Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রম্যগ্রন্থ আলোচনা: কে এই আবদুল মালেক?


৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৯:২৯

‘‘ তিনিই প্রথম দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে; উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। তিনিই প্রথম দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়। তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে।’’

কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। বঙ্কিমচন্দ্র চট্যোপাধ্যায়ের হীরকোজ্জ্বল কৌতুকরস সম্পর্কে গুণমুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রদ্ধার্ঘ্য। আর এই কথাগুলো মুদ্রিত আছে ‘বাংলা সাহিত্যের নির্বাচিত রম্যরচনা ও গল্প’ গ্রন্থের ভূমিকার শীর্ষদেশে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সঙ্গীতজ্ঞ ও গোলাপ-বিশেষজ্ঞ আব্দুস শাকুর। তিনিই আবার পরশুরামের সেরা হাসির গল্প গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘নেহাত কাটছাঁট করে বলতে গেলে, হাসির জনক-জননী হল আবেগ আর বুদ্ধি। পরস্পরের অসমান গতি সম্পন্ন হওয়ার দরুন পরিস্থতি-বিশেষে মানুষের আবেগ এবং বুদ্ধির মধ্যে লুকোচুরির খেলা চলে এবং অন্তে দুই বিপরীতের সম্মিলনে, উঞ্চ বায়ু ও শীতল বায়ুর সংমিশ্রণের মতো বাষ্পীভূত যে ফলটি ফলে, তাকেই হাসি বলে। মগজের ছাদে অবস্থিত নিওকর্টেক্সই বুদ্ধির একমাত্র উৎস বলে ওটি দ্রুতগামী। বুদ্ধি লাফিয়ে চলে, তো আবেগ চলে গড়িয়ে।… স্থানাভাবে ব্যাখ্যাার বখেড়ায় না গিয়ে এখানে আমি কেবল গ্রহণযোগ্য কয়টি সিদ্ধান্ত উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হতে চাই যে : উইট হচ্ছে হিউমারের উন্নয়নের উপাদান, বুদ্ধিপ্রধান বৈদগ্ধরসরূপে প্রাণবান হাস্যরসের শক্তি সঞ্চারীজ্ঞাতি ; অর্থাৎ হিউমার যদি হয় মানসিক অবস্থা, উইট তবে মানসিক শক্তি; হিউমার যদি বিশেষ, উইট তবে নির্বিশেষ এবং এই নির্বিশেষের নেহাত জীবানুসৃতি হয়ে ওঠে মহতী শিল্পকৃতি…’’

বিজ্ঞাপন

হিউমার এবং উইট ; একটা হচ্ছে হাস্য রসাত্মক, আরেকটা ব্যাঙ্গ বিদ্রুপাত্মক। হিউমার অনেকটা নির্মল হাসি। উইট হচ্ছে গোলাপ স্পর্শ করতে গিয়ে কাঁটার আঘাত। যে মাধ্যমটিকে আবার সৈয়দ মুজতবা আলী বিশিষ্টতা দান করেছেন। তিনি শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলিম ছাত্র। সিলেটে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য উপভোগ করে আকৃষ্ট হন তিনি এবং পরবর্তীতে পত্র যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে শান্তি নিকেতনের ছাত্রত্ব গ্রহণের সুযোগ লাভ করেন। তাঁর সহপাঠী প্রমথনাথ বিশী-ও প্রখ্যাত রম্য সাহিত্যিক। একই বিষয় নিয়ে পাদটীকা ও গঙ্গাধর পত্নি নামে দু’জনের দু’টি আলাদা রম্যগল্প আছে। দু’টি গল্পই হুল ফোটানো বিদ্রুপাত্মক গল্প।

