করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০৩)
৩ জুলাই ২০২০ ১০:০০
তুমি যে আকাশের কথা বলা শুরু করলে, আমি বিরক্ত হলাম, তারপর আবার আমারই মনে হলো, আকাশ থাকলে পারত। একটা সঙ্গ, একটা কথা বলার লোক…।
কিন্তু ও যদি মাহবুবের ছেলের মতো হতো?
হতো না। আমাদের ছেলে কখনো এরকম হতো না।
হয়তো। …তবে ও থাকলে এখন ওর জন্য চিন্তা হতো। ওর বয়স কম, ওর জন্য ওর বউয়ের জন্য ওর ছেলেমেয়েদের জন্য, যাদের বয়স হতো আরো কম, আমাদের কত-কত চিন্তা হতো!
আমরা ওদের দূরে দূরে থাকতে বলতাম, খুব সাবধানে থাকতে বলতাম…।
ধরো, আলাদাই থাকত ওরা। আমার তাতে আপত্তি থাকত না।
হ্যাঁ, আলাদাই থাকত। সেটাই ভালো। কিন্তু নিয়মিত আমাদের খবর নিত।
যদি হঠাৎ শুনত, আমরা না আমাদের কেউ আক্রান্ত হয়েছি, ছুটে আসতে চাইত।
কিন্তু আমরা ওকে নিষেধ করতাম, আমরা বলতাম- না, আসতে হবে না।
তবুও ও হয়তো একটা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করত…।
তারপর এই হাসপাতাল থেকে সেই হাসপাতাল….।
হাসপাতাল কিন্তু নির্দিষ্ট করা, তার কোনোটাতেই যেত হতো।
নিয়ে যেত। আকাশ নিশ্চয় জানত, কী করতে হবে।
যে, জানত। … নুসরাত…।
এসব কথা খারাপ লাগছে…।
বাদ দাও।…আমেরিকায় কীভাবে মারা যাচ্ছে দেখেছ? লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আমরা তো খুব ঘনবসতির। লোকজনও নিয়ম মানে না। তার ওপর নেই যথেষ্ট ব্যবস্থা, হাসপাতাল নেই, বেড নেই, ডাক্তারদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই…।
বড় বড় কথা আছে। অনর্গল মিথ্যা আছে। টাকা পাচার আর লুটপাট আছে।
আমি বলছিলাম আমাদের এখানে তাহলে কত-কত লোক মারা যাবে?
যাবে। … আমরাই কি বাঁচব!
আমি এভাবে নিয়েছি- মারা তো একদিন যাবই…।
সে যাব। কিন্তু এরকম ভাবলেই মনে হয়- যদি আরো কিছুদিন…।
আমরা আরো কিছুদিন অবশ্যই বাঁচব। তুমি সেদিনও বেড়েতে যাওয়ার কথা বলছিলে। দিল্লি…।
দিল্লি আগ্রা আজমির। রাজস্থান। কুনু মানালী সিমলা…। একবারে হবে না।
দেখো, যাব আমরা।
যদি না যাই, কে জানে কতদিন থাকবে এই অবস্থা, যদি না যাই….নুসরাত, মারা যদি যাই, দুজন একসঙ্গে যাব। আমাদের একজনের বেঁচে থাকা হবে মৃত্যুর চেয়ে কঠিন।
নুসরাত চুপ করে থাকল।
একজন আক্রান্ত হলে অনেক ঝামেলাও আছে। আমাদের যে বয়স, অন্যজনকে নিয়ে ছোটাছুটিও করতে পারব না। পারব?
না।… কিন্তু আমাদের হবে না কিছু, দেখো তুমি।
নুসরাত হোসেনের এই যে আশাবাদ, এর হাত ধরে এ গল্প, কিংবা যা বলেছিলাম আমরা সূচনায়, কিংবা শুনেছিলাম- এ নিছকই তাদের থাকা, যে থাকার কথা প্রচ্ছন্নভাবে হলেও তারাই মনে করে ও রাখে, তা, শেষ হয়ে যেতে পারে। তাদের নিয়ে আমরা আরো অগ্রসর হলেও আমরা দেখব, তারা, রমিজ ও নুসরাত, এ কথাগুলো বলছে, পরদিন, তার পরদিন, তারও পরদিন, এবং এভাবেই চলছে। তখন আমরা অনেক বিরক্ত হয়ে যাব, কিংবা আমরা হয়তো ইতিমধ্যেই অনেক বিরক্ত হয়েছি। এই বিরক্ত কাটানোর জন্য কি কিছু কি করা যায়? করা যায় অনেক কিছু, কেউ কিছু বলতেও পারবেন না, কারণ তারাও জানেন, গল্পের গল্প হয়ে ওঠার কারণে অনেককিছুই হয়।
এই যেমন, এই কালে, তারা যে বিল্ডিং-এ থাকে তার কোনো অ্যাপার্টমেন্টে কারো করোনা হতে পারে। রমিজ স্তম্ভিত গলায় বলবে- এবার কী হবে, ভাবো নুসরাত, এবার এই বিল্ডিং-এর সবার হবে।
দেরি করার আগেই কালাম সাহেবকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত, তার ছেলেমেয়েরা কী করছে?
জানি না। নিশ্চয় তারা সে চেষ্টা করবে।
শোনো, তুমি আবার খবর নেওয়ার জন্য বাইরে যাবে না। ওরা যা করার করবে।
না না, পাগল নাকি যে বাইরে যাব। আর এটা এমন একটা অসুখ, কারো কিছু করারও নেই।
সন্ধ্যার দিকে খবর পাওয়া গেল, বাড়িঅলা কালাম সাহেবকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে বাড়ির আর সবাইকে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে বলেছে।
রমিজ বললেন- হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই উচিত।
কিন্তু হাসপাতালে নাকি ভালো চিকিৎসাই হচ্ছে না। কোনো সরঞ্জাম নেই। ডাক্তারদের কিছু করার থাকে না, ফেলে রাখা ছাড়া…।
তাও ডাক্তারের আন্ডারে থাকা, তাই না?
তা ঠিক, কিন্তু শুনেছি ভর্তি করাও কঠিন…।
আমাদের হলে জ্বালা। এভাবে বলা উচিত না। কিন্তু বিল্ডিং-এ একজন করোনা রোগী, তার মধ্যে আমরা, ভাবা যায়…!
খবর পেলে নাকি পুলিশ এসেই হাসপাতালে নিয়ে যায়, বাড়ির সবাইকে কোয়ারিন, ঐ যে কী যেন, করে।
অনেক সময় নাকি পুরো এলাকাই। … না না, নুসরাত, সেটা হয় করোনায় কেউ মারাগেলে। তখন এসে নাকি রেড ফ্লাগ উড়িয়ে দেয়…।
পরদিন সকালে কালাম সাহেবকে তার দুই ছেলে হাসপাতালে নিয়ে গেল। তারপর বিকাল পর্যন্ত তাদের আর কোনো খোঁজখবর পাওয়া গেল না। বিকালে দেখা গেল তারা আবার ফিরে এসেছে। হেঁটে যেতে হয়েছে, ফিরেছে অবশ্য রিকশায়। সারাদিনের ধকলে তাদের বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তারা যে ফিরেছে, সেটা তারা বাড়ি ফেরার আগেই চাউর হয়ে গেল। বাড়ির মালিকের নির্দেশে দারোয়ান বাড়ির গেট বন্ধ করে দিল। বারান্দায় মুখে মাস্ক বেঁধে এসে দাঁড়াল বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্টের লোক- অ্যাই অ্যাই, তোমরা করোনা নিয়ে এই বাড়িতে ঢুকতে পারবা না।
কালাম সাহেবের এক ছেলে নীচ থেকে উত্তর দিল- হাসপাতালে যায়গা নাই, বলেছে বাবারে আলাদা ঘরে রাখলেই চলবে।
এহ, তারা বেশি জানে! আমরা জানি না!
অই অলিউল, গেট খোলো। আমরা ভেতরে যাব।
অলিউল উদাস গলায় বলল- হুকুম নাই।
বাড়িঅলা চাচা কই, বাড়িঅলা চাচা…?
বাড়িঅলাকে কোথাও দেখা গেল না। তার বারান্দায় কেউ নেই।
তবে কালাম সাহেবের বারান্দায় তার বাড়ির অন্যান্য লোকজন, তার স্ত্রী, মেয়ে ও দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় বেরিয়েছে ও তারাও চিৎকার করছে- দেশে বিচার নাই।
হ্যাঁ, দেশে বিচার নাই।
এইটাই বিচার। জামাল সাহেবের গলা জোরাল শোনা গেল। তাদের বাড়িতে ঢুকতে দিব, আর তারা করোনা ছড়াবে, সেইটা কি বিচার হবে?
আমরা কিন্তু পুলিশ ডাকব। কালাম সাহেবের মেয়ে ফৌজিয়া চেঁচিয়ে বলল।
পুলিশ শুধু তুমিই চিন। জামাল সাহেব হাসল, কেমনে চিন, ফাজিল মেয়ে।
আমি ফাজিল! আপনি, আপনি কী? সিঁড়ির মধ্যে দেখা হইলেই কুত্তার মতো…।
অ্যাই, অ্যাই মেয়ে, চাপড়ায়ে দাঁত ফেলে দিব। কী করছি আমি?
কী করছেন আর কী করেন, এই বিল্ডিং এর সব মেয়ে জানে। এখন বাবারে ঢুকতে দেন।… বাড়িঅলা চাচা…।
বাড়িঅলার সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। জামাল সাহেবেরও না, কারণ তার স্ত্রী তাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেছে।
এই গল্প এই এখানে এভাবে শেষ হয়ে যতে পারে। কালাম সাহেবের দুই ছেলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, কালাম সাহেব বসে থাকবেন ফুটপাতে, তাদের সবাইকে অসহায় ও বিধ্বস্ত দেখাবে, আবার আশাবাদিও- এই বুঝি গেট খুলল। তবে গেট খুলবে না, তাদের অপেক্ষা, তাদের পরিবারের অন্যান্যের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসা কন্ঠ ও একসময় কান্নার আওয়াজ উপেক্ষা করে গেট বন্ধ হয়ে থাকবে।
বারান্দা থেকে সরে আসতে আসতে রমিজ হোসেন বলল- এই দৃশ্য দেখা যায় না।
মানুষ কী যে নিষ্ঠুর হয়ে গেছে!
নুসরাত সায় দিলেন- এরা এখন কী করবে, বলো?
তবে তাও ঠিক, বাড়িঅলাই বা কী করবেন। একজন নাকি ৩-৪ জনকে ছড়ায়। এরমধ্যে কালাম সাহেবের দুই ছেলেও নিশ্চয় সংক্রমিত, তারপর বাসায় আনলে…।
নুসরাত আবারও সায় দিলেন- তা-ও ঠিক।… আমাদের আসলে কিছু করার নেই।
নাহ।… দেখি কী হয়।
তারপর অনেক কিছু হতে পারে, আবার নাও পারে। হয়তো এভাবেই যাবে দিন।
রমিজ হোসেন একদিন বিরক্ত গলায় বলে উঠবেন- নাহ, আর পারতেছি না।
আবার!
আহা, না পারলে কী করমু?
নুসরাত হোসেন টিভির দিকে তাকিয়ে থাকলেন বিরক্ত মুখে।
করোনা একটা সময় ধরে দিত- এই এতোদিন থাকতে হবে ঘরবন্দি, তা হলেও একটা কথা ছিল। জানা থাকত, ওর পর বাইরে যেতে পারব।
ধরো, করোনা নেই, বাইরে তুমি যাবে কোথায়?
কোথাও না, রিকশা নিয়ে ঘুরব। রিকশায় উঠে বলব- চালাও।… তুমি যাবে?
বাসায় টাকা কত আছে?
চলবে। আমাদের আর খরচ কী!
যাদের বলার মতো অবস্থা নেই, তাদের কথা ভাবো।
ভয়াবহ।… তবে ত্রাণ পাবে অনেকেই। জ্বালা হচ্ছে আমাদের। আমাদের এতো লজ্জা, দশদিন না খেয়ে থাকলেও ত্রাণ চাইতে পারব না।
আমার মনে হয়, না খেয়ে থাকলে একসময় মানুষ সব পারে।
তা হলে এমন অবস্থা হলে আমাদের, লাইনে কে দাঁড়াবে, তুমি না আমি?
দুজনই দাঁড়াব। ডবল পাব।
এখন নাকি ফোন করলেও কোথাও কোথাও ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে…আরে আরে।
নুসরাত একটু চমকে উঠলেন- কী?
গার্মেন্টস নাকি খুলে দেবে?
একবার না দিল! ঐ যে শ্রমিকরা সব হেঁটে হেঁটে…।
হ্যাঁ, আরেকবার ডেকে এনেছিল।… এদের আসলে অনেক ক্ষমতা, যা ইচ্ছে তা-ই পারে।
সরকারও দেখি সব কথা শোনে…।
উপায় নেই। প্রায় সব মন্ত্রী, সাংসদ, বড় বড় নেতা- এদের গার্মেন্টস আছে। এদের কথা গভমেন্ট শুনবে না তো কার কথা শুনবে!
শুধু আমাদের কথা শুনবে না, শোনার দরকার পড়বে না, এই যা।
আমাদের আবার কী কথা! আমাদের কথা নেই।
নেই?
আছে? … নেই। (চলবে…)
আরও পড়ুন,
করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০২)
করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০১)