মহাবিশ্বের কি সবই পূর্ব নির্ধারিত?
১৮ জুন ২০২০ ১৪:৫০
পূর্ব নির্ধারণে চরম বিশ্বাসী এক বিচারপতিকে তার সামনে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামী একবার নাকি বলেছিল, “হুজুর, আমি তো কোন অপরাধ করিনি, যদি করে থাকি তাহলে সেটা তো আগেই আমার কপালে লেখা ছিল, কাজেই আমাকে অযথা দোষ দেবার কী আছে?” বিচারপতিও নাকি উত্তর দিয়েছিল, “আমারও কোন দোষ নেই, যে বিচার এখন আমি করছি সেটা অনেক আগেই করা আছে।”
প্রশ্নটা সেখানে, এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটছে তা কি আগেই নির্ধারিত? এই যে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে অদৃশ্য ভাইরাসে, বিশ্ববাসীর এতো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অথবা এরই মাঝে আমেরিকাতে জর্জ ফ্লয়েড নামে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হত্যা, বিক্ষোভ, লুটপাট, এমনকি এ সপ্তাহজুড়ে ঢাকা শেয়ার বাজারে দরপতন ইত্যাদি ইত্যাদি; এসব কিছুই কি পূর্ব নির্ধারিত ছিল?
যদি সত্যি সত্যি সবকিছু পূর্ব নির্ধারিতই থাকে তাহলে মানুষের কাজ করে লাভ কী? আবার যদি কাজের বিনিময়ে এই নির্ধারণের চাকা উল্টো পথে ঘোরানো সম্ভব হয়, তাহলে নির্ধারণবাদে বিশ্বাস করেই বা লাভ কী? ভাগ্যের ওপর শতভাগ আস্থা থাকার পরও মানুষের ‘ভাগ্য’ পরিবর্তনের কী প্রাণান্তকর চেষ্টা!
বিষয়টা ভয়ানক গোলমেলে। আলোচনা শুরুর এক ফাঁকে বলে রাখি নির্ধারণবাদ এমন এক ধরণের চিন্তা যেখানে মনে করা হয়, সবকিছু কমপ্যাক্ট ডিস্কের (সিডি) মতো একটা কিছুতে ভরে রাখা আছে, এর বাইরে কোনোকিছু ঘটার সুযোগ নেই। অদৃষ্টবাদের একটু দার্শনিক তকমার নাম নির্ধারণবাদ।
আসলে পূর্বনির্ধারণে বিশ্বাস মানুষের অনেক পুরনো। বলতে গেলে সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে তাদের ভাগ্যে আগেভাগেই সবকিছু লেখা আছে। কিছুতেই সেটা রহিতযোগ্য নয়, ইংরেজিতে ছোটবেলা থেকে বাচ্চাদের মুখস্ত করানো হয়, ‘what is lotted can not be blotted’।
সারা বিশ্বে হস্তরেখা বিদ্যার প্রতি মানুষের আগ্রহ অপরিসীম, রাস্তার ধারে হাতদেখা গণকদের পাশে উচ্চ শিক্ষিত মানুষের যে ভিড় দেখা যায়, সেটা খুব একটা কাউকে হতবাক করে না। কারণ, সবাই চায় তার অনাগত ভবিষ্যৎ কী আছে তা জানতে। পামিস্টি বহু পুরনো এক বিদ্যার অন্যতম যার ওপর মানুষের আস্থা অনেকটা মিশ্র। অনেক মানুষ বিশ্বাস না করলেও বিপুল মানুষ এটাকে শ্রদ্ধা করে, আস্থা রাখে, আর কুষ্ঠি বিচার করার জন্য খরচাও করে। তবে পূর্বনির্ধারণের বিষয়টা অত্যন্ত জটিল আর রোমাঞ্চকর করে তুলেছে পদার্থবিজ্ঞান। আর এই বিতর্কে আগুন জ্বালিয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের দুটো প্রধান ধারা চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান (Classical psysics) আর কণাবাদী বলবিজ্ঞান (Quantam mechanics)।
ফরাসী বিজ্ঞানী পিয়েরে ল্যাপলাস ছিলেন বৈজ্ঞানিক নির্ধারণবাদের পথিকৃৎ। তিনি অত্যন্ত দুর্বোধ্যভাবে ফরাসী ভাষায় যা লিখেছিলেন তার তরজামা করলে এই দাঁড়ায়, “যদি আমরা এই মহাবিশ্বের কোন বস্তুর গতি আর অবস্থান একবার জেনে ফেলতে পারি, তাহলে তার অতীত কিম্বা ভবিষ্যৎ জানা একেবারে সোজা।”
এর প্রেক্ষিতে সে সময় একটা গল্প তৈরি হয়েছিল, নেপোলিয়ান নাকি ল্যাপলাসকে প্রশ্ন করেছিলেন, “তাহলে ঈশ্বরের ভূমিকাটা কোথায়?” ল্যাপলাস বড্ড বিনয়ের সাথে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘স্যার, এখানে তাঁর আর টেনে আনার কোন দরকার পড়েনি।’
স্টিফেন হকিং এ বিষয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন, এর মানে এই না যে ল্যাপলাস বলেছেন ঈশ্বর নেই, বরং তিনি মনে করেছেন, বৈজ্ঞানিক বিধি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ঈশ্বরের আদতে কিছু করার নেই। যেমন- ঘড়ি একবার বানানো হয়ে গেলে ঘড়ি নির্মাতার আর কিছু করার থাকে না। সেই সুদূর সুইজ্যারল্যান্ডের ঘড়ির নির্মাতা যদি মনে করেন তাদের বাংলাদেশের সব ঘড়ি অচল করে দেবেন সেটা এক্কেবারে অসম্ভব। সম্ভবত ল্যাপলাসের মতোই সব বৈজ্ঞানিকেরই একই অবস্থান, একই বক্তব্য।
অর্থাৎ এই মহাবিশ্বটা অন্তত পাশা খেলা বা লুডু খেলার মতো অনিশ্চিত কিছু না। এটা বিজ্ঞানের বিধি মেনেই সুবোধ বালকের মতো ঠিক ঠাক চলে। বাস্তবতাই তাই। যেমন ধরুন, বস্তুর সরণ গতি আর সময় নিয়ে অতি সাধারণ একটা সূত্র, সরণ=গতি X সময় (S= VT) আগামীকাল থেকে আর কোন কাজ করলো না। তাহলে? মোটেও না, এমন কিছু ঘটার সম্ভাবনাই নেই, নেই বলেই সেটা বহু পরীক্ষার পর একটা বৈজ্ঞানিক সূত্রে পরিণত হয়েছে। তাহলে কিছুটা অনুমান করা যাচ্ছে এই মহাবিশ্বটা একটা কার্যকারণ সূত্রের মাঝে বাঁধা। অর্থাৎ কারণ ছাড়া কার্য নেই। কোন কিছু দৈবাৎ বা আকস্মিক ঘটে না, এ যেন এক অবধারিত গাঁটছড়া। যেমন- জন্ম হলে মৃত্যু অনিবার্য, ‘জাতস্য হি ধ্রুব মৃত্যধ্রুবং’।
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সবার আগে এই কারণের বিষয়টা নজরে আনেন। মেটাফিজিক্স নামে তিনি একটা বই লেখেছিলেন, শোনা যায় বইটা নাকি তিনি ফিজিক্স বইটার নিচে রেখেছিলেন। অর্থাৎ এই দৃশ্যমান বিশ্বজগতের ব্যাখ্যার বাইরে এক গভীর অন্তর্জগতের ব্যাখ্যা দিতে তিনি মেটাফিজিক্স বইটা লেখেন। তিনি মনে করতেন, এই জগতের কোন কিছুই কারণের বাইরে না, সবকিছুর একটা কারণ থাকবে। যেমন ধরুন, কাওকে যদি প্রশ্ন করেন আপনি কেন ইশ্বরে বিশ্বাস করেন? সে উত্তর দেবে, ‘বাহ, কোনকিছু কি আপনা আপনি ঘটে?’
