কাঁদতে জানে বেনারসি
২৮ আগস্ট ২০২০ ১২:০০
গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্র পায়ে চলা অগণিত মানুষের দ্রোহ দেখে কমল। সে মানুষের মিছিল যাওয়া দেখে। তারও ইচ্ছা করে মিছিলে যোগ দিতে। ইচ্ছা করে গলা ফাটিয়ে কিছুক্ষণ চিৎকার করতে। কিন্তু মিছিলে যাওয়ার সময় নেই তার। তাকে যে কোনোভাবেই হোক ঢাকা থেকে আজকের মধ্যে পৌঁছাতে হবে গ্রামে। বাড়িতে অপেক্ষায় কমলের মা, ছোট বোন আরতি, অপেক্ষায় আছেন কালু মামা।
দুইদিন পর কমলের ছোট বোনের বিয়ে। হরতাল-অবরোধের এই দুঃসহ-দুঃসময়ে কৌশলে লাল একটা বেনারসি শাড়ি জোগাড় করেছে বোনের জন্য। এটি বোনের জন্য কেরানি ভাইয়ের ছোট উপহার।
এই যে শান্ত দেশটি ক্রমে ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, কোথাও না কোথাও বারুদের গন্ধ কিংবা রক্তের দাগ লেগে। হয় মারামারি, না হয় গোলাগুলি এখন গা সওয়া ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব দোষ জেনারেল এরশাদের। ছলচাতুরিতে এতগুলো বছর ক্ষমতায় আসে চেয়ার ছাড়ার নাম নেই। ‘এবারের সংগ্রাম বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার সংগ্রাম’ এই ঘোষণা দিয়ে ধর্মভীরু মানুষগুলো নিজের দিকে নিতে চেয়েছেন জেনারেল। কিন্তু মানুষ ধর্মের কথা না ভেবে কথা বলার স্বাধীনতা খুঁজছে। জনদাবি উঠেছে, এরশাদের পতন চাই, স্বৈরাচার নিপাত যাক।
এই ৯ বছরে এরশাদ রাস্তাঘাট করেছে, উন্নয়নও হয়েছে ঠিক। কিন্তু পুরো দেশটা যেন ক্যান্টনমেন্ট। মানুষের কথা বলার অধিকার নেই। কথা বলতে গেলে হয় গুলি, না হয় জেলখানায় মানুষ আটকে রাখা হচ্ছে।
তিনদিন আগে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে গৃহবন্দি করে রেখেছে এরশাদ সরকার। ঘরের বাইরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তাকে নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ-গোয়েন্দারা। এদিকে বিএনপি সভানেত্রী খালেদা জিয়া গ্রেফতার এড়িয়েছেন। পুলিশের নাগাল ছেড়ে তিনি চলে গেছেন গোপন আস্তানায়। ফলে প্রধান দুই দলের আন্দোলন এখন জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
এরশাদের পতন চেয়ে লাঠি মিছিল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। মিছিল শেষে পিজি হাসপাতালের দিকে যাওয়ার পথে বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম খান মিলনকে হত্যা করা হয়েছে। সহকর্মীকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে ডাক্তাররা ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আন্দোলনে গেছেন আইনজীবীরাও। স্বৈরাচার সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা লাগাতার কর্মবিরতি দিয়েছেন। সরকারবিরোধী তিন জোট হরতাল দিয়েছে। একইসঙ্গে চলছে কারফিউ ও লাগাতার হরতাল।
হোক হরতাল-অবরোধ। যে কোনো উপায়েই হোক কমলকে তার বাড়িতে পৌঁছতে হবে।
পল্টনে তোপখানা রোডে হঠাৎ জড়ো হওয়া লাখো লাখো মানুষ এদিক-সেদিক দৌড়াতে শুরু করে। কেউবা দৌড়ে পালায় আবার কেউবা পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। কাঁদানে গ্যাসে অনেকের সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কমল। তার হাত থেকে ছিটকে পড়ে বোনের জন্য কেনা বেনারসি শাড়িটি। জ্ঞান ফিরলে কমল নিজেকে আবিষ্কার করে এক আবছা অন্ধকার ঘরে। কমলের সঙ্গে আরও কয়েকজন।
ওই অন্ধকার ঘরে কেউ কেউ সব চিন্তাভুলে একে অপরের সঙ্গে ফিসফিস করে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। কমল চুপচাপ বসে আছে। একজন আরেকজনের কাছে জানতে চায় ঢাকার মিরপুরে বিডিআরের গুলিতে আটজন নিহত হয়েছিল তার খবর কী? চট্টগ্রামে কালুরঘাটে শ্রমিকদের মিছিলে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয় একজন তার খবর কী? খুলনায় এরশাদের কুশপুত্তলিকা বহনের সময় গুলিতে মহারাজ নামে এক রিকশাচালক মারা গেছে তার খবর কী? কমল বুঝতে পারে এরা আন্দোলনকর্মী। রাজনীতির হাল-হকিকত সব তাদের জানা। কিন্তু কমল তো এ সবের কিছুই না। একটা স্কুলে কেরানির চাকরি করতে। হরতাল-অবরোধে সেই স্কুলটি আপাতত বন্ধ।
অনেকদিন মায়ের কাছে যাওয়া হয়নি কমলের। নিতান্ত উৎসব ছাড়া যাওয়া হয় না তার। এই অন্ধকার ঘরে হাঁটুমুড়ে বসে থাকা অবস্থায় মাকে খুব মনে পড়ছে কমলের। মনে পড়ছে ছোট বোন আরতির কথা। বয়সে কমলের বছর সাতেক ছোট হলেও দুষ্টুমিতে সে অনেক। কমলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে টেবিল থেকে মাঝেমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খাতাটি লুকিয়ে রেখে নানারকম কালি দিয়ে কোনো এক মেয়ের ছবি একে বলত, ‘জানো দাদা এই মিষ্টি মেয়েটি আমার বউদি। দেখো, তোমার সঙ্গে ভালো মানাবে।’ কমল হাতাহাতি শুরু করত রাগে। সুযোগ পেয়ে পালিয়ে যেতে ভুল করত না আরতি। আবার কখনওবা খাতার ওপরে হুঁতোম পেঁচার ছবি একে বলত, ‘দাদা তোর মুখটা ঠিক এরকম। চোখ দুটো কেমন যেন বিশ্রী।’ আবারও দুষ্টু, আবারও পালিয়ে যাওয়া।
বাবা অনেক আগে মারা গেলেও সংসারের দায়িত্ব কমলের কাঁধেই এসে পড়ে। কমলের মনে পড়ছে মায়ের লেখা চিঠির কথা। এই চিঠি পেয়েই সে যেতে চাই গ্রামে।
নিজের ঘরে নিঃশব্দ বিকেলে শুয়ে ছিল কমল। আজ তিন বছর ধরে এই রুমটিকে এমনভাবে কখনও দেখেনি সে। সাদা রং করা দেয়ালে মাঝে মধ্যে খসে পড়েছে চুন। ঘরের ছাদে মরচে পড়া কালো রড চোখে পড়ে কোথাও। এমন সময় দরজার এসে চিঠি দিয়ে যায় ডাকপিয়ন। মায়ের চিঠি। মা লিখেছে, বোন আরতির জন্য ছেলে ঠিক করা হয়েছে। তোমার কালু মামা বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক করেছে। ছেলে দেখতেও সুন্দর, ব্যবসা করে। ইনকামও ভালো।
বিয়ের কথা জানার পর থেকেই আরতি কান্নাকাটি শুরু করেছে। মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা, আমি কি তোমাদের বোঝা হয়ে গেছি মা? আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাও? আচ্ছা যখন তাড়িয়ে দিতে যাও যেন দাদা আসে বাড়িতে।
মা চিঠিতে আবদার লিখেছে, জানি দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। এই অবস্থায় তোকে ঢাকা থেকে আসতে বলতাম না। কিন্তু পাত্রপক্ষের জোরাজুরি। মেয়ের বিয়েটা হলে একটা চিন্তাও কমে।
বোনের বিয়ে বলে কথা। হরতাল-অবরোধের এই দিনে বহু কষ্ট করে একটা শাড়ি ম্যানেজ করতে পেরেছে কমল। পরিচিত এক দোকানি পিকেটারদের চোখ ফাঁকি দোকান থেকে বের করে দিয়েছিল লাল রঙের বেনারসি শাড়িটি।
শাড়িটি হাতে নিয়ে কমল ছোট বোনের বিয়ের পিঁড়ি আর সাতপাঁকে বাধার ঘটনা কল্পনা করে। মনে মনে বলে অন্যের ঘরে বউ হয়ে যাওয়ার মতো এত বড় হলি কবে পাজি?
আজই কমলকে তো বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল। ভেবেছিল হরতালে বন্ধ রাস্তাঘাট। ঢাকার অবস্থা সামনের দিনগুলো কী দাঁড়ায় অনুমান করা যাচ্ছে না। ক্ষমতায় থাকার জন্য এরশাদ বেপরোয়া হয়েছে। মানুষ বাঁচানোর চেয়ে গদি বাঁচানো তার একমাত্র কাজ। বিক্ষুব্ধও জনতাও কারও কথা শুনছে না। বেহায়া এরশাদও কথা শুনছে না। কথা শুনছে না সেনাবাহিনী, কথা শুনছে না পুলিশ। বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করার চেয়ে গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে শক্তি ব্যয় করছে বাহিনীগুলো। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মৃত্যুর খবর আসছে, হাঙ্গামার খবর আসছে।
এই অবস্থায় ঢাকায় থাকার চেয়ে বোনের বিয়ের উছিলায় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন বসে থাকা ভালো। পথে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে তাহলে বেনারসি শাড়ির প্যাকেট দেখিয়ে বলবে তার বোনের বিয়ে।
কষ্ট করে সদরঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে হয়। নিশ্চয় চাঁদপুর থেকে আসা মাছবাহী কোনো ট্রলার পেলে তাতেই চড়ে রওয়ানা দেবে। চাঁদপুরের হাইমচরের লঞ্চঘাটে নামলেই মাঝিবাড়ি গ্রাম। বাড়ি যাওয়ার বদলে কমলে ঠাঁই হয়েছে এই কারাগারে। হরতালে মিছিলে অংশগ্রহণের সন্দেহে পুলিশ যাকে পেয়েছে তাকেই ধরেছে। কমলও বাদ যায়নি। সে গোমরা মুখে বসে আছে। কমলের মা অপেক্ষায় আছে, বোন বেনারসির অপেক্ষায় আছে।
কমল কারাগার থেকে কবে মুক্তি পাবে কি না জানা নেই! আদৌও কি পাবে? কারাগার থেকে বের হয়ে সে কি ওই স্কুলে আবার কেরানির চাকরিটি করতে পারবে?
কমল হারিয়ে বেনারসির কথা ভাবে আর বিড়বিড় করে বোনের উদ্দেশ্যে বলে, অন্যের ঘরে বউ হয়ে যাওয়ার মতো অতবড় হলি কবে পাজি? কমল কাঁদছে। হাইমচরের মাঝিবাড়ি গ্রামে কমলের মা কাঁদছে, বোন কাঁদছে। তোপখানা রোডে হারিয়ে যাওয়া বেনারসি শাড়িটিও হয়ত কাঁদছে।