বঙ্কিমচন্দ্র এবং উপরোক্ত দু’জন তো আছেনই। এছাড়া বাংলা রম্য সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেছেন, তারা হলেন কালিপ্রসন্ন, পরশুরাম, তারাপদ রায়, আবুল মনসুর আহমদ, শিবরাম চক্রবর্তী, বনফুল, চৌধুরী জহুরুল হক, আবদার রশীদ, সঞ্জীব চট্যোপাধ্যায় প্রমুখ। বছর দুয়েক আগে ‘আড্ডায় রসভঙ্গ’ নামে নাট্যকার রবিউল আলমের একটি রম্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী ফাহমিদা আমিন ও আতাউল হাকিমও রম্য ধারাকে সমৃদ্ধ করেছেন। এই লেখার শুরুতে যে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথেরও হাস্যকৌতুক ও ব্যঙ্গকৌতুক নামে দু’টি গ্রন্থ রয়েছে। এছাড়া ব্যঙ্গ বিদ্রুপাত্মক অসংখ্য রচনা রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। এই ধারাটি কাজী নজরুলও সমৃদ্ধ করেছেন।

এতোসব ফিরিস্তির কারণ, সম্প্রতি ‘উল্টো থেকে’ নামক একটি রম্যগ্রন্থ পাঠের সুযোগ হয়েছে। গ্রন্থটির প্রকাশকাল কিন্তু সম্প্রতি বা এখন নয়, একত্রিশ বছর পূর্বে। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৪ এপ্রিল ১৯৮৯ তে, ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখে। গ্রন্থকার আবদুল মালেক। প্রকাশক চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লাস্থ কোহিনূর লাইব্রেরী। কোহিনূর লাইব্রেরি এখন বিলুপ্ত। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন রফিকুন্নবী (রনবী)। এতো পুরনো একটি এই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে বিশিষ্ট গবেষক ড.ইলু ইলিয়াস ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার বদৌলতে। রম্য রচনা, রম্যগ্রন্থ, রম্য সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়ে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি তার ব্যক্তিগত গ্রন্থশালা থেকে বের করে ‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থটি পড়তে দিলেন। বাসায় এসে গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম।

বিজ্ঞাপন

গ্রন্থটির প্রচ্ছদও কেমন যেন উল্টো থেকে। গ্রন্থটিতে ষোলটি রম্য রচনা স্থান পেয়েছে। সেগুলোর কোনাটা গল্প, আবার কোনোটা গল্পচ্ছলে গদ্য রচনা।লেখাগুলোর অধিকাংশই সত্তর ও আশির দশকের বিষয় আশয় নির্ভর। এতে পাঠক সমাজ নির্মল আনন্দ উপভোগ ও বিদ্রুপ দর্শনের পাশাপাশি ইতিহাস -ঐতিহ্যেরও সন্ধান পাবেন। কোনো লেখা পড়ে মনে হয়েছে, এটা ষাটের দশকের শেষভাগে রচিত। যেমন, হাইওয়ান শার্ট (পৃষ্ঠা-৬৭), অথ বাস সমাচার (পৃষ্ঠা-৭১)। লেখাগুলোতে গ্রন্থকারের সুক্ষ রসবোধ ও তীক্ষ পর্যবেক্ষণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রন্থের সূচনা-রচনা ‘পিন সমাচার’ লেখাটিতে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। স্ট্রাপলার, স্কচ টেপ, জেমস ক্লিপ এসবের আগ্রাসনে এখনকার প্রজন্ম অবশ্য পিন এর ব্যবহার করেন না বললেই চলে। অথচ দেখতে সূঁই আর পেরাগের সংমিশ্রণ এই পিন এক সময় অফিস আদালত থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত নানা কাজে অপরিহার্য ছিলো। লেখক সেই সময়ে এই পিনের নানা রকম ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন রসিয়ে রসিয়ে পিনের হুল ফোটানো মেজাজে। লেখাটি শুরু হয়েছে এভাবে, ‘‘পিন, বিংশ শতাব্দীতে এ আবার কি প্রসঙ্গ? স্পুটনিক, গ্যাগারিন, ৫০ ম্যাগাটন, আইসিবিএম এ-সব গেল কোথায়? এদের বাদ দিয়ে তুচ্ছ নগন্য পিন? … পিন একেবারে পুঁচকে জিনিস, নিতান্ত তুচ্ছ, নগন্য। কিন্তু নাম আর আকৃতিতে ছোট হলেও কর্ম ক্ষমতায় এর পরিসর যে নেহায়েত ছোট নয় তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন? পিন কোথায় না বিরাজ করছে? আর কী কাজেই না লাগছে বলুন?” এরপর লেখক পিন নিয়ে আর পিন দিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রাচার ইত্যাদিকে হুল ফুটিয়ে শেষ করলেন এভাবে, ‘‘ সাম্প্রতিক কালের বিখ্যাত ছবি ‘অপুর সংসার’ দেখছেন। হঠাৎ দেখা গেল, সত্যজিৎ বাবু একটা নগন্য হেয়ার পিনকে প্রাধান্য দিয়ে দিলেন। একটা হেয়ার পিন দিয়ে যদি অনেক কিছু প্রকাশ করা সম্ভব হয়, তবে নগন্য পিন দিয়েই বা নয় কেন?’’

