গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে
৬ আগস্ট ২০২০ ১২:৫৯
সৈকত আরেফিন
যখন কেউ গায় না, তখনো সে গীত হয়। শ্রুত হয়।
অনেক দূরে কোথাও গিয়ে হয়তো বা থামে এই গান,
কিন্তু আমার মন থামে না। আমার প্রাণ থামে না।
মনে হয় একটি গান আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো
অন্য একটি গানের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে যায়।
– নির্মলেন্দু গুণ
বিপুল মেঘদল ও তুমুল বৃষ্টিসম্ভাবনা নিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশে বর্ষা আসে; কালিদাসকে, বিদ্যাপতিকে, রবীন্দ্রনাথকে চেতনার প্লুতপ্রদেশে সংগুপ্ত তীব্রতম অনুভূতি দিয়ে অনুভব করে আমরাও সেইসব বাদলমুখর দিনগুলোকে ভালোবেসে ফেলি। আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের চালে বৃষ্টিপতনের সুরের ঐকতান সাংগীতিক মূর্ছনা জাগিয়ে দেয়। তবে এই সুরদ্যোতনাই হয়তো সব নয়, বাংলাদেশে বর্ষার দিন কখনো কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিড়ম্বনার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আমাদের বর্ষাপ্রীতিকে উপহাস করে; তবু কালিদাসের যক্ষ যখন ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’ রামগিরির উপত্যকায় দাঁড়িয়ে মেঘের কাছে তার আকুতি নিবেদন করে প্রিয়াকে পৌঁছে দেবার জন্য, বস্তুত সেদিনই বর্ষার সঙ্গে আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের সম্প্রীতির ইতিহাস রচিত হয়ে যায়। এ যেন আমাদের অনিবার্য নিয়তি; মানবিক যাপনার সঙ্গে জৈব উপলব্ধির রসায়ন, প্রেম ও বিরহপ্রিয়তার যে চিরকালীন ঐতিহ্য আমরা সংগোপনে লালন করি তা বহুদিন আগের কোন এক ভাদ্রমাসে মিথিলার কবি বিদ্যাপতি টের পেয়ে যান; হয়তো সেদিন খুব বৃষ্টি হয়, বৃষ্টিতে ভেসে যায় চারদিক, ঘর থেকে বাইরে যাওয়া তাঁর স্ত্রী আটকা পড়ে মন্দিরে বা তখন যে গোপন প্রেমিকার আসবার কথা তার ঘরে, বৃষ্টি সে গোপন অভিসারিকার পথের বাধা হয়; কবি একা ঘরে বৃষ্টির গান শুনতে শুনতে বিরহবোধের শূন্যতার মধ্যে নিপতিত হন; তখন তাঁর নিজের সঙ্গে শ্রীরাধিকা বা শ্রীকৃষ্ণের কোন ভেদ থাকে না; তিনি লেখেন- ‘এ সখি হামাক দুখক নাহি ওর/ এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর।’ বৃষ্টিদিনের এই শূন্যতাবোধ এরপর থেকে আমাদেরকে বিরহকাতর ও রোমান্টিকতায় ধারাবাহিকভাবে নিমজ্জমান রাখে।
বিদ্যাপতির শূন্য ঘরের বা হৃদয়মন্দিরের শূন্যতাপোলব্ধির অনেক বছর পরে হারিয়ে যাওয়া বা দূরে থাকা বঁধুর জন্য অতুলপ্রসাদ সেন ব্যাকুলতার যে বেহাগ সংরচন করেন তার গানে- ‘বঁধু এমন বাদলে তুমি কোথা!’ এই অতলান্ত বেদনাবোধের হাহাকার সেই চিরায়ত বিরহপ্রিয়তারই ধারাবাহিকতা। বস্তুত বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত কবিতায় ও গানে বর্ষা এক বিশেষ মাত্রা নিয়ে উপস্থাপিত হয় এবং সেই মাত্রাকে উত্তুঙ্গে পৌছে দেন একমেবাদ্বিতীয়ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এ কথা আজকের আগে হয়তো অযুত নিযুতবার বলা হয় যে, সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথ তার সাফল্যের প্রমাণ রাখেননি; কী উপন্যাসে, কী ছোটগল্পে, কী কবিতায়, গানে, সুর সৃষ্টিতে, নাটকে, ছবি আঁকায়, সব শাখায় রবীন্দ্রনাথ শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছেন; আমরা রবীন্দ্রনাথের এমত কর্মকাণ্ডের জন্য ঋণ, মধুরতম বিরক্তি ও ঈর্ষা স্বীকার করি; মনে হয় এ ঋণ, বিরক্তি ও ঈর্ষা আমাদের বংশ পরম্পরায় বয়ে যেতে হবে। যদি শুধু গানের কথা বলি এবং শুধু বর্ষার গানের কথা তবুও আমরা একসময় বিহ্বল হয়ে পড়বো এই ভেবে, আমাদের মনের সবচেয়ে গোপন কথা এই লোকটি/মানুষটি কীভাবে বহু আগেই জেনে যান! হয়তো এজন্যেই তিনি ক্রমে আমাদের প্রিয়তম বিরক্তিকর ঈর্ষিত রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন। যখন বৃষ্টির দিনে বাদলধারা বৃক্ষসমূহের নুতন পাতায় এসে লুটিয়ে পড়ে তখন আমাদের মনের মযুরটিও কেন জানি অকারণে নেচে ওঠে। সেই বৃষ্টিপাতের অবিরল ধারার মোহাবেশে যে কথাটি মনের মধ্যে সংগোপনে স্পন্দিত হতে থাকে, সেই কথাটি আমাদের মুখে গান হয়ে গীত হয় রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে/ শতবরনের ভাব-উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ, আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।’ হয়তো তেমনই এক শ্রাবণদিনে আমাদের প্রাণ যখন শ্রাবণবর্ষণসংগীতে আকুল হয়, পূর্বসমুদ্র থেকে বায়ু এসে মাঠে মাঠে ধানখেতে, বৃক্ষে ও জলে ঢেউয়ের দোলায় উচ্ছল ছলো ছলো করে, তাল তমালের অরণ্যে ক্ষুব্ধ শাখার আন্দোলনে মত্ত হয়, তখনও আমাদের মন মেঘের সঙ্গী হয়ে দিগ্দিগন্তের পানে উড়ে যায়। সেই মুহূর্তটিকে বাঙ্ময় করে চিরকালীন রূপ দেন রবীন্দ্রনাথ- ‘মন মোর হংসবলাকার পাখায় যায় উড়ে/ক্বচিৎ ক্বচিৎ চকিত তড়িত-আলোকে/ ঝঞ্ঝনমঞ্জীর বাজায় ঝঞ্ঝা রুদ্র আনন্দে/ কলো-কলো কলমন্দ্রে নির্ঝরিণী/ ডাক দেয় প্রলয়-আহ্ববানে।’ তখন হংসবলাকার পাখায় ভর করে আমাদের মন কোথায় যে হারায়, উড়ন্ত ও পথভ্রান্ত সে মন হয়তো অন্তবিহীন পথ পেরিয়ে মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিম বাংলাদেশে প্রিয়তমের কাছে পৌঁছতে পারে। কিন্তু তখন আমাদের মনের মধ্যে মুহূর্তে যে সৌধ বিগঠিত হয়, সেই সৌধের এপিটাফ লিখে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- ‘পথ হতে আমি গাঁথিয়া এনেছি সিক্ত যুথীর মালা/ সকরুণ-নিবেদনের-গন্ধ-ঢালা-/ লজ্জা দিয়ো না তারে॥ সজল মেঘের ছায়া ঘনাইছে বনে বনে/ পথ-হারানোর বাজিছে বেদনা সমীরণে/ দূর হতে আমি দেখেছি তোমার ওই বাতায়নতলে নিভৃতে প্রদীপ জ্বলে—/ আমার এ আঁখি উৎসুক পাখি ঝড়ের অন্ধকারে।’ এ গান হয়তো এলিজিই, কেননা যেখানে পথ খুঁজে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে পথ হারানোর বেদনাই বেশি করে বাজে, সকরুণ হয়ে বাতাসে বাতাসে গীত হয়; তারচেয়ে নিবিড়ঘন শোকগীতি রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কে আমাদের শোনাতে পারেন! আবার এতে হয়তো শুধুই শোক হয় না, শোকের অন্তরতলে একধরনের আনন্দ মিশে থাকে, সুরের ভেতর দিয়ে তার ক্যাথারসিস হয়। তখন যেন অনেকদূর থেকে আমরা বৃষ্টির আগমনীসঙ্গীত শুনতে পাই, যে, লালনশাহের দেশে আসে লালনের বেশে— ‘বাদল বাউল বাজায় রে একতারা—/ সারা বেলা ধরে ঝরোঝরো ঝরো ধার॥/ জামের বনে ধানের ক্ষেতে আপন তানে আপনি মেতে / নেচে নেচে হল সারা॥/ ঘন জটার ঘটা ঘনায় আঁধার আকাশ-মাঝে,/ পাতায় পাতায় টুপুর টুপুর নূপুর মধুর বাজে।/ ঘর-ছাড়ানো আকুল সুরে উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে/ পুবে হাওয়া গৃহহারা॥’
বর্ষার দিনে বৃষ্টির গানে আজ যেমন আমরা এলোমেলো, বিচ্ছিন্ন বহুধা বিখ- হয়ে ঘুরে বেড়াই; মনে হয়তোবা গান আসে, কিন্তু কী গান, কী তার সুর বা সেই গান বা সুরের অন্তরালে কার মুখের ছবি আমাদের মনের গভীরে আঁকা হয়ে থাকে তার কিছুই আর বোধগম্য থাকে না, তখন রবীন্দ্রনাথের কাছেই ফিরে যেতে হয়— ‘আমি কী গান গাব যে ভেবে না পাই—/ মেঘলা আকাশে উতলা বাতাসে খুঁজে বেড়াই॥/ বনের গাছে গাছে জেগেছে ভাষা ভাষাহারা নাচে—/ মন ওদের কাছে চঞ্চলতার রাগিণী যাচে,/ সারাদিন বিরামহীন ফিরি যে তাই॥/ আমার অঙ্গে সুরতরঙ্গে ডেকেছে বান,/ রসের প্লাবনে ডুবিয়া যাই।/ কী কথা রয়েছে আমার মনের ছায়াতে/ স্বপ্নপ্রদোষে—আমি তারে যে চাই।’ মেঘ ও বৃষ্টির পৃষ্ঠপোষকতায় যে প্রিয়মুখটি ক্রমে অন্তরাল থেকে আলোয় আসতে থাকলে আমরা আনন্দ ও উল্লাসে মেতে আমাদের ভাবনাসমূহকে উদ্ভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত করে দিই, সে প্রিয়জনের নূপুরধ্বনির তরঙ্গহিল্লোলে তখন আপনা আপনিই বুকের ভেতর হারমনিকায় সুর বাজে— ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,/ দোলে মন দোলে অকারণ হরষে/ হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘের রসের ধারাবরষে॥/ তাহারে দেখি না যে দেখি না,/ শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়/ বাজে অলখিত তারি চরণে/ রুনুরুনু রুনুরুনু নূপুরধ্বনি॥/ গোপন স্বপনে ছাইল/ অপরশ আঁচলের নবনীলিমা।/ উড়ে যায় বাদলের এই বাতাসে/ তার ছায়াময় এলোকেশ আকাশে।/ সে যে মন মোর দিল আকুলি/ জল-ভেজা কেতকীর দূর সুবাসে॥’ যে অদেখা প্রিয়, রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানে রুনুরুনু নুপুর বাজায়, যার মুখচ্ছবি আমাদের দেখাই হয়ে ওঠে না, তবু তার অস্পর্শিত নীল আঁচলখানিই ব্যক্তিগত কল্পলোক রাঙিয়ে দেয় বা ঘুমঘোরেও আমরা তার কথাই ভাবি; অথচ সে যখন আমাদের বন্ধ দরজায় করাঘাত করে, আমরা নিঃসাড়ে পড়ে ঘুমাই, ঘুম ভেঙে গেলে যখন বুঝতে পারি সে এসেছিল, আমাদের হাহাকার তখন আকাশে আকাশে ছড়িয়ে যায়; উপলব্ধির এই মাত্রায় ‘স্বপ্নে আমার মনে হল কখন ঘা দিলে আমার দ্বারে, হায়’ বলে রবীন্দ্রনাথ হাহাকারের ব্যাপ্তি আরও বিস্তৃত করেন; বলেন- ‘আমি জাগি নাই জাগি নাই গো,/ তুমি মিলালে অন্ধকারে, হায়॥/ অচেতন মনো-মাঝে তখন রিমিঝিমি ধ্বনি বাজে,/ কাঁপিল বনের ছায়া ঝিল্লিঝঙ্কারে।/ আমি জাগি নাই জাগি নাই গো, নদী বহিল বনের পারে॥’ তখন আমাদের আর্তির সঙ্গে প্রিয়তমের বেদনাও একীভূত হয়ে পাতায় পাতায় অশ্রুকণার সঞ্চার করে; প্রিয়তম যে ঘাসে ঘাসে চঞ্চল চরণ ফেলে চলে যায়, সে ঘাসের ডগায় বেদনা লিপিবদ্ধ হয়; শ্যামল বনান্তভূমি জুড়ে এই বিষাদগীতি ছলোছলো সুরে বেজে যায়- ‘এসেছিলে তবু আস নাই জানায়ে গেলে/ সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে॥…তুমি চলে গেছ ধীরে ধীরে সিক্ত সমীরে,/ পিছনে নীপবীথিকায় রৌদ্রছায়া যায় খেলে॥’
১.
ধারাবাহিকভাবে আমরা আগত বর্ষার প্রতীক্ষায় থেকে নিশিদিন যাপনা করি। যক্ষ যেমন একদিন প্রতীক্ষায় থেকে থেকে আটমাসের নির্বাসন শেষে যক্ষপ্রিয়ার কাছে যাবার আনন্দ পেয়েছিল, তেমনি যেদিন বাংলাদেশের প্রকৃতি বর্ষাকে আবাহন করে, আমাদের মনও সেদিন বিমূঢ় ও উল্লসিত হয়; এই বিমূঢ় উল্লাসের ভাষা অনূদিত হয় রবীন্দ্রনাথের গানে- ‘আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল দিন বয়ে।/ বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে॥/ একলা বসে ঘরের কোণে কী ভাবি যে আপন-মনে,/ সজল হাওয়া যূথীর বনে কী কথা যায় কয়ে॥/ হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল—/সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তোলে ভিজে বনের ফুল।’ আষাঢ়সন্ধ্যার বাঁধনহারা বৃষ্টি হৃদয়ে যে ঢেউ দেয়, সে ঢেউয়ের দোলায় আমাদের দেহলতা থরথর করে কাঁপে; বুকের ভেতর লুকায়িত বেদনার ভারে বা অসহ্য আনন্দের আতিসহ্যে জলে চোখ ভিজে ওঠে—‘বাদল নিশীথেরই ঝরঝর/ তোমারি আঁখি-পরে ভরভর॥/ যে কথা ছিল তব মনে মনে/ চমকে অধরের কোণে কোণে॥’ তখন বাদলনিশীথের বৃষ্টি আর প্রিয়তমের চোখের জল এক অভিন্ন জলধারার সৃষ্টি করে, যে জলধারার উৎসস্থল হয়তো একই যমুনা, যেখানে সম্রাট শাহজাহান মর্মর পাথরে প্রেমের সমাধি বানান—‘নীরব হিয়া তব দিল ভরি কী মায়া স্বপনে যে, মরি মরি,/ আঁধার কাননের মরমর/ বাদল-নিশীথের ঝরঝর॥’
অবশ্য রবীন্দ্রনাথের গানে এবং বর্ষার গানে দূরস্থিত যে প্রিয়তম আমাদের ভেতরে মানবিক প্রেম জাগিয়ে দেয়, সবসময় সে হয়তো রক্তমাংসের মানবী নয়, মেঘের মধ্যেই, বৃষ্টির মধ্যেই হয়তো সে ব্যাপ্ত হয়ে থাকে; মেঘ ও বৃষ্টির যৌথ যোজনায় যে নীরব শিল্পের নির্মিতি ঘটে দৃশ্যত সেখানে নারী রূপেরই উদ্ভাসন হয়- ‘ওই যে ঝড়ের মেঘের কোলে/ বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে॥/ ওরই গানের তালে তালে আমে জামে শিরিষ শালে/ নাচন লাগে পাতায় পাতায় আকুল কল্লোলে॥; বা পুব হাওয়াতে মালতীলতা দুললে রবীন্দ্রনাথের হৃৎস্পন্দন দুলতে দুলতে আমাদের বুকের মধ্যে এসে দোলায়িত হয়—‘মোর হৃদয়ে লাগে দোলা, ফিরি আপনভোলা—/ মোর ভাবনা কোথায় হারা মেঘের মতন যায় চলে॥’ কিন্তু বিগত যেসব দিন মেঘের মতন চলে যায়, এই চলে যাওয়া শাদামেঘের মতো হালকা ও পেলব নয়, জলভরা মেঘের মতো সেইসব দিন চোখের জলে ভেসে যায়—‘ সে দিন যে রাগিণী গেছে থেমে, অতল বিরহে নেমে গেছে থেমে/ আজি পুবের হাওয়ায় হাওয়ায় হায় হায় হায় রে কাঁপন ভেসে চলে॥’; তবে— ‘নিবিড় সুখে মধুর দুখে জড়িত ছিল সেই দিন—/ দুই তারে জীবনের বাঁধা ছিল বীন।’ তবু শুধু বিগত দিনেই আমাদের সুখের বা দুখের দিনের অবসান ঘটে না, বহতা জীবনে আজ এবং আগামীকালে এই নিরবচ্ছিন্ন সুখ দুঃখ বহমান থাকে; আবার কখনো কখনো অতীতের সুখের বা দুঃখের প্রতিক্রিয়ার রেশ একেবারে ফুরিয়ে যায় না, বুকের মধ্যে নিভৃতে ঘুমায়; তবে সে অন্তর্লীন ঘুমন্ত সুখ বা দুঃখ কোন এক বৃষ্টিদিনে লুকোনো কাঁটার মতো ব্যথা দিয়ে জানান দেয়, গোপন কাক্সিক্ষত সুখে মন ভরে ওঠে।
বৃষ্টির অবিরল ধারা আমাদেরকে সামূহিক উদ্ভ্রান্তির জগতে সমর্পণ করে, সেই বিপর্যস্ত প্রতিকূলতায় আমরা প্রিয়তমকে কত কি যে বলতে চাই, সেই অব্যক্ত অন্তর্বেদনা যখন বুকের মধ্যে গুমড়ে গুমড়ে মরে তখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের সে বেদনাভার লাঘব করেন তাঁর গানে- ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে/যে কথা শুনায়েছি বারে বারে॥ আমার পরানে আজি যে বাণী উঠিছে বাজি/অবিরাম বর্ষণধারে। কারণ শুধায়ো না, অর্থ নাহি তার,/ সুরের সঙ্কেত জাগে পুঞ্জিত বেদনার।’ বস্তুত এই গানে বেদনাভার লাঘবের যে সম্ভাবনার কথা বলা হয়, তা হয়তো শেষপর্যন্ত একটা সান্ত¡নাই; অর্থাৎ বেদনার কথা বলতে গিয়ে যাতনার উপশম হয় না, বরং তা আরও মন্দীভূত হয়—‘স্বপ্নে যে বাণী মনে মনে ধ্বনিয়া উঠে ক্ষণে ক্ষণে/কানে কানে গুঞ্জরিব তাই/বাদলের অন্ধকারে॥’ তাহলে বাদলের অন্ধকার বেদনা লুকোনোর একটা উপলক্ষ হয় মাত্র! বাদল-অন্ধকারের নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিষাদগ্রস্ত সময়ের স্থায়িত্বকাল হয়তো বেশি নয়, কেননা বৃষ্টির গান আমাদের কখনো কখনো বলাকার মতো উড়িয়ে নিয়ে কোথায় যায় চঞ্চল সজল পবন বেগে, তা আমরা জানি না, মনের মধ্যে তখন-‘মেঘমল্লারে সারা দিনমান/ বাজে ঝরনার গান।’ আর অবচেতনে আঁকা প্রিয়তমের কথা মনে পড়লে আমাদের হৃদয়খানি তখন সেদিকে ধাবিত হয়— ‘মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা-মন চায়/ মন আয় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে।’
২.
আমরা যখন শৈশব কৈশোর করে বালকবেলায় উত্তীর্ণ হই, আমাদের মনের পালকগুলি একে একে ডানা মেলতে শুরু করে, তখন বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধহীন অঞ্চলে প্রথাগত বর্ষা এসে মাঠঘাট ভাসিয়ে নেয়, সারাদিন থেকে থেকে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি হয়, আমরা বর্ষার নুতন জল দেখতে বিলে গিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ঝাঁপাঝাঁপি করি, অকারণে হৈহৈ চিৎকার করি, গান গাই; সেইসব গানের কথা নাই, সুর নাই, শুধু কী এক ভাব থাকে, কিন্তু সেই ভাবের ব্যাপারটাই তখনও আমাদের জানা হয় না। এই ভাব যে মূলত শূন্যতাবোধ এবং এ শূন্যতাবোধের উৎসমূলে প্রিয়তমের অধিষ্ঠান, যখন তা আমরা বুঝি, সেই উপলব্ধির ভাষা কেমন মুগ্ধকর হতে পারে রবীন্দ্রনাথের গানের ভাব ও সুরে গমন না করলে সহজে তা অনুধাবনযোগ্য হয়ে ওঠে না- ‘এমন দিনে তারে বলা যায়/ এমন ঘনঘোর বরিষায়।/এমন দিনে মন খোলা যায়—/এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরোঝরে/তপনহীন ঘন তমসায়॥’ এই ‘তারে’ দূরে থাকলে তখন আর আমাদের ভালো লাগে না, তার সঙ্গে নির্জনে, নিভৃতে মুখোমুখি বসে মনের দুটো গোপন কথা বলতে চাই-‘দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি/আকাশে জল ঝরে অনিবার—/জগতে কেহ যেন আর॥’ তাকে সঙ্গে নিয়ে তেমনই আবহের কল্পনা আমরা করি, আকাশ ভেঙে বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে প্রান্তর, মনে হবে পৃথিবীতে কেবল আমরা দুজন আছি। সেরকম বাদলমুখর অভিসারের দিনে সমাজ সংসারের নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে হৃদয়ের দাবিকে মেনে নেবার মতো সাহসী হতে আমাদের প্রণোদনার কমতি হয় না।
রবীন্দ্রনাথ প্রেম পর্যায়ের একটা গানে যেমন বলেন- ‘অনেক কথা যাও বলে কোন কথা না বলি/ তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’ সেরকম মনের কথা বলবার জন্য ভাষা হয়তো সবসময় সর্বোত্তম মাধ্যম নয়-‘কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে হৃদয় হৃদি অন্ভুব—/আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥’ মনের সবচেয়ে গোপন কথাটি, যা কোনদিন কাউকে বলা হয় নাই, সেই কথা বলবার জন্য অবধারিতভাবে তাই আমাদের ঘন বরষার দরকার পড়ে, যেদিন—‘ব্যাকুল বেগে আজি বহে যায়,/ বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।/যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে/সে কথা আজি যেন বলা যায়—/এমন ঘনঘোর বরিষায়।’ কিন্তু চিরকালীন বিরহপ্রিয়তা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে, রবীন্দ্রনাথই যেমন বলেন—‘বিরহ মধুর হল আজি মধুরাতে।’ যে ‘তারে’ দুটো কথা জানাবার জন্য মন আকুল হয়, তার সাথে হয়তো সুদূর অতীতকালে কোন এক ঘনঘোর বরষার রাতে একটা নিবিড় ঘন আনন্দমুখর দুঃখরজনী কাটিয়ে আসি; সেই রাতের স্মৃতিই তখন আমাদের সারাজীবনের বিরহকে জাগিয়ে রাখে। আবার কোন এক শ্রাবণের রাতে, যখন ধুমল বৃষ্টি হয়, তার কথা ভেবে আমাদের আঁধার ঘরের দরজা হাট খুলে রাখি—‘আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবণরাতি,/স্মৃতিবেদনার মালা একেলা গাঁথি॥ আজি কোন ভুলে ভুলি আঁধার ঘরেতে রাখি দুয়ার খুলি,/মনে হয় বুঝি আসিছে সে মোর দুখরজনীর সাথি॥’ হোক সে দুখরজনীর সাথি অথবা হোক বিরহযাপনার আনন্দ, সে ব্যাপক বন্ধুকে সমগ্র জীবন ব্যেপে আমরা সঙ্গে করে ফিরি; এই প্রগাঢ় অবিচ্ছিন্নতায় আমাদের অনুভূতির অনুবাদে শ্রীযুক্ত ঋষি রবীন্দ্রনাথ বহুদিন আমাদের সঙ্গে আছেন, থাকবেন। আসুন, এই অন্তরবন্ধুটিকে আমাদের প্রাণের গভীর থেকে একবার প্রণতি জানাই—নমস্কার; আর বলি—
বন্ধু, রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণরাতে
৩.
‘যখন কেউ গায় না, তখনো সে গীত হয়। শ্রুত হয়।/ অনেক দূরে কোথাও গিয়ে হয়তো বা থামে এই গান,/ কিন্তু আমার মন থামে না। আমার প্রাণ থামে না।/ মনে হয় একটি গান আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো/ অন্য একটি গানের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে যায়।’ -কবি নির্মলেন্দু গুণের এই অসাধারণ কবিতাটির কাছে না ফিরে আমাদের উপায় থাকে না। রবীন্দ্রনাথের গান তো এমনই, কেউ না গাইলেও আপনা আপনিই তা অনিবার গীত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানও আমাদের আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো অন্য একটি গানের কাছে নিশ্চিত পৌঁছে দিয়ে যায়; কিন্তু এই লেখাটিতে সেই নৈর্ব্যক্তিক অতীন্দ্রিয় অনুভূতিকে ধরবার চেষ্টা করা হয় নি, এখানে প্রেমের মানবীয় অংশটিতে ঈষৎ আলোকসম্পাত করে দেখবার প্রয়াসই বরং উচ্চকিত।
৪.
‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো, সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো’ -এই গানে রবীন্দ্রনাথ বিশুষ্ক জীবনে নিশ্চিত করেই বৃষ্টিকে আহ্বান করেন নি। কেননা যাতনায় ও শোকে যখন আমাদের জীবন শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়, চিত্ত সকল মাধুরীশূন্য হয়ে পড়ে, সেখানে বৃষ্টির সামান্য জল তার প্রলেপ হয় না; তখন চাতকের মতো যে ধারাবারির জন্য আমরা যাচনা করি এবং অদৃশ্যলোক থেকে যা করুণাধারায় প্রবল বেগে নেমে আসে, তার চেয়ে বিপুল বর্ষা বাংলাদেশের মাটিতে কবে আর হয়!
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই