
পরে আর এক সহপাঠী স্বামী ওঁকারানন্দও বলেন, ‘মারটা তো দেন অনঙ্গ দাস’। অনঙ্গমোহন দাস নিজে লিখেছেন, ‘ওটেন পড়ে গেলে আমি ও বিপিন দে (পরে ঈশান স্কলার) তাঁকে দু-চার ঘা দিই। ওই মারামারিতে সুভাষ ছিল না’।
সুভাষচন্দ্রের শেষ জেলপর্বের সঙ্গী নরেন্দ্রমোহন চক্রবর্তীর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ওই গন্ডগোলের সৎকর্মটি যে কে করেছিল ঠিক বুঝতে পারিনি। মনে হয় ওই বাঙালটাই (অনঙ্গমোহন দাস) মেরেছিল’।
সে ঘটনায় বংশীলাল নামের বেয়ারার সাক্ষ্যে সুভাষ ও অনঙ্গমোহন উভয়কে বহিষ্কার করা হয়। ওটন সাহেবকে সিরিয়ালে যতটা খারাপভাবে দেখানো হয়েছে প্রকৃতপক্ষে তিনি এতোটা খারাপ ছিলেন না। ১৯৪৫ সালে সুভাষচন্দ্র হারিয়ে গেলে ওটেন সাহেব তাঁর স্মরণে কবিতা লিখেন। সেই কবিতায় এই মরামারির কথা স্বীকার করা হয়। কবিতাটি তিনি শুরু করেন একটি জিজ্ঞাসা দিয়ে— ‘ডিড আই ওয়ান্স সাফার, সুভাষ অ্যাট ইয়োর হ্যান্ড?
নাটকীয়তা ছাড়া নাটক জমে না এটা ঠিক, কিন্তু ইতিহাসের মধ্যে নাটক ঢুকিয়ে দিলে পরবর্তী প্রজন্ম ভুল শিক্ষা নিয়ে বড়ো হয়।
তারা ভাববে নেতাজি যদি প্রকাশ্যে অধ্যাপককে ঘুষি মারতে পারে, আমি মারলে ক্ষতি কি। আমি তো জাতীয় বীর হব।
সূত্র: আমার দেশ আমার শতক- নীরদ চন্দ্র চৌধুরী ও আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বেলুড় মঠের অরুণকান্তি দত্তের একটি চিঠি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা