কুকুর, বিড়াল এবং মানুষের উপাখ্যান!
৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৩:২২
০১.
সোলায়মান সাহেব প্রতিদিন সকালে বাড়ির গেটের কাছে তিনটি কুকুরকে পাওরুটি খাওয়ান।
কাজটা তিনি বেশ আগ্রহ নিয়েই করেন।
তেমন দামি কোন রুটি না;
রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে গোল গোল এই রুটি ঝুলতে দেখা যায়।
স্বল্প আয়ের মানুষেরা প্রায়ই দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে বসে চায়ে ডুবিয়ে এই রুটি খায়।
করোনার এই দুঃসহকালে মানুষেরই ঠিকমত খাবার জোটে না; কুকুর পুষবে কী দিয়ে?
গৃহস্থ বাড়ির কুকুরগুলোও তাই এখন রাস্তায় রাস্তায় অভুক্ত ঘুরে বেড়ায়।
এখন কেবল সকালই না;
দুপুর আর রাতেও ঠিক সময়মতো কুকুর তিনটি এসে হাজির হয়;
এসময় তাদের খাবার থাকে ‘ভাত-তরকারি’।
তার এক পুত্রবধু খুব যত্নের সাথে খাবারের আগে সেসব একসাথে মিশিয়ে দেন।
কুকুরগুলোকে সময় মত খাওয়ানোটা এখন সোলায়মান সাহেবের যেন এক ‘নিত্য কর্তব্য’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুকুরজাতীয় প্রাণীগুলো সাধারণত প্রভুভক্ত আর কৃতজ্ঞ হয়।
যদিও তিনি এদের কোন ‘প্রভূ’ নন, এরা বেওয়ারিশ।
কিন্তুু কুকুরগুলো এরই মধ্যে তার বেশ ভক্ত হয়ে উঠেছে।
কোন কোন মাঝরাতে কুকুরের দীর্ঘ, প্রলম্বিত কুঁউউউ ডাকে সোলায়মান সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়;
তিনি বিছানায় উঠে বসে থাকেন।
বাকি রাত আর ঘুম আসে না।
দেশে কোন দূর্যোগ, মহামারি লাগলে নাকি কুকুরেরা এমন দীর্ঘ, করুণ সুরে রাতভর থেকে থেকে কাঁদে!
ভয়ংকর ‘করোণা’ আজ অতিমারী আকারে শুধু দেশ নয়; সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে।
দেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার শুরুতেই সোলায়মান সাহেব তাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা শহর ছেড়ে পদ্মাপারের যশোলদিয়া গ্রামে তার ছায়াঘেরা, নিরিবিলি, ‘কমান্ডার হাউজ’এ এসে উঠেছেন।
সাথে আছে তার প্রয়াত বড় ভাইয়ের পরিবারের সদস্যরাও।
বাইরে বেরনো তার একদমই নিষেধ।
আশির উপরে বয়স; সাথে প্রেসার, ডায়াবেটিস।
ঝুঁকি নাকি তারই সবচেয়ে বেশি!
আজ পাঁচ মাসেরও বেশি চলছে তাদের এই প্রায় অবরুদ্ধ জীবন।
চারদিকে সুউচ্চ দেওয়াল ঘেরা বাড়িটির সামনের দু’পাশে আম-কাঠাল-লিচুসহ নানা জাতের ফল-ফুলের গাছ।
মাঝখান দিয়ে গেট পর্যন্ত বিস্তৃত টানা, প্রশস্ত বাঁধানো পথ।
ফজরের নামাজ শেষে সেখানেই সোলায়মান সাহেব কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন।
ভোরের এই সময়টায় মানুষের মন বড় দুর্বল থাকে।
প্রতিদিনই সাদা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তিনি অজান্তেই যেন একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে কেমন বিষন্ন হয়ে যান;
‘তারই শুধু এ বাড়ি দেখা হ’ল না…
যে ছিল সবচেয়ে ছোট; সবচেয়ে আদরের…
বড় অবেলায় তাকে চলে যেতে হয়েছে;
সে শুয়ে আছে এই যশোলদিয়ারই মাটিতে;
তার স্মরণে গড়া মসজিদটির পাশেই।’
০২.
সকালে তিনি হাঁটতে বেরোলেই কোথা থেকে যেন কুকুর তিনটি গেটের কাছে এসে হাজির হয়!
এরা কি রাতভর তার অপেক্ষায় থাকে?
হবে হয়তো!
জীব-জন্তুুর মনের কথা কে আর বোঝে!
একজন বুঝতেন!
তিনি হযরত সোলায়মান (আঃ)।
তার ঠোটের কোনে মৃদু একটু হাসি দেখা দেয়;
তার নিজের নামও যে সোলায়মান!
তিনি অবশ্য মানুষের কথাই এখনও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন না!
একটু পরই যে কাহিনী সোলায়মান সাহেব শুনবেন;
তা বুঝে উঠাও তারপক্ষে একটু কঠিনই হবে!
০৩.
আজ গেটের কাছে কুকুর নয়;
দাঁড়িয়ে আছে তিনজন মানুষ।
মানুষ-জনের এসময় আসার কথা নয়; তাদের আসার সময় ন’টার পর।
সময়টা তিনিই বেঁধে দিয়েছেন।
তিনি কিছুটা কৌতুহল নিয়েই গেটের দিকে এগিয়ে যান।
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে বছর ষাট বয়সের একজন মানুষ;
মুখে লম্বা দাড়ি,
দাড়িতে বিবর্ণ মেহেদির হালকা আভাস!
পরনে লুঙ্গি আর রঙজ্বলা ছিটা ছিটা ‘তিলা পড়া’ আকাশি রঙের পাঞ্জাবী।
তাকে ঠিক ভিক্ষুক বলে মনে হয় না।
তার সাথে মলিন শাড়ি পরা মাঝ বয়েসী এক নারী;
আর উদোম গায়ের পাঁচ-ছ বছরের একটা ছেলে।
এরা বৃদ্ধের বৌ-বাচ্চা কি না তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না;
গ্রামের মানুষদের বয়স দেখে সম্পর্ক আন্দাজ করা মুশকিল।
অনেক সময় আশি বছরের বৃদ্ধেরও দেখা যায় মেয়ের বয়সী বউ…
বৃদ্ধের সাথে কথা বলে সোলায়মান সাহেব দীর্ঘক্ষণ একটা দোটানার মধ্যে রইলেন।
‘বৃদ্ধ দূর গায়ের মানুষ;
সাথের স্ত্রী তার দ্বিতীয় পক্ষ।
প্রথম স্ত্রী দীর্ঘদিন রোগে ভুগে মারা যাবার পর গত বছর তিনি ছেলেসহ এই বিধবাকে ঘরে তুলেছেন!
আর তারপরই শুরু হয়েছে তার ভোগান্তি।
ছেলেরা দেখতে পারে না;
ছেলের বৌরা বুড়া বয়সে ভীমরতি’ বলে আড়ালে-আবডালে হাসে।
এদিকে প্রথম স্ত্রী মারা যাবার মাস কয়েক পরেই ছেলেদের প্রচন্ড চাঁপে পড়ে তিনি জমি-জমা সবই দুই ছেলের নামে লিখে দিয়েছেন।
তার এখন উপোষ দেওয়ার দশা!
মানুষের মুখে শুনে শুনেই সে সোলায়মান সাহেবের কাছে এসেছে কিছু সাহায্যের আশায়।’
লোকটার কথা বিশ্বাস করবেন কিনা তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না।
পিতা-মাতাকে ভরণ-পোষনের বিষয়ে এখন কঠোর আইন হয়েছে।
ইচ্ছে করলেই সে আইনের আশ্রয় নিতে পারে…
তাছাড়া এই ‘ভীমরতি’র কারণে তিনি নিজেও মনে হয় লোকটার উপর কিছুটা বিরক্ত!
তিনি কিছু বলার আগেই মানুষটা বলে উঠল,
‘অনেকে কইছে ছেলেগো নামে মামলা করতে;
বাপ হইয়া ছেলের নামে কেমনে মামলা করি সাব, কন?
আপনা রক্তের ছাওয়াল আমার
দরকার হইলে ভিক্ষা কইরা খামু!’
বলতে বলতে বৃদ্ধের দু’চোখ গড়িয়ে পানি নামে।
সোলায়মান সাহেব হতভম্বের মত সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।
সাথের বাচ্চাটাকে বার বার চকচকে চোখে তার হাতের রুটির প্যাকেটেটার দিকে তাকাতে দেখে তিনি জানতে চাইলেন;
‘রুটি নিবা?’
সে উপর-নিচ মাথা নাড়ে।
কুকুরের জন্য আনা খাবার বাচ্চাটাকে দিতে সোলায়মান সাহেবের কেমন একটা অসস্তি হয়!
”আচ্ছা একটু দাড়াও,
এটা কুকুরের খাবার…’
বলে তিনি বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে থমকে দাড়ালেন!
‘সাব কুত্তার খাওনডাই আমারে দ্যান!’
কথাটা যেন সোলায়মান সাহেবের বুকে গিয়ে বাড়ি খায়!
তিনি অবাক হয়ে দেখলেন নির্বিকার মুখে কথাটা বলছে বাচ্চা ছেলেটা!
সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে!
সোলায়মান সাহেব বিমর্ষ মুখে দাড়িয়ে রইলেন।
তিনি ফতুয়ার পকেট থেকে ৫০০ টাকার দুটি নোট এবং পাউরুটির প্যাকেটটা দ্রুত দারোয়ানকে দিয়ে তাদের হাতে দেন।
ছেলেটা ছোঁ মেরে প্যাকেটটা লুফে নেয়;
টাকাটা নেওয়ার সময় বৃদ্ধের শীর্ণ হাতটা কি একটু কাঁপলো?
ঠিক বুঝা গেল না।
তবে বিবর্ণ শাাড়ীর ঘোমটা তোলা মাঝ বয়সী মহিলাটির মলিন চোখমুখে ফুটে উঠল এক ধরনের বোবা-কৃতজ্ঞতা!
এ পর্যন্ত মহিলাটি কোন কথাই বলেনি।
দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ জড়বস্তুুর মত।
হয়তো কারো কাছেই তার বলার কিছু নাই…
০৪.
কুকুর তিনটি গেট থেকে একটু দূরেই পাশাপাশি অনড় দাড়িয়ে আছে।
মানুষ দেখেই হয়তো তারা গেটের দিকে আসতে সাহস করে না;
অথবা অপেক্ষায় আছে কখন মানুষেরা সরে যাবে।
কিন্তুু খাবারের প্যাকেটটা চোখের সামনে এভাবে হাতছাড়া(!) হয়ে যেতে দেখে তারা এবার অস্হির হয়ে উঠল!
ঘন ঘন লেজ নাড়তে নাড়তে নিঃশব্দে তারা মানুষ তিনজনকে ঘিরে অবিরাম চক্রাকারে ঘুরতে থাকে।
ছেলেটা ততক্ষনে রুটি বের করে খাওয়া শুরু করেছে;
কুকুর তিনটি তখনও ক্রমাগত তাদেরকে ঘিরে চক্কর দিয়ে চলেছে!
চক্রের পরিধী তারা ক্রমে ছোট করে নিয়ে আসছে!
এই সাত সকালে প্রায় নির্জন রাস্তার উপর ভোরের আলোয় এ এক অদ্ভুত দৃশ্য!
তিনজন মানুষকে গোল করে ঘিরে নিয়ে চলেছে তিনটি কুকুর!
যেন খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে মানুষগুলোকে তারা এখান থেকে যেতে দিতে চায় না!
যেন এ খাবার তাদের!
কুকুরগুলোর চোখে এখন ঝিলিক মারে এক অচেনা ক্রোধ!
তারা কি রুটির প্যাকেটটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে?
কেউ জানে না!
কুকুরের ক্ষুধা মানুষের মতোই…
হঠাৎ কি মনে করে ছেলেটি হাতের আধ-খাওয়া রুটিটা একটা কুকুরের সামনে এগিয়ে দেয়।
কুকুরগুলো হঠাৎ থেমে যায়;
তাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই বৃদ্ধটি আচমকা কষে ছেলেটার গালে এক চড় বসিয়ে দিয়ে খেঁকিয়ে উঠেন;
‘হারামজাদা, নিজেগো প্যাটে খাওন নাই;
কুত্তার জন্য দরদ…’
ছেলেটা হতভম্বের মত বাপের দিকে তাকিয়ে থাকে;
তার চোখে বোবা দৃষ্টি।
বৃদ্ধের হঠাৎ এমন আচরণে ভড়কে যায় কুকুরগুলোও।
আক্রমনটা তাদের উপর আসবে, সে বিষয়ে তারা একরকম প্রস্তুুতই ছিল; হয় লেজ উচিয়ে দৌঁড়; না হয় ঝাঁপিয়ে পড়া!
