হাসির সিনেমা
৯ জুন ২০২০ ১৯:২৯
এক.
চারতলায় চারজন নতুন মানুষ এসেছে। ধরা যাক তাদের নাম ক, খ, গ এবং ঘ। ক মধ্যবয়সী পুরুষ, শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভালো, গোঁফ আছে, হাসিখুশি। খ হলেন তার স্ত্রী। তিনি দেখতে শ্যামলা, ক্ষীণাঙ্গী। তিনি বেশি কথা বলেন। তাদের ছেলে গ এবং মেয়ে ঘ। গ পড়ে ক্লাস সেভেনে। ফুটবল খেলা পছন্দ করে। সারাক্ষণ কম্পিউটার নিয়ে পড়ে থাকে। ঘ পড়ে ক্লাস ফাইভে। সে টেলিফোনে কথা বলতে ভালোবাসে। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার।
আমাদের বাসায় নতুন কোন ভাড়াটে এলে আমি দেখা করতে যাই। বুঝিয়ে দিয়ে আসি আমাদের ভবনের নিত্যদিনের কাজে লাগার বিষয়গুলো। খুব জটিল কিছু না। এই কখন পানি ছাড়া হয়, কখন মোটর টানা হয়, ইলেকট্রিক মিস্তিরির ফোন নাম্বার, এসব। এরপরে তারা দীর্ঘদিন আমার দেখা পায় না।
আমি মানুষ হিসেবে খুব মিশুক না। প্রয়োজন ছাড়া অনাত্মীয়দের সাথে কথা বলতে আগ্রহ পাই না। তবে এই ‘পরিবার’টির সাথে আমাকে অনেক সময় কাটাতে হবে। তাদেরকে আনাই হয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্যে।
তিন তলায় আমার বাবা ইজিচেয়ারে বসে জবা ফুল আর কামরাঙ্গা গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন অপলক। সারাদিন শুয়ে শুয়ে এই করবেন। তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ প্রায়। আমাদের পরিবারের মানুষেরা দীর্ঘায়ু এবং সুঠাম দেহের অধিকারী হয়। সত্তরেও তাদেরকে মনে হয় পঞ্চাশ। পঞ্চাশে মনে হয় পঁয়ত্রিশ। অথচ আমার বাবা বাষট্টি বছর বয়সেই একদম নুয়ে পড়েছেন গুল্মের মত। তার হৃদরোগ বা রক্তচাপের সমস্যা নেই, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শীঘ্রই এসবে আক্রান্ত হয়ে পড়বেন। তিনি বড্ড মানসিক পেরেশানিতে আছেন। আমি নিজেও। গত কদিন ধরে আমাদের শরীরের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় যাচ্ছে। বাবা তার অসুস্থ এবং অপ্রস্তুত শরীর নিয়ে খেটেছেন, এখানে ওখানে গেছেন, দরদাম করেছেন। এই কাজটাতে তার যথেষ্ট উৎসাহ ছিল বলেই করতে পেরেছেন। এখন শরীর ছেড়ে দিয়েছে। গত দুই বছরের ধকল আষ্টেপৃষ্ঠে জাঁপটে ধরেছে তাকে। তাই চারতলার ভাড়াটে সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ এখন আমাকেই করতে হবে।
আমি কলিংবেল চাপলাম। আমাদের কলিংবেলের শব্দ ডিংডং। ছোট্ট, প্রায় অর্থহীন একটি শব্দ। আমার মনে হলো কয়েক শতাব্দী ধরে শব্দটি প্রাপকের কাছে পৌঁছোনোর জন্যে ছুটছে। ‘ক’ দরোজা খুলে আমাকে সম্ভাষণ জানালেন। আমি ঘরের ভেতরে ঢুকে খ, গ এবং ঘ এর কথা জিজ্ঞেস করলাম।
তারা ভালো আছে তো? বিশ্রাম নিয়েছে? হ্যাঁ, তারা ভালো আছে। স্নান এবং খাবার খেয়েছে।
-আপনারা কি একটু গড়িয়ে নেবেন বিছানায়? আমি সন্ধ্যার পরে আসি?
-আরে না, সন্ধ্যায় আবার কী! এসে পড়েছেন, বসেন, চা-বিস্কুট দিচ্ছি, খান। এরপর আমরা কাজের কথায় চলে আসবো।
বিকেল বেলায় আমার ক্ষুধা পায় বেশ। আমি চা-বিস্কুটের প্রস্তাবটা সানন্দে মেনে নিলাম। বিস্কুটগুলো বেশ কুড়মুড়ে। সাবধানে চায়ের কাপে ডুবোতে হবে, যেন টুপ করে ভেতরে পড়ে না যায়। আমি মনোযোগের সাথে কাজটা করতে লাগলাম।
-আসলে হয়েছে কী, এই কাজটা করতে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়। আমার ভাই এই কাজটা খুব ভালোভাবে করতে পারতো। ঠিক কতক্ষণ বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে রাখলে সেটা নরম হবে, আবার স্বাদও থাকবে, সে খুব ভালো আন্দাজ করতে পারতো।
-খুবই প্রশংসনীয় লাইফ হ্যাক।
সে গদগদভাবে বললো। এভাবে একটা আলাপ চলতে পারে না। যে আলাপটা শুরু করতে যাচ্ছি, সেটা কীভাবে শুরু করতে হয়, থৈ পাচ্ছি না বলেই এই অবস্থা। আগে কখনও এমন আলাপ করি নি তো! ইতিমধ্যেই খ, গ এবং ঘ এসে গেছে। ক এবং খ আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করলো। তারা পাবনার খাজা বিস্কুট সম্পর্কে সুনাম করতে লাগলো। কতটা খাস্তা সেই বিস্কুট, কতটা স্বাদের, কীভাবে মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এসব নিয়ে নানা ইতং বিতং। আমি ধৈর্য ধরে তাদের কথা শুনছিলাম। জানতাম, কোন না কোন কথার সূত্র ধরে আমি আলোচনা শুরু করতে পারবো। হলোও তাই।
-আপনাদের সবার বাড়ি তাহলে পাবনা?
-না, আমার এবং আমার স্ত্রীর বাড়ি পাবনা। ছেলে মেয়ে একজনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ, আরেকজন খুলনা।
-এটা সমস্যা হবে না?
-নাহ। সমস্যার কিছু নেই। পাবনা আর সিরাজগঞ্জ তো পাশাপাশি। আর খুলনার ভাষা পাবনার মতই।
-ঠিক আছে, আমি একট পরীক্ষা করি। কী বলেন?
-জ্বী, করতে পারেন। কোন সমস্যা নেই।
আমি তাদের ভাষা এবং উচ্চারণের পরীক্ষা নিলাম। আসলেই, খুব একটু পার্থক্য করা গেলো না তাদের উচ্চারণে। আমার দরকার হলো পাবনার ভাষা। সেটা তারা ভালো মতই পারে। আমি তাদের আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে রাতে আমাদের বাসায় খেতে আসতে বলে চলে এলাম। এখন আমি যাবো সেই একাকী বৃদ্ধের কাছে, যে অপলক চেয়ে আছে জানালা দিয়ে বাইরে।
দুই.
-কেমন দেখলি ওদের? কেমন শেখালি? কাজ চলবে তো?
-দেখে শুনেই তো নিয়ে আসা, তারপরেও গড়ে তুলতে বেশ দীর্ঘ সময় লাগবে।
-অত দীর্ঘ সময় কি আমার আছে রে বাবা?
-আছে। তুমি দেখো, আমি সব ঠিকঠাক করে নেবো। আমার ওপর ভরসা রাখো। আজ রাতে ওরা আসবে। ওরা প্রফেশনাল না হলেও প্রতিভাবান। দেখবে, সব ঠিকঠাকই হবে। এখন তোমাকে কফি দিই। নাকি গ্রিন টি খাবে? গ্রিন টি স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো। দেই?
আমরা অত্যন্ত বিস্বাদ গ্রিন টি এবং ততোধিক বিস্বাদ নোনতা বিস্কুট দিয়ে সন্ধ্যাযাপন করলাম। অনেকদিন পর আমরা পুরোনো দিনের কথা তুললাম। যখন পাঁচটা তরতাজা মানুষ আমাদের পরিবারে ছিলো। আমার মা, ভাইয়া, ভাবী, এবং তাদের দুই সন্তান। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। মানুষ কীভাবে থাকে আর কীভাবে নেই হয়ে যায়, এ জটিল ধাঁধার সমাধান হয়তো আমরা কখনই জানবো না। শুধু জানবো, ঝলমলে রোদের উজ্জ্বল সকাল কীভাবে নরকের দরোজা খুলে দেয়।
একদিন সকালে, সেদিন সকালে আমি আর বাবা ছিলাম বাসায়। আমরা খবর পেলাম, আমাদের স্বজনেরা, ওরা পাঁচজন লাশ হয়ে গেছে। ওরা একটা মাইক্রোবাসে করে ফিরছিল কক্সবাজার থেকে। ট্রাকের ধাক্কায় গিয়ে পড়ে নদীতে। তারপর কী হয়েছিল আমি ভাবতে চাই না। ভাবতে না চাইলে কী হবে, আমি অসংখ্যবার দুঃস্বপ্নে সেই দৃশ্য দেখেছি। মায়ের শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। প্রায়ই তাকে নেবুলাইজার নিতে হতো। আমিই দিতাম। আমার মা মারা গেলেন শ্বাসের জন্যে হাঁসফাঁস করতে করতে! আমার ভাইয়া তখন কী করছিল? অন্তু, শান্তকে বের করার চেষ্টা করছিলেন প্রাণপন? ইশ, বাচ্চা দুইটা! আক্ষরিক অর্থেই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি আমি। এখন ওরা কার কোলে উঠছে? কে ওদের আদর করছে? কোন মহাপ্রাণের মহাঅস্তিত্বে তারা মিশে গেছে, নাকি ফসিল হয়ে প্রত্নতত্ববিদদের গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে? ভাবী, বড় মায়াবতী মহিলা ছিলেন। আমাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই কথা বলতেন পাবনার মিষ্টি টানে।
আমার স্বপ্নে দুই একবার তাকে রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখেছি। তবে বেশিরভাগ সময়ই সবার করুণ মৃত্যু দেখে হাঁসফাঁস করতে করতে আমার ঘুম ভাঙে। আমি আর আমার বাবা এই দিনগুলোর শেষ চেয়েছি। জোড়াতালি দিয়ে বছরের পর বছর ভগ্নহৃদয় নিয়ে বেঁচে থাকার বদলে আমরা খুঁজেছি নতুন উপায়।
মানুষের ব্যবহার্য জিনিস সবই প্রতিস্থাপন করা গেলে মানুষকে করা যাবে না কেন? এই যে তাদের এতো এতো স্মৃতিচিহ্ন, তাদের ইয়েলো থেকে শার্ট, নবরূপা থেকে কেনা শাড়ি, ঘড়ি, ফোন সবকিছুর হুবহু প্রতিলিপি বাজার থেকে কিনে আনা যায়। মানুষকে কেন যাবে না? আমি প্রথমে বাবাকে এই ভাবনাটা জানাই। ভেবেছিলাম বাবা ভীষণ রেগে যাবেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! তিনি আমার দিকে ভেজা চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হেসে সম্মতি দিয়ে দিলেন! প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে থেকে এমন কাউকে বেছে নেবো। কিন্তু আত্মীয়স্বজনকে নিতে গেলে সমস্যা হচ্ছে, তাদেরকে পুরো সেট ধরে নিয়ে আসতে হয়। তারা তো আর পেশাদার অভিনেতা না। তাদের কী এতো দায় পড়েছে বিভিন্ন জায়গা থেকে একত্রিত হয়ে এসে বাবা-মা-ভাই-বোনের অভিনয় করার! ভালো এক সেট পেয়েছিলাম অবশ্য, তারা চারজন ছিল। পরিবারের প্রধান ছিলেন আমার মামা। কিন্তু তারা এখানে এসে উঠতে রাজি হয় নি। তাই বাধ্য হয়ে আমরা অভিনেতাদের মধ্যে খোঁজা শুরু করি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর যাদেরকে নির্বাচিত করা হয়েছে, তারা মোটামুটি মানিয়ে যায় এই ভূমিকায় অভিনয়ের জন্যে। তাদের বাসা ভাড়া লাগবে না, কর্মসংস্থান করে দেয়া হবে, এবং তাদের অভিনয়ের পেশাটি স্বাধীনভাবে চালিয়ে যেতে পারবে এই শর্তাবলীতে এক বছরের চুক্তিতে তাদেরকে নেয়া হয়েছে। আজ রাত থেকে তাদের আসল কাজ শুরু।
ডিং ডং! কলিংবেল বাজছে। তারা মনে হয় এসে গেছে। হ্যাঁ, তারাই।
-চলে আসলাম। চাচা কি খায়েছে?
-না, এখনো খায় নি। আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।
আমি ‘ক’কে জানালাম। সাথে এও জানিয়ে দিলাম যে, সবসময় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার দরকার নেই। এটা অতি অভিনয় হয়ে যায়। অনেক আলোচনার পর এটাই ধার্য হয়েছে যে আমার বাবাকে ‘ক’ এবং তার ‘পরিবার’ বাবা বলে সম্বোধন করবে না। হুবহু প্রতিস্থাপন করতে গেলে ব্যাপারটা কেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
-চাচা, আপনার জন্যে আজকে সর্ষে ইলিশ করবো। আপনার বউ মা খুব ভালো সর্ষে ইলিশ করতে পারে।
‘ক’ জানালো।
বাবা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পরখ করছেন তাদেরকে। এভাবে তাকিয়ে থাকলে হবে! আমি বাবাকে চোখের ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলাম তাদের সহযোগিতা করতে। আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা চমৎকার প্রতিক্রিয়া দেখালেন।
-বাহ, সর্ষে ইলিশ, পেট ভইরে খাবো। সাইটে পুইটে খাবো!
বাবা সম্ভবত ইচ্ছে করেই কড়া আঞ্চলিক টানে কথা বললেন। তাদেরকে একটু বাজিয়ে দেখার জন্যে। আমাদের পয়সা বৃথা যায় নি। ‘খ’ উপস্থিত বুদ্ধির চমৎকার নমুনা দেখালো।
-হ্যাঁ, খাবেনই তো। মিয়ের হাতের রান্না না খালি কারটা খাবেন! আমি তো আপনার মিয়ের মতই!
তার কন্ঠের আন্তরিকতা পুরো পরিবেশটাকে সহজ করে দিলো। ‘গ’ এবং ‘ঘ’ও তাদের ভূমিকায় ভালো অভিনয় করছে। প্রায় আমার বাবার কোলের কাছে গিয়ে বসেছে। বাবাকে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে বেশ। তবে একবার একটু বিপত্তি ঘটলো। ‘গ’ এর উচ্চারণে সিরাজগঞ্জের টান চলে আসলো প্রায়ই। আমি বাবাকে আশ্বস্ত করলাম, প্রথম প্রথম এমন হতেই পারে। একটা ছোট খাতায় আমি নোট রাখলাম কোন কোন জায়গায় উন্নতির দরকার আছে।
তিন.
