লুডুর পাকা ঘর
১৭ আগস্ট ২০২০ ১২:৪৭
তার সাথে যে আমার প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সেটা আমার মনে থাকতনা, যদিনা তার সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হত। এবং সে দ্বিতীয়বার এক যুৎসই আলাপের জন্ম না দিত। সাক্ষাৎ বলতে চোখে চোখ মেলানো দেখা ছিলোনা যদিও। কাঁচের ওপার-এপার সাক্ষাৎ। কোনো হাসপাতাল বা এয়ারপোর্ট না। আন্তর্জালের কাঁচের দেয়াল। ইন্টারনেট। অনলাইন। দুপুরে, এই সময়টায় লাঞ্চ ব্রেক নিতাম অফিসে। ক্রান্তিকালের এই সময়ে, ঘরই অফিস। তো ঘরে থেকে অফিস করার এই সময়ে, কাজের ফাঁকে লুডু খেলার নেশা ধরেছে। ওই অনলাইনে। লুডু স্টার-কিং কত কিছু। তার একটিতে ঢুকে, কফির চুমুকে আর ভাতঘুম তাড়ানো এক দুপুরে এক দান লুডু খেলায় তার সাথে আমার সাক্ষাৎ।
লুডু খেলায় ওপাশের জন অপরিচিত। কত দেশের কত নাম, কত জন। কত ছবি। তাদের সাথে খেলা- শেষে ভুলে যাওয়া। তার মাঝে যখন দেখলাম- সাবিহা গোলাপ নামটা, মনে পড়ল আমি নামটি আগেও দেখেছি। নামটি একটু অন্যরকম বলে, দেশের পাশে বাংলাদেশ লেখা বলেই হয়ত মনে পড়ে গেল, সাবিহা গোলাপের সাথে আমি আগেও লুডু খেলেছি।
দ্বিতীয়বার খেলতে খেলতে কথা হয়। সাবিহা শুরু করে। একই দেশ। সেই সূত্র ধরে। আগে একবার খেলেছি, সে কথা দিয়ে। আমরা কথা বলতে বলতে খেলি। লাল হলুদ গুটি এগিয়ে এগিয়ে চলে। আর আমরা তার মাঝে লিখে লিখে কথা বলি,
সে বলে: ঢাকায় থাকেন?
আমি বলি: হু, আপনি?
সে বলে: হ্যা। ভাত খেয়েছেন?
আমি বলি: হ্যা, আপনি?
সে বলে: খেয়ে বসলাম। এখন আর কাজ নাই। তাই খেলি।
আমি হাসি মুখের স্টিকার পাঠাই।
সে বলে: খেলার পর কি করবেন?
আমি বলি: মিটিং আছে।
সে বলে: ওহ , চাকরি করেন?
আমি বলি: আপনার নামটা সুন্দর।
সে বলে: আমার ডাক নাম গোলাপ।
গোলাপ আমাকে লুডু খেলার বন্ধু হবার আমন্ত্রণ পাঠায়। আমি ইয়েস বোতামে টিপ দিয়ে আমন্ত্রণ গ্রহণ করি।যাতে আমরা একসাথে আবার খেলতে পারি। এবারের মতন খেলা শেষ হয়, গোলাপ জিতে যায়। আমরা বিদায় নেই।
আমরা লুডু খেলা শুরু করি। সেটা এক অন্যদিনের কথা। ছক্কা চার কেটে কেটে গুটি এগুতে থাকে। আমার গুটি, তার গুটি, এক ওকে ছাড়িয়ে যায়।
সে বলে: আজকে মিটিং নাই?
আমি বলি: নাহ।
সে বলে: আপনি রান্না করতে পারেন?
আমি হাসির ছবি পাঠিয়ে বলি: পারি তো।
আমি বলি: আপনি কি রান্না করলেন?
সে বলে: লাউ শাক, বরবটি ভর্তা, রুই মাছ, ডাল।
আমি বলি: কি মজা।
সে বলে: আমার রান্না ভাল। আপনার সাথে দেখা হলে খাওয়াবো।
গোলাপের গুটি আমাকে ছাড়িয়ে, খেয়ে একাকার। আমি খেলায় মন দেই। খেলা চলতে থাকে।
আমরা আরেকদিন যেদিন খেলি, সেদিন সাবিহা গোলাপ, কোন কথা বলেনা। মন দিয়ে খেলে। সেদিন সে আক্রমণাত্মক ও বটে। খেলে, যেতে, চলে যায়। আমারও সেদিন কথা বলা হয়না।
আমরা এমন করে প্রায়ই খেলি। খেলতে খেলতে আমাদের দুপুরের জমে থাকা গল্প হয়। দুপুরের জমে থাকা গল্প, অন্য সময় জমেনা। এক বাটি আচার নিয়ে বসে রোদে পিঠ রেখে, গলে গলে যাওয়া ঘিয়ে মাখা যেসব গল্প, অন্য সময়ে তা বড় বেমানান হয়ে যায়। আমাদের লুডু ঘরে রোদ নেই, কিন্তু আমাদের কথা হয়। খেলায় খেলায়।
লুডু খেলার ঘরের পাশে বার্তা লেখার ঘর, চ্যাটবক্স। আমি টুকরো টুকরো বার্তায় গল্পে জানি যে, আঠার বছর আগে এক দুপুরে ঘটে যাওয়া, উনিশ বছর বয়সের গোলাপের বিয়ের গল্প। আমি জানি তার হাতের তৈরী সর্ষে ইলিশের ঘন ঝোলের স্বাদ, কাঁচামরিচ সবুজে মাখামাখি। আমার প্রতিদিনের ছক কাটা নিশ্চিত ঘর এবং ঘড়ির জীবনের চেয়ে গোলাপের প্রতিদিনের রং মশলার গল্প অনেক আকর্ষণীয়, আমার কাছে। তাই আমি জানাই কম, জানি বেশি। গোলাপ ও ততটুকুই জানতে চায় যতটুকু আমি জানাতে চাই, ততটুকু জানায় যতটুকু আমি জানতে চাই।
কখনো কখনো সে নিজেই বলে, “মানুষ এখন বুঝবে, ঘরে থাকতে দিনরাত কেমন লাগে। ”
আমি বলি, “ভাল লাগার তো কথা না, চারিদিকে এত অসুখ।”
সে বলে,” সুখ থাকলে ও তো কত মানুষের ২৪ ঘন্টা ঘরেই থাকতে হয়। আমার মতন।”
লুডুর গুটি গতি বাড়িয়ে জিতে যেতে থাকে। কখনো আমার কখনো গোলাপের লাল হলুদ গুটিগুলো মেরে কেটে জিতে ঘর খুঁজে নেয়। পাকা ঘর।
এর মাঝে কখন যেন সাবিহা গোলাপকে হারিয়ে ফেলি। লুডু ঘরে আমাদের দেখা হয়না। বেশ ক’দিন। অন্যদের সাথে খেলতে খেলতে মাঝেমধ্যে মনে পড়ে। লুডু ঘর থেকে বের হয়েও আমার যখন দু’দিন পরপর সাবিহা গোলাপের কথা মনে পড়ল, ভাবলাম তাকে খোঁজা উচিত। ফোনবুকে তার নম্বর খুঁজি। নম্বরটা দিয়েছিল একবার। ফোন করব কি, করবনা, উচিত-অনুচিত নানা দ্বন্দে, ফোন করি।
ওপারের নিতান্ত খসখসে এক আবেগহীন গলা, প্রায় রোজকার শুনতে পাওয়া সাধারণ এক কণ্ঠ। গল্পের মতন মসৃণ নয় মোটেও। দু’ এক কথা হয়, জানতে পারি ঘরের কাজ আর ঝক্কি সামলে সে বড্ড ব্যস্ত ছিল এ’কদিন। ফোন রাখবার আগে কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানায়, তার খবর নিয়েছি বলে। তবে তার আবেগটুকুর প্রকাশও খুব পরিমিত। আমি ফোন রেখে মনে হল, ধুর ফোন না করলেই হত। তারপর আমি ব্যস্ত মানুষের মতন নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
পরদিন দুপুরে আগের মতন, তাকে লুডু ঘরে দেখি সে আমাকে খেলার আমন্ত্রণ জানায়। আমরা খেলতে থাকি।
সে বলে, “আপনি রাগ করেছেন?”
