Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বরফ রানী


৩০ জুলাই ২০২০ ১৯:০৭

মূল গল্প: হ্যান্স ক্রিশচিয়ান আন্দেরসন
অনুবাদ: নাসরীন মুস্তাফা

আয়নাটা
এক দিন। তার মন ছিল খুব খুশি। কেন খুশি হবে না? এক আয়না বানিয়ে ফেলেছে সে। এক আজব আয়না, বুঝলে? যা কিছু ভালো আর সুন্দর, তা এই আয়নায় দেখা দেয়। তারপর মিলিয়ে যায়। যেন কোথাও সেসব ছিল না।

দৈত্যদের মাঝে যেগুলো সবচেয়ে খারাপ, সে ছিল সেরকমই। সত্যি বলতে কী, সত্যিকারের দৈত্যই ছিল সে।

একদিন। এক আয়না বানিয়ে ফেললো সে। এক আজব আয়না, বুঝলে? যা কিছু ভালো আর সুন্দর, তা এই আয়নায় দেখা দেয়। তারপর মিলিয়ে যায়। যেন কোথাও সে সব ছিল না। আর যা কিছু খারাপ আর বাজে, তা এই আয়নায় আরও বেশি খারাপ আর বাজে দেখাতে থাকে।

দৈত্যটা খুব খুশি এটাকে নিয়ে। কারোর মনে যদি বা কোনো ভালো চিন্তা ঘুরঘুর করত, আয়নায় এটি বদলে যেত ভেংচিওয়ালা হাসিতে। আর তখন দৈত্যটার মনে সত্যিকারের আনন্দ জমে উঠত।

দৈত্যটার একটি ইসকুল ছিল। সেই ইসকুলে যত জ্ঞানী-গুণী ছিল, তারা আয়নাটা দেখে জানালো, আজব ঘটনা সত্যিই ঘটে গেছে। তারা আয়নাটা নিয়ে কত যে দৌড়ালো! পৃথিবীর কোনো দেশ বাকি ছিল না, যেখানে আয়নাটা যায়নি। কোনো মানুষও আর ছিল না, যে কি না এই উল্টোপাল্টা আয়নার মাঝে নিজেকে দেখেনি। জ্ঞানী-গুণীরা আয়নাটা নিয়ে স্বর্গেও যেতে চেয়েছিল। সেখানে দেবদূতদের সঙ্গে আয়নাটা নিয়ে বেশ মজা করা যেত। পারা গেল না। উড়তে উড়তে বেশি উঁচুতে যেই উড়ছিল, আয়নাটা তত বেশি ভেংচিওয়ালা হাসি দিচ্ছিল। ধরে রাখাটাই কষ্টের হয়ে গেল।

হাত ফসকে আয়নাটা পড়ে গেল। নেমে গেল পৃথিবীর বুকে। মাটিতে পড়েই গুঁড়িয়ে গেল। টুকরো টুকরো হয়ে গেল। হাজার টুকরো। লাখো টুকরো। কোটি টুকরো।

টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া আয়নাটার শক্তি কি কমে গেল তবে? মোটেও না। এখন আগের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হয়ে গেল।
কোনো কোনো টুকরো বালির কণার চেয়ে বড় নয়, উড়ে বেড়ায় সারা দুনিয়ায়, ঢুকে যায় মানুষের চোখে, আর তারপর, তারপর কি যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে! যাদের চোখে আয়নার টুকরো পড়েছে, তারা যা কিছু দেখে, তা মোটেও আসল নয়। তারা দেখে আসলের মিথ্যে রূপ, কিন্তু বুঝতে পারে না ফাঁকিটা। ভাবে, তারা সত্যিটাই দেখছে।

বিজ্ঞাপন

বুঝলে তবে? গোটা আয়নাটার যে ক্ষমতা ছিল, টুকরোগুলোর ক্ষমতাও ঠিক সে রকমই রয়ে গেল। কোনো কোনো মানুষ আয়নার টুকরো বুকের গভীরে পেয়েছিল। ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেল তখন। এই মানুষগুলোর হৃদয় বদলে গেল এক টুকরো বরফে। আয়নার কিছু টুকরো এখনো ঘুরছে দুনিয়া জুড়ে। সেগুলো নিয়ে কী ঘটল, তা এখন শুনবে তুমি।

খুদে এক ছেলে আর খুদে এক মেয়ে
কত কত শীতের রাতে পথে পথে উড়ে বেড়াত মেয়েটা! জানালায় দিত উঁকি। জানালার কাঁচে তখনি জমে যেত বরফ। বরফের সে নকশা কত যে সুন্দর! যেন সব ফুল!

এক বিরাট শহরে বাস করত দুই শিশু। খুদে এক ছেলে আর খুদে এক মেয়ে। ওরা খুব বন্ধু। ওদের বাবামায়েরা মুখোমুখি দু’টি চিলেকোঠার ঘরে বাস করত। দুই বাড়ির ঢালু ছাদের নিচেই খুদে জানালা, একটি করে। দুজনেরই বাবামায়েরা জানালার কার্নিশে বিশাল বাক্স রেখেছিল। এর ভেতরেই পাত্র রাখা হতো বেশ কয়েকটা। বেশ কিছু ঔষধি গাছ আর গোলাপ গাছ বেড়ে উঠছিল সেখানে।

খুদে সেই ছেলের নাম ছিল কেই।
খুদে সেই মেয়ের নাম ছিল গেরডা।

বাক্সগুলো মেঝে থেকে উঁচুতে রাখা। খুদে সেই ছেলে আর খুদে সেই মেয়ে গোলাপ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মজার মজার খেলা খেলত। কেবল মাত্র শীত কালে এসব থেমে যেত। জানালাগুলো ঢেকে যেত সাদা বরফে। ওরা তখন খেলত অন্য খেলা। চুলার ভেতর তামার তার ঢুকিয়ে গরম করত। গরম তার দিয়ে ঠাণ্ডা জানালার কাঁচে চাপ দিয়ে সুন্দর গোল গর্ত করল। দুই জানালায় দু’টি গর্ত। তখন একটি উজ্জ্বল চোখ এই গর্ত দিয়ে তাকাত আরেক জানালার দিকে। সেখানে যে গর্তটা, তার ভেতর দিয়ে তাকাত আরেকটি উজ্জ্বল চোখ।

সন্ধ্যায়, যখন খুদে কেই ছিল বাড়িতে, সব পোশাকও পরেনি, জানালার পাশে চেয়ার নিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াল এর উপর। জানালার খুদে গর্তের ফাঁকে চোখ রাখল। অল্প স্বল্প তুষার কণা ঝরছিল। বাক্সের কিনারায় তখনো কিছু তুষার কণা পড়েছিল। এর ভেতরে সবচেয়ে বড় যে তুষার কণাটি, সেটি ওর চোখের সামনেই বড় থেকে আরও বড় হতে থাকল।

বিজ্ঞাপন

বড় হতে হতে তুষার কণাটি কি হলো?

সেটি হয়ে গেল এক নারী। তার পরনে ফিনফিনে সাদা জামা, মনে হচ্ছে লাখো লাখো তারার কণা দিয়ে সাজানো। কী যে সুন্দর সেই নারী! কিন্তু তার পুরো শরীরটাই বরফ, ঝকঝকে চকমকে বরফ। এরপরও সে বেঁচে আছে। তার চোখ জোড়া জ্বলজ্বলে তারার মতো করে জ্বলছে। সেই চোখে যেন কোনো বিশ্রাম নেই। নেই কোন শান্তি।

বরফ নারী জানালার দিকে তাকাল। তারপর নেড়ে দিল হাত।

খুদে ছেলেটা যা ভয় পেল না! লাফিয়ে নেমে গেল চেয়ার থেকে। আর তখুনি তার মনে হলো, জানালার ও পাশে বিশাল এক পাখি বুঝি উড়ে গেল।

পরের দিনটা ছিল উজ্জ্বল আর তুষার ঘেরা। এরপর এলো বরফ গলে যাওয়ার সময়। এরপর এলো বসন্ত। সূর্য আলো ছড়াচ্ছে, সবুজ পাতাগুলো চোখে পড়তে শুরু করেছে, সোয়ালো পাখিরা শুরু করেছে বাসা বানানো, আর মানুষজন খুলে দিচ্ছে বাড়ির জানালা।

এর পরের এক দিন।

কেই আর গেরডা একটি বই দেখছিল এক সাথে। ছবির বই। পাখি আর পশুদের নিয়ে লেখা। ঘড়িতে তখন কেবল পাঁচটা বাজার ধ্বণি বাজলো, আর তখুনি কেই  কিনা বলে উঠল, ‘ওহ্! কী যেন আমার বুকের ভেতরে লেগেছে! আর কিছু একটা বিঁধেছে চোখে।’

এটা তো ছিল সেই আজব আয়নার খুব খুদে এক টুকরো। মনে আছে তো সেই ভয়ানক আয়নার কথা, যেখানে সব ভাল বা সেরা বস্তুর ছবি দেখা যায় ছোট আর তুচ্ছ, আর যেখানে বাজে সব কিছু দেখা যায় চকমকে, সব ভুল হয়ে ওঠে খুব স্পষ্ট।

বেচারা কেই! আয়নার টুকরো সোজা চলে গেছে ওর অন্তরে, আর ওর হৃদয়টা হয়ে গেছে এক থাল বরফ। ও আর কিছু টের পাচ্ছে না। কিন্তু ওটা রয়ে গেছে ওখানেই।

‘কেন কাঁদছ?’ ছেলেটা জানতে চায়। বলে, ‘কান্না তোমাকে কুৎসিত দেখাচ্ছে; আমার কিছু যায় আসে না। কী ভয়ানক!’ এরপর ছেলেটা হঠাৎ করে নিজেই কাঁদতে শুরু করল। বলল, ‘গোলাপের ভেতর একটা কেঁচো ছিল, আর ঐ গোলাপটা তো কেমন কুটিল দেখতে; আসলে গোলাপগুলো নোংরা, আর ওগুলো যে বাক্সে জন্মেছে সেগুলোও নোংরা বটে!’

ছেলেটা বাক্সে লাথি মারল। এতে গোলাপের দুটি পাত্র গেল ভেঙ্গে।

‘কেই, তুমি কী করছ?’ খুদে মেয়েটি চিৎকার করে উঠল। তখন ছেলেটি আরেকটি গোলাপের পাত্র ভেঙ্গে দিল।

সব সময়ের মতো দাদীমা যখন গল্প বলছিলেন, সব সময়ের মতো সে মনোযোগ দিল না, বরং- দাদীমার চেয়ারের পেছনে কেমন কেমন করে যেন চলে গেল, দাদীমার চশমাটা চোখে ঝুলিয়ে দাদীমাকে নকল করতে শুরু করল।

এই কাজটা সে এখন খুব ভাল পারে আর মানুষ তখন খুব হাসে। খুব শিগগিরি ছেলেটা পথের সবাইকে নকল করতে পেরে গেল। প্রত্যেকের ধরণ আর অনুভূতি নিয়ে মজা করতে পেরে গেল। লোকেরা বলতে লাগল, ‘ছোকরা তো খুব চালাক বনে যাচ্ছে।’

আসলে এ সব কিছুই ঘটছে ওর অন্তরে ঢুকে যাওয়া কাঁচের টুকরো আর চোখের উপর থাকা কাঁচের টুকরোটার জন্য। এ সবের জন্যই ও খুদে গেরডাকে নিয়ে তামাশা করতে পারত। অথচ গেরডা কত না কাছের ছিল ওর!

একটু পরেই কেই ওর পুরু হাতমোজা পরে পিঠে স্লেজ ঝুলিয়ে এলো। গেরডার কানের কাছে চেঁচিয়ে বলল, ‘বড় ময়দানটায় আমি যাচ্ছি ছেলেদের সাথে খেলতে!’

কেই চলে গেল এরপর।

বড় ময়দানটায় সাহসী ছেলেগুলো যার যার ছোট্ট স্লেজ খামারের মালবাহী গাড়ির সাথে বেঁধে দেয়। গাড়ি চলে আর ওরাও স্লেজে দাঁড়িয়ে চলে যায় অনেক দূর। এই মজার কোন শেষ নেই।

খেলার ঠিক মাঝ পথে বড়সড় একটা স্লেজ এলো। সাদা রঙ করা। এর মালিকের গায়ে সাদা পশমের কোট আর মাথায় টুপি। ময়দানটা দুইবার ঘুরল এটি। এর পেছনে কেই ওর স্লেজ বেঁধে নিয়েছিল জলদি। স্লেজটা চলছিল দ্রুত, আরও দ্রুত, আরও- পাশের রাস্তায় গেল চলে। চালক ঘুরে কেইয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিল, মনে হলো কেই তার চেনা কেউ। যতবার কেই সেই স্লেজটাকে হারাতে চাইছে, ততবার এর চালক ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। বেচারা কেই রয়ে গেছে যেখানে সে ছিল। শহরের তোরণের দিকে ছুটল ওরা।

তুষার পড়তে শুরু করল জোরেশোরে। খুদে ছেলেটা দেখতে পায়নি কিছু, কেউ তার সামনে হাত নেড়েছিল কি না। বাঁধন খুলে দিয়ে চাইল বড় স্লেজটাকে এড়িয়ে যেতে। কোন লাভ হলো না। ওর খুদে স্লেজটা ধাক্কা খেল প্রথমে, উড়ে গেল জোরে, বাতাসের চেয়েও জোরে। খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল কেই। কিন্তু কেউ শোনেনি। তুষারের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল স্লেজটা। সব সময় এমন হলে লাফিয়ে যেতে হয়। ছেলেটা এত বেশি ভয় পেয়েছিল যে প্রার্থনা করতে চাইলেও পারেনি। কেবল মনে পড়েছিল নামতাগুলো।

তুষার কণাগুলো আরও বড় হচ্ছে। শেষ মেষ এগুলোকে ইয়া বড় সাদা মুরগীর মতো দেখাল। বড় স্লেজটা থামল। কেউ একজন নেমে এলো। কোট আর মাথার টুপি ছুড়ে ফেলে তুষারে। লম্বা, খটোমটো এক নারী সে, আপাদমস্তক সাদা। এ নারী আর কেউ নয়, বরফ রানী নিজেই।

বরফ রানী কেইকে স্লেজের ভেতর থেকে বের করল। নিজের পশমি গলাবন্ধ দিয়ে জড়িয়ে দিল ওকে। কেই তখন ভাবছিল, ও বুঝি বরফের নদীতে ডুবে যাচ্ছে। বরফ রানী কেই-এর কপালে চুমু খেলেন। আর তখনি কেই ভুলে গেল খুদে গেরদা’র সব কথা। দাদীমা আর বাড়ির সবাই যে ওর ছিল, তাদের কারোর কথা ওর আর মনে রইল না।