এই বিশ্বজগতেরও নিশ্চয় একটা কারণ থাকবে, আর সেই কারণটাই ঈশ্বর। ঠিক এরিস্টটলও তাই ভাবতেন ঈশ্বর হলেন সব কারণের চূড়ান্ত কারণ যিনি বসে আছেন এই জগতের শেষ স্তরে। নিজে নড়াচড়া করেন না, তবে সবকিছুকে চালান। এরিস্টটলের এই ধারণার একটা বিস্তৃত রূপ আমরা পাই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে তবে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে। এরিস্টটল যেখানে আধিবিদ্যক ব্যাখ্যাকে বড় করে দেখেছিলেন, ক্লাসিক্যাল পদার্থবিজ্ঞান সেখানে এর প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত উদাহরণ দিয়ে। সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের অন্যতম নিউটন কার্যকারণ ধারণার একটা চাবি পেয়েছিলেন। খুব ভেবেচিন্তে তিনি দেখলেন এই মহাবিশ্বটা একটা নিয়মের আধার, নিয়মের বাইরে এক চুলও সে হাঁটে না। এখানে প্রত্যেকটা বস্তুর গতি পরিমাপ করা একেবারে ঝকঝকে স্বচ্ছ ব্যাপার। ঘরে বসে আমরা চোখ বুজে বলে দিতে পারি কবে সূর্যগ্রহণ, কবে চন্দ্র গ্রহণ, কয়টার সময় আম্পান সমুদ্র উপকূলে আঘাত করবে, কখন সেটা কোন কোন পথ দিয়ে যাবে। একটা মিশাইল ঠিক কোথায় গিয়ে শত্রু শিবিরে আঘাত করবে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটা কীভাবে গিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে গিয়ে চলতে শুরু করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব যেন একটা নিরীহ সুশীল ছেলের পথ চলা। বাড়ির থেকে যা আনতে বলবে ঠিকঠাক দোকান থেকে গিয়ে কিনে আনবে, পথের মাঝে ভুলে গিয়ে চাল কিনতে ডাল আর তেল কিনতে বেল কিনে ফেলবে না।
নিউটনের এই নির্ভুল গতির ভবিতব্য মেনে সবকিছু চলছিলো ঠিকমতো। কেও তার বাধা দেয়ার ছিল না। না থাকার কারণ হলো কেও ভাবতেই পারেনি নিউটনের গতির সূত্র যে একসময় ভীষণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। কম গতিশীল বস্তুর গতির নির্দেশনা হিসেব কষে বের করার জন্য নিউটন ছিলেন অব্যর্থ মহৌষধ। কিন্তু আলোর গতির বেগে যদি কোন বস্তুর হিসেব নিকেশ বের করতে হয় তাহলে তো আর সেই সূত্রগুলো ভেঙে পড়ে। এই সত্যটা উপলব্ধি করলেন ইতিহাসের আরেক মহীরুহ আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বললেন, নিউটনের গতির সূত্রগুলো আলোর গতিতে চলমান বস্তুর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন দেখালেন কোন বস্তু যদি এই গতিতে চলে তাহলে তার দৈর্ঘ সঙ্কুচিত হয়, সময় পরিবর্তন হয় আর ভরেরও মারাত্মক হেরফের ঘটে। সোজা কথায়, এটা ছিল তাঁর বিশেষ আপেক্ষিক তত্বের অন্যতম এক অনুমান। ১৯১৫ সালে এই তত্বেরই কিছু ত্রুটি সংশোধন করে তৈরি করলেন সাধারণ আপেক্ষিক তত্ব। আর সাথে সাথে ভেঙে পড়লো নিউটনের পবিত্র