করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০৪)
১০ জুলাই ২০২০ ১১:৩০
এ গল্প এখানেও শেষ হয়ে যেতে পারে। তাদের কথা না থাকার মধ্য দিয়ে। তারা আছে, কিন্তু তাদের কথা নেই। কথা না থাকার কথা বলতে বলতে তারা ঘুমোতে যাবে, পরদিন সকালে উঠবে, টিভি দেখবে, দুপুরে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করবে, বিকালে ঘরের ভেতর পায়চারি করবে, কখনো বারান্দায় দাঁড়াবে- ঐ যে, ফুটপাতের ঐ জায়গাটায় কালাম সাহেব বসে ছিলেন, না?
যেঁ, ওখানেই।…বাদ দাও, কী হবে এসব কথায়…।
গল্প এভাবে শেষ হতে পারে, কিংবা অন্যভাবেও। রমিজ হোসেন হয়তো একদিন বলল, নুসরাত, একটা বলব। তুমি সিরিয়াসলি নিও। আমার গলাটা দুদিন হলো ব্যথা করছে। দু’তিন দিন হলো জ্বর জ্বরও আছে।
তোমার মনের ভুল। ভাবছ এরকম।
না। সেজন্যই তোমাকে বললাম সিরিয়াসলি নিতে।
জ্বর আর গলা ব্যথা হলেই করোনা না।
না, তা না। কিন্তু…।
তা ছাড়া তোমার করোনা হবেই বা কেন। বাইরে যা যাওয়ার আমিই যাই…।
ঐ যে একদিন, এক বিকালে, খুব অস্থির লাগছিল, বাসায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল, একটু হেঁটে আসি একটু হেঁটে আসি বলে তোমার অনুমতি নিয়ে সামনের পার্কে গেলাম না হাঁটতে…।
মাস্ক পরে গিয়েছিল।
গ্লাভস ছিল না হাতে। আমি সিঁড়ির রেলিং ধরে নেমেছিলাম। অদ্ভুত দ্যাখো, আমি কিন্তু রেলিং না ধরেই নামতে পারি, কিন্তু সেদিন হঠাৎ মনে হলো শরীর ভারি… তারপর পার্কে নিয়ে সেই ঠেলে খোলা… ঠিক মনে নেই সবকিছু…।
গ্লাভস পরা জরুরি। মাস্কের চেয়ে বেশি।… আমিও যে কেন খেয়াল করলাম না। তবে রমিজ তোমার কিছু হয়নি। মনের ব্যাপার…। জ্বর মেপেছ?
জ্বর আছে। একশ-র মতো।
জ্বর নানা কারণে থাকতে পারে। বাদ দাও। … টেস্ট করাবে?
টেস্ট? সাতদিন ঘুরতে হবে, আর সাতদিন পরও রেজাল্ট পাওয়া যাবে না… আমার ইচ্ছা ছিল গণস্বাস্থ্যের কিটটা এলে এমনিতেই একবার টেস্ট করাব…।
অনুমতি দিল না…।
আরে ওরা ধরো পাঁচ হাজার টাকা খরচ দেখিয়ে টেস্ট, তিনশ টাকার কিটে টেস্ট যে করাবে, ওদের থাকবে কিছু?
ঐ যে, হু, ওরাও নাকি অনুমতি দেয়নি।
দেয়নি। হু’র প্রধান কাজগুলোর একটা হচ্ছে বড় বড় ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ দেখা।
কত কী যে দুনিয়ায়…! শোনো, তোমার কিছু হয়েছে, এ ব্যাপারটাই মাথায় রেখো না।
রমিজ হোসেন মাথা দোলালো।
চ্যানেল বদলাও। ঐ যে রিমোট। একাত্তর দেখতে ইচ্ছে করে না। বড় বেশি দালালি করে।
বদলাচ্ছি।… তুমি কি একটু সরে বসবে?
কেন! …তোমার কিছু হলে তখন দেখা যাবে।
নুসরাত হোসেন এমন বললো বটে, তবে ভোররাতেই সে উঠে চাদর বিছিয়ে ড্রয়িংরুমে শুলো। রমিজ হোসেন সকালে উঠে তাকে ঘরে না দেখে, বারান্দা বা রান্নাঘরেও না পেয়ে খুবই অবাক হলো। তাকে না বলে কোথায় গেল নুসরাত! রমিজ আবার রান্নাঘরে গেল, আবার বারান্দায়। তারপর কেন সে নুসরাতকে ফোন করছে না, কেন এই সামান্য ব্যাপারটা মাথায় আসছে না, এসব ভেবে রমিজ লজ্জা বোধ করলো ও নুসরাতকে ফোন করলো। প্রথমবার ফোন ধরলো না নুসরাত, দ্বিতীয়বার ধরলো- উঠেছো?
কিন্তু তুমি কোথায়? কী আশ্চর্য! তুমি কোথায়?
আমি ড্রয়িংরুমে।… হ্যা, ড্রয়িংরুমে।… না, তুমি আসবে না এদিকে।
কী যে করোনা! কী করে বুঝলে তোমার কিছু হয়েছে!
সিম্পটমগুলো তো জানি…।
ছাই জানো। তাছাড়া কিছু যদি হয়েই থাকে তুমি থাকবে এখানে, আমি ড্রয়িংরুমে।
না, এটাই ঠিক আছে। একটা বাড়তি তোষক ছিল, ওটা বিছিয়ে নিয়েছি। গেস্ট বাথরুমও কাছেই আছে।… রমিজ…।
তোমার আসলে কিছুই হয়নি। বলো।
ভাত রান্না করতে পারবে না?
পারবো।
ডিম? মামলেট?
পারবো।
আপাতত এই খেতে হবে আমাদের।
অসুবিধা নেই।… আমি আসছি তোমার কাছে।
যদি আসো, দরজা পর্যন্ত আসবে। ভেতরে ঢুকবে না।
এগোতে এগোতে রমিজ বললো- আমার ধারণা বিকেল নাগাদ তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে, অর্থাৎ তোমার সন্দেহ কেটে যাবে। তোমার করোনা হওয়ার কোনই কারণ নেই।
রমিজ ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিল, নুসরাত হোসেন তাকে অনুমতি না দিয়ে ধমকাল। সে বলল- আর এক পাও না, এক পা-ও না, ওখানেই দাঁড়াও। দরজার কাছে।
রমিজ দরজার কাছে দাঁড়াল, বারকয়েক নুসরাতের দিকে তাকাল, বারকয়েক এদিকওদিক, তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করল- কষ্ট হচ্ছে?
নুসরাত মাথা নাড়ল- না অস্বস্তি। … শোনো, তুমি খাবার ঐ দরজার কাছে রেখে যাবে। আমি নিয়ে নেব। একটা জগ আর একটা গ্লাস রাখবে। জগ শেষ হয়ে গেলে ধরবে না। অন্যকিছুতে পানি এনে ভরে দেবে। আর প্লেট আমি বাথরুমে ধুয়ে নেব। তুমি ওখানে সাবান, ব্লিচিং পাউডার আর স্যানিটাইজার রেখে এসো।
রমিজ হোসেন জিজ্ঞেস করল- তোমার কি কষ্ট হচ্ছে?
বলেছি না। … হচ্ছে। একটু। ভয়ও হচ্ছে।
মনের জোরটা নাকি খুব দরকার, নুসরাত।… খুব দরকার।
আমার মনের জোর আছে।
একবার টেস্ট করাবে?
না। রিকশায় করে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল ঘোরার ইচ্ছা আমার নেই। ভর্তিও হতে চাই না। তাছাড়া আমরা বের হলে এখানকার লোকজন টের পেয়ে যাবে। তখন কী হবে, তুমি জানো। … তুমি যাও, নাস্তা বানিয়ে খেয়ে নাও।
সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, তারপর রমিজের একটু বিশ্রাম- এভাবে বিকাল পার হলো। সন্ধ্যার আগে রমিজ যখন চা বানিয়ে চার আর দুটো বিস্কিট নুসরাতের দরজার কাছে রেখে আসতে গেল, নুসরাত বলল- খুব বেশি চাপ পড়ে গেছে, না? তোমার এতসবে অভ্যাস নেই।
আরে না, এসব হচ্ছে খুচরা কাজ। … তোমার জ্বর কেমন?
একটু বেড়েছে মনে হচ্ছে।
মেপেছ?
ইচ্ছে করছে না। … মাপব পরে।
জ্বর কি হঠাৎ করে আসে?
হু। সর্দি সর্দি একটা ভাব হয়।
ঘরে একটাই থার্মোমিটার, না?
রমিজ…!
আহা। একটু মেপে দেখতাম।… ঘুম থেকে…।
মাথা থেকে এসব চিন্তা সরাও। আমার হয়েছে, তাই অনেককিছুই মনে হবে তোমার।… গা গরম অনেকসময় এমনিতেও হয়।
সেসব আমি জানি। কথা হচ্ছে, তোমার হলে আমারও কেন হতে পারবে না? আমরা এতদিন একসঙ্গেই ছিলাম…।
তার মানে আমার কাছ থেকে তোমার হয়েছে?
আহা। আমি কি তা বুঝিয়েছি। তোমার কাছ থেকে আমার কেন হবে! ঐ যে, ডিপার্ট্মেন্ত স্টোরে অর্ডার ছিল সপ্তাহের বাজারের, ডেলিভারি বয় মালপত্র সামলাতে পারছিল না, দরজার কাছে সব এলোমেলো করে ফেলেছিল… হয়তো ওই ডেলিভারি বয়ই ক্যারিয়ার ছিল…।
নুসরাত রমিজের দিক থেকে মুখ সরিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাল।
ঐ থার্মোমিটারটাই দাও। আমি ভালোভাবে স্যানিটাইজ করে নিচ্ছি। তারপর আবার স্যানিটাইজ করে তোমাকে দেব। জ্বরটা দেখতে হবে নিয়মিত কত। অন্যান্য উপসর্গগুলোও মাথায় রেখে। আর হ্যা, মনের জোরটাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মনের জোরেই মানুষ বাসায় থেকে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। … থার্মোমিটারটা দাও।…সবসময় শুয়ে থেকো না, একটু বসে থাকা, হাঁটাচলা, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ…।
তুমি এখান থেকে যাও, প্লিজ। না হলে অদ্ভুত কথা বলা বন্ধ করো। আমি ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ কী জানি? জীবনে করেছি? (চলবে…)
বাকি পর্ব পড়ুন
করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০৩)
করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০২)
করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০১)