স্বর্গের চওড়া কিনারায় চোখ যায় কেই-এর। ওরা কেবলই উঠছিল। বরফ রানী ওর সাথে উড়ছিল বড় এক কাল মেঘের মতোই। বন-জঙ্গল আর হ্রদ পার হয়ে ওরা উড়ছিল। সাগর-মহাসাগর আর দ্বীপগুলোর উপর উড়ছিল। ঠাণ্ডা বাতাস ওদের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল শীষ দিতে দিতে। নেকড়াটা মুখ উঁচিয়ে ডেকে ওঠে। কাল কাকগুলো ঝগড়াটে চড়–ইদের তাড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সবচে উপরে দেখা দেয় চাঁদটা, যেমন উজ্জ্বল, তেমনি ঝকঝকে। কেই তখন তাকায় চাঁদের দিকে। পুরো পথ জুড়ে, শীতের লম্বা রাত জুড়ে ও তাকিয়ে দেখে চাঁদকে। কেবল দিনে ও ঘুমায় বরফ রানীর পায়ের উপর।

বাগানে জাদু শেখা বুড়ি
তখন এক বুড়ি, থুরথুরে বুড়ি বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে; বিশাল এক বাঁকানো মাথার লাঠিতে ভর দিয়ে ছিল সে। মাথায় ছিল বিশাল এক রোদ ঠেকানো টুপি, যা সুন্দর ফুলের নকশায় ঢাকা পুরোটা।

কেউ জানে না, কেউ জানে না কেই-এর কি হয়েছে। অবশেষে, সবাই ধরে নিল কেই মরে গেছে। হয়তো কেই পড়ে গেছে শহরের কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে। ওহ্, কী লম্বা, কালো শীতের দিনই না ছিল!

অবশেষে এলো বসন্ত। সূর্যটা উঠল হেসে।
‘কেই মরে গেছে, তাই চলে গেছে,’ বলল খুদে গেরডা।
‘আমি বিশ্বাস করি না,’ বলল সূর্যের আলো।
‘কেই মরে গেছে, তাই চলে গেছে,’ সোয়ালো পাখিদের বলল মেয়েটা।
‘আমরা বিশ্বাস করি না এ খবর।’ সোয়ালোরাও যখন এ কথা বলল, তখন গেরডাও আর বিশ্বাস করল না সে কথা।
এক সকালে মেয়েটা বলল, ‘আমার নতুন লাল জুতোটা পায়ে গলিয়ে নিচে নেমে যাব নদীর কাছে। কেই জুতো জোড়া কখনোই দেখেনি। আমি নদীর কাছে জানতে চাইব কেই-এর কথা।’

খুব সকালের কথা এসব। বুড়ো দাদীমা তখনো ঘুমচ্ছেন। তাকে চুমু খেয়ে লাল জুতো জোড়া পায়ে গলিয়ে একলা একা বেরিয়ে এলো গেরডা। তোরণ পার হয়ে চলল নদীর দিকে।

‘এটা কি সত্য যে তুমি আমার খুদে খেলার সাথিকে নিয়ে গেছ? আবার তাকে ফিরিয়ে দাও, তাহলে এই জুতো জোড়া তোমাকে দিয়ে দেব, নদী।’
নদীর বুকে খুদে ঢেউ কেমন করে যে জেগে উঠল! গেরডা লাল জুতো জোড়া খুলে নেয়। কত সাধের জুতো জোড়া ওর! সোজা পানিতে ছুঁড়ে মারে সেগুলো। তীরের কাছাকাছি ডুবে গেল বটে, একটু পরেই খুদে ঢেউ আবার ফিরিয়ে দিল ওগুলো। মনে হ’ল, নদী ওর উপহার নেয়নি। মনে হ’ল, খুদে কেই-এর কী হয়েছে, তা জানে না নদী।

গেরডা ভাবল, আরও দূরে ছুঁড়ে দিতে হবে জুতো জোড়া। তবেই বুঝি জবাব মিলবে।

কাজে কাজেই একটা খুদে নাও নিয়ে গেরডা চলল নদীর অনেক ভেতরে। আবার ছুঁড়ে দেওয়া হ’ল জুতো জোড়া। নাও ছিল ঢিলেঢালা, গেরডা নড়তেই চলে গেল দূরে, তীর থেকে বহু দূরে। পায়ে মোজা পরা খুদে গেরডা বসে আছে শক্ত হয়ে। ওর লাল জুতো জোড়া ভাসছে পেছন পেছন, বেচারারা নাওটার নাগাল পাচ্ছে না। নদীর ¯রাতে জোরে ভেসে চলে নাও। নদীর দুই পাড় ফুলে ফুলে সাজানো। দারুণ সব গাছ। পাড়ের ঢালুতে ভেড়া আর গরুর পাল চোখে পড়ল। কেবল মিলল না কোন মানুষের দেখা। একজনও না।

গেরডা ভাবল, ‘হয়তো নদীটা আমাকে কেই-এর কাছে নিয়ে যাচ্ছে।’ এই ভাবনা ওকে আনন্দিত করল। নড়েচড়ে বসে ও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর দুই পাড়ের মন মাতানো সবুজ দেখতে থাকে। এরপর যেখানে এলো, সেটি একটি বিশাল চেরি বাগান। ছোট একটি বাড়ি সেখানে। বাড়ির জানালা মন মাতানো নীল আর লাল রঙের। খড়ের ছাদ। বাইরে দুজন কাঠের সৈনিক দাঁড়িয়ে। দেখে মনে হয় গেরডা বুঝি নাও চালিয়ে পুরনো সময়ে চলে এসেছে। গেরডা সৈনিকদের ডাকে। ও ভেবেছিল এগুলো বুঝি জীবন্ত। মোটেও কথা বলেনি ওগুলো।

নদীর পাড়ের কাছে এসে গেরডা আবারও ডাকল। আগের চেয়ে জোরে এবার। তখন এক বুড়ি, থুরথুরে বুড়ি বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে; বিশাল এক বাঁকানো মাথার লাঠিতে ভর দিয়ে ছিল সে। মাথায় ছিল বিশাল এক রোদ ঠেকানো টুপি, যা সুন্দর ফুলের নকশায় ঢাকা পুরোটা।

‘বেচারা বাচ্চাটা!’ বুড়ি বলল। জিগ্যেস করল, ‘বিশাল, বিশাল পৃথিবীর এই বিরাট, শক্তিশালী নদী একা পেরিয়ে এলে কেমন করে?’ বুড়ি পানির দিকে এগিয়ে এসে বাঁকানো লাঠি দিয়ে নাওটাকে তীরে আটকাল। গেরডা নেমে এলো নিচে।

পায়ের নিচে মাটি পেয়ে গেরডার ভাল লাগতে থাকে। তবে এই অদ্ভুতুড়ে বুড়ি ওকে ভয়ও পাইয়ে দিয়েছে।

‘বলতো বাছা, তুমি কে আর এখানেই বা এলে কিভাবে’, বলল বুড়িটা।

সব কথা খুলে বলল গেরডা। জানতে চাইল, কেইকে দেখেছে কি না। বুড়ি কেইকে দেখেনি, তবে দেখা হবেই। গেরডাকে মন খারাপ করতে বারণ করল। গেরডার হাত ধরে বুড়িটা ঢুকে গেল ছোট বাড়ির ভেতরে। এরপর বুড়িটা দরজায় লাগিয়ে দিল তালা।

জানালাগুলো নাগালের বাইরে, অনেক উঁচুতে। জাানালাগুলো লাল, নীল আর হলুদ রঙের। জানালাগুলোর ভেতর দিয়ে রহস্যময় আলোরা এসে ঢোকে ঘরের ভেতর। টেবিলের উপর অনেক অনেক খুব মজাদার চেরি, গেরডা তো খেলো ইচ্ছে মতো। গেরডা যখন খা্িচ্ছল, বুড়ি তখন সোনার চিরুনি দিয়ে ওর চুলগুলো আঁচড়ে দিচ্ছিল। গোলাপের মতো মিষ্টি মুখখানা ওর। সোনার চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানোর পর ওর চুলগুলো মুখটাকে ঘিরে ছিল সোনার কোঁকড়ানো ঢেউ ছড়িয়ে।

‘তোমার মতন একটি মেয়ের জন্য আমি কতকাল ধরে যে অপেক্ষা করছি!’ বলল বুড়িটা। আরও বলল, ‘দেখবে, আমরা দুজন এক সাথে কত মজা করব।’
চুল আঁচড়ানোর পর কেই-এর সব কথা ভুলে গেল গেরডা। কেন ভুলবে না? বুড়ি যে জাদু জানে! না না, তাই বলে ভেবো না, এ বুড়ি দুষ্টু ডাইনিদের কেউ। বুড়ি কেবল খানিক মজা করার জন্য মানুষের উপর জাদুমন্ত্র ছুঁড়ে দেয়। আর গেড়ডার বেলায় যা ঘটল তা হচ্ছে, বুড়িটা সত্যি সত্যিই গেরডাকে নিজের কাছে রেখে দিতে চাইছিল।

বাগানে গিয়ে সবগুলো গোলাপ ঝাড়ের উপর বুড়িটা তার বাঁকানো মাথার লাঠি বোলালো। আর তাতেই দারুণ সুন্দর সব গোলাপ নিয়ে গাছগুলো কাল মাটির তলায় ডুবে যেতে লাগলো। দেখে মনে হ’ল, কোনদিন কখনোই এখানে কোন গোলাপ গাছ ছিল না। কেন এমন করল বুড়িটা? আসলে গোলাপ দেখে গেরডা যদি কেই-এর কথা মনে করে কখনো, এই ভয় ছিল তার মনে। গেরডা যদি ফিরে যেতে চায়, এই ভয়ে সে গোলাপ গাছগুলোর এই অবস্থা করল।

যখন কোথাও কোন গোলাপ গাছ থাকলো না, তখন বুড়ি গেরডাকে নিয়ে বাগানে বের হ’ল। গেরডা মনের আনন্দে লাফাতে লাগলো। লম্বা চেরি গাছগুলোর আড়ালে সূর্য লুকিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত ও খেলল। এরপর গোলাপ রঙের সাথে বেগুনি মেশানো পশমি চাদরের বিছানায় শুয়ে পড়ল।

পরদিনও গেরডা বাগানের ফুলদের সাথে খেলল। এরপরের বহু বহু দিন এভাবেই কেটে গেল ওর। গেরডা প্রতিটি ফুলকে চেনে, যত বেশিও ওরা হোক না কেন। তারপরও ওর কেবলই মনে হ’ত, কেউ যেন নেই এর মাঝে। কেউ যেন হারিয়ে গেছে। কে হারিয়ে গেছে, কে নেই, তা আর মনে পড়ে না ওর।

এক দিন মনে পড়ল ওর। যেই দিন ও বুড়ির মাথার টুপিটার দিকে তাকাল। টুপিতে ফুলের ছবি আঁকা। গোলাপ ফুলের। বেভুলা বুড়ি টুপির গোলাপের কথা মনে করেনি। আর তাতেই ঘটে গেল যা ঘটার। গেরডা চেঁচিয়ে উঠল। ‘কী! কোন গোলাপ নেই এখানে?’

গোলার খুঁজতে গেরডা ফুলের বাগানে ছুটল কেবল। সব ফুলের গাছের কাছে গেল। নাহ্, কোন গোলাপ মিলল না। যেখানে যেখানে গোলাপ ছিল, তার সবখানে বেচারির চোখের গরম পানি গড়িয়ে পড়ল। ভিজে উঠল মাটি। তখন যেখানে যেখানে গোলাপ ছিল, সেখানে সেখানে আবারো মাটি ফুঁড়ে মাথা তুলল গোলাপের গাছ। পুরোপুরি ফুটে ওঠা গোলাপসহ। গেরডা গোলাপগুলোকে চুমু খায়, জড়িয়ে ধরে বুকে। তখন তার মনে পড়ে, ওর বাড়িতে কী সুন্দর গোলাপই না ফুটত! তখন ওর মনে পড়ে যায় কেই-এর কথা।

‘আমি কীভাবে এত দেরি করে ফেললাম!’ ভাবল খুদে মেয়েটা। ভাবল, ‘আমাকে কেই-এর খোঁজে যেতে হবে!’ গেরডা গোলাপগুলোর কাছে জানতে চায়, ‘তোমরা কি জান, কেউ কোথায় আছে? তোমরা কি মনে কর, কেই মরে গেছে আর চলে গেছে?’

গোলাপগুলো কথা বলে উঠল। বলল, ‘ছেলেটা মরেনি। আমরা তো মাটির গভীরে ছিলাম, মাটির গভীরে যে মৃত মানুষরা থাকে তা তো তুমি জানোই। কই, সেখানে তো কেই ছিল না!’

‘ওহ্! ধন্যবাদ তোমাদের।’ খুদে গেরডা বলে গোলাপদের। তারপর যায় অন্য ফুলদের কাছে। বলে, ‘তোমরা কি জান, কেই কোথায়?’

সূর্যের নিচে দাঁড়ানো প্রতিটি ফুল কত কথাই না বলে। নিজেদের স্বপ্নের কথাও বলে। গেরডা কত কথাই না শুনল। তবে এসবের কোন কিছুই কেই-কে নিয়ে ছিল না। গেরডা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘ওহ্! আমার বেচারি দাদীমা! কত দিন আমাকে দেখতে না পেয়ে কত দুঃখই না তিনি পাচ্ছেন। কেইকেও নিয়েও একই দুঃখ তার। কিন্তু আমি খুব তাড়াতাড়িই ফিরে যাব, কেইকে সাথে নিয়ে যাব। ফুলদেরকে কেই-এর খবর জিগ্যেস করা উচিত হয়নি। এরা কেবল নিজেদের গল্প জানে। আমাকে দেওয়ার মতো কোন খবর ওদের কাছে নেই।’

খুদে ফ্রকটাকে উঁচিয়ে ধরে গেরডা ছুট দিল। বাগানের শেষ সীমায় যেতে হবে। বাগানের দরজায় চাপ দিতেই খুলে গেল ওটা আর খুদে গেরডা খোলা পৃথিবীর মাঝে এসে পড়ল। তিন বার পেছনে ফিরে তাকাল ও। না, কেউ ওর পিছু নেয়নি। এক সময় যখন ও আর ছুটতে পারছিল না, তখন বসে পড়ল বড়সড় এক পাথরের উপর। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, গ্রীষ্মকাল চলে গেছে কবে! হেমন্ত এখন। সুন্দর বাগানের ভেতর কেবলই সূর্যের ঝকমকও আলো আর সব ঋতুতে ফোটে ফুলগুলো, গ্রীষ্মকাল কবে চলে গেছে তা ও একদম টের পায়নি।

‘ওহ্! কত সময় যে আমি নষ্ট করেছি!’ ভাবল গেরডা। ‘এখন হেমন্ত। আমার আর বিশ্রাম নেওয়া ঠিক হবে না।’ উঠে দাঁড়াল গেরডা। চলতে শুরু করল।
আহা, গেরডার খুদে পা কত না ক্লান্ত, কালশিটে পড়ে গেছে! চারদিকে কত না ঠাণ্ডা আর বিষণœ। লম্বা উইলো পাতাগুলো প্রায় হলুদ। গাছ থেকে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে ম্যাড়মেড়ে কুয়াশা, ঝরে পড়ে পাতারা একের পর এক। কেবল ছোট ছোট নীলচে কালো রঙের বুনো কুল-কাঁটায় ফল ধরেছে। যদিও সে ফল এতটাই তেতো, দাঁত ধরে যায়।

আহা, বাইরের দুনিয়া কত না দুঃখী দেখতে!

রাজপুত্র আর রাজকন্যা
দুনিয়ার সব খবরের কাগজ তার পড়া, আর ভুলেও যায় আবার। কত না চালাক সে!

আবারো দম নিতে হ’ল গেরডার। বরফের উপর ডানা ঝাঁপটাতে থাকা বিশাল এক কাক ঠিক তার সামনেই বসা। কত না সময় ধরে কাকটা গেরডার দিকে তাকিয়ে ছিল, মাথা দোলাচ্ছিল। অবশেষে এটা বলল, ‘কা কা, শুভ দিন, শুভ দিন।’

যতটা ভাল ভাবে বলা যায়, ততটা ভাল ভাবেই কাকটা যা বলল, তার অর্থ হচ্ছে খুদে মেয়েটার প্রতি সে সদয়, জানতে চেয়েছে খুদে মেয়েটা এই একলা একা দুনিয়ায় যাচ্ছেটা কোথায়।

গেরডা ‘একা’ শব্দটি বুঝল। তখন কাকটাকে খুলে বলল সব। জানতে চাইল কেই কে কোথাও দেখেছে কি না।

কাক তার মাথা খুব ঝাঁকিয়ে বলল,‘ মনে হচ্ছে দেখেছি, মনে হচ্ছে।’

‘সত্যিই দেখেছ?’ কেঁদে ফেলল খুদে মেয়েটা। কাকটাকে জড়িয়ে ধরে কত যে চুমু খেল!

‘আস্তে, আস্তে!’ কাক বলে, ‘আমার বিশ্বাস ওটা কেই-ই ছিল। কিন্তু সে তো তোমাকে ভুলে গেছে, ভুলে গেছে রাজকন্যার জন্য।’

গেরডা জানেত চায়, ‘কেই কি রাজকন্যার সাথে আছে?’

‘হুম।’ কাক বলে, ‘শোনো মেয়ে, যদিও তোমার ভাষায় কথা বলা খুব কঠিন। যদি তুমি কাকদের ভাষা বুঝতে, আমি তোমাকে আরও ভাল ভাবে বোঝাতে পারতাম।’

‘না। আমি তো সে কখনো শিখিনি।’ গেরডা বলে, ‘দাদীমা কিন্তু জানে এ ভাষা। কথাও বলে। আহা, আমি যদি শিখতাম!’

‘ব্যাপার না।’ কাক অভয় দেয়। বলে, ‘যত ভাল ভাবে পারি আমি তোমাকে বলছি। যদিও কতটা ভাল যে হবে!’

এরপর কাকটা বলল, যা কিছু সে শুনেছে।

‘যেখানে এখন তুমি আছ, এ এক রাজ্য। এখানে বাস করে এক রাজকন্যা, যে কিনা খুব চালাক। দুনিয়ার সব খবরের কাগজ তার পড়া, আর ভুলেও যায় আবার। কত না চালাক সে! রাজকন্যার এক কথা, তার প্রশ্নের জবাব যদি কেউ দিতে পারে তো তাকেই সে করবে বিয়ে।’

কাকটা নাকি এসব শুনেছে তার এক বন্ধুর কাছে, যে কিনা প্রাসাদে যায়, যখনি তার মন যেতে চায় সেখানে। আরও শুনেছে, অনেক অনেক মানুষ দল বেঁধে রওনা হয়েছে রাজকন্যার প্রাসাদের দিকে। সারা পথ বহু বকবক করলেও প্রাসাদের ফটক পার হতেই আর রূপালি পোশাক পরা পাহারাদারদের দেখলেই আর সিঁড়ি বেয়ে সোনালি পর্দা দিয়ে ঘেরা ঘরে ঢুকতেই তাদের সাহস হারিয়ে যেত। সিংহাসনে বসা রাজকন্যার সামনে কোন কথা খুঁজে পেত না, মানুষগুলো কেবলই রাজকন্যার বলা প্রশ্নের শেষ শব্দগুলো আওড়াত। আর তাতে তো আর রাজকন্যার চাওয়া উত্তর হয়ে যেত না।

কাকটা বলে, ‘মনে হয়, মানুষগুলো ঘুমের গুঁড়ো নিয়ে নিত। আর হয়ে যেত জবুথবু। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পথে না আসা পর্যন্ত এই জবুথবু ভাব কাটত না। আর যখন কেটে যেত, তখন যেন মুখে খই ফুটত।’

কাকটা নাকি সেই আজব কাণ্ড দেখতে নিজেও গিয়েছিল। তৃতীয় দিনে নাকি ও দেখেছিল খুদে এক ছেলেকে। একা একা হেঁটে আসছিল। ওর না ছিল ঘোড়া, না ছিল ঘোড়ার গাড়ি। মনের খুশিতে গাইছিল গান। ছেলেটার চোখ নাকি গেরডার চোখের মতোই জ্বলজ্বল করছিল। তার চুল ছিল লম্বা সুন্দর। কিন্তু পরনের কাপড় ছিল খুবই মলিন।

হাততালি দিয়ে ওঠে গেরডা। বলে, ‘ওহ্! ঐ তো কেই! তাহলে আমি তাকে খুঁজে পেয়েছি।’

‘ছেলেটার পিঠে খুদে এক ব্যাগ ছিল।’ বলল কাক।

‘ওটা নিশ্চয়ই ওর স্লেজ। ওর সাথে ছিল আর তারপরই তো ও হারিয়ে গেল!’ জবাব দিল গেরডা।

‘হতে পারে।’ বলল কাক। আরও বলল, ‘আমি খুব ভাল করে দেখিনি। তবে আমার বন্ধু জানিয়েছে, ছেলেটা নাকি প্রাসাদের ফটক দিয়ে ঢুকে রূপালি পোশাক পরা পাহারাদারদের দেখে আর সিঁড়ি বেয়ে সোনালি পর্দা দিয়ে ঘেরা ঘরে ঢুকলেও অবাক হয়নি। কেবল মাথা নাড়িয়ে বলেছে, ‘আমি ভেতরে যাচ্ছি।’ আলোয় ভরা ঘরটাতে ঢুকতেই ওর পায়ের জুতো পর্যন্ত ভয়ের চোটে ফেটে গেল, তবুও না এক ফোঁটা এলোমেলো হ’ল না সে। সোজা চলে গেল রাজকন্যার কাছে, যে কিনা ঘুরন্ত চাকার সমান বিশাল এক মুক্তার উপর বসে ছিল। দেখতে সুন্দর আর ভদ্র ছেলেটা রাজকন্যাকে রাগিয়ে দেয়নি। বরং তার বুদ্ধির তারিফ করেছে। ছেলেটা রাজকন্যার ততটুকু প্রশংসাই করেছিল, যতটুকু প্রশংসা রাজকন্যাও করেছিল তাকে।’

‘তবে তো ও কেই-ই হবে।’ গেরডা বলে, ‘কেই যে কতটা বুদ্ধিমান ছিল! মানসিক পাটিগণিত থেকে ভগ্নাংশ পর্যন্ত করতে পারত। ওহ্! কখন তুমি আমাকে নিয়ে যাবে প্রাসাদে?’

‘তাহলে এখানেই অপেক্ষা করো।’ এটুকু বলে কাকটা উড়ে চলে গেল।

কাকটা ফিরে আসার আগেই সন্ধ্যা ঘন হয়েছিল। এসে বলল, ‘কা কা! আমার বন্ধু প্রাসাদের পেছন দিকের সিঁড়িটা চেনে, যেখান দিয়ে উঠে শোবার ঘরে যাওয়া যায়। আর জানে, কেই-কে কোথায় রাখা হয়েছে।’

বাগানের পেছন দিকে অতএব এসেছিল ওরা। পাতারা ঝরে পড়ছিল টুপটাপ। এক এক করে। প্রাসাদের আলোগুলো নিভে গেল। এক এক করে। তখন কাকটা গেরডাকে নিয়ে এলো পেছনের দরজায়, যার খিড়কি খোলা ছিল একটু। খুঁজতে খুঁজতে ওরা এসে পড়ে এক ঘরে। দুটো বিছানা পাতা সেখানে। সাদা বিছানায় ঘুমাচ্ছে রাজকন্যা। আর লাল বিছানায় ঘুমাচ্ছে যে, পুরোটা দেখতে পাচ্ছে না, তবে চাদরের ফাঁক দিয়ে দেখা গেছে ঘাড়ের কিছুটা, তা একদম দেখতে কেই-এর মতো! আহা কেই! তাকে খুঁজতেই না এসেছে খুদে গেরডা!

না। ছেলেটা ছিল এক রাজপুত্র। তবে কেই নয়।

জেগে গেছে রাজকন্যা। জেগে গেছে রাজপুত্র। তখন সব কথা খুলে বলতে হয় গেরডার। সাথে থাকা কাকটার কথাও বলে। রাজকন্যা সদয় কাকটার উপর খুশি হয়। রাজসভার কাক পদে চাকরি দিয়ে দেয় কাকটাকে। গেরডাকেও থাকতে বলেছিল। কিন্তু কেই-এর খোঁজে যেতে হবে গেরডাকে। আর তাই ওকে দেওয়া হয় ঘোড়া আর খুদে এক ঘোড়ার গাড়ি। গেরডার পায়ে পরার জন্য নতুন বুটজুতোও দেয় রাজকন্যা। সব নিয়ে গেরডা রওনা হয় আবার।

খুদে ডাকাত মেয়ে
‘সোনা! সোনা!’ চেঁচিয়ে বলে ওরা।

গেরডার ঘোড়ার গাড়ি ডাকাতের কবলে পড়ে।

‘সোনা! সোনা!’ চেঁচিয়ে বলে ওরা। ঘোড়াগুলো দখলে নেয়। গেরডাকেও নামিয়ে আনে গাড়ি থেকে। দলে থাকা এক বুড়ি ডাকাত গেরডাকে দেখে বলে, ‘এটা মোটা, কিন্তু দেখতে ভালই। মনে হয় এর স্বাদ ভালই হবে!

বুড়ি ডাকাতের হাতে ধরা চুরি চকচক করে ওঠে। গেরডাকে মারবে বুঝি! তখন কিনা বুড়িটার ছোট মেয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘মেয়েটা আমার সাথে খেলবে! ওর সুন্দর জামা আমি নেব। আমার বিছানায় ঘুমাবে ও। হু!!’

বুড়িটার ছোট মেয়ে গেরডার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও দেখতে গেরডারই সমান। তবে ওর গায়ে জোর গেরডার চেয়েও বেশি। গেরডার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমাকে যতক্ষণ রাগাবে না, ততক্ষণ ওরা তোমাকে মারবে না। তুমি তবে রাজকন্যা হবে।’

গেরডা সেসব হতে চায় না। ও ছোট মেয়েটাকে খুলে বলে সব। ও কেই নামের খুদে বন্ধুকে খুঁজতে এসেছে, বলে মেয়েটাকে। ও যখন বলছিল, ডাকাত দলের পোষা দুই সাদা কবুতরও শুনছিল সব। খাঁচায় থাকা এক কবুতর বলে, ‘কু কু! আমরা দেখেছি খুদে কেই-কে। সাদা এক মুরগি ওর স্লেজকে আটকে ফেলেছিল। তারপর ওকে দেখেছি বরফ রানীর স্লেজে বসে থাকতে। গাছের নিচ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল ওরা। তখন আমরা ছিলাম আমাদের বাসায়। তখনি ওদেরকে দেখেছি। বরফ রানীর গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের বাসাগুলো। আমরা এই দুইজন ছাড়া মারা পড়েছিল আর সবাই। কু কু!

গেরডা জানতে চায়, বরফ রানী কোথায় চলে গেছে তা যদি ওরা জানে। কবুতরটি বলে, ‘বরফ রানী কেবল বরফের দেশ ল্যাপল্যান্ডেই যেতে চায়। কেননা সেখানে সব সময়ই কেবল বরফ আর তুষার।’ বলগা হরিণ নাকি আরও ভাল জানে। ডাকাত দল বন্দী করেছিল এক বলগা হরিণকে।

‘বরফ আর তুষার আছে বটে, তবে সে এক দারুণ দেশ।’ বলগা হরিণ গেরডাকে জানায়, ঐ দেশে নাকি বরফ রানীর গরম কালের তাঁবু টানানো। বরফ রানীর প্রাসাদ আছে উত্তর মেরুতে। সে মেরু নাকি স্পিৎজবারগেন নামের এক দ্বীপে আছে। খুদে ডাকাত মেয়েটা জানতে চায়, বলগা হরিণ জানে নাকি কোথায় সেই ল্যাপল্যান্ড?

‘জানি বৈকি! আমার চেয়ে ভালো আর জানে কে!’ বলে হরিণটা। ওর চোখ নাচছে। বলে, ‘আমার জন্মু ওখানে। বড় হয়েছিও ওখানেই। বরফের মাঠগুলোতে লাফিয়ে বেড়াতাম হরদম।’

গেরডা যেতে চায় সেখানে। চাইলেই তো হ’ল না। ডাকাতের দল ওকে ছাড়লে তো?

