একটা লাল বাড়ি
১২ জুলাই ২০২০ ১৩:২৪
একটা পুরনো একতলা লাল বাড়ি, ইঞ্জিনিয়াররা কেতাবি ভাষায় যাকে বলেন এক্সপোসড ব্রিকস বিল্ডিং, শহর ছাড়িয়ে একটু দূরে শহরতলীর কোল ঘেঁষে ইছামতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে। গেটের একপাশে একটা লাল জবা আরেক পাশে শিউলি গাছ। বাড়িটার সামনে এক চিলতে জায়গা। কোনো এককালে শখের বশে পরিকল্পনায় বাগান করা হলেও এখন সেখানে ঝোঁপঝাড়। পেছনে বেশ খানিকটা জায়গা। যেখানে বড় বড় পুরোনো গাছ।
ওই লাল বাড়ির পাশ দিয়ে রোজ স্কুলে যেতাম। বাড়িটার সাথেই ভরাট হওয়া ইছামতি নদী। পার হওয়ার জন্য একটা বেখাপ্পা উঁচু ব্রিজ। ব্রিজটা পার হতে রিকশাওয়ালাকে বেশ বেগ পেতে হতো। প্রতিদিন বাড়িটা দেখতাম। সেই কোন আদ্যিকালের বাড়ি- কত গল্প, কত কষ্ট, কত হাসি বুক পেতে নিয়ে ভোরের আলোয় থ মেরে বসে আছে।
পুরনো বাড়ির গায়ে জমে থাকা শ্যাওলা, বুকে জমে থাকা গল্প; সবসময়ই আমাকে টানে। আমাদের পুরনো শহরজুড়ে বেশ কয়েকটি পুরনো বাড়ি আছে। স্কুল থেকে আমাদের বাড়িটা বেশ দূরে হওয়ায় প্রতিদিন আমাকে শহরের বেশ খানিক পথ পাড়ি দিতে হতো। কিশোরীর কৌতুহলে চারপাশটা দেখতে দেখতে স্কুলে যেতাম। পথে অনেকগুলো পুরনো বাড়িও পড়তো। কিন্তু কেন জানি না ওই লাল বাড়িটার প্রতি আমার ছিল আলাদা একটা আকর্ষণ। ভাবতাম বাড়িটা কে বানিয়েছিল? কেন বানিয়েছিল? ঠিক বানানোর পরপরই নতুন বাড়িতে কারা থাকতো? কেমন ছিল বাড়িটা দেখতে তখন?
আবার ভাবতাম বাড়ির ভেতরটা কেমন? উঁচু উঁচু কড়িকাঠ আছে নিশ্চয়ই। দেওয়াল আলমারিও আছে? গুপ্ত দরজা? কিংবা গোপন ঘর? এসব অনেক প্রশ্নের উত্তরের মতোই তখনও জানতাম না বাড়িটাতে সনম ভাই থাকেন। সেই সনম ভাই; যার সাথে আমার প্রথম দেখা বনমালী ইনস্টিটিউটের এক পুষ্প মেলায়। স্কুল শেষে কয়েক বন্ধু মিলে গিয়েছিলাম মেলায়। সেখানে দেখি এক শ্যামবর্ণের লম্বা তরুণ কয়েকজনের উপর খুব চোটপাট করছেন ফুলের টবগুলো সুন্দরভাবে রাখা হয়নি বলে। আমার বন্ধু তৃণা গটগটিয়ে তার পাশে গিয়ে ডাকলো, অ্যাই সনম ভাই! সেই থেকে সনম ভাইকে চিনি। এরপর ওনার সাথে দুয়েকবার দেখা হয়েছে। তবে লাল বাড়িটাকে দেখতাম রোজ। কিন্তু তখনও জানতাম না ওই বাড়িটাতেই সনম ভাই থাকেন। একদিন তৃণার কাছে শুনলাম সনম ভাইদের বাড়ি ওইটা। সেই লাল বাড়ি। আর এই একটা কারণে আমি তার প্রেমে পড়লাম!
বাড়িটা সনম ভাইদের জানার পর থেকে বাড়িটাকে নিয়ে আমার ভাবনাগুলো বদলে গেল। বাড়িটার অতীতের পাশাপাশি ভবিষ্যত নিয়েও ভাবা শুরু করলাম। ভাবতাম; সনম ভাইয়ের দাদা নাকি পরদাদা বাড়িটা বানিয়েছিলেন? উনারা কি জমিদার ছিলেন? সেই যুগে তো দালান আর যে সে লোক বানাতে পারতো না!
সনম ভাইকে আমার ভালো লাগার কথাটা কখনো জানানো হয়নি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমার আসা-যাওয়ার রাস্তাটা বদলে গেল। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তো শহরটাকেই ছেড়ে চলে আসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তীব্র স্রোতে অনেক কিছুই বদলে গেল। ছুটিতে বাড়ি গেলেও আর ওই রাস্তা মাড়ানো হয়নি! মনের কোণে চাপা পড়ে গেল সনম ভাই; হারিয়ে গেল লাল বাড়ি!
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে আমি তখন সদ্য চাকরিতে ঢুকেছি। ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটিতে বাড়ি গেলাম সেবার। ছোট ভাইয়ের আবদার, যেতে হবে বইমেলায়। আমি তো কিছুতেই যাবো না। অফিস থেকে রোজ বইমেলায় গিয়েছি ঢাকায় থাকতে। তারপরও ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে গেলাম বইমেলায়। প্রতিবার মেলা এডওয়ার্ড কলেজের মাঠে হয়, এবার হচ্ছে বনমালী ইনস্টিটিউটে। মেলায় ঢুকেই বাদিকের স্টলে দেখি সনম ভাই! কয়েকজনকে বকাবকি করছেন ডিসপ্লের বই গুছিয়ে সুন্দর করে না রাখার জন্য! এগিয়ে গেলাম সনম ভাইয়ের দিকে। জিজ্ঞেস করলাম; আমাকে চিনেছেন কী না। বললেন, চিনবো না কেন, তুমি তৃণার বন্ধু। তোমাকে কিন্তু এখানেই প্রথম দেখেছিলাম। আমি বললাম, আপনার মনে আছে! উনি হাসলেন। সেদিন মেলার কোণে বসানো কফি মেশিনের বিস্বাদ কফি খেতে খেতে জানলাম; সেই লাল বাড়ির কথা, ওনার কথা।
বাড়িটা সনম ভাইয়ের দাদা বা পরদাদা কেউ বানাননি। ওইটা সরকারি সম্পত্তি। ওনার বাবা পৌরসভায় চাকরি করতেন। উনি একশ’ বছরের জন্য ১৯৮০ সালে লিজ নিয়েছিলেন বাড়িটা। বাড়িটা বানিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকার; কর্মচারীদের বাসভবন হিসেবে। ওনাকে বাড়ির ভেতরটার ব্যাপারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। উনি জানালেন খুব বেশি বড় নয় বাড়ির ভেতরটা। সাকুল্যে চারটা থাকার ঘর। রান্নাঘর আর বাথরুম মূল ভবনের বাইরে বাড়ির পেছনে।
সনম ভাইকে হাসতে হাসতে বললাম, একশ’ বছর পর তো আপনাদের ভিটেছাড়া হতে হবে। সনম ভাই বললেন, একশ’ বছর পর তো আবার লিজের মেয়াদ বাড়ানো যায়। আর একশ’ বছরে আমার নাতির জীবন কেটে যাবে!
নাতির কথায় সনম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম; বিয়ে করেছেন? জানালেন বিয়ে করেছেন ক্ষমতাসীন এক নেতার মেয়েকে। উনি নিজে কী করেন জিজ্ঞেস করতে জানালেন, শহরে তিনটা দোকান আছে, মাস গেলে সেগুলোর ভাড়ার টাকা পান। আর এই সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে সময় দেন।
সনম ভাইয়ের কাছ থেকে জানা হলো না কড়িকাঠের কথা, জানা হলো না দেওয়াল আলমারির কথা! আর গুপ্ত দরজা কিংবা গোপন ঘরের কথা শুনলে উনি নিশ্চয়ই আমাকে পাগল ভাবতেন!
বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসছিল। একটু দূরে বন্ধুদের সাথে আড্ডারত ছোটভাইকে পাকড়াও করে সনম ভাইকে বিদায় জানালাম। ফেরার পথে রিকশাওয়ালাকে বললাম, ভাই একটু গোবিন্দার রাস্তা দিয়ে যাবেন? এতো ঘুরে যাবো ক্যানো? উনার যৌক্তিক আপত্তি। একটু বেশি ভাড়া কবুল করে শেষমেষ রাজি হলেন। বিকেলের শেষ আলোয় আমার কৈশোরের চিরচেনা রাস্তাটায় চেনা ঘরবাড়ি খুঁজতে বেগ পেতে হচ্ছিল! বদলে গেছে চারপাশ। পুরোনো শহর আড়মোড়া ভেঙে যেন এখানেও একটু একটু করে নতুন ঘাঁটি গাড়ছে! লাল বাড়িটা অবশ্য আগের মতোই আছে। বাড়ির সামনের ঝোঁপঝাড়ও! নেই শিউলি আর জবা গাছটা। বাড়ির লাগোয়া ব্রিজটাও আর উঁচু নেই। রাস্তার সাথে সমান করে ফের বানানো হয়েছে। রিকশাওয়ালা একটানে ব্রিজটা পার হয়ে আমাদের বাড়ির দিকে নিয়ে গেলেন। জীবনের রোজকার প্রয়োজনে ভুলে গেলাম লাল বাড়ির কথা।
এরপর কেটে গেছে কয়েক বছর। আমার ছেলে বেশ ছোট। ঢাকার বাসায় একা একা ওকে সামলাতে আমার লেজেগোবরে অবস্থা। তাই কয়েক মাস থাকার জন্য বাড়ি গেছি। এক অনলাইন শপ থেকে ছেলের জন্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছে ওর বাবা। সেগুলো আনতে শহরের কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে যেতে হবে। বিকেলে রিকশা নিয়ে বেরুলাম সেসব আনতে। রিকশাওয়ালা সেই লাল বাড়ির রাস্তা ধরলেন। ব্রিজটা পার হওয়ার আগেই চোখ গেল বাড়িটার দিকে। আমার বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল! বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে! রিকশাওয়ালাকে থামতে বললাম। বিকেলে কাজ করে শ্রমিকরা চলে গেছে। সামনের ঝোঁপঝাড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো লাল ইটের স্তূপ। জীবনের প্রথম এবং শেষবারের মতো বাড়িটার ভেতর পা রাখলাম। কাঠামোটা শুধু আছে। কড়িকাঠ, দেওয়াল আলমারি, গুপ্ত দরজা কিংবা গোপন ঘর কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। একটা কঙ্কাল যেন অন্তিম দীর্ঘশ্বাসে নিজের ফেলে আসা সোনালি দিনগুলোকে শেষবারের মতো মনে করছে। আমার গলার কাছটায় কান্নার ঢেউ! এটা তো কোনো জমিদার বাড়ি না। আমি যা ভাবতাম তার কিছুই না। তারপরও বাড়িটার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার কৈশোরের সুন্দর দিনগুলোর একটা অংশ বাড়িটার সাথে সাথে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার ছেলেবেলার রঙিন কিছু কল্পনা লাল ইটের সাথে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। রিকশাচালক তাগাদা দেয়, ‘আপা, আসেন’। আমি সন্ধ্যে নামার মুখে শেষবারের মতো লাল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সামনে অপেক্ষায় থাকা অনিশ্চিত সাদাকালো জীবনের দিকে বাড়াই।