ক, খ, গ এবং ঘ অল্প কদিনেই আমাদের মন জয় করে নিলো। তারা খুটিনাটি ব্যাপার এমনভাবে রপ্ত করে নিলো যা রীতিমত বিস্ময় জাগায়। আমি যখন কফি খাই, আশেপাশে তাদের কেউ থাকলে অবশ্যই ড্রাই কেক এনে দেবে। বাবার সাথে গ এবং ঘ লুডু খেলার দান নিয়ে ঝগড়া করবেই। আমাদের প্রিয় খাবারগুলো কিছুদিন পরপরই খ রান্না করে। আর গল্পে গল্পে ভুলিয়ে রাখতে ক এর জুড়ি নেই।
দেখতে দেখতে ছয় মাস চলে গেল। বাবার সাথে কথা বলে আমরা ঠিক করলাম তাদের সাথে চুক্তির মেয়াদটা বাড়িয়ে নেবো। প্রচুর টাকা খরচ হচ্ছে অবশ্য। কিন্তু কী আর করা! বাবা বড্ড বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন তাদের ওপরে। আমি নিজেও অনেকটাই। মানুষ প্রতিস্থাপন করা যায় না, কিন্তু মানুষের বিকল্প মানুষ ছাড়া আর কিছু হয় না। আমি তাদের সাথে কথা বলতে গেলাম। আমাদের হতাশ করে তারা চুক্তির মেয়াদ নবায়নের জন্যে আরো বেশি টাকা দাবী করে বসলো।
-দেখেন, এই টাকায় কিছুই হয় না। আপনাদের আমরা যে সার্ভিস দিচ্ছি, সেটা আর অন্য কারো কাছে পাবেন না। আর ছয় মাস প্রবেশনের পরে পার্মানেন্ট করলে তো বাড়তি কিছু খসাতেই হবে।
চাঁছাছোলা কথাবার্তা তার।
-ঠিক আছে বলুন, কত চান?
-এখন যা দিচ্ছেন তার দ্বিগুণ দিতে হবে। আপনারা মন ঠিক করে দ্রুত জানান। আমাদের আবার অন্য একটা প্রজেক্টে কাজ করার কথা চলছে। কয়েকদিনের মধ্যে তাদের পাকা কথা দিতে হবে।
বাহ, এর মধ্যে তারা অন্যদের সাথে কথা বলাও শুরু করেছে!
বাবাকে জানিয়ে দিলাম। বাবা আবেগপ্রবণ মানুষ। তিনি কষ্ট পেলেন তাদের এমন প্রস্তাবে। তারপরেও হয়তোবা রাজী হয়ে যেতেন, কিন্তু ইদানিং বাবার শরীর খারাপ করেছে। কিডনির সংকটে ভুগছেন। নিয়মিত ডায়ালিসিস করতে হয়, প্রচুর ঔষধ লাগে। তাই এই অবস্থায় বাড়তি খরচ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত চুক্তিটা বাতিলই করে দিতে হলো।
চার.
ওরা যেদিন চলে যাবে, সেদিন বাবার শরীর খুব খারাপ করলো। শরীরে পানি উঠে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট। আমি তাদেরকে প্রস্তাব দিলাম আর কটা দিন বাড়তি সেবা দিতে। কদিনের জন্যে পারিশ্রমিক দিয়ে দেবো। কিন্তু তারা এতে রাজী হল না। সিনেমার শুটিং শুরু হয়ে যাচ্ছে। তাদের ওখানে সময় দিতে হবে। খুব হাসির সিনেমা নাকি। মিউজিকাল কমেডি। আমাদের এখানকার ট্রাজিক দৃশ্যপটে তারা থাকতে চায় না।
আমি বাবার পাশে বসে আছি হাসপাতালের বিছানায়। বাবা খুব কষ্টে আছেন। তাকে দিনে আধা লিটারের বেশি পানি খেতে নিষেধ করা হয়েছে। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। থেকে থেকে কেঁপে উঠছেন। ডিউটি ডাক্তার এসে কিছু ঔষধ আর ইনজেকশন লিখে দিলেন।
-প্রেসক্রিপশনটা আমার কাছে দে তো। আর একটা কলম দে।
বাবা বললেন। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের ওপর আবার কিসের লেখালেখি করবেন তিনি! তিনি গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছেন, “মানুষ- চারটে”।
ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে আমি চলচ্চিত্র সংসদের দিকে রওনা দিলাম। ওখানে কম দামে এক্সট্রা পাওয়া যায়। হাসপাতালের কয়েকটা দিন চালিয়ে নেয়া যাবে। দামদর করতে করতে আমি মাঝারি মানের ষাটোর্ধ কিছু অভিনেতার সাথেও কথা বলে নেই।
বাবার যদি কিছু হয়, তখন কাজে লাগতে পারে। এতদিনে জেনে গেছি, জীবনের কোনকিছুই চুক্তির বাইরে নয়।