গ্রন্থের দ্বিতীয় লেখাটিই উল্টো থেকে। মানে ‘উল্টো থেকে’ শিরোনামে। লেখাটির প্রারম্ভিকা-‘‘লোকে বলে, হায়রে কপাল। আমি বলি, আমার কপাল। হ্যাঁ, আমার না হয়ে কার আর হবে? রাস্তায় এককালে চেয়ে চেয়ে দেখতাম, ধাবমান যন্ত্রদানব। আর এখন আমি তাতে চড়ি। ভিতর থেকে বাইরের চলমান লোক দেখি। তফাৎটা সেখানেই। যখন নিজে রাস্তায় হাঁটতাম তখন মনে হতো, সব গাড়িওয়ালা রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতের উপর দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছে। আর এখন গাড়ির মধ্যে বসে মনে হয়, তার ঠিক উল্টোটা। অর্থাৎ সব পথচারী ফুটপাত ছেড়ে রাস্তাটা দখল করে হাঁটছে। তাই, কি আর বলবো ! উল্টো থেকে দেখাটাই এখন আমার স্বভাবে পরিণত হয়েছে।’’

পাঠক, আবদুল মালেক কিন্তু উল্টো থেকে দেখার ঘোষণা দিয়ে শুধু এই লেখাটি নয়, গ্রন্থভুক্ত প্রতিটি লেখাতেই সোজাসাপ্টাভাবে সমাজের নানা গলদ, অসংগতি, রাষ্ট্রীয় গলদ, প্রাতিষ্ঠানিক গলদ, এমনকি ব্যক্তিগত দায়বোধ চিহ্নিত করেছেন। ওই যে বঙ্কিমের রম্য রচনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে’, এই গ্রন্থেও লেখক তাই করেছেন। গ্রন্থের শেষ লেখা ‘একটি সেমিনার ও বিরস ভবনা’ -তে আবদুল মালেক লিখেছেন, ‘‘প্রায় সব আলোচকই দাবি আদায়ের মোক্ষম যন্ত্র হিসেবে আন্দোলনের কথা বলেছেন। আমি বলি কী, আন্দোলনের অনিশ্চিত ধারায় না গিয়ে তেল দানের অব্যর্থ পথটি ধরলেই ভালো। খাঁটি সরিষার তেল না থাক, পাম অয়েল তো আছে! তেল নিঃসন্দেহে পথকে মসৃণ করবে।’’ তার এই কথাগুলো ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হলেও এখনকার আন্দোলনে ব্যার্থ রাজনৈতিক ও বুদ্ধিজীবী সংগঠন এবং তেলবাজ ক্ষমতালোভী গোষ্ঠীর জন্য সমধিক প্রযোয্য ও একটি মোলায়েম চপেটাঘাত। প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে, ‘‘তৈল যে কি পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম-স্নেহ। বাস্তবিকও- স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নহেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি। স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে, তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কিসে পারে? … যে তৈল দিতে পারে, সে সর্বশক্তিমান। কিন্তু তৈল দিলেই হয় না। দিবার পাত্র আছে, সময় আছে, কৗশল আছে। … কৌশল করিয়া এক বিন্দু দিলে যত কাজ হয়, বিনা কৌশলে কলস কলস ঢালিলেও তত হয় না।’’

