সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণে নজরুলের ভূমিকা
৩ আগস্ট ২০২০ ২০:১৮
শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির এই শীতল দেশে নজরুল নিয়ে এসেছে সাম্যের বানী। নজরুল ইসলাম সাম্যবাদী ছিলেন কিনা সে আলোচনা আজকের যুগে গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে আমরা বাস করছি বৈষম্যমূলক একটা অনাচার, অবিচারের সমাজে। যেখানে রয়েছে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্য। সাম্যবাদের সাথে অসাম্য, বৈষম্য অনাচার, অবিচারর সম্পর্কটা মিলনাত্মক নয়, বরং রয়েছে বিরোধাত্মক সম্পর্ক। নজরুলকে কেন সামনে আনা হয় না ?এই প্রশ্নটা গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, নজরুল সামনে আসলে রাষ্ট্র বৈষম্যের অসংখ্য নোংরা ছিদ্র জনসম্মুখে চলে আসার বিপজ্জনক সম্ভাবনা রয়েছে। সচেতন রাষ্ট্র তা কখনোই সচেতনভাবে চাইবে না। রাষ্ট্র যখন অত্যাচারের চাবুক হাতে নিয়েছে তখন সেই চাবুক কিভাবে কেড়ে নিতে হয় এবং শাসন-শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে কিভাবে কাজে লাগাতে হয় তা প্রতিভাবান নজরুল ভালোভাবে জানতেন এবং মানুষকে জানাতেন। কারণ নজরুলের একহাতে ছিল বিষের বাঁশি আরেক হাতে ছিল রণতূর্য। সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নজরুল শুধু পরিচিতই ছিলেন না, সমসাময়িক সমস্ত চিন্তাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সাম্যবাদী চিন্তার আলোকে।
রাজনৈতিক ময়দানে সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণে আশা আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন অনেকেই, কিন্তু কী উপায়ে, কোন পদ্ধতিতে কোন দর্শনে সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণ হবে? সেই পথ নিয়ে ছিলো হাজারো দার্শনিক মতবাদিক বিতর্ক। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন মাও সেতুংয়ের মত এবং পথ নিয়েও ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্ব। কিন্তু আর্থ-সামাজিক -রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং বিবর্তনে মানুষের ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তা করেছেন মার্কস-এঙ্গেলস, লেনিন স্ট্যালিন ও মাওসেতুং। তারা শুধু চিন্তাশীল মানুষই ছিলেন না, একই সঙ্গে ছিলেন চিন্তাশীল দার্শনিক ও কর্মী ।তাদের উদ্ভাবিত বস্তুবাদী বিকাশতত্বে (Materialist Dialectics) বিধৃত রয়েছে প্রকৃতি জগৎ ও মানব জগতের পরিবর্তনের রূপ-স্বরূপেরই বিবরণ। অথচ হাজারো বিভ্রান্তির ঘোলা জলে এই দৃষ্টিভঙ্গিটি ধরতে না পারার দরুন দেশি শাসকগোষ্ঠী এবং বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং অধঃপতিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি শক্তিশালী হয়েছে যুগের পর যুগ।
আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের অভ্যন্তরে স্থায়ী সম্পত্তির উপর একাধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে দাস এবং দাস মালিক বৈষম্যের সমাজের আবির্ভাব। দাস মালিক হয়েছে ভূস্বামী আর দাস হয়েছে ভূমিদাস।সামন্ততন্ত্রের অভ্যন্তরে উৎপাদিকা শক্তি যখন আর কোনোভাবেই আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে পারছিল না। তখন সামন্ত-প্রভু এবং ভূমিদাসের সম্পর্কের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্ন এবং দ্বন্দ্বকে সামনে রেখেই সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি ভেঙে পুঁজিবাদী অর্থনীতি বিকশিত হয়। সামন্তবাদের গর্ভে গড়ে উঠা আধ্যাত্মবাদ, ধর্মীয় চিন্তার সঙ্গে ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা, যুক্তি বিচার, পর্যবেক্ষণ, আলোচনা, সমালোচনার প্রশ্নে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই পথ বেয়ে তৈরি হয় বুর্জোয়া মানবতাবাদী চিন্তা। যার গোঁড়ায় ছিল যুক্তির কষ্টি পাথর। যা বিচার্য তাই মানুষ গ্রহণ করবে। যা যুক্তি তর্কের অতীত, যার প্রমাণ নেই, তা মানুষ বর্জন করবে।এরই নাম নবজাগরণ। নব জাগরণের মূল সুর ছিল; সমাজের প্রতিটি মানুষ রাজা-প্রজা, সামন্ত-প্রভু, পুরোহিত সকলেই সমান। সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, জন্মগত মানবিক অধিকার বর্তমান, ভবিষ্যৎ, ব্যক্তিগত জীবন যাত্রা নির্ধারণে সকলের সমান অধিকার আছে। যার ছোঁয়া লেগেছে ভারতবর্ষের মাটিতে।
নবজাগরণের নিগূঢ়ে পুঁজিবাদের ঊষালগ্নে উত্থাপিত সাম্য, মৈত্রী, ভাতৃত্ব বোধ, স্বাধীনতা, নারী স্বাধীনতা, এর গোঁড়ায় আসতে হলে,প্রথমে দেখতে হবে Concept of secularism অর্থাৎ পার্থিব চিন্তাধারা নজরুল কতটুকু তার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে তুলে ধরেছেন। কেননা সেক্যুলার বা পার্থিব কথাটির মানে হল Non recognition of any supernatural or spiritual entity. অর্থাৎ কোনরকম অতিপ্রাকৃত বা প্রকৃতিবর্হিভূত সত্তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।এই চিন্তাটি দাঁড়িয়ে আছে একটি বস্তুবাদী দার্শনিক ভিত্তির উপর। যা সমাজ বিবর্তন এবং আমূল পরিবর্তনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানোর ব্যাপার থাকে। কারণ সাম্যবাদী চিন্তার উপাদান অতিপ্রাকৃত নয়। বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং বৈষম্যমূলক সমাজ বিবর্তনের আদি এবং গোঁড়ার কথাই হচ্ছে সাম্যবাদ।
ব্যক্তি মানুষ সমাজ রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্র সার্বজনীন প্রয়োগ পদ্ধতি ও ব্যবহারের কলাকৌশলই বলে দেবে বিষয়বস্তু কোন দর্শন তত্ত্বের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে।তা কি ভাববাদ নাকি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ? হাজারো কথার ফুল হয়তো ফুটতে পারে তাতে মানুষের কী বা আসে যায়। কিন্তু শিল্পী সাহিত্যিক যে দার্শনিক চিন্তার ভিত্তিতে সমাজকে দেখছেন, বিশ্লেষণ করছেন, ব্যাখ্যা করছেন সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা সমাজের ক্ষতি করতে পারে, আবার করতে পারে উপকারও। দৃষ্টিভঙ্গির উপকরণ এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত লেখক শিল্প সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে। কারণ তারা সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ। প্রভাবশালী মানুষ এই কারণে যে সমাজের সকল মানুষের মোটা দাগের ক্ষতস্থানে তারা স্পর্শ করার ক্ষমতা রাখেন।
নজরুলের বিচিত্র জীবন, সৃষ্টিশীল জীবন এবং তার সাহিত্য জীবনকে তিনটি স্তরে ভাগ করলে দেখতে পাবো তার সৃষ্টিকাল, তার উত্থানকাল একদিকে পার্থিব ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চিন্তা দর্শনের ভিত্তিতে তার কাব্য সাহিত্য নির্মাণের কাজ করেছেন। নজরুলের লেখনীতে দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রচুর তথ্য, উপাত্ত, চিন্তা, প্রসঙ্গ এবং বিশ্লেষণ করে সংক্ষেপে অথচ আকর্ষণীয়, সহজ ও গতিশীল, বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, ভাষায় অসাধারণ পর্বত পরিমাণ শব্দের সম্ভারে কাব্য সাজাতেন। গতিশীল প্রতিবাদী ভাষা, শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতি, দ্রোহ, বিদ্রোহ, প্রেম, সুন্দর, সাম্য মৈত্রী, নারী মুক্তি, ভ্রাতৃত্ব, কোমলপ্রাণ শিশু নির্মলমন, ডানপিটে, দুঃখ-দুর্দশা, সুখ, আনন্দ, বেদনা, ভালোবাসা, সংবেদনশীলতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের সৈনিক, কবিতা গান, কবিতার নাট্যপ্রিয়তা, সুর, ছন্দ, অবলীলা, স্বাধীন স্ফূর্তি, অবাধ আবেগ, জনগণের প্রতি দরদ বোধ, বিস্ময়, ভয়হীন, ভক্তি, সাহস, অটল মনুষ্যত্ব, ভীষণ গম্ভীর কল্পনা, শব্দ বিন্যাস, ছন্দ-ঝঙ্কার, প্রকৃতি, সৃষ্টিশীল, ঐশ্বর্য মানসিক প্রতিভা, ঝকঝকে তকতকে শব্দের ব্যবহার, প্রাণের প্রাচুর্য, নতুন রঙ, আলোচ্ছটায় শক্তি রূপ সুন্দর অর্থাৎ কিটসের মত মন্ত্র নজরুল নিজেই বলে গেছেন আমারও মন্ত্র -Beauty is truth, truth is beauty. পাহাড়, পর্বত, ফুটন্ত ফুল আর কলকলে ঝর্ণার মতই প্রবহমান আবেগ দীপ্ত, শোকসন্তপ্ত অনুনয়ী নীরব বৃক্ষ, বিষণ্ণ আকাশ, ধীরা স্রোতস্বিনী, আলোকময় চন্দ্র, লাজ নম্র গ্রাম্যবালিকা যোদ্ধা ও প্রেমিক সাম্যের কবি, পুরাতনকে ভেঙে নতুনকে আহ্বান করা যুগের শৌর্য বীর্য অক্ষয় মনুষ্যত্ব বিরাট চরিত্র নজরুল। নজরুল নতুন চেতনার প্রতিনিধি।
ভারতবর্ষ একাধারে সামন্ততন্ত্র অপরদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই দুইয়ের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া মানবতাবাদীদের আন্দোলন গড়ে উঠেছিল নবজাগরণের পথ বেয়েই। বাংলার নবজাগরণ এবং মানবতাবাদের উন্মেষ ঘটেছে বিশ্ব ব্যবস্থার বাস্তবতার আলোকেই। যেখানে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ ক্ষয়িষ্ণু প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে সামন্ততান্ত্রিক আধ্যাত্মিক ভাব মানসের সঙ্গে আঁতাত করে দুনিয়ার দেশে দেশে একহাতে সামন্তীয় সংস্কৃতি, অন্য হাতে শোষণের জোয়ালকে শক্ত করে অপর দেশ দখল, শ্রমিক শোষণ, জাতীয় স্বাধীনতা হরণ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি জাতপাত, বর্ণবৈষম্য ইত্যাদির দিকে মুখ ফিরিয়ে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে চলছিল। ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ জীবনের প্রতি হতাশা, সন্দেহবাদ বৃদ্ধি এবং, নৈরাশ্যবাদকে প্রচারে নিয়ে আসে। তখন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জরাগ্রস্ত মানবতাবাদ জন্ম দিয়ে বিশ্বব্যাপী ধুকে ধুকে চলছে। ইতিমধ্যে পৃথিবী নামক গ্রহ তিনটি বড় বড় বিপ্লব সাধন করে নতুন একটি বিপ্লবের পথ পরিক্রমা করছে। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে নজরুলের সাহিত্য নির্মাণে শক্তি নিংড়ে নিয়েছে। নজরুল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন শ্রমিক কৃষক আন্দোলনে।
ভারতবর্ষে সাহিত্য উপাদানে দুইটি বিপরীত ধারা ক্রমবর্ধমান। পুরনো চিন্তা আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে আপোষকামী ব্যক্তি মালিকানাধীন শাসন শোষণ জাতীয় বুর্জোয়া মানবতাবাদ। আর ইউরোপে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলেশনের ধারাবাহিকতায় দর্শন জগতে ভাববাদী খাদ থেকে মুক্ত হয়ে বস্তুবাদী দর্শনের প্রবর্তন এবং রাশিয়ায় ঘটে যাওয়া আপোষহীন যৌবনোদীপ্ত সর্বহারা পার্থিব মানবতাবাদের প্রসার। সর্বহারা বিপ্লব এবং মতবাদ তখন দুনিয়ার দেশে দেশে বাস্তব চিত্র। এমন একটি যুগে নজরুলের আবির্ভাব।
ভারতবর্ষ তখন অধিকাংশ মানুষ কৃষক। প্রায় আধা সামন্ত অর্থনীতি ব্যবস্থায় গোটা ভারতবর্ষ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। আধা সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতি ছিল ভূমি ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। কৃষক খাজনা দিয়ে জমি ব্যবহার করতো। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে খাজনা আদায় হতো উঠতি মধ্যবিত্ত হিন্দু জমিদারদের দ্বারা।লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সরকার উচ্চতম খাজনা চালুর মাধ্যমে খাজনা আদায় ব্যবস্থা একটি সরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় কৃষক ছিল ভূস্বামীদের শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নায়েব গোমস্তা খাজনা আদায় করতে গিয়ে সীমাহীন অত্যাচার নিপীড়ন চালাতো। খাজনা আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পর তখন একদল দ্বিতীয় সারির জমিদার তৈরি হয়। যার নব্বই শতাংশই ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষিত জনগণ। কিন্তু ভারতবর্ষে অন্য জায়গায় বাঙালি সংখ্যালঘু হলেও পূর্ব বাংলা মুসলমান ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। যার বেশিরভাগ ছিল ভূমিদাস কৃষক, বর্গাচাষী। তারা ছিল হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে।
ব্রিটিশ শাসন শোষণের মাত্রা কৃষকের ঘাড়েই ছিল বেশি। ফলে গোটা ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে কৃষক বিদ্রোহ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ব্রিটিশ শাসকের প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বি। ফলে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে হিন্দুরা ছিল এগিয়ে। ভারতবর্ষে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নির্মাণের ক্ষেত্রে তাদের পদচারণা ছিল ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার। ফলে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি নির্মাণে কোথাও মুসলমানদের জীবনের সন্তোষজনক কোনো চিত্র পাওয়া যায় না। ইংরেজ শিক্ষার মাধ্যমে ভারতবর্ষে একঝাঁক নতুন মানুষ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যারা ব্রিটিশ শাসনের ছায়াতলে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় নিবিষ্ট ছিলেন। ব্রিটিশ শাসন শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ কেউ ছিলেন ক্ষণস্থায়ী প্রতিবাদী। তখন দেশি জমিদারেরা ছিল সহানুভূতিহীন নিষ্ঠুর।রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভেজা কঙ্কালসার কৃষককেই মাঝে মাঝে জোট বাঁধতে হয়েছে ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে, নায়েব গোমস্তাদের বিরুদ্ধে।
ব্রিটিশ শাসন শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেনি উঁচুতলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় নিবিষ্ট মানুষজন। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একদল মানুষ উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে কেউবা বিলেত থেকে ডিগ্রি নিয়ে এসেছে তা ঠিক, কিন্তু জনসাধারণের দুঃখ কষ্ট অনুভূতি ক্ষোভ-বিক্ষোভ ক্রোধকে সাহিত্যে চরিত্র দেওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি। দেওয়া সম্ভবও ছিল না। কারণ দেশের কৃষক খেতমজুর দিনমজুর শোষিত শ্রেণীর সঙ্গে তাদের শ্রেণীগত দূরত্ব ছিল বিস্তর। বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীর আর্থিক সংকট, ব্রিটিশের নিষ্পেষণের ফলশ্রুতিতে চরম দারিদ্র্য, অজ্ঞানতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, যুক্তিবোধহীন, অসহিষ্ণু, জনগণের ভিতরে প্রবেশ করার দুঃসাহস তেমন দেখা যায়নি। কারণ সেখানে ছিল জীবনের অনিশ্চয়তা। ইংরেজ শাসনে পূর্ব বাঙলা ছিল সবচয়ে পিছিয়ে। এক কথায় শ্মশান। মরা লাশ নদীতে ভেসে চলা ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। মহামারি কলেরা গুটিবসন্তে মানুষ ছিল জরাগ্রস্ত দিশাহীন।
নিপীড়িত জাতির বুকের ব্যথা আর মুখের ভাষা প্রথম সাহিত্যে বলিষ্ঠতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেন নজরুল ইসলাম। তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন উত্থিত হচ্ছে একটু একটু করে। বাঘা যতিন, ক্ষুদিরাম, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাস বোস, প্রীতিলতা, মাস্টারদা সূর্যসেন, ভগৎসিং, প্রফুল্ল চাকীদের আবির্ভাব। অগ্নি যুগের অগ্নি সন্তানদের সামনে নজরুল হয়ে উঠলেন সবার আপনজন। তাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিলেন নজরুল। জোর কদমে চললো ব্রিটিশ শাসন-শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের গর্ভেই উত্থিত হচ্ছে সর্বহারা মানবমুক্তির শ্লোগান। নজরুল কবিতায় কাব্যে সাহিত্য শ্রমিক শ্রেণীর লড়াই সংগ্রামের হাতিয়ার সাম্যবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরলেন। ভারতবর্ষে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী সামন্ততন্ত্রের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন ছিল দুর্বল, আপোষকামী এবং সংস্কারবাদী।
অন্যদিকে যারা আপোষহীন বিপ্লববাদী তারা সামন্ততন্ত্র এবং সাম্রজ্যবাদীদের শক্তির বিরুদ্ধে বেছে নিয়েছে সশস্ত্র বিদ্রোহ। তারা বেশিরভাগ ছিলেন আপোষহীন পার্থিব মানবতাবাদী যা অনেকটাই সাম্যবাদেরই সুর প্রতিফলিত করেছিলেন। তাদের মধ্যে নজরুল ছিলেন বাঙালিজাতির মুসলমানদের মধ্যে প্রথম যুগ সন্তান। যুগ সন্তান এই কারণে যে নজরুল ছিলেন সবার থেকে এগিয়ে। যদিও আপোষকামী ধারার প্রভাব ছিল প্রবল শক্তিশালী। বস্তুত সামন্ততান্ত্রিক ধর্ম, সংস্কারবাদী ও আধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে এতো আপোষহীন জেহাদ এবং ব্রিটিশরাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নবজাগরণের যুগে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে এতো বলিষ্ঠ আবেদন আর কোনো মনীষার মধ্যে দেখা যায়নি। নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন অতিবাহিত হয়েছে শাসন শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করতে করতে। আমরা নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবন বাদ দিয়ে মূল্যায়ন করলে এবং স্থান কাল পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে মূল্যায়ন করলে নজরুলকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতি পারি না। কাব্যধারায় নজরুল আপোষহীন পার্থিব মানবতাবাদী এবং তার ভিতরে ছিল সাম্যবাদী সুর। পার্থিব মানবতাবাদীরা সমাজ জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্থিব ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসলেও ভাববাদের প্রভাব থেকে তারা সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন না।বিশেষ করে ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়, আচার ব্যবহার অভ্যাস অভিজ্ঞতায় অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারলেও বহুজনেরই ক্ষেত্রে ভিন্নতা এই জায়গায় যে নজরুল তার কাব্য সৃষ্টির পথটি বেছে নিয়েছেন রাজনৈতিক সংগ্রামকে তীব্র করার পরিপ্রেক্ষিতে। ফলে ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধার প্রশ্নে, পার্থিব চিন্তা দিয়েই সাহিত্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে সমাজের মানুষের উপর শাসক শ্রেণীর অত্যাচার নিপীড়ন অবিচার কুসংস্কার জাতপাত অনুশাসন ভেদাভেদ এবং অন্ধতার বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াই করার সাহস যুগিয়েছেন, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
নজরুলের ব্যক্তিজীবন নানান চিত্রে চিত্রায়িত থাকলেও তার সৃষ্টিশীল সাহিত্য কব্য-কবিতা গান কোথাও অন্ধতার আশ্রয় নেননি। বরং দেখা যাবে নজরুল সমাজে দীর্ঘদিনের আড়ষ্ট অন্ধত্বের বিরুদ্ধে দুরন্ত সংগ্রামী প্রবল জোয়ার সৃষ্টি করেছেন। মানুষের প্রতি নজরুলের বাঁধভাঙা আবেগ, অটল দরদ বোধ, প্রাণমাতানো দুর্বার কবিতা, সংগ্রামী তেজোদৃপ্ত শব্দ কিশোর-তরুণদের আকৃষ্ট করতো। যুব আন্দোলনে বিপ্লবী চেতনা শানিত করতো। ফলে সমস্ত বাঙালি জাতির দুঃখ কষ্ট অনুভূতি ক্ষোভ-বিক্ষোভ এমন তির্যক শব্দ দিয়ে তুলে ধরেছেন ধূমকেতুর বিষের বাঁশির বংশী বাদক নজরুল উঠেছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে।সাধারণ জনগণের প্রাণভোমরা।
নজরুল ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন কাব্য। শব্দের ঝংকার শক্তিশালী করেছে দেশে অবহেলায় পড়ে থাকা শব্দকে। পুরনো শব্দকে ঝকঝকে তকতকে করে ব্যবহার করেছেন মানুষের মনের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে। প্রতিবাদী সুর তৈরিতে শব্দ বেছে নিয়েছেন ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, গুজরাটি ভাষাকে। বৃহত্তর জীবনের সন্ধানে সৈনিক হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমালেও দেশে ফিরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনর টগবগে জোয়ারে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নজরুল। শাসন শোষণ নিপীড়নে জাতপাত ধর্ম-বর্ণ বৈষম্যের অন্তর্ঘাত থেকে মুক্তির জন্য রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের পরিপূরক সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক আত্মিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার প্রয়াস নজরুল আত্মনিয়োগ করেছিলেন। যেকোনো আন্দোলন সংগ্রাম এবং সমাজ বৈপ্লবিক পরিবর্তনে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গড়ে তুলতে না পারলে যত বড় আন্দোলনই হোক মুখ থুবড়ে পড়ার হাজারো বিপজ্জনক সম্ভাবনা থাকে। নজরুল নির্মাণ করেছেন বিদ্রোহী চরিত্র। তৈরি করেছেন সাম্যবাদী চরিত্র। জেলে বসে লিখেছেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’। একফোঁটা কার্পণ্য করেননি জেলবন্দী, হাজতবন্দী স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের বিপ্লবীদের উদ্দীপ্ত করে তুলতে। ধর্মীয় অনুশাসনে জর্জরিত মানুষের আত্ম চিৎকার ব্যথা বেদনা যন্ত্রণা রূপ দিতে গিয়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর মুক্তির বানী, নারীর কান্না মূর্ত করে তুলেছেন প্রতিবাদী সুরে সমাজ মননে। পচা গলা নষ্ট সমাজ ভাঙ্গার আকুতি সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি যারা সমাজের অধিপতি তাদের বিরুদ্ধে তীব্র কষাঘাত করেছেন বিদ্রূপ করেছেন সাহিত্যিক ঢঙে।
স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে গিয়ে সমাজের নিচতলার মানুষের, কৃষক, দিনমজুর খেতমজুর, কুলি, চাষী, বর্গাচাষী শ্রমিকের উপর মালিকের অত্যাচার শোষণ নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে করতেই অদম্য নজরুল এগিয়ে গিয়েছেন সাম্যবাদের দিকে। শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুব আন্দোলনেই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না, এগিয়ে গিয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন কমরেড মুজফফরের দর্শনের দিকে। প্রাণের বন্ধু ছিলেন মুজফফর। মুজফফরের মতোই নজরুল বিশ্বাস করতেন সর্বহারার শ্রমিক কৃষকের রাজনীতিতে। তিনি “কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল” প্রথম অনুবাদ করে সুর দিয়েছেন। ভারতবর্ষের নিষ্পেষিত দিশেহারা জনগণকে মুক্তির দিশায় ছটফট করেছেন নজরুল। ভারত পাকিস্তান বিভক্তি দুই বাংলা বিভক্তি নজরুল সমর্থন করেননি। প্রতিবাদ করেছেন বিভক্তির বিরুদ্ধে। চেয়েছেন অবিভক্ত স্বাধীন ভারতবর্ষ। পরবর্তী সময়ে উঠতি ধনিক গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়াদের স্বার্থ হাসিলের দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর দিয়েছেন নজরুল। দেখাতে চেয়েছেন দ্বিজাতিতত্ত্ব শাসকগোষ্ঠীর দাবা খেলা ব্যতীত ভিন্ন কিছু নয়। ভারতবর্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বার্থ তাতে নেই। রয়েছে জাতীয় বুর্জোয়াদের শাসন শোষণকে পাকাপোক্ত করার কলাকৌশল। হিন্দু-মুসলমান মিলন নজরুল তার সাহিত্যে কাব্যে গানে নিজেকে সময়ের মানসিকতায় অনন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। তিনি বীরের মতো মানুষের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করার সাহস যুগিয়েছেন। এই দিক থেকে বিচার করলে নজরুলের শ্রেণী চেতনা ছিল শানিত। রাজনৈতিক ময়দানে আন্দোলন সংগ্রামে সভা সমাবেশে নজরুল সাহসী বক্তব্য রেখেছেন। প্রেম ভালোবাসা আবেগ অনুভূতি ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রতিবাদ দিয়ে শিল্পীর মতো এঁকেছেন শাসকগোষ্ঠীর অনিয়ম দুর্নীতি শাসনের বিরুদ্ধে মানবমুক্তির পথে। মানবমুক্তির পথে যারাই হেঁটেছেন তারাই সাম্যবাদী পথ বেছে নিয়েছেন। একটি সাম্যবাদী সার্বজনীন সেক্যুলার সমাজ নির্মাণে নজরুল ছিলেন বিভোর।
নজরুল সারা জীবন সর্বহারার মতোই জীবন কাটিয়েছেন। কোথাও এক টুকরো সম্পত্তি রেখে যাননি। সম্পত্তি রাখার সুযোগ ছিল না। ছোট সময়েই বাবা হারিয়ে ছন্নছাড়ার দলে নজরুল। ঘর নেই, সংসার নেই, বাবা নেই, মা নেই একাই যখন যা পেয়েছেন তা করেই জীবন অতিবাহিত করেছেন। তবে মনোযোগ ছিল মানুষের প্রতি, মনোযোগ ছিল সমাজে নানান রকম চিত্র-বিচিত্র জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি। প্রবল কৌতূহলী মন না থাকলে কীট-পতঙ্গ থেকে শুরু করে মহাকাশ পর্যন্ত ভাবতে পারতেন না। দৃষ্টি রেখেছেন দেশ-বিদেশের শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি। কাব্যে রসদ সংগ্রহ করেছেন দেশ-বিদেশের সাহসী চরিত্র থেকে। নানা ভাষা রপ্ত করেছেন। লিখেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। অনর্গল লিখে যেতে পারতেন। গল্প লিখেছেন অল্প তাতেই ব্রিটিশ খেপেছে। এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে জেলবন্দী করেছে। ১৯২২সালে ধূমকেতু বই নিষিদ্ধ করেছে। হুগলী জেলে বন্দীদের নিয়ে নজরুল গান লিখেছেন। সারা ভারতবর্ষে নজরুল মুক্তির দাবীতে ধর্মঘটের পর ধর্মঘট চলতে থাকে। জেলবন্দীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারজনিত কারণে নজরুল ৩৯দিন টানা অনশন করেন জলবন্দী অবস্থায়। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস নজরুলের মুক্তির দাবীতে জনসভায় বক্তব্য রাখেন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র কবির কাছে চিঠি লিখেন। নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ যখন প্রকাশিত হয় তখনও নজরুল জেলে। ১৯২৪ সালে প্রমীলাকে বিয়ে করার পর পরেই তিনি লিখেছেন ‘মৃত্যুক্ষুধা’। ১৯২৭ সালে প্রথম নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গঠন করে মুসলিম সাহিত্য সমাজ। বিখ্যাত রসায়ন বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে ১৯২৬ সালে কলকাতায় গণ-সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে বক্তব্য রাখেন নবজাগরণের অন্যতম আপোষহীন নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু।
নজরুলের কবিতার চেয়ে গান বেশি। সকল বিষয়ে বিচিত্র আঙ্গিকে গান লিখতে পারতেন এবং বিচিত্র সুরে গাইতে পারতেন। নজরুল গানে ভারতবর্ষে ছিলেন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তিনি গান রেকর্ডিংয়ে গ্রামোফোন কোম্পানিতে কবি, আবৃত্তিকার, গীতিকার এবং পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। শিশুদের নিয়ে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন নজরুল। কিশোরদের নিয়ে লিখেছেন ছোটগল্প। শিশুদের প্রিয় আপনজন ছিলেন নজরুল। ১৯২৮ এবং ১৯৩০ সালে পরপর দুটি আঘাত পান নজরুল। ১৯২৮ সালে মাকে এবং ৩০ সালে প্রিয় সন্তান বুলবুলকে হারান। তীব্র মানসিক অশান্তির মধ্যেও নজরুল ‘প্রলয়শিখা’ এবং ‘চন্দ্রবিন্দু’ দু’টি বই প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়ে যায় বই দু’টো। লেখকের সাজা হ ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড।
দারিদ্র্যের কষাঘাতে ক্ষতবিক্ষতের দাগ গায়ে আঁচ পড়তে দেননি নজরুল। সুঠাম দেহের বলিষ্ঠ পদচারণায় মানুষের মাঝে আশা আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছেন সারাজীবন নিজের দুঃখ কষ্ট ভুলে। আর্থিক দুর্যোগের মাঝে ১৯৪০ সালে তার প্রিয়তমা স্ত্রী প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৬৩ সালে মৃত্যুপূর্ব পর্যন্ত তাকে বিছানায় যন্ত্রণাকর জীবন কাটাতে হয়।
১৯৪১ সালে ২৫শে মে কবির ৪৩তম জন্মজয়ন্তীর পরের বছরই ২০ আগস্ট নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। রোগে আক্রান্ত হওয়ার এগারো বছর পর নজরুলের চিকিৎসার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়। লন্ডন ও ভিয়েনার চিকিৎসাদল পরীক্ষা করে দেখেন নজরুল আর আরোগ্য লাভ করবেন না। এইভাবে তার সমসাময়িক সবচেয়ে বাকপটু স্পষ্টবাদী নজরুল স্তম্ভিত হয়ে পড়েন।
বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচিত Introducing Nazrul Islam বইতে দারুণভাবে বলেছেন; ‘নজরুলের জীবন বাঙ্গালী প্রকৃতির মতো। তিনি তাঁর জীবন যাপন করেছিলেন পরিপূর্ণভাবে, সাহসিকতার সাথে, বৈশাখ মাসের মতো। কিন্তু তার চেয়ে ভাল একটি নাটকের মত। যেখানে আছে অনেক দৃশ্য, তাছাড়া আছে, যেমন থাকা দরকার হয় ভালো নাটকে, অনবরত কর্মের ঐক্য, সততার উদ্দেশ্যমূলকতার ঐক্য।’
লেখক: লেখক ও কলামিস্ট