নজরুলে উপনীত হওয়ার বন্ধুর পথ
২৭ আগস্ট ২০২০ ১৬:৩৫
মেহেদী উল্লাহ
বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল কাইউম ‘নজরুল-চর্চার ধারা ও প্রকৃতি’ প্রবন্ধে আশান্বিত হয়ে বলেছিলেন,‘লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যতই দিন যাচ্ছে, আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নজরুল ইসলামের গুরুত্ব ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই সঙ্গে নজরুল-চর্চার ক্ষেত্রও ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে।’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার সার্বিক নজরুল-চর্চার ধারা ও প্রকৃতি বিষয়ে এই মন্তব্য করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এই বিস্তৃত ক্ষেত্রে কতটা নজরুলে উপনীত হতে পেরেছি? আমার ‘নজরুল বিষয়ক সংকলন চর্চার ধরন’ গ্রন্থের একটি অধ্যায়ে আমি মোহাম্মদ আবদুল কাইউম-এর উদ্ধৃতি ব্যবহার করেই দেখানোর চেষ্টা করেছি প্রকৃত বাস্তবতা আসলে কেমন।
মোহাম্মদ আবদুল কাইউম মত প্রকাশ করেছেন, ‘উভয় বাংলার লেখকগণই নজরুল সাহিত্যের বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। যথার্থ গবেষণাধর্মী রচনা তুলনামূলকভাবে কম, একথা অনস্বীকার্য। তার প্রধান কারণ, নজরুলের জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কিত তথ্যাদি পশ্চিম বাংলার কোথাও সংরক্ষিত থাকলেও বাংলাদেশের কোথাও নেই বললেই চলে। নজরুলের জীবনী রচনার বিভিন্ন পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ তথ্যের তুলনামূলক বিচার আবশ্যক। নজরুলের সমকালীন পত্র-পত্রিকায় নজরুল সম্পর্কে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে; তাও সংগৃহীত হয়নি।’ তার মানে বুঝতে অসুবিধা হয় না, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের বেশ অভাব রয়েছে। এই তথ্য-সংকট ও একই সঙ্গে তথ্যের গড়মিল নজরুল জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়।
মোহাম্মদ আবদুল কাইউম আরো তথ্য দেন যে, সমকালীন পত্র-পত্রিকার কিছু বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া গেলেও অধিকাংশই পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন গ্রন্থাগারে অথবা ব্যক্তিগত সংগ্রহে সংরক্ষিত আছে। সমকালীন পত্র-পত্রিকায় নজরুলের গ্রন্থসমূহের যে সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে, তা আংশিক সংগৃহীত হলেও সম্পূর্ণ সংগৃহীত হয়নি। ফলে, সমকালীন সমালোচকের দৃষ্টিতে নজরুলের পূর্ণ পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়নি। নজরুলের সমকালীন দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্রে নজরুল সম্পর্কিত যেসব সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল তারও পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহ ও সংকলন আবশ্যক। নজরুলের গ্রন্থাদির আদি সংস্করণ বিভিন্ন গ্রন্থাগারে রয়েছে। ঢাকার বাংলা একাডেমি কর্তৃক নজরুল রচনাবলী সম্পাদনাকালে সবগুলি গ্রন্থের প্রথম বা আদি সংস্করণ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। নজরুল সাহিত্যের বিশুদ্ধ পাঠ নির্ধারণের জন্য তা সংগৃহীত হওয়া আবশ্যক। একই সমস্যা নিয়ে মন্তব্য করেছেন মুস্তফা নূরউল ইসলামও। তিনি সমকালে নজরুল ইসলাম গ্রন্থে তিনি বলেন, ‘নজরুল-অধ্যয়নে আগ্রহী ব্যক্তিমাত্রেরই সাধারণ অভিজ্ঞতা যে, নজরুল ইসলাম এবং তার কর্মকাণ্ড, তার সৃষ্টি-সাধনা সম্পর্কিত তথ্যাদি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলী সহজলভ্য নয়। উপরন্তু প্রাপ্ত উপকরণসমূহের প্রামাণিকতা নিয়েও পণ্ডিতজনের মধ্যে নানা বিতর্ক। ফলে নিশ্চিত, নজরুলে উপনীত হওয়ার পথ ইতিমধ্যেই জটিল-বন্ধুর হয়ে উঠেছে। (পৃষ্ঠা: ১৩)
এই দুটি মন্তব্যকে আমলে নিয়ে আমি আমার গ্রন্থে বলেছি, এমন হবার কারণের মধ্যে অন্যতম কবি স্বয়ং। স্বভাব-বৈশিষ্ট্যে অগোছালো এই কবি কখনো ডায়রি লিখতেন বলে জানা যায় না। আপন রচনার স্থান, তারিখ সম্বলিত প্রতিলিপিও নিয়মিতভাবে রক্ষা করেন নি। চিঠিপত্র লিখলেও সেগুলোর প্রতিলিপি নেই। আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, তার অকালে অসুস্থতা। এসব কারণে, নতুন বিষয়ে গবেষণা যেমন কম হয়েছে তেমনি প্রকৃত নজরুল ইসলাম কী ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছেন- এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে আশার কথা, এই অভাব কিছুটা হলেও ঘুচিয়ে দিয়েছে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত ‘সমকালে নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থটি। নজরুল চর্চার ধারায় উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ। গ্রন্থের সম্পাদক নজরুলের সমকালে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে নজরুল-বিষয়ক সংবাদ, মন্তব্য ও সমালোচনা সংকলন করেছেন। নজরুলের জীবনী রচনায় বা নজরুল সাহিত্য বিচারে এ গ্রন্থটি একটি অপরিহার্য উপাদান বলেই আমার কাছে বিবেচিত।
গ্রন্থের শেষাংশে নজরুলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের স্মৃতিকথারও অংশবিশেষ উদ্ধৃত হয়েছে। নজরুল সুস্থাবস্থায় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পরিভ্রমণ করেছেন। সেসব অঞ্চলে গমন, অবস্থান বা সংবর্ধনা সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পরোক্ষ উপাদান অবলম্বনে নজরুলের কিছু ভ্রমণ-বৃত্তান্ত রচিত হয়েছে। সেগুলোও নজরুল বিষয়ে নতুন তথ্যের সন্ধান দিয়েছে। এছাড়াও নির্ঘন্ট জাতীয় উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘নজরুল নির্দেশিকা’(১৯৬৯)। নজরুল নির্দেশিকায় নজরুলের প্রায় সমস্ত রচনার কালানুক্রমিক ও বর্ণানুক্রমিক সূচী এবং উৎসপঞ্জি সংযোজিত হয়েছে। নজরুলের কোন রচনা কখন এবং কোথায় প্রথম প্রকাশিত হয়, সে তথ্য গবেষকদের গবেষণার মূল্যবান উপাত্ত স্বরূপ। নজরুল বিষয়ক যে কোনো তথ্যের জন্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ মাহবুবুল হক রচিত ‘নজরুল তারিখ অভিধান’, প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে। কবির জীবন ও কর্ম, সৃষ্টি ও সাধনার কালানুক্রমিক ও ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত রচনার প্রয়াস নজরুল তারিখ অভিধান। গ্রন্থটিতে প্রামাণ্য তথ্য ও আকর-উপাদানের ভিত্তিতে ড. মাহবুবুল হক নজরুল জীবনী পুনর্গঠনে ব্রতী হয়েছেন। নজরুলের জীবন বিষয়ক যে কোনো নতুন প্রবন্ধ সৃষ্টিতে এটি সহায়ক। (মেহেদী উল্লাহ, নজরুল বিষয়ক সংকলন চর্চার ধরন)
প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগেই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতার জন্য নজরুল পাঠকমহলে নন্দিত ও সমাদৃত হতে শুরু করেছিলেন। করাচী সেনানিবাস থেকে কলকাতায় আসার পর তার সাহিত্য চর্চার প্রথম বছরেই ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘খেয়া-পারের তরণী’ কবিতাটি। এই কবিতা পড়ে মোহিতলাল মজুমদার কবিকে অভিনন্দন জানিয়ে পত্রিকায় যে সমালোচনা পত্র পাঠিয়েছিলেন সেখান থেকেই মূলত শুরু হয়ে যায় নজরুল সৃষ্টির ব্যাখ্যা কিংবা সাহিত্য সমালোচনা। পরবর্তীকালে নজরুল বিভিন্ন সময়ে অভিনন্দিত হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ নাটকের উৎসর্গ পত্রে, ‘ধুমকেতু’ পত্রিকার শুভেচ্ছা বাণীসহ সমকালীন বিশিষ্টজনদের নানা লেখাপত্রে।
১৯৪২ সালে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯২০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত সময়কালকে আমরা নজরুলের সক্রিয়কাল বলে জানি। কিন্তু এই দীর্ঘ ২২ বছরে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন প্রবন্ধ লেখা হলেও নজরুলের সৃষ্টিকর্মের সমালোচনামূলক কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। নজরুল বিষয়ে প্রথম গ্রন্থ আবুল ফজলের ‘বিদ্রোহী কবি নজরুল’, প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল মাসে। এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে নজরুল-চর্চার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে একের পর এক এ ধরনের প্রয়াস লক্ষণীয় হলেও সেসময় নজরুল চর্চার প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল, নজরুল রচিত অনেক গ্রন্থের দুষ্প্রাপ্যতা। ‘অগ্নি-বীণা’, ‘সঞ্চিতা’ প্রভৃতি কয়েকটি জনপ্রিয় গ্রন্থ ছাড়া অধিকাংশ গ্রন্থই দীর্ঘকাল অপ্রকাশিত ছিল। এছাড়া ৫টি গ্রন্থ ছিল নিষিদ্ধ। ফলে জীবদ্দশাতেই নজরুল সাহিত্য সমালোচনা একটা সংকটে পড়ে গিয়েছিল।
অধিকাংশ সংকলনে একই বিষয়ের লেখা বারবার এবং একই প্রবন্ধের পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। এই সংকটকে স্পষ্ট করে দেখাতেই আমার গ্রন্থে তালিকাকারে একই বিষয়ের, প্রায় কাছাকাছি বিষয়ের ও একই শিরোনামের প্রবন্ধগুলোকে আমি বোল্ড করে পরিবেশন করেছি। (পৃষ্ঠা: ৪১-৫৩) তালিকাটি দেখলেই বোঝা সম্ভব কী পরিমাণে রিপিটেশন রয়েছে সাহিত্য সমালোচনায়। এই ছোট পরিসরে তা দেখানো সম্ভব নয়।
নজরুল সাহিত্য সমালোচনা নিয়ে প্রকাশিত কয়েকটি সংকলনের বিশেষ দুর্বলতা হচ্ছে, সংকলনের নামের সঙ্গে ভেতরে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধসমূহের সমন্বয়হীনতা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন: আবু ইসহাক হোসেন সম্পাদিত সংকলনের নাম ‘বাঙালির নজরুল’। কিন্তু সংকলনে বাঙালির নজরুল বিষয়ের উপর প্রবন্ধের সংখ্যা হাতে গোনা। অধিকাংশেরই সংকলনের নামের সঙ্গে সাদৃশ্য নেই। বাঙালির নজরুল নামটি সার্থক হয়ে উঠতো তখনই যখন নজরুল ও বাঙালি বিষয়েই প্রবন্ধগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হতো। কিন্তু সে অন্বয় রক্ষিত হয়নি। এক্ষেত্রে সংকলনটিতে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলো দেখলে সহজেই অনুমান করা যায়, ‘নজরুলের মানসভঙ্গি, নজরুলের লোকায়ত ও সাম্যবাদী চেতনা, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নজরুল, নজরুল সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, নজরুল সাহিত্যে মানুষতত্ত্ব, নজরুল সাহিত্যের ভাষা বৈশিষ্ট্য, যদি বাঁশি আর না বজে, নজরুল ও গণমাধ্যম, প্রসঙ্গ: সাম্যবাদী, নজরুল-রচনায় মানবতা, শ্রুতিতে নজরুল সঙ্গীত, নজরুল প্রবন্ধ সাহিত্য, নজরুলের ধর্মভাবনা প্রভৃতি। এমন আরো উদাহরণ দেওয়া সম্ভব। সম্পাদনার এই ক্রটির দায়ভার কোনোভাবে সম্পাদক এড়াতে পারেন না। সংকলনের বিষয় নির্বাচন ও সেই মোতাবেক বিশেষজ্ঞ প্রবন্ধকার নির্বাচন করে বিষয়ানুগ লেখা লিখিয়ে নিয়ে প্রকাশ করতে পারলেই সম্পাদকের সার্থকতা। বিষয় ও অন্তভুর্ক্ত প্রবন্ধের অসামঞ্জস্যতার কারণে সম্পাদনা মানহীন ও দুর্বল হিসাবে আখ্যায়িত হতে পারে অগ্রসর পাঠক সমাজে বা গবেষকের দৃষ্টিতে। ‘বছরের পর বছর প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে নেই খুব বেশি নতুন বিষয়ের উপস্থিতি। একদিকে নজরুল চর্চার প্রয়োজনীয়তার দায়, অন্যদিকে নতুন বিষয়ের লেখার অভাবের দায়; দুটি ঘোচাতেই যেন হিমশিম খেতে হয়েছে সম্পাদকদের। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই বিষয়ের লেখা ও পুনর্মুদ্রন কৌশল বেছে নিয়ে আকার ঢাউস করলেও তা পাঠকের নতুন প্রয়োজনের চাহিদা খুব কমই মিটিয়ে এসেছে। সেই কারণেও নজরুলের সাহিত্যকর্ম নিয়ে নতুন চিন্তা ও বিশ্লেষণের অভাব ফুটে উঠেছে গত তিন-চার দশকে।’ (মেহেদী উল্লাহ, নজরুল বিষয়ক সংকলন চর্চার ধরন, পৃ: ৫৯)
অধিকাংশ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলোর আরেক ধরনের সমস্যা হচ্ছে, ঢালাও বিষয়। অর্থাৎ, মূল্যায়নের প্রেক্ষিত বা দৃষ্টিভঙ্গি শিরোনামে অনুপস্থিত। যেমন, এই ধরনের বিষয়গুলো হচ্ছে, নজরুলের গল্প, নজরুলের উপন্যাস, নজরুলের নাটক, নজরুল কবিতার ছন্দ, বিদ্রোহী কবি প্রভৃতি। এই ধরনের বিষয়গুলোকে মূল্যায়নের প্রেক্ষিত-বর্জিত মনে হয়েছে। অর্থাৎ, নজরুলের নাটক, কিন্তু কোন প্রেক্ষিত থেকে একে মূল্যায়ন করা হচ্ছে তা শিরোনামে অনুপস্থিত। নজরুলের নাটক, উপন্যাস, কবিতা বিভিন্ন প্রসঙ্গে ঋদ্ধ। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ থেকে প্রবন্ধকার কোন প্রসঙ্গ-এর মূল্যায়ন করেছেন সেটি শিরোনামে বলা নেই। এমনকি ভেতরেও পড়তে হচ্ছে নাটক, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাদি নিয়ে বিচ্ছিন্ন মূল্যায়ন।
কবির স্মৃতিকথামূলক বিভিন্ন প্রবন্ধ নানা সংকলনগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। কোনো কোনো স্মৃতিচারণ পরিমার্জন বা বর্ধিতকরণ বা পরিবর্তন ছাড়াই একাধিক গ্রন্থে লক্ষ করা যায়। তবে এসব সংকলন-গ্রন্থের সম্পাদকগণ স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধের মূল উৎস অর্থাৎ কোন গ্রন্থ বা পত্রিকা থেকে উদ্বৃত বা সংগৃহীত, সে তথ্য উল্লেখ করেন নি বা বলা যায় দায় এড়িয়ে গেছেন। এতে সংকলনের মৌলকতা ও বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। যা যে কোনো মানসম্পন্ন সম্পাদনার নীতি-বিরুদ্ধ। এছাড়াও আরেকটি ক্রটি প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। তিনি বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, স্মৃতিকথা-জাতীয় কোনো কোনো রচনায় নজরুল যতটা না উপস্থিত, তার চেয়ে রচয়িতা নিজে অধিকতর জায়গা জুড়ে আছেন। নজরুলের কে কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তার পরিচয় প্রদানই অনেকক্ষেত্রে মুখ্য হয়ে উঠছে। যেহেতু অধিকাংশ রচয়িতাই প্রৌঢ় বয়সে স্মৃতিকথা লিখেছেন, সে কারণে প্রচুর স্মৃতিবিভ্রমেরও নিদর্শন মেলে এসব স্মৃতিকথায়।’
নজরুলের জীবন ও সাহিত্যের নানাদিক, তার প্রতিভা ও অবদানের সব দিকের সমানুপাতিক আলোকপাত এখনো পর্যন্ত ধৃত হয়নি। নজরুলের কবিতা ও নজরুল সঙ্গীতের কথা নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে, সুর ও স্বরলিপি নিয়ে গবেষণা ও মূল্যায়ন হয়নি। তাই নজরুল সাহিত্য সমালোচনার সংকলনগুলোতে এ বিষয়ক লেখা অনুপস্থিত। তবে একটি সত্য স্বীকার করতে হবে, ষাটের দশকে নজরুল একাডেমি ও আশির দশকে নজরুল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সার্বিকভাবে ও প্রাতিষ্ঠানিক বাতাবরণে নজরুল গবেষণা ব্যাপকতা লাভ করে একটি বৃহৎ পরিসর পরিগ্রহ করেছে। নজরুল সঙ্গীত নিয়ে মানসম্মত গবেষণা যা হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানদ্বয় থেকেই হয়েছে।
সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভাবের গোড়াতেই নজরুলের মৌলিক কবি-প্রতিভা, তার স্বাতন্ত্র্য ও শক্তি আর সামাজিক ভূমিকা প্রাজ্ঞজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও বিদ্রোহীচেতনার রূপকার, ঔপনিবেশিকতা, শোষণ-বঞ্চনা, গোঁড়ামি আর প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব বিদ্রোহী কবির প্রতিভা ও সৃষ্টির মূল্যায়ন সমকালে হয়নি। হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজের সংকীর্ণমনা, ধর্মান্ধ এবং ঈর্ষাকাতর মহলের তীব্র আক্রমণের শিকারও তাকে সেকালেই হতে হয়েছে। নজরুলের কবিমানস এবং প্রতিভার স্বরূপ উপলব্ধি ও নিছক গোঁড়ামির দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করে একশ্রেণির সমালোচক বাংলা সাহিত্যে ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্যের অসাধারণ রূপকারকে ‘কাফের’ ফতোয়ায় চিহ্নিত করতেও দ্বিধা করেনি। অন্যপক্ষে, একশ্রেণির গোঁড়া হিন্দু-সমালোচক বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-ঐতিহ্যের অতুলনীয় রূপকার ও হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির বাণীবাহক নজরুলকে ‘যবন; বলে ধিক্কার জানাতে দ্বিধা করেনি। আশার কথা, বর্তমানে এ পরিস্থিতি পাল্টেছে। কবির উপর আরোপিত অন্যায্য, অজ্ঞনতা, অমূলক ও অবিবেচনাপ্রসুত তকমাসমূহ যুগের বিবেচনা ও সময়ের হিসাবে লুপ্ত হয়েছে।
*লেখাটি রচনায় লেখক তার নজরুল বিষয়ক সংকলন চর্চার ধরন গবেষণাগ্রন্থের ‘সংকলনচর্চার ধরন : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ অধ্যায়ের সাহায্য নিয়েছেন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ
সারাবাংলা/এসবিডিই