গ্রন্থের পঁয়ত্রিশ পৃষ্ঠায় পাবেন ‘আন্দরকিল্লা’ রম্য রচনাটি। একটি সময়ে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান আন্দরকিল্লা বা আন্দরকিল্লার মোড় নিয়ে এবং এর চর্তুদিকের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও কর্মচঞ্চল মানুষদের নিয়ে রসের ভিয়েনে চুবিয়ে লিখেছেন রচনাটি। যেমন,‘‘ দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে, এই আন্দরকিল্লার মোড়। বলুন, কিসের অভাব এখানে? পূর্ব দিকে সুউচ্চ পাহাড়রাজি, দক্ষিণ দিকে লালদীঘি, পশ্চিমে জামে মসজিদ আর উত্তরে পৌরসভা। তেরাস্তার মাথায় এস লোকে পাগল হয় কিনা জানি না। তবে বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, দুখানা পাগল চিকিৎসালয় সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে এই মোড়ে। কখনো এই মোড়ে এসে যদি আপনার মাথায় ছিট্ দেখা দেয়, তবে হুঁশ করে এর যে কোন একটাতে ঢুকে পড়বেন।’’

লেখাটিতে সেই সময়ের আন্দরকিল্লার আরো কিছু বৈশিষ্ট্য এবং আন্দরকিল্লা মোড়ে এসে যেসব রাস্তা মিশেছে, সেগুলোর তথ্যবহুল রমণীয় উপস্থাপন করেছেন আবদুল মালেক। তবে, শুধু আন্দরকিল্লা নয়, নয় শুধু চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, কোহিনূর লাইব্রেরি, কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস এবং এখান থেকে প্রকাশিত এক সময়কার সাড়া জাগানো নারী বিষয়ক পত্রিকা ‘কোহিনূর’ নিয়ে তিনি কিছু লিখেননি বা এড়িয়ে গেলেন।

‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থটিতে রম্য কথার ফুলঝুরিতে লেখক রমণীয়ভাবে রোমন্টিকতাও প্রকাশ করেছেন। যেমন,‘ট্র্যাজেডী’ লেখাটিতে আছে, ‘‘যখন একটু মোচের রেখা ফুটতে আরম্ভ করেছে আর নতুন নতুন উপন্যাস পড়ছি তখনই একদিন খায়েশ হলো, হ্যাঁ প্রেমে পড়তে হবে … কোনো এক উপন্যাসে পেয়েছিলাম, নায়কের দেখা হয়েছিল নায়িকার সাথে বাসে। তাই বাস দিয়েই আরম্ভ করলাম। প্রায় এক বছর বাসে চড়লাম, কিন্তু নায়িকার দেখা পেলাম না।… উপন্যাসের আর এক নায়ক নায়িকার দেখা পেয়েছিলো এক সিনেমা হলে। সুতরাং এরপর আমিও সিনেমা দেখতে আরম্ভ করলাম। তাও আবার বেশি দামের সিটে বসে।’’

পাঠক, এসব বৈশিষ্ট্য কি বয়সন্ধিকাল বা আবহমান বাংলার তরুণ সম্প্রদায়ের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নয়? লেখকের রোমান্টিক বহিপ্রকাশের আরেকটি উদাহরণ দিই। ‘পিন সমাচার’ এ লিখেছেন ‘‘কোন পিয়জনকে চিঠি লিখছেন। তার সঙ্গে আপনার এত সহৃদয় সম্পর্ক যে, চিঠি কয়েক পৃষ্ঠার কম হয় না। হৃদয়ে হৃদয় গাঁথার বেদনায় আপনি ব্যাকুল। কিন্তু হৃদয় গাঁথতে না পারলেও আপনার চিঠির পাতাগুলো অন্তত গেঁথে দিলেন। এখানেও সেই পিন।’’

আবার লেখকের বাস্তবতাবোধ দেখুন। ‘লিভিং ট্র্যাজেডী’ লেখাটিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া যুবকের সময়কে আটকে রাখার প্রচেষ্টায় শেভ করার জন্য ঢুকেছে সেলুনে, ‘‘সামনেই সেলুনটা দেখে আপনি ঢুকে পড়লেন। একটা খালি চেয়ার পেয়ে বসে গেলেন। দাড়ি কামালেন। বের হওয়ার সময় আপনার পকেটের সর্বশেষ টাকাটি দিয়ে দিলেন। অবশ্য ফিরে পেলেন দশ আনা। অর্থাৎ আপনি সাতদিন না কামিয়ে যা সেভ করেছিলেন, তা আপনার কাছ থেকে ক্লিন সেভ্ড করিয়ে দিল।… ফুটপাত দিয়ে হাঁটছেন আর আপনার ঘরের সমামনের ব্রিক সেলুনওয়ালাদের ছবি আপনার চোখের উপর ভেসে উঠছে। মাত্র ছটা পয়সার বিনিময়ে তারা আপনার বাসায় এসে আপনাকে কামিয়ে দিয়ে যেত।’’

লেখকের বাস্তবতাবোধের আরেকটি উদাহরণ দেখুন ‘ক্রিকেট দর্শন’ লেখাটিতে। এক সময় বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো। মার্কিন বিশ্ব আর সোভিয়েত বিশ্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর সোভিয়েত ইউনিয়ন, এই দুই পরাশক্তি বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতো। সোভিয়েতের রাজধানি ছিলো রাশিয়ার মস্কোতে। তাই অনেকে সোভিয়ত ইউনিয়নকে সোভিয়েত রাশিয়া আর দেশটির জাতিকে রুশ জাতি বলতো। এখন সোভিয়েত নেই। ১৯৯১ সালে ভেঙ্গে গেছে। রাশিয়া আছে, সোভিয়েতের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে ব্যাস্ত। ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থের লেখায় (ক্রিকেট দর্শন) কি আছে দেখুন, ‘‘ বর্তমান দুনিয়ার দুই সভ্য জাতি মার্কিন আর রুশ এ খেলা দেখাতে মোটেও ওস্তাদ নয়। তেমন হাউসও তাদের নেই। আকাশ-পাতাল জয়েচ্ছু এই দুই প্রতিযোগীর কাছে ‘টাইম ফ্যাক্টার’ মহামূল্যবান। সার্কাসের জমায়েতে জনতার হাততালিতে ঘুরে ঘুরে শুকরিয়া জানানোর চেয়ে ল্যাবরেটরীতে বসে শান্তির ভয়াবহ অস্ত্র তৈরী করে এরা বিস্মৃত বিক্ষুদ্ধ জনতার অলক্ষ্যে হাততালি দেওয়াই বেশি পছন্দ করে’’। বলাই বাহুল্য পরাশক্তিগুলোর পারমানবিক অস্ত্র ও ক্ষেপনাস্ত্র তৈরীর প্রতিযোগিতাকেই এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থটি আরো সুখপাঠ্য করে তুলেছে রনবী’র অলঙ্করণ। প্রিন্টার্স লাইনে লেখা আছে প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ রফিকুন্নবী (রনবী)। পাঠক, খেয়াল করুন, রফিকুন্নবী লিখে ব্র্যাকেটে রনবী লেখা হয়েছে। অলঙ্করণগুলো যতটা না রফিকুন্নবীর, তার চাইতেও বেশি রনবী’র। সাপ্তাহিক বিচিত্রার টোকাই এর কার্টুন অঙ্কনের মাধ্যমে সত্তর আশি ও নব্বইয়ের দশকে রনবী পাঠকদের মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে রেখেছিলেন। বলা যায় তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় কার্টুনকে একটা ভিন্ন মাত্রা দেওয়া ও জনপ্রিয় করতে অবদান রেখেছেন। তিনি সব রকমের অঙ্কন করতেন রফিকুন্নবী নামে। কিন্তু, টোকাই ও অন্যান্য স্যাটায়ার অঙ্কন করতেন রনবী নামে। তাই বলছি, রফিকুন্নবী ওরফে রনবী’র অলঙ্করণে ‘উল্টো থেকে’ এর পৃষ্ঠাগুলো আকর্ষণীয় তো বটেই, আরো বক্তব্যধর্মী হয়েছে।