খুদে ডাকাত মেয়েটা বুদ্ধি শেখায়। ডাকাতি করতে বেরিয়ে যাবে দলটা। কেবল ওর মা ডাকাতটা রয়ে যাবে। দুপুরে খেয়েদেয়ে যখন সে একটু ঘুমোবে, তখন খুদে মেয়েটা কিছু একটা করবেই।

করলও তাই। ছুরি দিয়ে বলগা হরিণকে মুক্ত করে বলে, ‘ল্যাপল্যান্ডের পথ দেখাও হে! দেখাও কোথায় থাকে সে বরফ রানী। দেখাও কোথায় আছে সে গেরডার খেলার সাথি কেই।’

মুক্তি পেয়ে আনন্দে নেচে ওঠে হরিণটা। ওর পিঠের উপর উঠিয়ে নেয় গেরডাকে। খুদে ডাকাত মেয়েটা কিছু খাবারও দিয়ে দেয় সাথে। তারপর বলগা হরিণকে বলে, ‘ছুটে যাও বন্ধু! আমার খুদে বন্ধুর যত্ন নিও।’

গেরডা খুদে ডাকাত মেয়েটাকে বিদায় জানায়। বলগা হরিণ আকাশের দিকে তাকায়। উত্তরের আকাশের তারাকে দেখে পথ ঠিক করে নেয়। তারপর ছুটতে শুরু করে। এ্যাতো জোরে, এ্যাত্তো জোরে ছোটে হরিণটা যে, চোখের পলকে চলে এলো ওরা ল্যাপল্যান্ডে।

ল্যাপ নারী আর ফিন নারী
বলগা হরিণ থামেনি কোথাও। লাল বেরির ঝাড়ের কাছ পর্যন্ত ছুটেছে ও। এরপর গেরডাকে নিচে নামিয়ে দেয়। আদর করে ওকে। যদিও ওর ঘন কালো চোখে টলটল করছিল পানি।

খুদে এক কুঁড়েঘরের সামনে থামে ওরা। দেখেই বোঝা যায় গরিব বাড়ি। ছাদ নেমে এসেছে মাটিতে। দরজাগুলো এ্যাতো নিচে যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে বা বেরুতে হয়। এক বয়সী ল্যাপ নারী কুপি নিয়ে এগিয়ে এলে হরিণ তাকে গেরডার গল্পটা বলে। গেরডা তো ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে কথা বলার জোরই পাচ্ছিল না।
‘আহা রে বেচারি!’ ল্যাপ নারী বলে গেরডাকে, এখন নাকি ওকে যেতে হবে আরও শতেক মাইল দূরে ফিনমার্কে। বরফ রানী নাকি বেড়াতে গেছে ওখানে। প্রতি রাতে বরফ রানী নীল আলো জ্বালিয়ে দেয়। ল্যাপ নারী বলে, ‘আমার কাছে তো কাগজ নেই। শুটকি মাছের গায়ে লিখে দিচ্ছি যা লেখার। ফিন নারীকে দেখালে সে তোমাকে পথ বাতলে দেবে।’

গেরডা খেয়ে দেয়ে একটু তাজা হ’ল, আর সেই ফাঁকে ল্যাপ নারী তার চিঠি লিখে শেষ করল। এরপর আকাশে জ্বলে ওঠা নীল আলোর দিকে যাত্রা শুরু করল ওরা। শেষ মেষ এসে গেল ফিনমার্কে। ফিন নারীর বাড়ির কোন দরজা নেই। তাই তার চিমনিতেই টোকা দিল ওরা। শব্দ হ’ল, ঠক্ ঠক্!

ছোটখাটো ফিন নারী চিমনির ভেতর থেকে গরমে হুশ্ হাশ্ করতে করতে বেরিয়ে এলো। তিন বার পড়ল শুটকি মাছের চিঠিটা। তারপর মাছটাকে খেতে শুরু করল। চিঠির কাজ হয়ে গেলে ওটাকে না খাওয়ার তো কোন কারণ নেই। তাই না?

বলগা হরিণ গেরডার গল্পটা বলল তখন। ফিন নারী কিছুই বলল না। কেবল চোখ পিটপিট করছিল। বলগা হরিণ বলল তাকে, ‘জগতের সব বাতাসকে বেঁধে ফেলতে পার তুমি এক টুকরো সুতো দিয়ে, এ আমি জানি। খুদে মেয়েটাকে একটু শরবত দাও না, তাতে ও বার জন মানুষের সমান জোর পাক আর বরফ রানীকে হারিয়ে দিক।’

ফিন নারী তখন আলমারির তাক থেকে বড় এক মোড়ানো চামড়া বের করে সে। মেলে ধরে চামড়াটা। কি কি সব লেখা আছে ওতে। ফিন নারী পড়ে বিড়বিড় করে। তারপর বলে কেই-এর অন্তরে গেঁথে থাকা আয়নার সেই টুকরোর কথা, বলে কেই-এর চোখে আটকে যাওয়া আয়নার টুকরোর কথাও। ওগুলো সরিয়ে ফেলা হলে কেই আবার মানুষ হবে। না হলে বরফ রানী চির দিন আটকে রাখবে কেই-কে। আর কেই ততদিন কিছু না বুঝেই নকল সুখে ভাসবে। ওর কিছুই মনে পড়বে না। কাউকেই না।

গেরডাকে একাই লড়তে হবে বরফ রানীর সাথে। কোন শক্তিতে লড়বে গেরডা? গেরডার শক্তি নাকি ওর হৃদয়টাই। বরফ রানীর কাছে পৌঁছুতে পারলে ফিন নারী ওকে সাহায্য করতে পারবে, তার আগে নয়। গেরডাকে খালি পায়ে রওনা হতে হয়। বলগা হরিণ পিঠে তুলে নেয় ওকে।

বলগা হরিণ থামেনি কোথাও। লাল বেরির ঝাড়ের কাছ পর্যন্ত ছুটেছে ও। এরপর গেরডাকে নিচে নামিয়ে দেয়। আদর করে ওকে। যদিও ওর ঘন কালো চোখে টলটল করছিল পানি।

গেরডা যত জোরে পারছিল ছুটছিল। বরফের বড় বড় চাকা আকাশ থেকে ঝরে পড়ছিল। এগুলো বরফ রানীরই সৈনিক। গেরডার চোখ ঝাপসা করে ফেলছিল বলে দেখতে কষ্ট হতে থাকে। প্রার্থনা শুরু করে গেরডা। প্রার্থনার কথাগুলো ধেয়ার মেঘ হয়ে ওর চারপাশে ঘিরে আসে। যেন এরা উজ্জ্বল খুদে দেবদূত। দেখতে দেখতে কেবলই বড় হতে থাকে। এদের মাথায় শিরস্ত্রাণ, হাতে ঢাল আর বর্শা। বরফগুলোকে বর্শা দিয়ে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিচ্ছিল এরা। সব বরফ তাড়িয়ে দিয়ে এরা গেরডার হাত আর পা স্পর্শ করে। সব শীত যেন সরে যায় তখন।

গেরডা রওনা হয় বরফ রানীর প্রাসাদে।

কী ঘটল বরফ রানীর প্রাসাদে এবং এর পর?
বরফ রানী একবারে মধ্যখানে বসে, যখন সে ঘরেই বসে।

তাল তাল বরফ দিয়ে প্রাসাদের দেয়াল বানানো। জানালা-দরজা বাতাসের। শত শত ঘর এই প্রাসাদে, সবচেয়ে বড়টা কয়েক মাইল লম্বা। অদ্ভুতুড়ে উত্তুরে নীল আলো জ্বলে সব ঘরে। খুব ফাঁকা সেসব ঘর। কেবলই বরুফে চকমকানি সেখানে। কখনো কোন আনন্দ আয়োজন ঘটেনি। মেরু ভালুকরাও খেলে না সেখানে।

এক বরুফে হ্রদ আছে, যার মাঝখানে বরুফে ঘর, যার শুরু নেই, শেষও নেই। হ্রদের বরফ তল হাজার টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেছে। প্রতিটি টুকরো এতটাই হুবহু এক রকমের যে পুরোটাকে দেখে মনে হয় শিল্পীর আঁকা জটিল কোন চিত্র বুঝি। বরফ রানী একেবারে মধ্যখানে বসে, যখন সে ঘরেই বসে। মধ্যখানে নাকি আছে এক ‘কারণের আয়না’। এটিই নাকি সবচেয়ে সেরা। এটিই নাকি একটাই আছে দুনিয়ায়।

খুদে কেই ঠাণ্ডায় নীল হয়ে গেছে। না না, কালই বলা চলে। তবে এসবের কিছুই ও টের পাচ্ছে না। আপন মনে বরফের টুকরো কুড়িয়ে বেড়ায়। সেগুলোকে মেলানোর খেলা খেলে। নাম দিয়েছে এ খেলার। চীনা ধাঁধা নাকি এ।

কেই-এর বরফ টুকরোর নকশা দেখে কেই নিজেই মুগ্ধ হয়। ওর চোখে সেসব অসাধারণ ঠেকে। কেননা, ওর চোখে বিঁধে আছে যে কাঁচের টুকরো। আর তাই বরফের টুকরো সাজিয়ে কী যেন কী শব্দ বানাতে চায়, পারে না। তাতে কোন দুঃখও নেই তার। আসলে যে শব্দ ও বানাতে চাইছে, তা হচ্ছে ‘চিরকাল’। পারছে না। বরফ রানী বলেছে, নিজের শব্দটা যদি ও বানাতে পারে, তবে নাকি ও ওর নিজের মালিক বনে যাবে। বরফ রানী ওকে নাকি দিয়ে দেবে গোটা দুনিয়া আর এক নতুন জোড়া স্কেট। ও তো পারছে না।

বরফ রানী গরমের দেশে উড়ে যায়। ইটনা আর ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরিতে ফুঁ দেবে নাকি।

ফাঁকা খা খা বরফ ঘরে একলা একা বসে থাকে কেই। ভাবে আর ভাবে। কি যেন মনে পড়ে না ওর। কেইকে দেখে মনে হয়, এক টুকরো বরফের মূর্তি বুঝি ও। এভাবে বসে থাকলে হয়তো বা বরফের মূর্তিই হয়ে যাবে বেচারা। আর ঠিক তখন খুদে গেরডা প্রাসাদের ভেতর ঢোকে। আর ঠিক তখনি বরুফে বাতাস থেমে যায়, যেন ঘুমিয়ে পড়ে সব। গেরডা কেই-কে দেখে। ছুটে এসে বলে, ‘কেই! খুদে কেই! তোমাকে শেষমেশ খুঁজে পেলাম তবে!’

কেই মোটেও নড়ে না। শক্ত বরফ যেন ও।

তখন গেরডা দুঃখে কাঁদে। ওর চোখের গরম পানি পড়ে কেই-এর শরীরে। কেই-এর হৃদয়ে যায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে। আর ঠিক তখন কেই-এর হৃদয়ের বরফ টুকরো গলে যায়। গলে যায় সেই কাঁচের টুকরো। আর ঠিক তখন কেই তাকায় গেরডার দিকে। গেরডা গাইছিল গোলাপ ফুলের গান। যে গান কেই শুনেছিল ওদের সেই গোলাপের বাগানে। ওর মনে পড়ে যায় সব কথা। গেরডার কথা। দাদীমার কথা। বাগানের গোলাপগুলোর কথা। আনন্দে ডগমগ করে বলে, ‘গেরডা! খুদে গেরডা! কোথায় ছিলে তুমি এত দিন?’

কেই আর গেরডা হেসে ওঠে এক সাথে। আর সাথে সাথে চারপাশে বরফের টুকরোগুলো ওদেরকে ঘিরে নেচে ওঠে। হাসি শেষ হয়। বরফের টুকরোরাও থামে। শুয়ে পড়ে হ্রদের উপরে। আর তখন টুকরোগুলো যেন ঠিক ঠিক জায়গায় বসে যায়, হয়ে যায় সেই শব্দ যা কেই চাইছিল। হয়ে যায় নিখুঁত এক শিল্প। বরফ রানী যেমন বলেছিল, নিজের শব্দটা বানাতে পারলে কেই তার নিজের মালিক বনে যাবে। ঠিক তাই। কেই মুক্ত হয়ে গেল। পেয়ে গেল গোটা দুনিয়া। আর ওর পায়ে বসে গেল নতুন এক জোড়া স্কেট জুতা।

বলগা হরিণ ঠিকই অপেক্ষা ছিল ওদের। কেই আর গেরডাকে পিঠে নিয়ে হরিণ চলে এলো ফিন নারীর কাছে। চিমনি বাড়ির গরমে তাজা হ’ল বেশ। এরপর এলো ল্যাপ নারীর কাছে। তার বানানো নতুন জামা পরে নিল। ল্যাপ নারী স্লেজ গাড়িও ঠিক করে দিল। সেই গাড়িতে করে ওরা চলে এলো বরফ দেশের শেষ সীমানায়, যেখানে সবুজ পাতার কুঁড়ি চোখে পড়ল প্রথম। বলগা হরিণ আর ল্যাপ নারীকে বিদায় জানাতে হ’ল এখানে। তারপর ছুটল আবার।

আবার কানে এলো পাখির ডাক, কত দিন পরে! আবার কানে এলো ঘোড়ার পায়ের ধ্বণি। ঘোড়ার পিঠে বসা ছিল সোনালি জামা পরা সেই খুদে ডাকাত মেয়েটা।

গেরডা রাজপুত্র আর রাজকন্যারও খোঁজ করেছিল। পাওয়া গেল না তাদের। ভিনদেশে বেড়াতে গেছে নাকি।

আর সেই কাক বন্ধুটা?

বেচারার বয়স হয়েছিল। বেঁচে নেই আর।

দাদীমারও তো বয়েস হয়েছে অনেক। দাদীমা কেমন আছে? দাদীমাকে দেখবে বলে কেই আর গেরডা খুব জোরে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে চলে আসে নিজেদের বাড়িতে। ঘরে ঢুকে দেখে ওরেদ খুদে চেয়ারগুলো একই ভাবে রাখা। এর সামনে বসে আছেন দাদীমা। ওদের প্রিয় দাদীমা।

ওরা তখন কী করল?

এই কয় দিনে ওরা কিন্তু বেশ বড় হয়ে গেছে। আগের মতো অতটা খুদে শিশু নেই। কিন্তু দাদীমার কোলের কাছে ওরা আবার খুদে শিশু হয়ে এলো। ওদের হৃদয় আগের সেই খুদে শিশুর হৃদয়ই রয়ে গেল।

দাদীমা বলতেন, এখনো বলছেন, যে হৃদয় শিশুর নয়, সে হৃদয় স্বর্গে যাবে না।

কেই আর গেরডা খুদে কেই আর খুদে গেরডা হয়ে তাকায় দাদীমার দিকে। দাদীমার শরীরে খেলা করছে উজ্জ্বল সূর্যের আলো। যেখানে কোন কনকনে শীত নেই। কেবলই ঝকঝকে গ্রীষ্মকাল।

কেই আর গেরডাও অনুভব করে হৃদয়ের উষ্ণতা। ভালবাসে সুন্দর গ্রীষ্মকে। ভালবাসতেই থাকে।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ বরফ রানী স্নো কুইন