অস্তিত্ববাদ মানুষের জীবনের কতো গভীরে?
৪ জুলাই ২০২০ ১২:০০
একটানা ৮৪ দিন কোন মাছের দেখা নেই কিউবিয়ান সাগরের খাড়িতে, তবু আশা বুকে নিয়ে বৃদ্ধ সান্টিয়েগো কিশোর ম্যানোলিনের সাথে চলেছেন এক অধরা স্বপ্নের খোঁজে। ক্লান্তিহীন দীপ্তিময় এক চোখ, অবসাদহীন নির্ভীক পথিকের মতো চলেছেন হার না মানা এক যুদ্ধে; সাথে অপলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অবশেষে ধরা দিলো স্বপ্নের মাছ মার্লিন। কিন্তু রাক্ষুসে হাঙ্গর পিছে ছুটেছে স্বপ্ন ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। ছোট্ট নৌকার আশেপাশে হায়েনার মতো ছোবল দিয়ে কেঁড়ে নিল স্বপ্ন, কেঁড়ে নিল এক যুদ্ধের গল্প। ১৮ ফুট লম্বা শুধু কঙ্কালটুকু উপরে উঠলো; আর উপরে উঠলো তার যৌবনের দিনগুলো যার সাথে মিশে আছে আফ্রিকান সমুদ্র বালুতটের ফেলে আসা স্মৃতি। The Old Man and the Sea-তে আনেস্ট হেমিংওয়ে জীবনের “এই হার-জিত-খেলা, — জীবনের মিথ্যা এ কুহক” নিয়ে গল্প লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। নোবেল বিজয়ী আমেরিকান এই উপন্যাসিক জীবনের যে ছবি এঁকেছেন তাতে উঠে এসেছে মানুষের অস্তিত্বের একান্ত গভীর অনুভূতি, বেদনা আর বিচ্ছিন্নতার এক উপশমহীন ক্লান্তিকর জলছবি।
ব্যক্তিজীবনের নানামুখী দ্যোতনা নিয়ে এক বিশেষ ধরণের অন্তর্মুখী চিন্তার নামই অস্তিত্ববাদ ইংরেজিতে যাকে বলে existentialism। বহুল প্রচলিত এই শব্দটা সাহিত্য আর দর্শনে মানুষের মুখে মুখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই শব্দের ব্যবহার বেড়েছে বহুল পরিমাণে- কী ভালো, কী মন্দ অর্থে। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস সর্বপ্রথম এই চিন্তার উদ্গাতা যদিও পরবর্তীতে ডেনিশ দার্শনিক সোরেন কেয়ার্কেগার্ড মোটামুটি এর একটা দার্শনিক অবয়ব দিয়েছিলেন। তবে চিন্তার শুরুতেই এই দর্শন মানুষের মনের ওপর ভীষণ নেতিবাচক এক প্রভাব ফেলে। জ্যাঁ-পল-সার্ত্র লিখছেন, তিনি নাকি এক মহিলাকে চিনতেন যে বলতো, সে যখন খুব অবসাদে ভুগতো তখন তার মুখ দিয়ে অশ্লিল সব কথা বেরিয়ে আসতো আর সঙ্গে সঙ্গে মহিলা বলে উঠত তার ধারণা সে একজন অস্তিত্ববাদী হয়ে উঠেছে। কারণ বেশিরভাগ মানুষ মনে করে অস্তিত্ববাদ মানুষের জীবনের হতাশা, দুঃখ, বিচ্ছিন্নতা, বেদনা, ক্লান্তি, অবসাদ, আর সবচেয়ে অপূরণীয় ক্ষতগুলো নিয়ে কথা বলে। কারো কারো ধারণা অস্ত্বিত্ববাদী চিন্তা একসময় মানুষকে আত্মহননের প্ররোচনা যুগিয়েছে। বেঁচে থাকার সব ভালোবাসা এই চিন্তা নষ্ট করে দেয়! কেও আরো এক ধাপ এগিয়ে অস্ত্বিত্ববাদকে নৈরাশ্যবাদের একটা তকমা দিয়ে বলেছেন, এটা বড্ড একটা অধিক্ষিপ্ত ভাবনা যেখানে শুধু আছে অন্ধকার আর চিন্তার না ফেরা কানাগলি। বিশেষ করে আলবেয়ার কামু মিথ অব সিসিপাস–এ যখন বলেন, “There is only one really serious philosophical question, and that is suicide” তখন এ সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়।
যুদ্ধ পরবর্তী ১৯৪০ আর ৫০-এর দশকে ইউরোপের একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে অস্তিত্ববাদের বেড়ে ওঠা। সিমন দ্যা বিভয়র, মরিস মার্লে পতি, আলবেয়ার কামু, এসব ফরাসী দার্শনিক এ সময়ে এই আন্দোলনকে আরো জনপ্রিয় করে তোলেন। এঁরা ছাড়াও আরও অনেকেই এই দর্শনকে বিভিন্নভাবে বিকশিত করেন, যেমন জার্মান কার্ল জেসপার্স, মর্টিন হাইডেগার, মর্টিন বুবের, ফ্রান্সের জ্যাঁ হল, গ্যাব্রিয়েল মার্সেল, স্প্যানিশদের ভেতর জোসে ওর্তেগা গ্যাসেট, মিগুয়েল দ্যা উনামুনো, রাশিয়ানদের ভেতর নিকোলাই বার্ডেভ, লেভ সেস্টভ প্রমুখ। তবে সোরেন কেয়ার্কেগার্ড এবং ফেড্রিক নিটসের নাম অস্তিত্ববাদের সাথে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে আছে। সত্যিকার অর্থে এসব দার্শনিকদের অতিক্রম করেছেন জ্যাঁ-পল-সার্ত্র। তাঁর নসিয়া, নো এক্সিট– এসব উপন্যাসের ভেতর দিয়ে অস্তিত্ববাদের মূল কথাগুলো বেরিয়ে এসেছে। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত সার্ত্রের প্রথম উপন্যাস নসিয়া যেখানে এন্টোআইন রোকেন্টিন নামে একজন ব্যক্তির জীবনের নানারকম প্রতিঘাতের গল্প লিখেছেন, যিনি ধীরে ধীরে কীভাবে তার পরিবেশ, চারপাশের মানুষ এমনকি ইংরেজ প্রেমিকা অ্যানি থেকে নিসঃঙ্গ হয়ে গেছেন। ব্যক্তি জীবনের নিঃসঙ্গতাবোধ নিয়ে সার্ত্র তৈরি করেছেন অনন্য এই জীবনগাঁথা। বিয়িং এন্ড নাথিংনেস, ক্রিটিক অব ডাইলেক্টিক্যাল রিজন ইত্যাদি গ্রন্থেও তিনি অস্তিত্ববাদী দর্শন তুলে এনেছেন। এখন প্রশ্ন আসে অস্তিত্ববাদ কী?
‘অস্তিত্ব সারসত্তার পূর্বগামী’ এই মন্ত্র নিয়ে ব্যক্তি মানুষকে ঘিরে তৈরি হয়েছে এই দর্শন। আদতে মানুষের জীবনের সম্ভাবনা, ইচ্ছা, প্রত্যয়, অঙ্গীকার, স্বাধীনতা, আর মানবতাবাদী চিন্তা এর বিষয়বস্তু। এখানে অস্তিত্ব বলতে বোঝানো হয়েছে “সেলফ-মেকিং-ইন-এ-সিচুয়েশান” অর্থাৎ একটা বিশেষ অবস্থা ঘিরে মানুষের আত্ম অর্জন। অস্তিত্ববাদ মনে করে প্রতিটা সত্য গড়ে ওঠে অবস্থান, পরিবেশ আর ব্যক্তিক ভাবনার সূক্ষ্ম অনুভূতির ওপর। নৈব্যক্তিক সত্য বলে কিছু নেই; মানুষ গড়ে ওঠে ব্যক্তি জীবনের ছোট ছোট প্লাটফর্মের সীমানা ঘিরে, আর সেখানে জন্ম নেয় অসম্ভব হার না মানা জমে ওঠা সব বেদনা, বুকের ভেতর চেপে রাখা ধুম্র কুণ্ডলী। তাই প্রতিটা জীবন এক ভয়ানক যুদ্ধের গল্প, এক নিরন্তর বাস্তব গাঁথা! এই সত্য থেকেই জন্ম নিয়েছে চিন্তার ইতিহাসে সাড়া জাগানো এই দার্শনিক মতবাদ। পদ্মার মাঝি কুবের, আর লালসালুর মজিদ বেঁচে থাকার যে প্রাণপণ লড়াই করেছেন সেটা বুঝি অস্তিত্ববাদ দর্শনের একান্ত গভীরের কথা। জীবনের নানা পর্বের ঘাত প্রতিঘাত, অসম্ভব্যতা, ভালোবাসা, আর অস্তিত্বরক্ষার এক ক্লান্তিহীন পদচারণার বাস্তব দৃষ্টান্ত এ দু’টো চরিত্র। অ্যারিস্টটল মানুষের চরিত্রের ওপর একটা যে সাধারণ লেবেল সেঁটে দিয়ে বলেছিলেন, “মানুষ একটা সামাজিক প্রাণী” অস্তিত্ববাদ মনে করে এটা হাস্যকর ব্যাপার। মানুষের চিরন্তন কোন ধারণা তাকে একটা নির্দিষ্ট সীমায় বেঁধে রাখতে পারেনা। তার মূল্যবোধ, ব্যক্তিত্ব, ইচ্ছা, আগ্রহ, অনুপ্রেরণা, এসব গড়ে ওঠে পরিস্থিতি বিবেচনা করে, অর্থাৎ মানুষ হয়ে কেও জন্ম নেয় না বরং প্রতিনিয়ত তাকে হয়ে উঠতে হয়। এ পৃথিবীর কোন মানুষই একরকম না, একরকম না তার সংস্কৃতি আর চেতনাবোধ। জীবনের এই আপেক্ষিকতা থেকে জন্ম নিয়েছে অস্তিত্ববাদ।
মানুষের দুটো সত্তা- সামগ্রিক আর ব্যক্তিক। প্লেটো এই সমগ্রতার দার্শনিক রূপ দিয়েছেন, বলেছেন ‘ধারণা’ সবকিছুর মর্মবাণী। অরূপ ধারণা একসময় রূপের ভেতর দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে। যেমন ‘মনুষত্ব’ মানুষ নামক প্রত্যয়কে বাস্তব আকার দেয়। পৃথিবীর সব মানুষ মারা গেলেও থাকবে মানুষের ধারণা, সব বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে ফেললেও থেকে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্ষয় ধারণা। সামগ্রিক সত্তা এক বিমূর্ত অনুভূতি, এটাকে বলা হয় এসেন্স বা সারবত্তা। সব মানুষ এর অন্তর্ভুক্ত, সব বিড়াল, পাখি আর শিম্পাঞ্জী এ ধারণাকে পরিব্যপ্ত করে। কালো, সাদা, লম্বা, খাটো, ধনী-নির্ধন সবাই। এ মানুষের ভেতর জর্জ ফ্লয়েডের মতো কালো মানুষ আছেন, আছেন ট্রামের মতন সাদা। আছেন মুকেশ আম্বানির মতো ধনপতি, আছেন আফ্রিকার কোটি নিরন্নও। রবিঠাকুরের কথায়, “কে গো অন্তরতর সে?” আমার চেতনায়, আমার বিশ্বাসে যে মানুষ আছে লুকিয়ে সেটা বাস্তব নয়। সে তো প্রতিটি অন্তরে বিরাজমান। কবির কথায়, “আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে”। এই মনের মানুষ বা আলেক সাঁই অমূর্ত ধারণা। প্রতিটা মরমীবিদ্যা “ধারণা” কে সবার আগে স্থান দিয়েছে। ভাববাদী এ ধারণাকে অস্ত্বিত্ববাদ সম্পূর্ণ নাকচ করে দিয়েছে। বলেছে এধরণের সামগ্রিক সত্তার ভেতর ব্যক্তি মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়না। খুঁজে পাওয়া যায়না তার দুঃখ, বেদনা, কষ্ট, হতাশা, স্বাধীনতা আর সম্ভাবনার গল্প।
ষোড়শ শতকের ফরাসী গণিতবিদ রেনে ডেকার্ত সংশয়মুক্ত চিন্তার কালক্রমিক পদযাত্রায় বলেছেন “আমি চিন্তা করি তাই আমি আছি”, “I think, therefore I am”। আমার অস্তিত্বের সন্দেহাতীত সত্যের খোঁজে তিনি হাত বাড়িয়েছিলেন নিজের দিকে। তিনি মনে করেন আমি যদি না থাকি তাহলে কে চিন্তা করবে? চিন্তার কর্তা হিসেবে তিনি আমার অস্তিত্বের প্রমাণ খুঁজে পেলেন। অস্তিত্ববাদ ঠিক এর উল্টো কথা বলে, অর্থাৎ কথাটা এমন হওয়া উচিৎ, “ I exist, therefore I am”। আমার অস্তিত্ব সবার আগে, তাই তো “আমি চোখ মেললুম আকাশে, জ্বলে উঠল আলো/পুবে পশ্চিমে”। আমির এই নিরঙ্কুশ অভিযাত্রায় একসময় “আঁধারের ঘটল সংগম, দেখা দিল রূপ, জেগে উঠল রস; ‘না’ কখন ফুটে উঠে হল ‘হ্যাঁ’ মায়ার মন্ত্রে,/রেখায় রঙ্গে, সুখে দুঃখে” (আমি, রবীন্দ্রনাথ)।
মার্টিন হাইডেগারের ভাষায় মানুষ হলো “ডেসেইন” অর্থাৎ মানুষ এমন এক সত্তা বহন করে চলে যাকে দেখতে হবে তার অস্তিত্বের সকল বিন্দু স্পর্শ করেঃ তার জীবন ধারণের সকল হেঁয়ালি, সম্পর্ক, সম্ভাবনা, আর চূড়ান্তভাবে তার নিঃসঙ্গতাকে বিবেচনা করে। বিং এন্ড টাইম গন্থে “ডেসেইন” শব্দটাকে হাইডেগার ব্যবহার করেছেন এমন এক বাস্তবিক পরিস্থিতিতে যা তার অস্ত্বিত্বকে সম্ভব করে তোলে। অস্তিত্বের পথে বিপদগুলো চিহ্নিত করে, সম্ভবত জীবনের লক্ষ্যের পথে নিয়ে যায়। তবে এটা ঠিক জীবনের লক্ষ্য চূড়ান্তভাবে কোনভাবেই চিহ্নিত নয়। ব্যক্তিই সিদ্ধান্ত নেবে সে কী করবে। অসুস্থ মাকে রেখে যুদ্ধে যাবে নাকি মাকে সেবা করার জন্য দেশের সেবা থেকে নিজেকে দূরে রাখবে সে সিদ্ধান্ত ব্যক্তির নিজের। পরিস্থিতি ঠিক করে দেবে ব্যক্তি কোন অবস্থায় কি করবে। কেননা ব্যক্তি সবকিছুর মাপকাঠি। এ যেন গ্রিক দার্শনিক প্রোটাগরাসের কথার অনুরণন, মানুষ সবকিছু পরিমাপের মাপকাঠি “Man is the measure of all thing”.
যখন এই জগত থেকে মানুষ আলাদা হয়ে পড়ে এবং চূড়ান্তভাবে সে তখন নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় বিচ্ছিন্নতা। ব্যক্তি ও জগত এ দুটো আলাদা সত্তার মাঝে যখন দূরত্ব তৈরি হয় তখন মানুষ নিজেকে এ জগতের অংশ ভাবতে পারেনা। এর প্রেক্ষিতে জগতটা তখন নিজের থেকে আলাদা হয়ে পড়ে। এটিই বিচ্ছিন্নতার মূল কথা। এই পরিস্থিতিকে বলা হয় “আনকেনি”। হাইডেগার বলেন মানুষের জীবনের এই ধরণের অভিজ্ঞতা সৃষ্টি হলে তখন সে নিজেকে এক অদ্ভুত প্রাণি হিসেবে ভাবতে থাকে। আরেকটা বিষয় বুঝতে হবে এ জগতে আমি ছাড়া আছে আরও অনেক মানুষ; আমি এখানে একমাত্র জগতকে প্রতিনিধিত্ব করিনা, অন্যরাও প্রতিনিধিত্ব করে। কাজেই আমি কে সেটাই একমাত্র আমার কর্মপ্রক্রিয়ার অন্তর্গত নয়, আমি অন্যের জন্যও সত্য। এই ধারনাকে সার্ত্র “দ্যা লুক” এর ভেতর দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন।
দর্শনে একটা শব্দের ভীষণ ব্যবহার আছে, ‘পরিণতিবাদ” বা “উদ্দেশ্যবাদ”। উদ্দেশ্যবাদ হলো ভাববাদী দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে বলা হয়, কোন কিছুই একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের বাইরে নয়। এখানে সবকিছু এক এবং অভিন্ন লক্ষ্যকে সামনে রেখে নিরন্তর ছুটে চলেছে। কবির কথায় ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু তোমার পানে, তোমার পানে তোমার পানে”— অস্তিত্ববাদের এমন কোন লক্ষ্য নেই। এ যেন অনির্দেশ্যের পথে পাল তোলা নৌকা, কোথায় ভিড়বে কেও জানেনা কিন্তু যত সময় নৌকা চলে ততক্ষন থেকে যায় এর বাস্তবতা।
তবে স্বাধীনতার ধারণা অস্তিত্ববাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। মনে রাখতে হবে, অস্তিত্ববাদ মানুষকে শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিয়েছে। ঘোষণা দিয়েছে ব্যক্তি মানুষের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। মানুষ যা করে তা তার স্বাধীনতা থেকে করে। সার্ত্র লিখেছেন, “আমি যদি কোন পার্টিতে যোগ দেই, কোন বই লিখি, বিবাহের সিদ্ধান্ত নেই তাহলে মনে করতে হবে এ সিদ্ধান্ত একান্ত আমার। তাই অবশ্যই স্মরণ রাখা দরকার মানুষ তার প্রতিটি কাজের জন্য দায়ি”। (একজিস্টেনশিয়ালিজম এন্ড হিউমানিজম)। এখানে মনে হতে পারে মানুষের এই স্বাধীনতা নিরঙ্কুশ বিধায় সে যা করে তা যাচ্ছেতাই রকম নিজের জন্য করতে পারে। সার্ত্র এ বিষয়ে নিজের স্বাধীনতার একটা লাগাম টেনেছেন। বলছেন, এই সাব্জেক্টিভিজমের দুটো দিক আছে- এক, একান্ত নিজের স্বাধীনতা, দুই, নিজের সাথে সাথে দেখতে হবে অন্যের স্বাধীনতাও। সার্ত্র মনে করেন, এই দ্বিতীয় অর্থে অস্তিত্ববাদে স্বাধীনতা শব্দটি ব্যবহৃত হয়। স্বাধীনতা নিয়ে সার্ত্রের তাই বহুল প্রচলিত কথা হলো, “Man is condemned to be free; because once thrown into the world, he is responsible for everything he does”.
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অস্তিত্ববাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠলে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ আসে মার্ক্সবাদ থেকে। এটা স্বীকার করতে হবে মার্ক্সবাদ যেখানে একটা সামগ্রিক মানবতাবাদের কথা বলে, অস্তিত্ববাদ সেখানে নিরঙ্কুশ ব্যক্তি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। ব্যক্তিক স্বাধীনতা মার্ক্সসবাদে ভীষণ পরিমাণে উপেক্ষিত। এটি একটি কালেক্টিভিজম দর্শন; কিন্তু অস্তিত্ববাদ ইন্ডিভিউজ্যালিজমের চরম দৃষ্টান্ত। তাই অনেকে মনে করেন অস্তিত্ববাদ মানুষের মনস্তাত্বিক ঘরানার অতি ঘনিষ্ঠ আয়োজন।
এই বিরাট পৃথিবীতে মানুষ সম্ভবত এমন এক প্রাণি যারা দুটো ভিন্ন বিশিষ্টতা নিয়ে বাঁচে, একটা তার সামাজিক দৃষ্টি, অন্যটা ব্যক্তিক। কিন্তু চূড়ান্তভাবে মানুষ সম্ভবত একা, বড্ড নিঃসঙ্গ। মানুষের জীবনের চরম নিজস্বতা, একান্ত অনুভূতি, প্রেম, বিরহ, বেদনা, হতাশা, ভালোলাগা এসব কিছু তার নিজের, একান্ত নিজের। সেখানে ব্যক্তি মানুষই তার একান্ত আপন, অন্য কেও নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো ‘জীবনের অর্থ কী?’। সম্ভবত এর উত্তরে কেও একমত হতে পারেনি ইতিহাসের লম্বা খাতায়। তবে তার থেকেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে যে জীবন আমরা পেয়েছি, তাকে আমরা কীভাবে সামনে নিয়ে যাবো? সেই মৌলিক প্রশ্ন থেকেই অস্তিত্ববাদের যাত্রা। পারস্যের কবি ওমর খউয়ামের একটা কবিতা সবচেয়ে বেশি অস্তিত্ববাদী সত্য তুলে ধরেছে মনে মনে হয়:
“Beyond the earth,
beyond the farthest skies
I try to find Heaven
and Hell.
Then I hear a solemn
Voice that says :
“Heaven and hell are inside”.
লেখক- অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
অস্তিত্ববাদ অস্ত্বিত্ববাদী চিন্তা অস্ত্বিত্ববাদী দর্শন সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার