করোনাকালের রোজনামচা (শেষ পর্ব)
১৭ জুলাই ২০২০ ১২:৩৫
তাদের চার- পাঁচদিন পার হয়ে গেল। জ্বর কমল না, কাশি হলো, নাক ভেজা থাকল সবসময়, আর গলায় প্রবল অস্বস্তি ও কখনো শ্বাশকষ্ট। তারা একসঙ্গে থাকতে আরম্ভ করেছে। এঘরে-ওঘরে হাঁটাহাঁটি করছে।
মাঝেমাঝে, তারা অ্যানিম্যাল প্রোটিন খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে।
এক বিকালে, তারা যখন পাশাপাশি হাঁটছিল, রমিজ হোসেন বলল- যতক্ষন শ্বাস ততক্ষন আশ।
সামান্য হাসল নুসরাত- তাই। … আমার শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে।
একটু ইতস্তত করল রমিজ- হুম আমারও। মাঝে মাঝে মনে হয় এই কষ্ট সামাল দেওয়া যাবে না।
যাবে না হয়তো।
নুসরাতের দিকে একপলক তাকায় রমিজ- না গেলে না যাবে না।… অনেকদিন হলো না এই পৃথিবীতে?
হলো।
তাছাড়া, ধরো, আরও কিছুদিন নাহয় বেঁচেই থাকলাম। কী আর হবে?
জানি না।
আমিও না।
ওষুধ শেষ হয়ে যাবে আজ। আনতে হবে।
ওষুধ, না?
ওষুধ। বাজারও করা দরকার।
দরকার? সত্যিই দরকার? হয়তো দেখা গেল দরকার না।
ওষুধের দোকান থেকে জানিয়েছে, তাদের ওখানে এত ভিড়, কেউই দোকান বন্ধ করার সময় ছাড়া বের হতে পারবে না। তবে ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকে বাজার নিয়ে একজন চলে এলো দুপুরের আগে। দরজার বেল বাজল, সে ছেলে ফোনও করল। রমিজ আগেই ঠিক করে রেখেছিল, সে দরজা খুলবে না। হাতে গ্লাভস পরে টাকাগুলো একটা খামের ভেতর রেখে দরজার নিচ দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেবে আর ডেলিভারি বয়কে বলবে বাজার দরজার কাছে রেখে যেতে, পরে সে নিয়ে নেবে। ডেলিভারি বয় ফোন করে তার উপস্থিতি জানালে, রমিজ প্রথমে বিল জেনে নিল। তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে, কিছু টাকা সে আগেই ইস্ত্রি করে রেখেছিল, সেখান থেকে বিলের অংশ গ্লাভস পরা হাতে খামে ঢুকিয়ে খামটা ইস্ত্রি করল, তারপর বাইরের দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল- তুমি আছ?
আছি।… চাবি কই স্যার?
শন, আমি বিল দরজার নিচ দিয়ে দিয়ে দিচ্ছি, তুমি বাজার বাইরে রেখে চলে যাও।
জি।… স্যার, দরজায় তালা কেন! বাজার নিবেন কেমনে?
কোন দরজায়?
এই যে এই দরজায়। বাজার নাহয় পরে নিবেন, কিন্তু বাইরে থেকে তালা দিছেন ক্যামনে!… স্যার সমস্যা কী?
রমিজ হোসেন বললেন- তুমি যাও। এখনই যাও।
স্যার সমস্যা কী? করোনা নাকি? বিল্ডিং এর লোকজন তালা দিছে? এইটা অন্যায়। আমি পুলিশরে ফোন দিব।
রমিজ হোসেন আবার বললেন- তুমি যাও, যাও এখান থেকে।
দরজায় কান রাখলে বোজা গেল ছেলেটা নেমে যাচ্ছে। নিশ্চিত হয়ে রমিজ নুসরাতের দিকে ফিরল- আমাদের কে তালা দিল, নুসরাত?
নুসরাত হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকল।
কিন্তু বুঝল কীভাবে! … দাঁড়াও দাঁড়াও, সেদিন কেয়াটেকার এসেছিল না? ভেতরে ঢুকে ইলেক্ট্রিক বিল নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিল। সম্ভবত ওটা ছিল বাড়িওয়ালার চাল। বিভিন্ন বাসায় পাঠিয়েছিল কেয়ারটেকারকে। আমরা ঢুকতে দিইনি জেদাজিদি সত্ত্বেও। তখন সন্দেহ করে দরজায় তালা দিয়েছে।
নুসরাত বলল- আমরা তাহলে বের হতে পারব না?
তারা একবার ঠিক করল দরজায় দুজন মিলে অনেকক্ষন ধরে লাথি মারবে। শিলপাটার শিল আর হাতুড়ি এনে দরজা ভাঙবে, একবার ভাবল বারান্দায় গিয়ে চেঁচাবে, এবং এরকম আরো কিছু। তাঁর একটিও অবশ্য শেষ পর্যন্ত করা হলো না। রমিজ বলল- মানুষ এমন নিষ্ঠুর হয় কী করে!
মানুষ এমনই। মাঝেমাঝেই আমরা বলি না- মানুষ কীভাবে পারল।… মানুষ পারে।
তারা আমাদের জিজ্ঞেস করতে পারত।
কিংবা বলতে পারত, আপনারা বাড়ি ছেড়ে চলে যান।
আহা নুসরাত, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বললে আমরা কোথায় যেতাম!
তাহলে পুলিশে খবর দিত…।
পুলিশ তখন পুরো বাড়ি লকডাউন করে দিত।
করে কী হোতো!… আমরা তো একবারও বাইরে যাইনি। ঘরের মধ্যে থেকেছি। মাঝেমধ্যে শুধু বারান্দায় বসেছি। বারান্দা থেকে নিশ্চয় উড়ে উড়ে করোনা কারো বাসায় যাবে না।
না, করোনা উড়ে উড়ে যায় না।
এখন মনে হচ্ছে, করোনা উড়ে উড়ে বাড়িঅলার বাসায় যাক।
এভাবে বলে না। … বাড়িঅলাই করেছে?
আর কে?… কিংবা এ বাড়ির সবাই মিলে।
করল। একবারও ভাবল না…।
ভেবে এটাই যুক্তিসঙ্গত মনে করেছে।
আমরা কিছু করব না?
কী।… ডিপার্টমেন্ট স্টোরের ছেলেটা বলল পুলিশে খবর দেবে…।
দেবে?
নুসরাত বলল- ছেলেটা পুলিশে খবর দেয়নি।
জানতাম দেবে না।… কিংবা দিতেও পারে, পুলিশ কতদিক সামলাবে!
আমরা নিজেরাই কিন্তু পুলিশে খবর দিতে পারি। নাম্বার আছে, মনে পড়ল।
রমিজ মাথা ঝাঁকাল- পারি। কিন্তু নুসরাত, পুলিশ এসে কী করবে? ধরো, হাসপাতালে নিয়ে গেল আমাদের। তোমাকে এক হাসপাতালে, আমাকে আরেক। তারপর ভাবো। আমরা কিছুই জানলাম না কে কোথায়, এমনকি এক হাসপাতালে থাকলেও না। কে কোথায় কেমন আছি, জানব না। কে বাঁচলাম কে মারা গেলাম জানলাম। ধরো, তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে, কোথায় ফিরবে? ফিরলে এখানে। তারপর? ঢুকতে দিল না। কিংবা দিল। তারপর?
এমন অবস্থা তোমারও হতে পারে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে…।
তারপর?
জানি না।
তোমার কবর কোথায় সেটাও কে জানাবে না।
কবর কোথায় জেনে কী হবে? আসলেই, বলো, জেনে কী হবে!
ধরলাম, কিছু হবে না। কিন্তু আমরা এমনিতেই একা। এরমধ্যে কেউ না থাকলে, যে থাকবে, সে কীভাবে থাকবে?
তুমি পারবে না?
আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, গলার কাছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে মাঝেমধ্যেই। আমার আর সময় নাই, জানি।
সে আমিও জানি, রমিজ।… কিন্তু তাই বলে আমাদের তালা দিয়ে রাখবে?
এটা অন্যায়, খুবই অন্যায়। হঠাৎ ইচ্ছে করে ওদের বলি, দরজায় তালা দিয়ে রাখলেও মারা যাব, ভাই, না দিয়ে রাখলেও। দরজা বরং খুলে দিন, খোলা দরজায় মরি।
নুসরাত…।
নুসরাত উত্তর দিল না।
নুসরাত…।
নুসরাতের উত্তর পাওয়া গেল না।
নু…। রমিজ পাশ ফিরে, পাশ ফিরতে সময় লাগল তার। নুসরাত আছ? নাকি আমার আগ চলে গেলে?
নুসরাত দম নেওয়ার চেষ্টা করল- সময় ফুরিয়েছে…।
আমারও। হয়তো আজই।…কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা বলারও ইচ্ছা হচ্ছে খুব।
বলো।
দরজা তালা দিল আমাদের। আমরা মেনে নিলাম।… হইচই করলাম না।… তোমার কাছে নাম্বার ছিল। কিন্তু পুলিশে খবর… দিলাম না। … অনেকে হয়ত বলবেন আমাদের অভিমান। … বলুক। কিন্তু বাড়িঅলা… ঠিকই শাস্তি পাবে…।
নুসরাত তাকানোর চেষ্টা করল। পারল না।
ভাবো- আমরা মরে পড়ে থাকব।
হুম…।
একসময় না… একসময়… তালা তো খুলবেই, না?… কী দেখবে?… দেখবে… আমরা মরে পোঁচে আছি… গন্ধ ছড়াচ্ছি… নুসরাত… বাড়িঅলার কী অবস্থা হবে তখন?
কী অবস্থা… রমিজ?
তার বাড়িতে দুই করোনা রোগীর পচা লাশ… কে আসবে… কে… সরাবে লাশ?
কে?
কেউ না।
ও।
বাড়িঅলার মাথায়… বাজ পড়বে।… তার অবস্থা ভেবে… আমার হাসি পাচ্ছে।… নুসরাত, বাড়িঅলার কথা ভেবে… হাসবে একটু?
হয়তো রমিজ ও নুসরাত হাসবে। কিন্তু তাদের হাসি ঠিক হাসির মতো দেখাবে বা শোনাবে না।
আরও পড়ুন,
করোনাকালের রোজনামচা (পর্ব: ০৪)