পোকামাকড়ের জবানবন্দি
২৮ জুন ২০২০ ১০:০০
‘গল্পটা কোত্থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। মানে, শুরুতেই তদন্তে ঢুকে যাবো, নাকি খানিকটা ব্যাকগ্রাউন্ড দেবো সেটা নিয়ে ভাবছি আর কি।’
বললেন অবসরপ্রাপ্ত হোমিসাইড ডিটেকটিভ আজিজ চৌধুরী, আমাদের প্রিয় আজিজ ভাই। যার সাথে ডালাসে আসার পর পরিচয় হয়েছিল।
আমি তখন ছাত্র মানুষ, একা একটি এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকি। পার্টটাইম কাজ ও ফুলটাইম পড়াশোনা করছি। দম ফেলার সময় নেই। নতুন শহর, নতুন দেশ, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়ের বাইরে খুব বেশি মানুষকে চিনিনা। এরই মধ্যে একবার এক ঘটনার মধ্য দিয়ে আজিজ ভাইয়ের সাথে পরিচয়। সেই ঘটনা এখন বলতে চাইছি না। তাহলে আস্ত উপন্যাস হয়ে যাবে। আপাতত শুধু একটি নির্দিষ্ট ঘটনাই বলি।
‘আপনি আপনার মতন গল্পটা শুরু করুন, যেভাবেই বলেন না কেন, আমার শুনতে ভালো লাগে।’
বসে আছি তার বাড়িতে। বিকেলে আড্ডা দিতে এসেছিলাম। আড্ডা মানে, তার গল্প শুনতে আর কি। উদ্দেশ্য, গল্প করতে করতে রান্নাবান্না করে রাতের খাবার একসাথে খেয়ে বাড়িতে ফেরা। তখনও বিয়ে করিনি, ব্যাচেলর লাইফ। সেমেস্টার ফাইনাল শেষ হয়ে গেছে বলে পড়ালেখার চাপ নেই। ফেরারও তাই কোন তাড়া নেই। তিনিও বিপত্নীক মানুষ। ভাবি মারা গেছেন তখন প্রায় আট দশ বছর হয়ে গেছে। আমার সাথে ভদ্রমহিলার কখনও দেখা হয়নি। তার তিন ছেলেমেয়ের কেউই বাবার সঙ্গে থাকেনা। সবাই বড় বড় চাকরি নিয়ে দেশের নানান রাজ্যে ছড়িয়ে গেছেন। পরিপূর্ণ অবসর জীবন উপভোগ করছেন তিনি।
কিছুক্ষন আগেই তার ব্যাকইয়ার্ডের সবজি বাগান থেকে তাজা সবজি তুলে এনেছি। আজিজ ভাই আবার দারুণ বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। নিজের বাড়িকে বোটানিক্যাল গার্ডেন বানিয়ে ফেলেছেন। আমার জানা মতে এমন কোন সবজি নাই যা তার বাগানে নেই। প্লাস্টিকের গ্রিন হাউজ বানিয়ে সেখানেও সবজি চাষ করেন তিনি। পুরানো বাড়ি হওয়ায় বেশ কিছু জায়গা পেয়েছেন সামনে ও পেছনে। সেটারই সঠিক ব্যবহার করছেন তিনি। আমি শাকাহারী না হলেও মাঝে মাঝে ফ্রেশ সবজি খেতে ভালোই লাগে।
সিংকে লাউপাতা ধুতে ধুতে তিনি বলতে শুরু করলেন। আমি ঢেড়শ কাটতে কাটতে তার গল্প শুনছি। ‘বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের ডালাসে এক সিরিয়াল রেপিস্ট খুব যন্ত্রনা শুরু করেছিল। হাইওয়ে থেকে যুবতী মেয়েদের লিফট দেয়। পথে এক বিশেষ জায়গায় ধর্ষণ করে অজ্ঞান করে ফেলে চলে যায়। জায়গাটা খুবই নির্জন, শুষ্ক মরু এলাকা। লোকজনের বসতি নেই। ভিকটিমরা প্রায় মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার হয়। একটু এদিক সেদিক দেরি হলেই ওরা মারা যেত, এমন অবস্থা।’ আমি চুপচাপ তার গল্প শুনছি। গল্পে বাঁধা দিতে আমার ভালো লাগেনা। আর তিনিও বাঁধা পেলেই দিব্যি অন্য প্রসঙ্গে চলে যান। আবার গল্পে ফেরাতে তাকে মনে করিয়ে দিতে হয়।
তিনি বলে চলেছেন, ‘একদিন আমি ডাক পেলাম। হাইওয়ে থেকে একটু ভেতরে একটি মেয়ের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে এটি একটি খুনের ঘটনা। তদন্তের ভার এলো আমার হাতে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি আসলেই খুন। অর্ধনগ্ন যুবতী। উপরের পোশাক ঠিক থাকলেও কোমরের নিচে কিছু নেই। ব্লন্ড। চেহারা রোদে ঝলসে গেছে। বোঝা যাচ্ছে কয়েকদিন ধরে সে এখানে পড়ে আছে। পুরো শরীরে পোকা ধরে গেছে। বিকট দুর্গন্ধ আসছে লাশ থেকে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলামত সংগ্রহে নেমে পড়লো। আমি বললাম পোকাগুলোরও কিছু স্যাম্পল নিয়ে রাখতে। তারা তাই করলো।’
একবার অন্য গল্প শোনার সময়ে আজিজ ভাইকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, এই যে তারা নিয়মিত মানুষের লাশ দেখতেন, বেশিরভাগ সময়েই পঁচা, গলে যাওয়া, বা পোকায় ধরা মৃতদেহ, তাদের ঘেন্না করতো না? কেবল লাশ কাটাকাটি করতে হবে বলেই ডাক্তারি পেশার দিকে আগ্রহ ছিল না আমার।
জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘কয়েকদিন কাজ করলেই এসব ঘেন্না-ফেন্না দূর হয়ে যায়। পরে এমনও অবস্থা হত যে, কয়েকদিনের পঁচা বীভৎস লাশ দেখে এসেও দিব্যি লাঞ্চ খেতে চলে গেছি। মনের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেনা।’
তিনি এই গল্প বলে চললেন, ‘লক্ষ্য করলাম, মেয়েটির যোনীপথ ধরে প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছে। পায়ে সেই রক্ত জমে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। এবং শুকনো খটখটে মাঠেও রক্তের ছিটা পড়ে কালো হয়ে আছে।
আমরা সেই রক্তের রেখাপথ ধরে মাইল খানেক হাঁটলাম। ভাগ্য ভালো ছিল। যদি এর মাঝে একবারও বৃষ্টি হতো, তাহলেও এইসব রক্তের দাগ মুছে যেত। উপরওয়ালাই যেন অতি যত্নে আলামত আগলে রেখেছিলেন।’
তার গল্পে প্রায়ই এমন কথা তিনি বলেন। কীভাবে ছোট ছোট আলামত অনেক বড় অপরাধকর্ম সমাধানে সহায়তা করে। একবার এক গল্পে বলেছিলেন, মুসলিম বিশ্বাস অনুযায়ী কেয়ামতের দিন আমাদের হাত-পা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেভাবে আমাদের হয়ে সাক্ষী দেবে, তেমনি এই পৃথিবীতেই তিনি দেখছেন, কীভাবে আমাদের মাথার চুল, আমাদের আঙুলের ছাপ, শরীরের ডিএনএ ইত্যাদি নিজের বিরুদ্ধেই আদালতে সাক্ষী দেয়। বিজ্ঞান আমাদের কতদূর এগিয়ে নিয়ে এসেছে!
‘হাইওয়ের কাছাকাছি একটি বিশেষ স্থানে আমরা এলাম যেখানে ধস্তাধস্তির আলামত সুস্পষ্ট। ঘাস, লতাপাতা দুমড়ে মুচড়ে আছে। ধুলামাটির অবস্থাও তাই। তারই আশেপাশে আমরা মেয়েটির টপস আর প্যান্ট উদ্ধার করলাম। সাথে তার পার্স। সেখানে তার আইডিতে নাম লেখা বনি মায়ার্স। ডেট অফ বার্থ থেকে হিসেব করে দেখি বয়স তেইশ। জিহবা দিয়ে চুকচুক শব্দ করতেই পাশের সহকর্মী বলে উঠলেন, ‘আই থিংক, দ্যাট সান অফ বিচ এগেইন।’
‘কোনজন?’ আমি ধরতে পারিনি।
সে তখন আমাকে ঘটনা জানালো যে এখানে কিছুদিন পরপর মেয়েরা রেপড হচ্ছে। এই এলাকাতেই সে নিজের শিকার ধরে এনে এনে ডাম্প করছে।
‘আমি আশার আলো দেখলাম। যাক। একেবারেই শূন্য থেকে শুরু করতে হবে না তাহলে। আগের তদন্তে কিছু না কিছু তথ্য নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
ঘটনাস্থল থেকে গাড়ির টায়ারের চিহ্ন উদ্ধার করা হলো। কিছু জুতার ছাপও ধুলামাটির উপর পড়েছে। সাইজ থেকে বোঝা যাচ্ছে একটি নারীর, একটি পুরুষের। আমরা দুটোই সংগ্রহ করলাম। তুমিতো জানোই, টায়ারের ছাপ থেকেও অপরাধী ধরার রেকর্ড আমার আছে। সিরিয়াল কিলার ধরার গল্পটা বলেছিলাম না?’
আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। গল্পটা আগে শুনেছি। একদিন সময় বুঝে লিখে ফেলা যাবে। আপাতত এই গল্প শোনা যাক।
আজিজ ভাই বলতে লাগলেন, ‘আমি পূর্ববর্তী ধর্ষণের রিপোর্টগুলো দেখলাম। ভিকটিমদের জবানী। সবারই ঘটনা এক। যেন একই স্ক্রিপ্ট ফলো করে কাজগুলো করছে সে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই ভিকটিম একজন নারী। বয়স আঠারো থেকে তিরিশের মধ্যে। সবাই ব্লন্ড। সবারই জবানী এক।
‘আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক লোক রুপালি রংয়ের সিডানে চড়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। জানতে চায় কোথায় যাবো। আমি গন্তব্য বলি। সে বলে আমাকে অতটুকু (নির্দিষ্ট স্থানের নাম বলে) পথ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারবে কিনা। আমি রাজি হয়ে যাই। কারণ সেখান থেকে আমার গন্তব্য খুব বেশি দূর না। লোকটা দেখতেও ভদ্রলোকের মতন, গাড়িটাও খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পথেও লোকটা খুবই সভ্য আচরণ করে। মাঝরাস্তায় সে বলে আমি অনুমতি দিলে সে টয়লেট করতে গাড়ি থামাবে। আমি অনুমতি দেই। সে হাইওয়ে থেকে গাড়ি নামিয়ে সাইড করে পার্ক করে। গাড়ি থেকে নেমে আমার দরজা খুলে বলে গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে তার সিগারেটের প্যাকেট আছে। আমি যদি কষ্ট করে তাকে একটু বের করে দেই। নিপাট ভদ্র আচরণ। সন্দেহ করার কোনই কারণ নেই।
যেই মুহূর্তে আমি সামনে ঝুকি, অমনি সে পেছন থেকে দড়ি দিয়ে আমার গলা প্যাঁচিয়ে ধরে। তারপরে আমাকে জোর করে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে নামায়। আমার তখন নিশ্বাস বন্ধ। শরীর দ্রুত দুর্বল হয়ে আসে। এবং আমি জ্ঞান হারাই।
যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখি মরুভূমিতে আমি একা পড়ে আছি। প্যান্ট বা আন্ডারওয়্যার কিছু নেই। কেবল উপরের জামা আছে। (কারোর কারোর ক্ষেত্রে সেটাও নেই) কোনরকমে দিক আন্দাজ করে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে যাই। কোন পথচারী তখন পুলিশে খবর দিলে পরে আমি উদ্ধার হই।’
সবার গল্প এক। কোন এদিক-সেদিক নেই। রুপালি সিডানটি ছিল হোন্ডা কোম্পানির- এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি দিয়েছে দুইজন ভিকটিম। তবে কেউই লাইসেন্সপ্লেটের ইনফরমেশন দিতে পারেনি।