মসনদ। স্থান, কাল যে আলাদা বাস্তবতা নিয়ে সমান্তরাল ভাবে পথ চলছিল সেটা একেবারে এক হয়ে হলো স্থান-কাল, শুরু হলো চতুর্মাত্রিক মহাবিশ্বের খেলা। তাছাড়া ‘আলো সরল পথে চলে’ এই সত্যও আইনস্টাইনের কাছে এসে মুখ থুবড়ে পড়লো, তিনি দেখালেন স্থান কালের বক্রতার জন্য যে কার্ভেচার তৈরি হয় তার জন্য অন্যকোনো নক্ষত্র থেকে সূর্যের কাছ ঘেঁষে আমাদের কাছে আলো আসতে ৪ ডিগ্রী আর্ক বেঁকে আসে। ১৯১৯ সালে সেটা হাতেনাতে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন।
খুব স্বাভাবিক ভাবে মনে প্রশ্ন আসতে পারে আইনস্টাইনের এই আপেক্ষিক তত্বের সাথে মহাবিশ্বের পূর্ব নির্ধারণবাদের সম্পর্ক কী? মনে হচ্ছে না, এটা ধান ভানতে শিবের গীতের মতো ব্যাপার? মোটেও না। কারণ আমরা লক্ষ্য করেছি, মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের ধারণা ধীরে ধীরে কীভাবে পরিবর্তন আসছে। তবে এই পরিবর্তনটা মারাত্মকভাবে একটা অনিশ্চয়তার দিকে মোড় নিয়েছে নতুন এক পদার্থবিজ্ঞানের আবির্ভাবের ফলে। কণাবাদী বলবিদ্যা নামে এই পদার্থবিজ্ঞান মানুষের ধারণার জগতকে সাঙ্ঘাতিক রকম পাল্টে দিয়েছে যার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন আইনস্টাইন নিজে। কিন্তু এই অনিশ্চয়তা আইনস্টাইনের একদম পছন্দ হয়নি। সে জন্যই এই পদার্থবিজ্ঞানের অনেক কিছু তিনি গ্রহণ করেননি। আপেক্ষিকতত্ব যেমনি এই বিপুল মহাবিশ্ব নিয়ে একটা বিশ্বধারনায় পৌঁছেছে, তেমনি কণাবাদী বলবিদ্যা ঠিক তার উল্টো অতি ক্ষুদ্র পরমাণুর অভ্যন্তরের কারসাজী নিয়ে তাকে বোঝার চেষ্টা চালিয়েছে। বোঝার চেষ্টা করেছে কী তুঘলুকি কাণ্ড ঘটছে সেখানে! পরমাণুর একান্ত জঠরে যে ইলেকট্রন কণিকগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে বড্ড বেয়াড়া।
জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হাইসেনবার্গ ১৯২৭ সালে Principle of Uncertainty তে দেখালেন ইলেকট্রনের গতি প্রকৃতি নির্ণয় করা বড্ড দুরহ কাজ। একই সাথে এর ভর আর অবস্থান নির্ণয় করা কিছুতেই সম্ভব না। একই সময়ে ভর নির্ণয় করতে গেলে অবস্থান; অবস্থান নির্ণয় করতে ভর পাওয়া যায় না। কি এক গোলক ধাঁধা। একবার প্রধানমন্ত্রী ভাবলেন তিনি সচিবালয়ে গিয়ে নিজের চোখে দেখবেন সমস্ত দফতরে কাজকর্মের ভেতর কোন অনিয়ম ঘটছে কিনা। ঘোষণা দিলেন আগেই। কিন্তু ঘোষণা দিয়ে যাবার আগেই যা অনিয়ম ছিল একদিনে তা উধাও। এরপর ভাবলেন, না এভাবে না। তিনি যাবেন ছদ্মবেশে। কিন্তু যেই প্রধানমন্ত্রী ছদ্মবেশে ঢুকতে গেলেন সচিবালয়ে, বেচারা দারোয়ান ঢুকতেই দিল না।
মোটকথা, প্রধানমন্ত্রীর আর দেখা হলো সচিবালয়ের আসল চরিত্র। ঠিক তেমনি ইলেকট্রনের ভর আর অবস্থান কিছুতেই একসাথে পরিমাপ করা গেলোনা। অর্থাৎ পরমাণুর অভ্যন্তরে রয়েছে কি নিদারুণ অনিশ্চয়তা। পরমাণুর অতি গভীরে যদি এতো অনিশ্চয়তা থাকে তাহলে না জানি মহাবিশ্বের অতি বৃহৎঅংশে কি ভয়ানক অনিশ্চয়তা আছে। আমরা সেটা কিছুতেই টের পাচ্ছিনা। মহাবিশ্বটা আদতে এতো বড় যে আমরা কিছুতেই এই অনিশ্চয়তা টের পাবোনা, অন্তত অতি সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে।
মজার ব্যাপার হলো, আইনস্টাইন এই অনিশ্চয়তার মহাবিশ্বকে একদম পছন্দ করেননি। কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি এর কূলকিনারা উদ্ধার করা যাবেনা। এ জন্য তিনি বলে ফেলেন, “ঈশ্বর নিশ্চয় পাশা খেলেন না।”
কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর মনে করতেন, আইনস্টাইন প্রকৃতপক্ষে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে মহাবিশ্বকে নিয়ে কোন একক সিদ্ধান্তে আসা একেবারেই অসম্ভব। তারমানে আমরা বাস করছি একটা বিরাট অনিশ্চিত মহাবিশ্বে।
স্টিফেন হকিং “ঈশ্বর কি পাশা খেলেন?” শিরোনামে একবার এক দারুণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন ল্যাপলাসের মহাবিশ্বটা খুবই স্থিতিশীল এবং নির্ধারণবাদের পেটের ভেতর; বস্তুর গতি প্রকৃতি একবার বুঝে ফেললে আর সমস্যা নেই, সবকিছু অংক কষে নির্ভুল ভাবে বের করা যাবে, পাওয়া যাবে ভবিষ্যতের চাবি। কিন্তু হাইসেনবার্গ তা ফেললেন উল্টে। কিন্তু হকিং বলেন, পদার্থের এই গতি আর অবস্থানের যে লুকোচুরি খেলা চলে তারপরেও হয়তো পদার্থের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া অসম্ভব কিছুনা। কিন্তু কৃষ্ণ গহ্বরের ধারণাটা মাথায় আনলে তবে ঐ ভবিষ্যৎ অনুমানের যে ক্ষীণ আলোকরশ্মি দেখা যায় সেটাও উধাও হয়ে যায় নিমিষে।
তাই এটা নিশ্চিত বলা যায়, আমরা বাস করছি একটা সম্ভাবনার মহাজগতে যার ওপর নিখুঁত ভাবে কোন কিছুই বলার অবকাশ নেই। একারণে ল্যাপলাস মহাশয় যে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন ভবিষ্যৎ নিয়ে সেটার কোন সুযোগের অবকাশ নেই। কাজেই বলতে হবে, আমরা যেন এক স্বপ্নের ঘোরের ভেতর বসবাস করছি। গৌড়ের কবি যেমন রাজার কাছে বললেন, “জগতে সকলই মিথ্যা সব মায়া ময়, স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়”।
পরিশেষে বলা যায়, এমনি এক সংশয়ী কাব্য ভাবনায় মিশে গিয়ে জীবনের শেষ অধ্যায়ে উচ্চারণ করলেন, “প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিলো সত্তার নতুন আবির্ভাবে-কে তুমি, মেলেনি উত্তর। বৎসর বৎসর চলে গেল, দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগর তীরে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়-কে তুমি, পেল না উত্তর।”
লেখক: অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা