করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০১)
১৮ জুন ২০২০ ১০:০০
এ গল্প দুজনের। রমিজ ও নুসরাত হোসেনের। তারা স্বামী-স্ত্রী। তারা স্বামী-স্ত্রী, এ কথা অবশ্য না বললেও বোঝা যেত, এ গল্প শুরু হলেই।
অবশ্য গল্প-গল্প বললেও, এ ঠিক গল্প নয়, এ নিছকই তাদের কথা, যা শুধু কেবল তারাই জানে, ও কিছু কথা আর কি, রোজকার। এখানে তাদের যে থাকা, সেখানে গল্প তৈরি হওয়ার উপাদান থাকবে বৈকি, হয়তো তাদের রোজকার যে কথা, সেখানেই কিছু গল্প অলস বেড়ালের মতো থাকবে থাবা গুটিযে, কিন্তু কখনো আড়মোড়া ভেঙে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে উদগ্রীব হবে না। কারণ, এখানে গল্পের যে উপাদান, সে নিজেও জানে, তার থাকা খুবই এলায়িত, সে মাথা চাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াবার মতো নয়। সুতরাং আমরা কিছ শুয়ে থাকা উপাদান দেখি, যার শুরু, শুরু আসলে যে কোনোভাবে হতে পারে, শেষও, আপাতত এভাবে-
রমিজ হোসেন বললেন, আমি আর পারতেছি না।
নুসরাত হোসেন চুলোর উপর থেকে ডালের ডেগচি নামাচ্ছিলেন, তিনি একটু থামলেন, রমিজ হোসেনের কথা শুনে কিংবা ডাল আরো কিছুটা সময় চুলোর ওপর রাখতে হবে কি না, এই দ্বিধায়, বোঝা গেল না। তিনি পেছন না ফিরেই জিজ্ঞেস করলেন, কি বললে?
আমি আর পারতেছি না।
তুমি এ ভাষায় কথা বলা শুরু করলে কবে? এবার নুসরাত হোসেন পেছন ফিরে তাকালেন। রমিজ হোসেনকে বিরক্ত দেখাল- আর কী বলব?
তুমি জানো। তুমি যেভাবে কথা বলো, সেভাবে বলবে।
রমিজ হোসেন বলল, আমি আর পারতেছি না।
নুসরাত হোসেন চুলোর ওপর থেকে ডালের ডেগচি নামিয়ে ফেলেছেন, সেটা জায়গামতো রাখতে রাখতে বললেন, যাও টিভি দেখো গিয়ে।
এতক্ষন তাই-ই দেখছিলাম। একইরকম, একদম একইরকম।
খবরের কাগজ পড়ো। আমি আয়রন করে রেখেছি।
একই খবর নুসরাত, সব একই খবর।
ঠিক আছে, তোমাকে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না…।
কাজ আছে কোনো?
পেঁয়াজ ছিলতে পারবে?
না, অন্য কোনো কাজ থাকলে বলো।
একটু আগে তো বাসন মেজে গেলে…।
আর নেই বাসন?
কোত্থেকে থাকবে? এ বাসায় কি তুমি আর আমি ছাড়া কোনো ভূতে খায়?
খেলে পারত। ওদের বাসনকোসন মাজতাম। ওদের সাথে গল্প করা যেত।
আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি। তুমি বারান্দায় গিয়ে বসো।
বারান্দায় বসতে ভালো লাগে না।
রমিজ হোসেন রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে বললেন, সুনশান, তারে, গাছ থেকে দুচারটে পাতা পড়লেও পারে…। নুসরাত…।
বলো।
আসো তুমি…। আমি আর পারতেছি না।
নুসরাত হোসেনের সময় লাগল মিনিট পনের। শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে, মুছতে তিনি বারান্দায় রমিজ হোসেনের পাশে এসে বসলেন। রমিজ হোসেন তার দিকে ফিরলেন না। তিনি তাকিয়ে আছেন রাস্তার দিকে। রাস্তায় দেখায় কিছু নেই।
তিন-চারটে কুকুর এদিক-ওদিক শুয়ে আছে। হঠাৎ কখনো একজন কি দুজন মানুষ বেরিয়ে যায়। কখনো একটা রিকশা, এদিক থেকে ওদিকে বা ওদিক থেকে এদিকে।
নুসরাতের দিকে ফিরতে ফিরতে রমিজ হোসেন বললেন, মানুষজন কী ডরান যে ডরাইছে! বাঙালি ঘরে বইসা দিন পার করতেছে, ভাবা যায়!
তুমি সকাল থেকে এটা কী শুরু করেছ?
আমি আবার কোনটা কী শুরু করলাম?
এভাবে কথা বলছ কেন? তুমি এভাবে কথা বলতে?
এই যে- বলতেছি, খাইতেছি, যাইতেছি- এইসব?
হুম। এসব বাদ দাও তো। অসহ্য লাগে। এমনিতে…।
একটু বাইরেও বাইর হইতে পারতেছি না, নুসরাত।
নুসরাত বলল, বলো।
কী?
তোমার যা ইচ্ছা, যেভাবে ইচ্ছা।
বলব?
বলতে বললাম।
বলব?
আহা…।
নুসরাত…।
আশ্চর্য!
ঠিক করেছ? জিজ্ঞেস করে রমিজ হোসেন নুসরাতের দিকে তাকিয়ে থাকল। নুসরাতও তাকিয়ে থাকল রমিজের দিকে। তাদের কিছু সময়ের জন্য স্থবির ও জড় মনে হলো।
নুসরাত মৃদু গলায় বলল, আমরা ঠিক করেছিলাম আমরা এ বিষয়ে কথা বলব না।
তুমি বলতে বললে।
আমি এই কথা বলতে বলিনি। কাল রাতে আমরা বলেছি, এই প্রসঙ্গ শেষ।
রমিজ হাসার টেষ্টা করল- ঠিক করেছিলাম। কিন্তু শেষ কি হয়?
নুসরাত চোখ ফিরিয়ে নিল। সে তাকাল নীচে, রাস্তার দিকে।
বলো।
দেখো, রমিজ…।
ঠিক করেছ?
আমাদের কারো হবে না।
এ কথা তুমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পার না…।
আমি রোজ নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে বলছি।
পৃথিবীর কোটি কোটি বলছে। আল্লাহর কাছে, ভগবানের কাছে, গডের কাছে।
তুমি বিশ্বাস না করো, আমি করি। আল্লাহ নিশ্চয় তার বান্দার কথা শুনবেন।
আচ্ছা, ধরো শুনলেন, কিন্তু ছড়াচ্ছে, ছড়াচ্ছে না?
সেটা স্বার্থপরের মতো কথা হয়ে গেল, নুসরাত। অন্য মানুষ আক্রান্ত হবে, কিন্তু আমরা হবো না, এ কেমন কথা?
হ্যাঁ হ্যাঁ, হবো না। নুসরাতের গলায় ঝাঁজ। যদি বলি, আমরাও হবো, আমরাও হতেই পারি, তুমি জানতে চাইবে- দুজনের মধ্যে কে প্রথম আক্রান্ত হবো, দ্বিতীয়জন তখন কী করবে…। এসব কী কথা, বলো তো?
প্রশ্নটা অবশ্য কঠিনই- একজন যদি আক্রান্ত হয়, দ্বিতীয় তখন কী করবে…!
চুপ করো। আবার কিন্তু ঝগড়া হবে।
প্রথমজন কি দ্বিতীয়জনের কাছে থাকবে, হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে, নাকি সে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবে?
তুমি জানো?
না। জানি না বলেই জানতে চাই…। ধরো, আমার হলো, তুমি কী করবে?
রমিজ, আমি বলেছি, আমাদের হবে না।
কিংবা ধরো, এমন হলো- আমাদের দুজনকেই ধরল ভাইরাস।
সেটা হলে ভালো। দুজন মরে পড়ে থাকব। ভর্তির চেষ্টা করে লাভ নেই। ভর্তি হওয়া, শুনছি তো, কঠিনের চেয়েও কঠিন। আর আমাদের যে বয়স, তোমার এতগুলো পুরনো অসুখ, আমার শ্বাসকষ্ট, হাসপাতালে ভর্তি হলেও আমরা টিকব না।
রমিজ হোসেন মাথা ঝাঁকালেন- এটাই ভালো হবে, যদি দুজনের হয়। যদি দুজন এই এবারই একসাথে মারা যাই, আরো ভালো…। আমাদের কোথাও তো কোনো সূতো নেই যে আমাদের মৃত্যুতে ছিঁড়ে যাবে…। নুসরাত…।
তুমি খুব মন খারাপ করে দাও।
আমার দুদিন হলো, তোমাকে বলিনি, আকাশের কথা খুব মনে হচ্ছে, ও যদি বেঁচে থাকত, ওর জন্য খুব চিন্তা হতো তখন, এই অবস্থায়, ওর জন্য চিন্তা হতো, ওর স্ত্রীর জন্য চিন্তা হতো, ওদের ছেলেমেয়েদের জন্য চিন্তা হতো।
নুসরাত হোসেন রমিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কাঁদতে আরম্ভ করলেন।
দুপুরের খাওয়ার পর ভাত-ঘুম রমিজ হোসেনের দীর্ঘদিনের অভ্যেস। আজ খাওয়ার পর বারবার বলছিলেন, আজ ঘুম হবে না, আজ ঘুম হবে না, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কারণ নেই, কিন্তু বারবার আকাশের কথা মনে পড়ছে, কী আশ্চর্য, সেই কবের কথা- বলতে বলতে তিনি বিছানায় গেলেন, বালিশ ঠিক করে নিলেন ও ঘুমিয়ে পড়লেন। তার ঘুম দীর্ঘ ও গভীর হলো।
তখন সন্ধ্যার মতো হয়ে এসেছে। রমিজ হোসেনের ঘুম ভাঙলো। প্রথমেই উঠলেন না। তিনি খাটের সামনের দিকে বসা নুসরাত হোসেনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একসময় জিজ্ঞেস করলেন, টিভিতে কী দেখো, নতুন খবর কি কোনো থাকে? সেই একই খবর সেই একই খবর…।
হঠাৎ রমিজ হোসেনের গলার আওয়াজে নুসরাত হোসেন চমকালেন না। যেন তিনি জানতেনই রমিজ হোসেন এখন এই প্রশ্ন করবেন, তিনি বললেন, কী আর করব, ঐ একই খবরই দেখি।
সর্দি জ্বরে মারা যাচ্ছে, শ্বাসকষ্টে মারা যাচ্ছে…তাই না?
হুম…। আফ্রিকার কোন দেশের সরকার নাকি বলেছে, তাদের দেশে কোনো রোগীই নেই, কারণ তাদের টেস্ট করার কিটই নেই।
নো টেস্ট নো পেশেন্ট, এটা ভালো সিস্টেম।
আবার যত টেস্ট তত পেশেন্ট।
রমিজ হোসেন উঠে বসলেন- নুসরাত, চা করে দেবে এককাপ? … আচ্ছা থাক, আমি নিজেই করছি। একটু মুভমেন্ট দরকার, হাঁটাহাঁটি একদমই বন্ধ।
ছাদে গিয়েও একটু হাঁটাহাঁটি করতে পার।
দম বন্ধ হয়ে আসে।
খোলা ছাদে?
হ্যাঁ। আমার ঘরে যেমন বন্ধ হয়ে আসে, খোলা ছাদেও।
কত কী যে তোমার হয়। নুসরাত হোসেন উঠতে উঠতে বললেন। গ্রীন টি, না?
গ্রীন টি। ওটাই বেশি বেশি খেতে বলেছে না?
যে যার মতো বলছে। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল কোনটা খামাখা- বোঝার উপায় নেই।
গ্রীন টি-ই দাও। রাতে কী রাঁধবে?
নুসরাত হোসেন উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। (চলবে…)
করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০১)