আমি বলি, “কেন?”
সে বলে, “ওই যে কালকে বেশি কথা বলতে পারলামনা ফোনে। ”
আমি বলি, “না তো। রাগ করিনি।”
সে বলে, “কানে শুনিনা বেশি, দু বছর হল । ডান কানে খুব কম শুনি। ফোনে কথা বলতে অসুবিধা।”
আর কথা বাড়ায়না সে। আমিও কথা যোগ করিনা আর। খেলা শেষ হয়। আমি জিতে যাই সেদিন, এক হালকা হু হু মন খারাপ নিয়ে।
আমরা এর পর যেদিন খেলি, সেদিন নিয়ম ভেঙে আমি প্রশ্ন করি, “আপনি কি কানে শুনতেই পাননা একদম।?”
সে বলে, “পাই, খুব অল্প।”
আমরা খেলায় মন দেই। খেলা জমে উঠেছে।
সে বলে, “একদিন রাগ করে থাপ্পড় দিল এমন, অনেক রক্ত … তারপর থেকে।
আমি বুঝি, তাও বলি, “কে দিলো থাপ্পড়?”
সে বলে, “আমার ছেলের বাপ, আ-আমার বর। ওই যে মাঝে কয়দিন খেলতে আসলামনা, কানে ব্যথা ছিল অনেক।”
আমি কি বলব, কি বলা উচিত এমন ভাবতে ভাবতে একটা একটা নিশ্চিত ভাল দান মিস করি। গোলাপ আমার পাকা গুটি খেয়ে ফেলে। আমি কাঁচা গুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।
সে বলে, “আমার বর নতুন করে একজনের প্রেমে পড়েছে তো। বাইরের প্রেমটা আসলে যখন বৈধ মনে হয়, তখন ঘরের বিয়েটাই অবৈধ হয়ে যায়।”
গোলাপ জিতে যাচ্ছে। কেমন একেঁবেঁকে গুটি পাকা করে ঘরে তুলছে।
আমি বলি, “তবু থেকে গেলেন?”
সে বলে,”কই যাব? ফিরে যাবার তো ঘর নাই।”
গোলাপ জিতে যায় খেলায়। লড়াকু গোলাপ। কেটে কেটে তার লুডুর পাকা ঘর খুঁজে নেয়। আমি প্রতিবার বলি- গোলাপের ঘর। গোলাপ হাসে। মন্ত্রের মতন বলি। বার বার বলি। প্রতিবার খেলতে খেলতে বলি- এই যে পাকা ঘর, গোলাপের ঘর।
আমি জানি, এমন করে গুটি কেটে কেটে লাল-হলুদ লুডুর পাকা ঘর খুঁজে নিতে নিতে গোলাপ, তার সত্যিকারের ফিরে যাবার ঘরও খুঁজে নেবে। তার নিজের ঘর। কত কত বসন্ত-বন্দি সময় কাটানো ঘর থেকে নিজের কাছে ফিরে যাবার ঘর সে খুঁজে নেবে। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করেই যাই- পৃথিবীর ক্রান্তিকাল শেষ হবে, গোলাপেরও। আর ততদিন পর্যন্ত আমি গোলাপের সাথে লুডুর পাকা ঘরের খেলা খেলে যাবো। লড়াই করে খেলতে খেলতে শুনিয়ে যাবো, সেই মন্ত্র প্রতিবার- ‘গোলাপের ও ঘর আছে’ ।
আর যেদিন গোলাপ এসে আমাকে জানাবে, সে তার নিজের কাছে ফিরে যাবার পাকা ঘর খুঁজে পেয়েছে, আমি তাকে গভীর আনন্দে আল্হাদে বলব, “বাড়ি কি পেয়েছো তুমি?”
আমি জানি সেদিন সে ‘আলোর তরল জলে ভেসে’ নিশ্চয়ই বলবে,
“বাড়ি তো পেয়েছি আমি বহুদিন –
মনে-মনে,
বাড়ি চাই বাহির-ভুবনে।”