কিন্তুু আঘাতটা বাচ্চাটার উপর আসায় তারা বেশ সতর্ক হয়ে উঠলো।
সাবধানে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বৃদ্ধের দিকে তারাও ব্যথিত, করুণ এবং অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল!
‘কুকুরের চোখে করুণ আর ব্যথিত দৃষ্টি!’
কল্পনা হিসেবে মন্দ নয়!
কিন্তুু তা কী করে হবে?
পশুর চোখের ভাষা কী আর মানুষ পড়তে পারে?
পশুতো আর মানুষ নয়!
বরং মানুষেরাই কখনো কখনো…
তবে একজন পারতেন;
তিনি হযরত সোলায়মান(আঃ)।
মহাপুরুষ তিনি।
০৫.
আমাদের সোলায়মান সাহেব কোন মহাপুরুষ নন।
কিন্তুু মানুষের জন্য তার রয়েছে অপরিসীম মমতা।
তিনি সম্ভ্রান্ত, দানশীল, সাহসী এবং সজ্জন এক মানুষ।
করোনাকালের এই দুঃসময়ে তিনি কয়েকবার ত্রাণ বিতরণের ব্যবস্হা করেছেন।
তাছাড়া প্রতিদিনই সকাল-বিকেল তিনি নিয়ম করে এই গেটের কাছে এসে দাঁড়ান;
তার কাছে এসে খালি হাতে ফিরে গিয়েছে এমন নজির নাই।
করোনার কারণে এ কাজগুলো তাকে ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রেখে গেটের ভিতর থেকেই করতে হয়;
মানুষগুলো দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে।
তার মনটা খচ খচ্ করে;
তার এলাকার মানুষ সব!
এরাই তাকে ভালবেসে এখনও ডাকে ‘কমান্ডার’।
মুক্তি যুদ্ধের সময় বিশেষ ভূমিকার কারণে এ এলাকায় তিনি ‘কমান্ডার সোলায়মান’ নামেই পরিচিত;
যুদ্ধের সময়ে এলাকাটা ছিল তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে।
তিনি ছিলেন সে সময় স্বেচ্ছা-অবসরে যাওয়া তৎকালিন পাকিস্তান আর্মির একজন চৌকষ ‘সার্জেন্ট’।
১৭ বছরের চাকুরী জীবনে তার ছিল নানা কৃতিত্ত্ব আর অর্জন;
২ বার তিনি সাঁতারে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পদক লাভ করেন।
৬৫’র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তার ছিল ‘সেতারা-ই-হরব’ খেতাব।
তবুও বাঙালি সেনাদের প্রতি পাকিস্তানিদের নানা বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে তিনি ‘৭০এ পাকিস্তান থেকে দেশে পোস্টিং নিয়ে এসেই অবসরে চলে যান।
৭১’র উত্তাল মার্চ;
দেশের এক চরম ক্রান্তিকাল।
চারিদিকেই একটা থমথমে পরিবেশ; কখন কি ঘটে যায়!
এ অবস্হায় ২৫ শে মার্চ ঠিক মাঝ রাতেই শুরু হল তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা।
ঢাকায় তখন ঘুমন্ত, নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাক হানাদার বাহিনী!
শুরু হয়েছে এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
২৬ শে মার্চ সকাল ৮টায় ভূমিষ্ট হল তার প্রথম সন্তান!
ততক্ষনে শুধু ঢাকা শহরেই মারা পড়েছে ৭ হাজারের বেশি মানুষ!
চলছে নির্মম ‘গণহত্যা’।
তার সৈনিক রক্ত টগবগিয়ে উঠল।
নবজাতক এবং স্ত্রীকে চোখের দেখা দেখেই তিনি প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এলাকার মুক্তিকামী মানুষদের সশস্ত্র ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতির কাজে।
কিছুদিনের মধ্যেই গড়ে তুললেন প্রায় ২৫০ জনের একটি শক্তিশালী ‘মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট’।
ট্রেনিং তিনি নিজেই দেন।
অভাব শুধু অস্ত্রের।
প্রথম দিকে তাদের সম্বল ছিল শুধু মাত্র দলের কাছে জমা দেওয়া স্থানীয় লোকজনের লাইসেন্সকৃত কিছু বন্দুক!
