রবীন্দ্রনাথের চোখে ইউরোপ
৬ আগস্ট ২০২০ ১৭:০৭
সতের বছর বয়সে পারিবারিক চাপে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভেন্ট হওয়ার বাসনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলাত যাত্রা করেছিলেন। ব্রিটিশ সার্ভেন্ট হওয়া তার ভাগ্যে না জুটলেও সে যাত্রায় ইউরোপ সম্বন্ধে বাঙালি পাঠকের নানা কৌতূহল তিনি মিটিয়েছিলেন। ১৮৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ বোম্বাই থেকে ‘পুনা’ স্টিমারে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তখন কবির বয়স ছিল সতেরোর কোটায়- কৈশোর ছেড়ে কেবল যৌবনে পা রাখতে যাচ্ছেন। এটিই কবির প্রথম বিদেশ যাত্রা। অবশ্য এর আগে তিনি দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার প্রবাসবাস করেছিলেন। এ যাত্রায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তার মধ্যম ভ্রাতা আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই যাত্রা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের জবানি ভিন্ন আমাদের খুব বেশি জানার সুযোগ নেই। তাই পুরোটাই রবীন্দ্রনাথের ‘যুরোপ-প্রবাসীর পত্র’ গ্রন্থের দোহাই দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। রবীন্দ্রনাথ কখন এ গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন তার সঠিক তথ্য সংগ্রহে নেই। তবে প্রশান্তকুমার পালের ধারণা এই লেখাটির সূচনা হয়েছিল জাহাজে থাকতেই আর শেষ হয়েছিল ব্রাইটনে পৌঁছাবার পর। ইউরোপ গমনের প্রায় এক বছর পর এটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘য়ুরোপ-প্রবাসী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ শিরোনামে নিয়মিত ছাপা হয়েছিল। কবির এ যাত্রা খুব সুখের ছিল বলে মনে হয় না। কারণ, প্রথমত ঘরকুনো এই কিশোর বাইরে যাবার ব্যাপারে খুব একটা অন্তরের তাগিদ পাননি। দ্বিতীয়ত পথের ধকলও তাকে কাবু করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ জাহাজে উঠে সমুদ্রপীড়ায় (সি সিকনেস) আক্রান্ত হয়েছিলেন।
‘যুরোপ প্রবাসীর পত্র’ রচনাকালে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তরুণ; তাই মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু লঘুত্বের প্রকাশ ঘটেছিল বলে রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন। তিনি বলছেন- ‘এই চিঠিগুলির অধিকাংশই বাল্যবয়সের বাহাদুরী, অশ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়া, অসম্মত করিয়া, তর্ক করিয়া রচনার আত্মশক্তি করিবার এই প্রয়াস। শ্রদ্ধা করিবার, গ্রহণ করিবার প্রবেশ লাভ করিবার শক্তিই যে সকলের চেয়ে মহৎশক্তি এবং বিনয়ের দ্বারাই যে সকলের চেয়ে বড়ো করিয়া অধিকার বিস্তার করা যায়- কাঁচা বয়সে একথা মন বুঝিতে চায় না।”
রবীন্দ্রনাথের বিলাতযাত্রার শুরুর দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল। মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ও বউঠাকুরানী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর যত্ন এবং বালক সুরেন্দ্র ও ইন্দিরার উপদ্রব তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন। কিন্তু যে উদ্দেশে লন্ডনে আসা তার বিহিত তেমন হচ্ছিল না। রবীন্দ্রনাথকে প্রথমে ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এই স্কুলের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রনাথকে দেখে যে মন্তব্য করেছিলেন, মন্তব্যটি রবীন্দ্রনাথের খুব ভালো লেগেছে বলে মনে হয় না। ব্রাইটনের স্কুলের সহপাঠিরাও যে খুব একটা কল্পিত ইংরেজ জাতির মতো সুবোধ ছিল তা নয়। তারা অনেক সময় রবীন্দ্রনাথের পকেটের মধ্যে কমলালেবু কিংবা আপেলের মতো পদার্থ চালান করে পালিয়ে যেত। ব্রাইটনে রবীন্দ্রনাথের খুব বেশিদিন পড়া চলল না। এখানে তাঁর পড়াশোনা খুব এগুচ্ছে না বিবেচনা করে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ তাকে লন্ডনে নিয়ে এসে রিজেন্ট উদ্যানের কাছে একটি বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেন। এখানে একজন রবীন্দ্রনাথকে ল্যাটিন শেখাতেন। এই শিক্ষকটি ছিলেন কিছুটা বাতিকগ্রস্থ। মানবজাতির কোনো একটা প্রবণতা প্রমাণে তিনি সচেষ্ট। তার ধারণা “পৃথিবীতে এক একটা যুগে একই সময় ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানব সমাজে একই ভাবের আর্বিভাব হইয়া থাকে; অবশ্য সভ্যতার তারতম্য অনুসারে সেই ভাবের রূপান্তর ঘটিয়া থাকে কিন্তু হাওয়াটা একই।”
এ সময় আরও একজন শিক্ষকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ঘটেছিল। তাঁর নাম ছিল বার্কার। বার্কারও পারিবারিক জীবনে অসুখী ছিলেন। তাদের কোনো সন্তান ছিল না; আবার স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো সুসম্পর্ক ছিল না। বার্কারের স্ত্রী একটা কুকুর পুষতেন- “স্ত্রীকে যখন বার্কার শাস্তি দিতে ইচ্ছা করিতেন তখন পীড়া দিতেন সেই কুকুরকে।” এরপর কিছুদিন রবীন্দ্রনাথ ডেভেনশায়ারের টার্কিতে মেজ ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে ছিলেন। জায়গাটি রবীন্দ্রনাথের খুব পছন্দ হয়েছিল। কিছুদিন পরে তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। এখানে তিনি ডাক্তার স্কট নামক একজনের পরিবারে আশ্রয় নেন। সম্ভবত ইউরোপের প্রবাস জীবনে এই পরিবারটি রবীন্দ্র মনে গভীর দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছিল। এই পরিবারের গৃহকর্ত্রী এবং এদের তিনটি মেয়ে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপের জীবনাচরণ কিছুটা আনন্দে ভরিয়ে তুলেছিলেন। ‘যুরোপ প্রবাসীর পত্র’তে এই ডাক্তার পরিবারকে স্বনামে উল্লেখ না করে মিস্টার. কে আর মিসেস. কে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এই গোপনীয়তার পেছনে রবীন্দ্র গবেষকদের অনেকেই কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। অনেকেরই ধারণা স্কট পরিবারের কন্যাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীরতার কথা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথকে হঠাৎ করে দেশে তলব করার এটিও একটি কারণ। তবে সম্ভবত এই অনুমানটি সত্য হওয়া স্বাভাবিক যে- ভারতীতে রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র ছাপা হওয়া এবং পত্রের বিষয় বয়সের তুলনায় অতিপাকামী গোছের হওয়াতে মহর্ষির পছন্দ হয়নি। এই পরিবার রবীন্দ্রনাথকে বাড়ির সদস্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। শৈশবে মাতৃহারা এবং বিদেশে স্বজন বর্জিত কিশোর তাদের আপন করে নিয়েছিলেন।
পরিবারটির সঙ্গে বাস করে রবীন্দ্রনাথের একটি ভ্রান্ত ধারণা অবলোপন হয়েছিল। তাঁর ধারণা ছিল পতিভক্তি বিষয়টি কেবল ভারতীয় নারীদের ভূষণ। ইউরোপীয় নারীদের পতিভক্তির মধ্যে তেমন বিশিষ্টতা নেই। কিন্তু স্কট দম্পতিকে দেখে তার মনে হয়েছিল ভারতীয় রমণীদের চেয়ে পতিভক্তির ক্ষেত্রে তাঁরা পিছিয়ে নেই। স্বামীর ছোটখাটো কাজও মিসেস স্কট নিজের হাতে করতেন। তাঁর দেশে ফেরার সময় মিসেস স্কট ঠিক ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন- “এমন করিয়াই যদি চলিয়া যাইবে তবে এত অল্পদিনের জন্য তুমি কেন আসিলে।”
রবীন্দ্রনাথ ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্রে’ ইংরেজ জাতির মূর্খতা নিচুতা নিয়ে যেমন কথা বলেছেন, তেমনি এ জাতির সততা ও কর্মনিষ্ঠতারও প্রশংসা করেছেন। তবে সেখানে কবির বঞ্চনার বোধ যে একেবারে ছিল না তা নয়। তবে তিনি সেসব ছোটখাটো বঞ্চনাকে বড় করে দেখতে চাননি। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন- “যাহারা নিজে বিশ্বাস নষ্ট করে না তাহারাই অন্যকে বিশ্বাস করে।” তবু ভারতবর্ষের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারীর বিধবার প্রহসনমূলক আচরণ- যা রবীন্দ্রনাথ ভুলতে পারেন নি। তিনি য়ুরোপ প্রবাসীর পত্রেও তার ঘটনাটি বেশ রসাত্মকভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ঘটনার বর্ণনা যতই রসাত্মক হোক না কেন তা বিদেশ বিভুঁইয়ে তাঁর জন্য ছিল মারাত্মক যন্ত্রণার কারণ। তবে এটি যে ইংরেজ জাতির চরিত্র নয় সেটি স্কট পরিবার তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
স্কট পরিবারে কয়েক মাস কাটাবার পর রবীন্দ্রনাথ লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের আর্টস অ্যান্ড ল বিভাগে ভর্তি হন। বিলাতে অধ্যায়নকালে তাঁর ভারতীয় ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে লোকেন পালিতের কথা রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয়বার ইউরোপে গিয়ে স্কট পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারা অন্যত্র চলে যাওয়ায় আর সম্ভব হয়নি। এই পরিবারটির ব্যাপারে শুরুর দিকে দেবেন্দ্রনাথের একটি ভয় ছিল। না জানি রবি মেম বিয়ে করে বসেন। সম্ভবত তাঁর য়ুরোপ প্রবাসে লোকেন পালিতের বিশেষ ভূমিকা ছিল। লোকেন পালিত রবীন্দ্রনাথের চেয়ে প্রায় বছর চারেকের ছোট হবে বলে তিনি উল্লেখ করলেও তাঁদের বন্ধুত্বের কোনো ফাঁক ছিল না।
বিলাত প্রবাসকালে রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রথম ধরা পড়ে ইংরেজি বানানের ক্ষেত্রে সর্বদা সাম্য রক্ষিত হয় না। ইংরেজি বানান কেবল নিয়ম রক্ষা করেই চলে না, পদে পদে সে নিয়ম লঙ্ঘনও করে। শিক্ষার্থীদের পক্ষে এসব বানান মুখস্থ না করার উপায় থাকে না। কিন্তু বাংলা বানানও যে একই বিষয় পরে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কথায় “ইংরেজি বানান রীতির অসংযত নিতান্তই হাস্যকর। কেবল তাহা মুখস্থ করিয়া আমাদিগকে পরীক্ষা দিতে হয় বলিয়াই সেটা এমন শোকাবহ। কিন্তু আমার গর্ব টিকিল না। দেখিলাম বাংলা বানানও বাধা মানে না; তাহা যে ক্ষণে ক্ষণে নিয়ম ডিঙ্গাইয়া চলে অভ্যাসবশত এতদিন তাহা লক্ষ্য করি নাই।” রবীন্দ্রনাথ এই পত্রগুচ্ছে ইউরোপ জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি লন্ডন পাঠ চুকিয়ে দিয়ে ফ্রান্সে সত্যেন্দ্রনাথের কাছে চলে আসেন এবং সেখান থেকে কলকাতায়।
‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’ প্রথমে ভারতীয় পত্রিকায় ‘য়ুরোপ-যাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্র’ নামে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়। কিন্তু কয়েকটি পত্র ছাপার পরে এটি বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করে। বিশেষ করে তরুণ কবির প্রগলভতা পিতা দেবেন্দ্রনাথ সুনজরে দেখেননি। শেষ পর্যন্ত তার পত্র ছাপা পত্রিকায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে কারণে এ গ্রন্থ তাঁর য়ুরোপ প্রবাসের শেষটা অজানা থেকে যায়। সেটি একটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের এই পত্রগুলো মুদ্রিত হয়। তবে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেতে অনেক দেরি হয়েছিল। বলা চলে রবীন্দ্র জীবনের শেষ পর্বে এসে এটি ছাপা হয়। গ্রন্থাকারে ছাপার সময় এটি ব্যাপকভাবে মার্জিত-পরিমার্জিত হয়েছে। এ রচনাগুলো তরুণ রবীন্দ্রনাথের ইংরেজ জাতির প্রতি উন্নাষিকতা প্রকাশ পেলেও গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হওয়ার পরে সেই তীব্রতা লক্ষ করা যায়নি।
‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ গুচ্ছ রবীন্দ্রনাথ কার উদ্দেশে বা কাকে লক্ষ করে লিখেছিলেন তার সঠিক তথ্য রবীন্দ্র গবেষকদের পক্ষে বের করা সম্ভব হয়নি। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে এগুলো তাঁর বৌঠাকুরাণী কাদম্বরী দেবীর উদ্দেশ্যে লিখিত। কিন্তু চিঠির বক্তব্যে এটি প্রমাণ হয় না; বিশেষ করে প্রশান্তপাল এ মত গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ এ পত্র গুচ্ছে অনেকগুলোতে স্পষ্ট প্রমাণ মেলে যে, কোনো এক রূপ সৌষ্ঠব পুরুষ বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লিখিত হয়েছিল। অবশ্য অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য দুটি মতই গ্রহণ করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, কিছুপত্র লিখিত হয়েছে বৌঠানের উদ্দেশ্যে কিছু কোনো পুরুষপ্রণব বন্ধুর উদ্দেশ্যে।
জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর সম্পাদিত ভারতীয় পত্রিকায় পত্রগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশকালে এগুলো বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করে। এমনকি নারী শিক্ষাসহ তরুণ কবির মত তখন ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়। এর বিতর্কেরও কিছুটা পত্রিকায় স্থান পায়। তবে একথা ঠিক সতের বছরের রবীন্দ্রনাথের পক্ষে যে পত্র লিখিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে চিরকালীন পরিপক্কতা লাভ করেছে। আমাদের মনে হয় এ পত্রগুলো বর্তমানে উত্তর উপনিবেশিক চিন্তা ধারাকে অনেকটা পরিপুষ্ট করতে পারবে।
বাংলা ১২৯৮ ও ১৩০০ সালে প্রথমে দুই খণ্ডে ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথমবার য়ুরোপ যান তখন তিনি ছিলেন নিতান্ত তরুণ। যদিও এই প্রতিভাবান তরুণ য়ুরোপকে দেখার একটি বিশিষ্টি দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছিলেন; তবু পরবর্তীকালের তার নিজের কাছে অনেক কিছু বালখিল্যে আক্রান্ত হয়েছিল বলে মনে হয়েছে। এই যাত্রার মাধ্যমে তিনি তা নতুন করে পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ করতে পারবনে বলে অন্তরে বাসনা ছিল। তাছাড়া তাঁর কৈশোরে দেখা এই বিদেশ বিভুঁই তিনি নতুন করে আবিষ্কার করতে চাচ্ছিলেন- এ ধরনের ধারণাও অবান্তর নয়। বিশেষ করে ড. স্কট পরিবার এবং তাদের তিন কন্যা- যারা যৌবনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথকে আলোড়িত করেছিলেন বলে মনে হয়। অন্তরে হয়তো গোপন বাসনা ছিল- সেই পরিবারের সঙ্গে পুনরায় তিনি মিলিত হতে পারবেন। যুরোপ-যাত্রীর ডায়ারির ভূমিকায় কবি লিখছেন, ‘অনেক দিন থেকে ইচ্ছা ছিল য়ুরোপীয় সভ্যতার ঠিক মাঝখানটাতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে একবার তার আঘাত আবর্ত এবং তার উন্মাদনা, তার উত্তাল তরঙ্গের নৃত্য ও কলগীতি এবং ফেনোচ্ছ্বাস, তার বিদ্যুৎবেগ, অনিদ্র উদ্যোম এবং প্রবল প্রবাহ সমস্ত শিরা স্নায়ু ধমণীর মধ্যে অনুভব করে আসব।’
কবির এই দ্বিতীয়বার য়ুরোপ যাবার প্রাক্কালে ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথেরও বিলাত যাওয়ার প্রস্তুতি চলছিল। এ সময় বন্ধু লোকেন্দ্রপালিতও বিলাত যাওয়ার জন্য ছয় মাসের ফার্লো ছুটি নিয়েছিলেন। লোকেন্দ্রপালিত তখন ত্রিপুরা এস্টেটের অ্যাসিসটেন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। বন্ধুর বিলাত যাত্রাও রবীন্দ্রনাথকে উৎসাহ যোগাতে পারে বলে মনে হয়। দুই বন্ধু একই উদ্দেশ্যে সোলপুরে ভাই সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে মিলিত হন।
১৮৭৮ সালে প্রথমবারের য়ুরোপ ভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে যে চিঠিপত্র লেখেন তার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি তার বিলাত যাবার ঘটনা এবং প্রবাস জীবনের কাহিনী- যা নিয়ে য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্রের অবয়ব গঠিত হয়েছে। কিন্তু এবার তিনি রীতিমত ডায়ারি রচনার কাজ শুরু থেকেই করতে থাকেন।
প্রথমবার বিলাত যাত্রার ১২ বছর পর রবীন্দ্রনাথ বোম্বাই বন্দর থেকে ২২ আগস্ট ১৮৯০ শুক্রবার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ও বন্ধু লোকেন্দ্র পালিতসহ বোম্বাই বন্দর থেকে ‘শ্যাম’ নামক একটি জাহাজে য়ুরোপের উদ্দেশে যাত্রা করেন। আগের বারের মতো এবারও তাকে সমুদ্রপীড়ায় কাহিল করে ফেলেছিল। কিন্তু এ সময় একটি মজার ব্যাপার ঘটেছিল- পীড়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতেই তিনি তাঁর নিজের কেবিনে প্রবেশ করতে গিয়ে অন্য একটা কুঠুরিতে প্রবেশ করেন। সে কুঠুরিটি ছিল একজন ইংরেজ ভদ্রলোকের এবং তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে যখন তিনি অন্য অরেকটি কুঠিরে প্রবেশ করলেন তখন দেখলেন, সেখানে স্ত্রীলোকের পরিচ্ছদ শোভা পাচ্ছে; তাই তৃতীবার ভুল করার সাহস না করে জাহাজের ছাদে তাম্রকুট গন্ধযুক্ত একটি কম্বলে কোনো রকম রাত্রি কাটিয়ে দিয়েছেন। এই অংশ রবীন্দ্রনাথ বেশ রসিয়ে বর্ণনা দিয়েছেন। এ নিয়ে লোকেন্দ্রপালিত বেশ কয়েকটি স্ল্যাং কবির জন্য বরাদ্দ করেছিলেন- যা তিনি স্কুল ত্যাগের পরে কখনো শোনেনি। ২৯ আগস্ট তিনি এসব অসুস্থতার কথা মৃণালিনী দেবীকে চিঠিতে বর্ণনা করেছিলেন। এই একটি মাত্র চিঠিতে স্ত্রীর প্রতি আকাশচারী কবির বেশ কিছু রোমান্টিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে।
জাহাজে বরাবরের মতো এবারও রবীন্দ্রনাথ নানা রকম মানুষের চরাফেরা দেখে তাদের সংস্কৃতি ও চেতনার সঙ্গে ভারতকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করে। এ রচনায় আমাদের তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার দরকার নেই। ৩১ আগস্ট ভারত-রাজ মন্ত্রণার সচিব ইভানস সাহেবের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা করেন। ঐদিন ব্রেকফাস্টের সময়ে চাকু দিয়ে রুটি কাটতে গিয়ে কবি হাত কেটে ফেলেন- তাতে কিছু রক্তপাতও হয়। কবি এতে রসিয়ে মন্তব্য করেছেন, অকাতরে রক্তদান করতে না পারায় ভারত আজ স্বাধীন হচ্ছে না অথচ রুটির টেবিলে অহেতুক এই রক্তপাতের কোনো সুফল নেই। এমনকি বাড়িতে এ ঘটনা ঘটলে অন্তত প্রিয়জনের সহমর্মিতা পাওয়া যেত। রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব নাগরিক হলেও, পৃথিবীর বহু প্রান্তরে ভ্রমণ করলেও সব সময় ঘরের জন্য তাঁর প্রাণ পড়ে থাকতো এই সব খুটিনাটি এই গ্রন্থে সহজভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ৭ সেপ্টেম্বর তিনি ইতালির বিন্দিসে পদার্পন করেন। দুই দিন পর ট্রেনে প্যারিসে আসেন। এখানে প্যারিসের বর্ণনার অনুপুঙ্খ তিনি তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে। ১০ সেপ্টেম্বর বুধবার সন্ধ্যা তারা লন্ডনে এসে পৌঁছান। সেখানে তারাকনাথ পালিত ও তাদের পুত্র-কন্যা তাদের অভ্যর্থনা জানান। এখানে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা সত্যেন্দ্রবালার খোঁজ করে ব্যর্থ হন; তারা বাড়ি বিক্রি করে কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। এরপর অধিকাংশ অনুসন্ধানই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এমনকি ডাক্তার স্কটের পরিবারের দেখাও তিনি পাননি। বাড়ির প্রতি এক ধরনের স্মৃতি কাতরতা তাকে পেয়ে বসে। এখানে অবস্থানকালে তিনি বেশ কিছু নাট্যাভিনয় দেখেছিলেন। এ যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ বাড়ির জন্য বেশ অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। যে সব উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলেন তার বাস্তবায়ন তেমন দেখা যায়নি। এমনকি সত্যেন্দ্রনাথের মতের বাইরে তিনি ৭ অক্টোবর দেশে ফেরার জন্য জাহাজের আসন নির্ধারণ করে আসেন। এতে সত্যেন্দ্রনাথ বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ৮ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ এই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, ইন্দিরা দেবিকে লেখা একটি চিঠির মাধ্যমে। তিনি লেখেন- ‘মানুষ কি একটি লোহার কল যে ঠিক নিয়ম অনুসারে চলবে।’
এই ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ যে দিনলিপি লিখেছিলেন তা সাধনা পত্রিকার প্রথমবর্ষে বিভিন্ন সংখ্যায় ছাপা হতে থাকে। দিনলিপি রচনার সময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার বিভিন্ন দিক, নর-নারী সম্পর্ক, কর্তব্য এবং নানা প্রাত্যহিকতা তুলে ধরেন। এই গ্রন্থে সম্পর্কে নেপাল মজুমদার বলেছেন উনবিংশ শতকের শেষভাগে ইংল্যান্ড, ইউরোপ তথা পৃথিবীর চিন্তাজগতে এক দারুণ বিপ্লব উপস্থিত হয়েছিল, সে রকম এক যুগসন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপ ভ্রমণের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পেরেছিলেন।
জীবনের শুরুতে ইউরোপ তথা বিলাত ভ্রমণ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল। এই ভ্রমণের মাধ্যমে নিজের দেশের সঙ্গে পরদেশের তুলনা করা, নিজের পারধীন উপনিবেশিত দেশের সঙ্গে ঔপনিবেশিক প্রভুদের স্বাধীন দেশের মানুষকে মিলিয়ে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। একই সঙ্গে উন্নত ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ঘটেছিল। মধুসূদন যেমন ইউরোপ ভ্রমণের দ্বারা আধুনিক বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন; রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণেও বাংলা সাহিত্যের জন্য ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল। সাহিত্য ও চিন্তার শৈলি নির্মাণে তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের সঙ্গে একটি মেলবন্ধ তৈরি করতে পেরেছিলেন। এ কথা আজ জোর দিয়েই বলা যায়, যৌবনের সূচনা লগ্নে রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ বাস পরবর্তীকালে তাঁকে বিশ্বকবি রূপে গড়ে তুলেছিল। সেদিনের সে যাত্রায় কবির আইসিএস বা ব্যারিস্টারি পাসের উদ্দেশ্য পূর্ণ না হলেও বাংলা সাহিত্যের জন্য কোনো ক্ষতি হয়নি।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
বার্কার পরিবার বিশ্বকবি মজিদ মাহমুদ য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ বাস রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলাত যাত্রা স্কট পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