লোকটির চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে সবাই বলেন হালকা পাতলা শরীরের এক মাঝবয়সী লোক। শেতাঙ্গ। বয়স চল্লিশোর্ধ হবে নিশ্চিত। মাথার চুল ছোট করে ছাটা। চোখে চশমা। গালভর্তি খোঁচাখোঁচা দাড়ি। ব্যস। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করেই আমাদের কাজ করতে হবে। কাজটি বেশ জটিল, বুঝতেই পারছো। ডালাস শহরে হাজারে হাজার সিলভার হোন্ডা সিডান আছে। যদি ডালাস ফোর্টওয়ার্থকে বিবেচনায় নেই, তাহলে কাজটা আরও জটিল হয়ে যাবে।
এখন বলি কিভাবে তথ্যগুলো ডিডাক্ট করলাম।
এখানে একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। লোকটি প্রতিবার একই জায়গা ব্যবহার করছে। মানে স্থানটি তার বেশ পরিচিত। সাধারণত কোন অপরাধী নিজের অপরাধকর্মের জন্য পরিচিত এলাকা বেছে নেয়। এতে সে স্বস্তি বোধ করে। ক্রিমিনাল সাইকোলজিক্যাল জেনারেল বিহেভিয়ার। এক্ষেত্রে তাই আমরা ধরে নিলাম খুনি সাউথ ডালাসের কেউ হবে। রেডিয়াসটা ছোট হয়ে এলো, দেখলে?
সাথে জুতা এবং টায়ারের ছাপ একটা বাড়তি তথ্য দিল।”
আজিজ ভাই কী বলেছেন সেটা বলার আগে সাধারণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে কিছু তথ্য শেয়ার করি। পৃথিবীর সব ব্র্যান্ডের সব মডেলের জুতার তলানি বা টায়ারের আলাদা আলাদা ডিজাইন থাকে। যেমন, ধরা যাক নাইকি কোম্পানির কোন জুতার কথা হচ্ছে। নাইকি ফ্লেক্স জুতার তলানি এবং নাইকি ডাউনশিফটারের তলানি সম্পূর্ণ আলাদা হবে। মাটিতে ছাপ দেখেই আপনি বলতে পারবেন কোনটা কোন মডেলের জুতা। নাইকি আর বাটার জুতার ছাপে কোন মিলই থাকবে না। এই পর্যন্ত বুঝতে পারছেন?
এখন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, একই মডেলের জুতার ছাপ একেক মানুষের জন্য একেক রকম হবে। কিভাবে এটি হয়? নির্ভর করে কে কিভাবে জুতাটির ব্যবহার করেছে। আমি যদি সেই জুতা পায়ে প্রতিদিন দশ কিলোমিটার হাঁটি, যার পাঁচ মাইল পথ হচ্ছে মেঠো, অন্য দিকে আমার বন্ধু সেই একই জুতা পায়ে কেবল শ দুয়েক ফুট হাঁটাহাঁটি করে, তাও পাকা সড়কে, তাহলে আমাদের জুতার তলানির ক্ষয় একেকজনেরটা একেক রকম হবে। যেহেতু পৃথিবীর দুইটি আলাদা মানুষ কখনই হুবহু একই কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে যায় না, তাই তাদের জুতার ছাপও একই হয়না। অতি সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকেই। একে জুতার ফিঙ্গার প্রিন্ট বলতে পারেন, গোয়েন্দারা নিজেদের মধ্যে এই শব্দটি ব্যবহার করেন। গাড়ির টায়ারের ক্ষেত্রেও ঘটনা তাই।
আজিজ ভাই বললেন, ‘আমাদের শু প্রিন্ট ডাটাবেস থেকে যে তথ্য পেলাম, তা বলছে জুতার দাম তিরিশ চল্লিশ ডলারের বেশি না। এবং টায়ারটিও সস্তা। মানে, আমাদের এই রেপিস্ট মহাশয় কোন বিত্তশালী ব্যক্তি নন। নিত্য খেটে খাওয়া মানুষ। মানে ঘন্টা হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনাই বেশি। বেকার হবারও সম্ভাবনা আছে। তদন্তের ক্ষেত্রে এইসব ছোটখাটো তথ্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’
অনেকক্ষন ধরেই কিছু বলছিনা। গল্পের বেগে হাওয়া দিতেই বললাম, ‘তা তো অবশ্যই।’
আজিজ ভাই বললেন, ‘তারপরে আরেকটি মহাগুরুত্বপূর্ণ আলামত যা পুরানো কেসগুলো এবং বনি মায়ার্সের পোশাক থেকে উদ্ধার করা হয়। সেটি হচ্ছে লাল রংয়ের কার্পেট ফাইবার। লোকটির গাড়ির কার্পেট থেকে এসেছে নিশ্চই। ভিকটিমরা যখন ধস্তাধস্তি করছিল, তখন সেটি তাদের পোশাকে লেগে থাকে। যদি কখনও এই খুনিকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়, তবে অন্যান্য পেন্ডিং কেসেও এর সম্পৃক্ততা যুক্ত করে দেবে এই ফাইবার। বুঝতে পারছো?’
হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। মুখেও বললাম, ‘হু।’
‘আমি তখন আমাদের রেকর্ড থেকে একটি তালিকা বের করি। সাউথ ডালাস এলাকায় সিলভার হোন্ডা সিডান গাড়ি ব্যবহার করে কারা কারা। সেখান থেকে তাদের বয়স বের করে তিরিশোর্দ্ধদের রেখে বাকিদের বাদ দেই। বাদ যায় বিত্তবান লোকেরাও। আমার তালিকায় তখন মাত্র চারটি নাম জ্বলজ্বল করছে। এদের ঠিকানায় গিয়ে গাড়িতে উঁকি দিলেই কার্পেটের রঙ জেনে ফেলার কথা। কী বলো?’
এতক্ষনে আমি মুখ খুললাম, ‘এতই সহজ?’
তিনি হেসে বললেন, ‘মাঝে মাঝে এতই সহজ। আবার মাঝে মাঝে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ চলে যায়। যেমন ধরো, এর আগেও কিন্তু লোকটা ধর্ষণ করেছে। কিন্তু যেকোন কারণেই হোক, আগের ঘটনাগুলোয় টায়ার বা জুতার ছাপ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এইবার ভাগ্যের জোরে আমরা উদ্ধার করতে পেরেছি। খুনের মামলা যত দ্রুত সমাধান করা যায় তত মঙ্গল। একবার কেস কোল্ড হয়ে গেলে সেটা সমাধান করা বেশ দুরূহ কাজ।
কোল্ড কেস মানে হচ্ছে যে তদন্ত করতে এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে যায়।
তা শেষ পর্যন্ত যে লোকটিকে আমাদের সন্দেহ হলো তার নাম গ্যারি এন্ডারসন। আন্ডারকভার ডিটেকটিভ ওর সম্পর্কে যা জানালো তা হচ্ছে, সে পেশায় মোটর মেকানিক। সিঙ্গেল। কখনই কোন মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়নি। একটি মোবাইল হোমে থাকে। বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। কারোর সাথে তেমন মেলামেশাও করেনা। অবসর কাটে স্ট্রিপ ক্লাবে গিয়ে, স্থানীয় একটি এডাল্ট ভিডিওর দোকানের ভিআইপি সদস্যও সে। তারচেয়ে বড় কথা ভিকটিমদের বর্ণনার সাথে তার চেহারার হুবহু মিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ইচ্ছা করলেইতো আর আমরা তাকে গ্রেফতার করতে পারি না। সে যদি অপরাধী না হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের বারোটা বেজে যাবে। তাই আমাদের খুব সাবধানে, আটঘাট বেঁধে পথে নামতে হয়।
রাতের অন্ধকারে আমাদের ডিটেকটিভরা গিয়ে তার টায়ারের ছাপ নিয়ে আসে। ল্যাবে নিশ্চিত হয় এটিই সেই গাড়ির টায়ার।’
এখানেও পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলি, উপরে যেমন জুতার ছাপের বিষয়টা উল্লেখ করলাম, গাড়ির টায়ারের ক্ষেত্রেও একই সূত্র প্রযোজ্য। দোকানে ব্র্যান্ড নিউ অবস্থায় একই মডেলের সব টায়ারের ছাপই এক থাকে। কিন্তু একেকটা গাড়িতে ফিট হবার পরে যত সময় যায়, ততই যে যার মতন স্বতন্ত্র হয়ে যায়। কাজেই, অপরাধী শনাক্তকরণে জুতার মতোই টায়ারের ছাপও অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আজিজ ভাই বলে চললেন, ‘একটিমাত্র সূত্র মিলে গেল। এবার আরও কিছু প্রমাণ লাগবে। কারণ, আদালতে ওর উকিল বলতেই পারে ঘটনাস্থলে টায়ারের ছাপের উপস্থিতি কোনভাবেই প্রমাণ করেনা যে সে খুনের সাথে জড়িত। আসলেই তাই। এমনিতেই সে সেখানে কোন কাজে যেতে পারে। এবং হয়তো খুনি ভিন্ন কেউ। তাই নিজেদের সন্তুষ্টির জন্যও আমাদের আরও বেশি প্রমাণ লাগবে।
বনির শরীরে পুরুষের স্পার্ম পাওয়া যায়নি। তাহলে ডিএনএ প্রোফাইল আমাদের জন্য একটা মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হতে পারতো। কারণ আগের ভিকটিমদের মাঝে পাওয়া ডিএনএ প্রোফাইল পরস্পরের সঙ্গে মিলে যায়। নিশ্চিত ছিলাম যে, যদি গ্যারির ডিএনএ প্রোফাইল নেওয়া হয়, তবে সেটা অবশ্যই ম্যাচ করবে। কিন্তু সেটা কেবল আগের ভিকটিমদের ধর্ষণ করাকে প্রমাণ করবে, বনিকে খুনের পেছনে গ্যারির সম্পৃক্ততার জন্য সেটি যথেষ্ট হবেনা।
লোকটাকে কীভাবে ঘটনাস্থলে ঘটনার সময়ে যুক্ত করা যায়, সেটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বনির মৃত্যুর সময়তো আর জানা নেই। যখন আমরা তার লাশ উদ্ধার করি, সে তখন কয়েকদিনের মৃতা। মৃতদেহ পঁচতে গলতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে এইভাবে শুকিয়ে যেতে থাকা মেয়ের লাশের বয়স বের করা খুব সহজ না।
হঠাৎ খেয়াল হলো, আমরাতো তার শরীরের পোকাগুলোর স্যাম্পেল সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। এই পোকাগুলোরই জবানবন্দি নেয়া যাক!
‘পোকাদের জবানবন্দি’ শুনে আমি চমকালেও অবাক হলাম না। আজিজ ভাইয়ের অন্যান্য কেস হিস্টোরি শুনে এতদিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। একবার এক নারীর খুনের মামলায় তিনি গাছের সাক্ষ্য নিয়ে অপরাধ প্রমাণ করেছিলেন। সেই গল্পটি (বৃক্ষের সাক্ষ্য) লেখার পরে বেশ পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছিল। যিনি গাছকে দিয়ে কথা বলিয়েছেন, তিনি পোকামাকড়কে ছাড়বেন কেন?
তিনি বলতে থাকলেন, ‘প্রথমেই আমাদের এইসব পোকামাকড়ের জীবনচক্র সম্পর্কে জানতে হবে। শ’খানেক স্যাম্পেল সংগ্রহ করা হয়েছিল, যেগুলোর কয়েকটাকে এলকোহলে চুবিয়ে রাখা হয়। ঠিক সেই অবস্থাতেই, যে অবস্থাতে তাদের উদ্ধার করা হয়েছিল।
ম্যাগটসগুলো সংকুচিত হয়ে শক্ত খোলসে পরিণত হয়। এবং এক সপ্তাহ পরেই দেখা গেল এদের পাখা গজিয়ে পূর্ণ বয়সে উপনীত হয়েছে। এক বিশেষ জাতের মাছি। তারপরে আমরা সেটি কোন জাতের অন্তর্গত তার খোঁজে নামলাম। জানো নিশ্চয়ই, পৃথিবীময় একলাখ বিষ হাজারেরও বেশি প্রজাতির মাছির অস্তিত্ব আছে? আমাদের টেক্সাসেই কয়েকশ প্রজাতির দেখা মেলে। ঘন্টার পর ঘন্টা অনুসন্ধান শেষে আমরা জানতে পারি, এই প্রজাতির নাম ‘সারকাফাকা’ আমরা যেগুলোকে ‘ফ্লেশ ফ্লাই’ বলি আর কি।
আমি কিছুই বুঝলাম না। মাছি নিয়ে অত গবেষণা জীবনেও করিনি। কেবল গুয়ের মাছি চিনি। যেখানেই গু দেখা যায়, সেখানেই মোটা নীলচে বর্ণের মাছি ভনভন করে উড়ে। মাংস দেখে কোনটা আসে, কোনটা মিষ্টির উপর বসে, এই ব্যাপারে আমার জ্ঞান শূন্য।
আজিজ ভাই হয়তো আমার চেহারা দেখেই সেটা বুঝলেন। তিনি গল্প চালিয়ে গেলেন, ‘এই জাতের মাছির সাথে অন্যান্য জাতের মাছির একটি বেসিক পার্থক্য হচ্ছে, এটি অতি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতেও ওড়াওড়ি করে। অন্যান্য মাছি যেখানে সামান্য বৃষ্টি, মেঘলা, কুয়াশাচ্ছন্ন ইত্যাদি আবহাওয়ায় ওড়ে না, বরং সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করে। এই মাছিগুলো পটেনশিয়াল হোস্টের সন্ধানে ঠিকই উড়ে বেড়ায়।
একটি ব্যাপার এখানে লক্ষণীয় ছিল। আবহাওয়া। আমরা আবহাওয়া রেকর্ড থেকে রিডিং নিয়ে চেক করে দেখি বনির মৃত্যুর সপ্তাহে সেই অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ছিল ৯২ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই তাপমাত্রায় ডিম থেকে সেই স্টেজে (যে অবস্থায় তাদের সংগ্রহ করা হয়েছে) পৌঁছাতে সময় লাগে তিনদিন। আরেকটা ফ্যাক্ট হচ্ছে, এরা কখনই রাতে ডিম পাড়ে না। দিনের আলোয় কাজটা করে। আর মাছিগুলো কোন অবস্থাতেই জীবিত মানুষের দেহে ডিম পাড়ে না। তার মানে, খাপে খাপে বসালে যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে, মেয়েটির লাশ উদ্ধার হয় ২১ তারিখ। তিনদিন পেছালে তার মৃত্যুক্ষণ হয় আঠারো তারিখ। তাও আবার খুব ভোরে। কারণ যদি দুপুর বা বিকালে সে মারা গিয়ে থাকে, তাহলেও মাছিগুলো তাদের জীবনচক্রের এই স্টেজে পৌছাতো না। মানে সতেরো তারিখ সন্ধ্যার আগে পর্যন্ত মেয়েটি জীবিত ছিল। কাজেই, আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে সতেরো তারিখ সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত সময়টাতে গ্যারি ঘটনাস্থলে ছিল।’
আজিজ ভাই এমনভাবে কথাগুলো বলে গেলেন, শুনে মনে হলো কতই না সহজ। অথচ জানি, কতটা পড়াশোনা করতে হয় এইভাবে ক্রাইম সলভের জন্য। মামলার সব রহস্য এখানেই শেষ। বাকিটা ফর্মালিটি।
তিনি বললেন, ‘কাজটি ছিল আমাদের জন্য খুবই সহজ। সে মোটর মেকানিকের কাজ করে। গ্যারাজে টাইম লগে খোঁজ নিয়ে দেখি সে সতেরো তারিখ কাজে আসেনি। সারাদিন বা সারা রাত সে কোথায় ছিল, কার সাথে ছিল, এই ব্যাপারে সে কোন সাক্ষী সাবুত হাজির করতে পারলো না। কোন এলাবাই নাই।
তার উপর বনির শরীরে পাওয়া যাওয়া ফাইবার তার গাড়ির কার্পেট থেকেই এসেছিল, ঠিক যেমনটা অন্যান্য ধর্ষণের শিকারদের শরীরে এসেছিল। ব্যস, সব ঘটনা লিংকড হয়ে গেল।
এরপরে আমরা ধরলার বাবাজিকে।’
আজিজ ভাইয়ের চোখ মুখ ঠিক সেভাবেই জ্বলজ্বল করছে যেমনটা মাত্রই কঠিন ক্রাইম সলভ করা কোন তরুণ ডিটেক্টিভের হয়ে থাকে। হঠাৎই আমার মায়া হয় লোকটির জন্য। বৃদ্ধ বয়সে এমন নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন! আমাকে কাছে পেয়ে মনের যাবতীয় গল্প বলে ফেলেন। ফিরে যান যৌবনে, তার সোনালী সময়ে, যখন বুদ্ধির জোরে তিনি গ্রেফতার করতেন একের পর এক দাগি আসামিকে। নিজের বর্ণালী ক্যারিয়ারের গল্প আমাকে শুনিয়ে হয়তো খানিকটা আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। আজ ভাবী বেঁচে থাকলেও হয়তো তার জীবনটা অন্যরকমই হতো।
পুরো ঘটনাটা শুনলাম তরকারি রান্না করতে করতে। চুলায় ভাজাভুজি শেষ। ভাত হয়ে গেছে বহু আগেই। টেবিলে বসে খাওয়া শুধু বাকি। কিছু মাছি ভনভন করে উড়ছে। গ্রীষ্মকালে ডালাস শহরে এই এক যন্ত্রনা, মাছির উপদ্রব বেড়ে যায়। দরজা খুলতে না খুলতে ফাঁক পেয়ে ঘরে ঢুকে যায়। আজিজ ভাই মাছি তাড়াতে তাড়াতে বললেন, ‘এগুলোকে দেখেই হঠাৎ এই ঘটনার কথা মনে পড়লো।’
আমি পাতে ভাত ওঠাতে ওঠাতে বললাম, ‘লোকটার কী সাজা হয়েছিল?’
আজিজ ভাই জবাবে বললেন, ‘সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের দায়ে আটাশ বছর সশ্রম কারাদন্ড। আর অন্যান্য ধর্ষণের জন্য এডিশনাল চৌদ্দ বছর করে। কোন পেরোলের অপশন নাই। ইহ জনমে বাবাজি আর বাইরের আলো বাতাস দেখবে না। জেলেই পঁচে মরবে।’
তিনি এক নলা ভাত মুখে নিতে নিতে বললেন, ‘কে জানে। এর মধ্যেই হয়তো মরে ভূত হয়েছে।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু মোটিভ? এতগুলো ধর্ষণ করলো, এর পেছনে কোন মোটিভ কাজ করেনি?’
তিনি মুখে ভাত নিয়েই বললেন, ‘সিরিয়াল ধর্ষকের বা খুনির কোন মোটিভ লাগে? ওরা মোটিভ ছাড়াই খুন করে। এই কারণেই ওদের ধরা কঠিন, এবং ওদের শিকারও random. তবে যদি জানতে চাও, এর পেছনে কারণ কী থাকতে পারে, তবে সেই পুরানো কাহিনী। এলকোহলিক বাবা-মা, শৈশবে ডমেস্টিক এবিউজের শিকার, লেখাপড়া করতে গেলে স্কুলে বুলির শিকার ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনেছি হাইস্কুলে থাকতে তাকে নাকি কোন এক সুন্দরী ললনা বেশ অপমান করেছিল। একে messed up শৈশব, তার ওপর এমন বুলি ও অপমান, মাথাটাই নষ্ট হয়ে গেল তার।’
‘আহারে!’
আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। সাথে সাথে তিনি বললেন, ‘তুমি কী সিম্প্যাথি ফিল করছো ওর জন্য?’
আমি নিজেও বুঝতে পারিনি কেন শব্দটা আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। ‘না… মানে, ধর্ষকের প্রতি সহানুভূতির প্রশ্নই ওঠে না… তবুও, প্রায় সব সিরিয়াল খুনি এবং সিরিয়াল ধর্ষকের মধ্যে এই একটা ব্যাপারই কমন পাওয়া যায়… শৈশবে কিছু একটা উল্টাপাল্টা ঘটে।’
আজিজ ভাই বললেন, ‘সেটা বিহ্যাভিওরাল সাইকোলজিস্ট, সোশিওলজিস্টরা গবেষণা করবেন। আমাদের কাজ অপরাধ তদন্ত করে সমাধান করা। আমরা সেটাই করেছি। দেখি চিংড়ির তরকারিটা একটু এদিকে দাওতো। ফাটাফাটি হয়েছে না?’
*বিদেশী সত্য ঘটনা ও তদন্ত অবলম্বনে লিখিত।