রাজাকার, আল-বদর আর পাক সেনাদের উপর চোরা-গোপ্তা হামলা চালিয়ে তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়াই ছিল তার অস্ত্র সংগ্রেহের প্রধান পন্থা।
এরপরই স্বতস্ফূর্তভাবে ‘লুট'(!) হয়ে যাবে দেশের অধিকাংশ থানা!
অস্ত্র ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে…
সে এক অন্য কাহিনী… অনন্য কাহিনী;
গল্পের চেয়েও সুন্দর আর ভয়ংকর!
০৬.
সে ‘কাহিনী’ সরাসরি দেখার সৌভাগ্য আমাদের না হলেও সোলায়মান সাহেবের ‘অব্যর্থ লক্ষ্য ভেদ’ এবং প্রয়োজনে এই মানুষটা যে কতটা কঠোর হয়ে উঠতে পারেন তার চাক্ষুস প্রমান পেলাম আমরা এই সেদিন!
বাড়ির সামনের আম বাগানে বাদুড়ের প্রবল উপদ্রব শুরু হয়েছে;
ধেড়ে ধেড়ে সব বাদুড়!
সন্ধ্যা নামতেই বাদুড়েরা গাছের ডালে ডালে মাথা নিচের দিকে দিয়ে পোটলার মত ঝুলতে থাকে;
তারপর রাতভর চলে তাদের ‘আম্র-উৎসব’!
সকাল বেলা গাছতলা আধ-খাওয়া, সিকি-খাওয়া আমে আমে ছয়লাব!
বাদুড় তাড়াতে প্রথমে খালি মুখেই হুস্-হাস শব্দ; গাছে ঢিল ছোড়া, গাছের ডালে ঘন্টা ঝুলানো এবং সবশেষে বন্দুকের ‘ফাঁকা আওয়াজ’!
কিন্তুু বাদুর তাড়ানো গেলো না।
সোলায়মান সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মায়া দেখায়ে লাভ নাই; একটাকে অন্তত ফেলতে হবে। বাকিরা তাহলে ভয়েই…’
দীর্ঘদিন পর তিনি নাতনী ইশরাতকে সাথে নিয়ে বেশ আয়োজন করে বসলেন বন্দুক পরিষ্কার করতে!
রশির সাথে শক্ত করে বাঁধা একখন্ড তেল মাখানো কাপড়কে বন্দুকের নলের একদিক দিয়ে ঢুকিয়ে
রশি ধরে টেনে অন্য পাশ দিয়ে বের করতে হবে!
কেয়ার-টেকারের সাথে রশি টানার সুযোগ পেয়ে ইশরাত খুশি আর উত্তেজনায় যেন টগবগ করে।
টগবগ করে উঠে আমার স্মৃতিরাও!
বাড়ির বড় উঠোনে গোল হয়ে বসে চাচাদের নেতৃত্বে এই ‘বন্দুক পরিস্কার’ করা ছোট বেলায় আমাদের কাছেও ছিল এক তুমুল আনন্দ আর উত্তেজনার বিষয়!
আমরা ছোটরা দলবেঁধে রশি ধরে ‘হেঁইওও’ টানতাম।
এক সন্ধ্যায় সোলায়মান সাহেব দো নলা বন্দুকটা নিয়ে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাড়ালেন।
বাদুড় আসতে দেখে দক্ষ শিকারীর মত পজিশন নিয়ে বন্দুক তাক্ করলেন।
বাদুড়টা গাছের ডালে বসেছে কি বসে নাই;
আমি শুধু শুনলাম ‘গুড়ুম’ (আমার কানে তখন আওয়াজটা এমনই শোনালো)
আমার হাত কেঁপে গিয়ে ঠিকমত ছবিও তুলতে পারলাম না!
ভাবলাম বাদুড়টা হয়তো উড়ে গিয়েছে।
কেয়ার টেকার দেখি দৌঁড়ে গিয়ে গাছতলা থেকে বাদুড় কুড়িয়ে এনেছে!
বাদুড়ের সাইজ দেখে আমি থ!
রীতিমত ঈগল-সাইজ!
বাকি বাদুড়েরা ততক্ষনে আকাশে উড়াল দিয়েছে;
কিন্তুু তিনি সেদিকে আর দ্বিতীয় গুলি ছুঁড়লেন না।
সন্ধ্যার ম্লান আলোয় তাকে কি কিছুটা বিষন্ন মনে হয়?
বাদুড়ের ডানায় গুলি লেগেছে;
জখম ততটা মারাত্বক নয়।
দু’দিন পরিচর্যার পর সোলায়মান সাহেবের নির্দেশেই বাদুড়টাকে ছেড়ে দেওয়া হল!
বাদুড় আবার আকাশে ডানা মেলল…
৮২ বছরের একজন মানুষ;
বন্দুক উঁচু করাই যার পক্ষে কষ্টকর হওয়ার কথা;
সেই তারই খালি চোখে, প্রায় পঞ্চাশ ফুট দূরের টার্গেট এমন নিঁখুতভাবে ঘায়েল করা!
কি অব্যর্থ নিশানা!
আমি হতভম্বের মত মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
আর তখনই মনে আসে বিক্রমপুরের গোয়ালীমান্দ্রার হাটের বিখ্যাত এক যুদ্ধে এই মানুষটি তার দল-বল নিয়ে ‘এ্যামবুশ’ করে মেশিনগানের ব্রাশ ফায়ারে একসাথে ১২ জন খান সেনাকে ঘায়েল করেছিলেন!
সে যুদ্ধে ৬০ জন পাকিস্তানি আর্মির মধ্যে মারা পড়েছিল মোট ৫৫ জন। বাকী ৫ জনের অসহায় আত্মসমর্পন।
এ গল্প এখনও এ এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
এ মানুষটিই ২৬ মার্চ তার সদ্যজাত প্রথম সন্তানের মুখ দেখে নাম রেখেছিলেন ‘বুলেট’!
তারপর দীর্ঘ ৯ মাস আক্ষরিক অর্থে ধাতব ‘বুলেট’ই হয়ে উঠেছিল তার ধ্যান-জ্ঞান আর জীবন-মরণ!
ওদিকে মায়ের কোলে তখন দিন দিন বেড়ে উঠছে রক্ত-মাংসের আরেক ‘বুলেট’!
কমান্ডার সোলায়মানের তা দেখার সময় কোথায়?
তিনি তখন অস্ত্র হাতে মরিয়া হয়ে ছুঁটছেন গালিমপুর, কামার খোলা, গোয়ালীমান্দ্রা হাট!
মেতে উঠেছেন শত্রু হননে!
যোদ্ধা সোলায়মানের চোখে-মুখে তখন একটাই অঙ্গিকার, জীবনের বিনিময়ে হলেও ‘নব জাতক’এর জন্য রেখে যেতে হব মুক্ত স্বদেশ!
হাঁটতে শিখে তার সন্তানের ‘প্রথম পদক্ষেপ’ যেন পড়ে এক স্বাধীন দেশের মাটির বুকে!
জীবন বাজি রেখে তিনি তার অঙ্গিকার পূরণ করেছেন;
কিন্তুু এমন ত্যাগী, নিভৃতচারী এই মানুষটির যথার্থ মূল্যায়ন কি আদৌ হয়েছে?
০৮.
মানুষ তিনজন চলে গিয়েছে;
পিছন পিছন গিয়েছে কুকুর তিনটিও!
কেন গিয়েছে কে জানে।
সোলায়মান সাহেব বিষন্ন মনে গেটের কাছ থেকে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন;
কুকুরগুলোর জন্য আরেক প্যাকেট খাবার আনতে হবে।
ওরা ফিরে আসবে;
তিনি জানেন।
কিন্তুু বাড়ির অদূরেই রাস্তার উপর একটু আগে তিনটি কুকুর এবং তিনজন মানুষের মাঝে ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র উপাখ্যানটুকুর কিছুই তিনি জানলেন না; দেখলেন না!
মহাপুরুষ কিংবা দেবতা হলে হয়তো না দেখেও তিনি তা জানতে পারতেন!
তিনি মহাপুরুষ বা দেবতা নন;
দেবতারা থাকেন আকাশে!
তিনি এই মাটির মানুষ;
মাটির মতই!
পুনশ্চঃ
লেখাটা যখন শুরু করি; কুকুরের সংখ্যা ছিল তিন;
এখন হয়েছে চার,
মাঝে মাঝে দেখি পাঁচ!
প্রথম ৩ টিই হয়তো পরেরগুলোকে এখানে খাবারের নিশ্চিত খবর জানিয়ে সাথে করে নিয়ে আসে!
চারিদিকে এখন খাবারের বিষম আকাল।
কুকুরগুলো আগে থাকতো গেটের বাইরে;
এখন সুযোগ পেলেই তারা ভিতরে ঢুকে দলবেঁধে বেশ পরিচিত, সহজ ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়;
কখনও কখনও বাঁধানো চত্তরে চোখ মুদে দেয় আয়েশী, অলস ঘুম!
সারারাত জেগে জেগে তারা বাড়িটিকে পাহারা দেয়;
কোথাও অস্বাভাবিক কোন সাড়া-শব্দ পেলেই তারঃস্বরে ডাকতে শুরু করে।
এ বাড়িটিই যেন এখন তাদের একান্ত ‘অভয়াশ্রম’!
এর মধ্যেই বন্যার পানি বাড়ার সাথে সাথে একদিন এক মা বিড়াল তার সদ্যজাত দুই বাচ্চাকে সবার অগোচরে এ বাড়ির উঠোনে ফেলে রেখে গেল।
আশ-পাশের বাড়িতে ঘর পর্যন্ত বানের পানি চলে এসেছে।
মানুষেরই এখন ঘরে থাকা দায়।
ঘুম থেকে উঠেই এমন দুটি বিড়াল ছানা দেখে সোলাইমান সাহেবের নাতি-নাতনিরা বেজায় খুশি!
প্রবল উৎসাহে তারা বাচ্চা দুটোকে ফিডারে করে দুধ খাওয়ানোর কসরৎ শুরু করল।
দুদিন পরই মা বিড়ালটা কোথা থেকে যেন হঠাৎ এসে একটা বাচ্চার ঘাড় কামড়ে ধরে তাকে নিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল এবং কিছুক্ষন পরই আবার তাকে ফেরত দিয়ে গেল!
প্রায় প্রতিদিনই চলতে থাকলো বাচ্চা দুটোর এভাবে পালাক্রমে আনা-নেওয়া!
বিড়ালের এমন রহস্যময় আচরণের কোন কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না।
এক গৃহকর্মী জানালো বিড়ালটা নাকি তার বাচ্চাদের দুধ খাওয়ানোর জন্যই এভাবে নিয়ে যায়, আবার দিয়ে যায়!
রাতের খাবারের সময় কুকুরের জন্য গামলায় মাকে ভাত মাখতে দেখে ছোট্ট ইশরাত জানতে চায়;
‘মাম্মি, আমরা চলে গেলে কুকুর কোথায় খাবে?
ওদের ভাত মাখিয়ে দিবে কে?’
মেয়ের এমন প্রশ্নে মেয়ের মা বিহব্বলের মত তার এই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকেন;
মেয়েটা যে কখন কি প্রশ্ন করে!
‘জান্নাত’ তার থেকে বয়সে একটু বড়;
সে বলে উঠে;
‘ওদের তখন আল্লাহ্ খাওয়াবে, বুঝেছ?
আল্লাহ্ সবাইকে খাবার দেন।’
‘আল্লাহ্ কি ভাত মাখাতে পারে?’
ইশরাতের সহজ, অবুঝ, অবোধ প্রশ্ন।
এ প্রশ্নের উত্তর জান্নাতের জানা নাই;
সে চুপ করে থাকে।
আমরা বড়রা তা শুনেও না শোনার ভান করি!
একদিন করোনার এই তান্ডব থেমে যাবে;
সোলায়মান সাহেব ফিরে যাবেন তার শহরের বাড়িতে।
এ বাড়িটি আবার নির্জন হয়ে যাবে!
মা বিড়ালটি এসে হয়তো তার ছানাদের এখান থেকে নিয়ে যাবে;
‘মানুষ-ছাড়া’ বাড়ি বিড়ালদের একদম পছন্দ নয়।
ছানারা ততদিনে বড় হয়ে উঠেছে;
কতো বড় আমরা এখনও তা জানি না!
কুকুর তিনটি পর পর কয়েকদিন এসে খাবার না পেয়ে হয়তো এদিক-ওদিক সোলাইমান সাহেবকে খুঁজবে;
তারপর একসময় রাস্তার কুকুর রাস্তায় হারিয়ে যাবে!
সোলায়মান সাহেব ফিরে এলে তারাও হয়তো আবার ফিরে আসবে!
শুধু মানুষই একবার হারিয়ে গেলে আর ফেরে না!