পাঠক, শেষ করছি ‘অ্যাকসিডেন্টাল অ্যাকসিডেন্ট’ রম্য রচনাটির প্রারম্ভে লেখক আবদুল মালেক যে ভূমিকাটি দিয়েছেন, সেটা দিয়ে। তৃতীয় বন্ধনীর ভেতরে ছোট ফন্টে লেখা আছে, ‘‘ এ গল্পের নায়ক গল্প নিজেই। সে জন্য গল্পে তার ভূমিকাই প্রধান। একদিন গল্প আমাকে এসে দুটো চিঠি দিয়ে গেল, আর বলে গেল, ‘আমাকে নিয়ে কিছু লিখো’। আমার গল্পের পড়ুয়াদের জন্য দুটো চিঠিই গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হলো। গল্পের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি, মনমতো হলো কিনা একমাত্র সেই বলতে পারে। কিন্তু অন্য কেউ চিঠি দুটো পেলে অন্যভাবে গল্প লিখতে পারেন, সে আশায় চিঠি দুটোর কোন স্বত্বাধিকার দাবি করছে না লেখক।’’

এখন কথা হচ্ছে অ্যাকসিডেন্টাল অ্যাকসিডেন্ট রম্য রচনার সূত্র চিঠি দুটোর সত্বাধিকার না হয় না-ই দাবি করলেন লেখক আবদুল মালেক। কিন্তু ‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থটির স্বত্বাধিকারী কে? গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে গ্রন্থকারের মা ও বাবাকে। প্রকাশকাল আছে, প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ শিল্পীর নাম আছে, প্রকাশক আন্দরকিল্লার কোহিনূর লাইব্রেরির (অধুনালুপ্ত) নাম আছে, আছে পরিবেশক মোমিন রোডস্থ কথাকলির(অধুনালুপ্ত) নাম। মূল্যও আছে। নেই স্বত্ত্বাধিকারীর নাম। তাতে সমস্যা নেই। প্রকাশনা সংস্থা বা লেখকেকেই না হয় সত্ত্বাধিকারী ধরে নিলাম। কিন্তু ‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থটির লেখক বা গ্রন্থকার আবদুল মালেক ব্যক্তিটি কে? গ্রন্থটিতে তার কোনো পরিচয় দেয়া হয়নি। কোনো ভূমিকা বা মুখবন্ধও নেই।

পাঠক, ‘উল্টো থেকে’ রম্য গ্রন্থের আলোচনা লিখতে বসে আমি কোনো রম্য কথা বলছি না বা উল্টো পাল্টা কিছু বলছি না। যা বলছি সোজা-সাপ্টা বলছি। আপনারা ‘উল্টো থেকে’ গ্রন্থটি পড়ে আমাকে জানাবেন, এতো চমৎকার রম্যরচনকারী কে এই আবদুল মালেক? তার প্রকৃত পরিচয় তিনি আড়ালেই রেখে দিলেন? নাকি আমাদেরকে উল্টো থেকে দেখতে উৎসাহিত করলেন! আবদুল মালেক রচিত রম্যগ্রন্থ ‘উল্টো থেকে’ এর ‘উল্টো থেকে’ রম্য রচনার শেষ কয়টি বাক্য দিয়ে লেখাটি শেষ করছি, ‘‘হায়রে কপাল! আমার চোখে সবকিছুই ওলট-পালট। উল্টো দেখাটা কি আমার স্বভাব? না কি আর কোনো কারণ আছে! বলুন পাঠক-পাঠিকারা আপনারই বলুন।’’

লেখক: নাট্যকর্মী ও প্রভাষক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর