Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লোকগবেষণায় শামসুল আরেফীনের আড়াই দশক


৪ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:৩২

চট্টগ্রাম ব্যুরো: লোকগবেষক ও লোকসঙ্গীত সংগ্রাহক শামসুল আরেফীন। চট্টগ্রামসহ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের পরিচিত মুখ। ছড়া, কবিতাও লেখেন। পাশাপাশি আড়াই দশক ধরে নিবিষ্ট আছেন লোকগবেষণায়। লোকগান সংগ্রহের ভাণ্ডারও তার বেশ সমৃদ্ধ। নিজেকে সবসময় আড়ালে রাখতে চাওয়া নিভৃতচারী গুণী মানুষটির জীবনচরিত পাঠকের সামনে আনতে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছে সারাবাংলা।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সদর এলাকায় ১৯৭৭ সালের ২০ নভেম্বর জন্ম নেন শামসুল আরেফীন। বাবা আবদুল মোবিন ও মা তমনারা বেগম। শামসুল আরেফীন নব্বই দশকের শুরুতে ছড়া ও কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও এই দশকের মাঝামাঝি লোকগবেষণায় সম্পৃক্ত হন। তিনি সর্বপ্রথম আস্কর আলী পণ্ডিতের রচনা সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। আস্কর আলী পণ্ডিত উনিশ ও বিশ শতকের লোককবি। ১৮৪৬ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার পুরানগড়ে জন্মগ্রহণকারী ও পরবর্তীতে পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী গ্রামে স্থায়ী বসতিস্থাপনকারী, মোসরফ আলির পুত্র এই আস্কর আলী পণ্ডিত (মৃত্যু ১১ মার্চ ১৯২৭) স্বকালে বড়মাপের লোককবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সময়ে আধুনিক সাহিত্য রচনা দেদারসে চললেও চট্টগ্রামের গ্রামীণ বা লোকসমাজে তার রচিত লোকসাহিত্য তথা মূলধারার বাংলা সাহিত্য মনের খোরাক যোগায়। তার সময়ে, সোজাসুজি বললে তখন থেকে এখন পর্যন্ত তার প্রভাবমুক্ত লোককবি বিশেষ করে চট্টগ্রামে অত্যন্ত অল্প। শামসুল আরেফীন তার রচনা সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন ১৯৯৫ সালের দিকে। তখন পণ্ডিতের অধিকাংশ রচনা প্রায় বিলুপ্ত।

বিজ্ঞাপন

শামসুল আরেফীন পণ্ডিতের গানের সংস্পর্শে আসেন চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়। পণ্ডিতের গান তার এতই ভাল লাগে যে, ১৯৯৫ সালের দিকে তিনি এই গান সংগ্রহ করার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে তা সংগ্রহে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হন। চন্দনাইশের পার্শ্ববর্তী উপজেলা পটিয়া। আরেফীনের বাড়ি থেকে পণ্ডিতের নিবাসস্থল পটিয়ার শোভনদণ্ডী গ্রামের ব্যবধান ৫-৬ কিলোমিটার। আরেফীন বারবার ছুটে যান পণ্ডিতের বাড়িতে। তখন পণ্ডিতের নাতি ইছমাঈল ও ইসহাক জীবিত। কিন্তু তখন তারা কোনো সহযোগিতা না করায় আরেফীন হতাশ হয়ে পড়েন।

বিজ্ঞাপন

অল্পকাল পরে আরেফীন সাহিত্যিক আহমদ ছফার একটি চিঠি পাঠ করেন, যেখানে চিঠির প্রাপকের উদ্দেশ্যে লেখা ছিল: ‘আমি তোমাকে শোভনদণ্ডী গ্রামের আস্কর আলী পণ্ডিতের গানগুলোর প্রতি একটু যত্নবান হওয়ার অনুরোধ করবো। আস্কর আলী কত বড় গীতিকার, মূল্যায়নের কোনো প্রয়াসই গ্রহণ করা হয়নি। আস্কর আলীর সুরের এক বিশেষ মাদকতা এবং দাহিকা শক্তি আছে। এই জিনিস বাংলা গানের এক বিশেষ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। আমি তো তাকে সিলেটের হাসন রাজার মতো বড় একজন ভাবুক এবং গীতিকার মনে করি।’

ছফার এই বক্তব্য পড়ে আরেফীন আলোড়িত হয়ে আবারও পণ্ডিতের রচনা সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। তিনি আবারও পণ্ডিতের বাড়িতে বারবার যেতে থাকেন। কিন্তু তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেননি। একদিন আরেফীন কয়েকজন অনুজকে সঙ্গে নিয়ে পণ্ডিতের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। পথিমধ্যে তাদের পেয়ে বসল বৃষ্টি। তারা বৃষ্টিতে ভিজে পণ্ডিতের বাড়ির উঠোনে উপনীত হলে, পণ্ডিতের বাড়ির লোকজন তাদের দেখে ঘরে বসতেও দেননি। তারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চন্দনাইশ সদরে ফিরে আসেন। তখন রাত প্রায় ৯টা। বৃষ্টিতে ভেজার কারণে মধ্যরাতে আরেফীনের শরীরে এলো প্রচণ্ড জ্বর। প্রায় ১৫ দিন লেগেছিল তার সুস্থ হতে। এ ঘটনার পর আরেফীন পণ্ডিতের বাড়ির বদলে চন্দনাইশ ও পটিয়ায় পণ্ডিতের ভক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এবার তিনি সফল হলেন। পূর্ব চন্দনাইশের সিরাজুল ইসলাম খুইল্যা মিয়া থেকে পণ্ডিতের ‘পঞ্চসতী প্যারজান’; চন্দনাইশের হাজিপাড়ার ছফুরা খাতুন (স্বামী কাঞ্চন মিয়া) থেকে ‘জ্ঞান চৌতিসা’; পটিয়ার শোভনদণ্ডীর মল্লপাড়ার মোহাম্মদ হোসেন থেকে ‘বর্গসাস্ত্র বা মাত্রি-ভাষা’, ‘গীত বারমাস (গীত বারমাস ২য় ভাগ)’, ‘নন্দবেহার: প্রথম ভাগ’; চন্দনাইশের সাতবাড়িয়ার হাফেজ নগর দরবার শরীফের শহিদুল আনোয়ার থেকে ‘হাফেজ বাহাদুর (গীত, বারমাস ও কবিতা: প্রথম ভাগ)’ প্রভৃতি গ্রন্থ উদ্ধার করতে সক্ষম হন। আরেফীনের পরিবারে রক্ষিত ছিল পণ্ডিতের গ্রন্থ ‘নন্দবিলাস’। এসব গ্রন্থের মধ্যে ‘পঞ্চসতী প্যারজান’ ও ‘জ্ঞান চৌতিসা’ হলো পুঁথি বা প্রণয়কাব্য, অন্যগুলো সঙ্গীতগ্রন্থ। ‘জ্ঞান চৌতিসা’ ও ‘পঞ্চসতী প্যারজান’ সম্পর্কে একটু বলা যাক। ‘জ্ঞান চৌতিসা’র অর্থ হলো জ্ঞানে স্তোত্র, জ্ঞান বিচারের পদ বা পয়ার, জ্ঞানের শ্লোক ইত্যাদি। এই পুঁথিতে প্রণয়কাহিনীর আশ্রয়ে মরমি বা আধ্যাত্মিক দর্শনের চর্চা করা হয়েছে। ‘পঞ্চসতী প্যারজান’ নামটি শুনলে ধারণা জন্মে, পাঁচজন সতী এবং প্যারজান নাম্নী কোন এক নারীকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এ ধারণা সঠিক নয়।

‘পঞ্চসতী প্যারজান’-এ বলা হয়েছে

কবি কুল দরিদ্র আরতি মহাজন।
পরভাগ্যে করয় কবিতা সুবচন॥
রাজকন্যা পেয়ারজান পাচক্ষরে সন্ধি।
এক সূত্রে পঞ্চসতী কেনে হৈল বন্ধি॥
দৈব গতি আমা প্রতি কৃপার বিধানে।
জিজ্ঞাসিলা পঞ্চ সতি কেবা কোন স্থানে॥
মহাজন আদেশ হীনের শিরে ধরি।
পঞ্চ শতি বলে জারে সেই পঞ্চ নারি॥

অর্থাৎ পুঁথিতে প্যারজানকেই পঞ্চসতী সাব্যস্ত করা হয়েছে। পুঁথিটি স্রেফ প্রণয়ভিত্তিক কাব্য। তা পাঠে, প্রধানত, কাহিনী পাঠের সাধারণ স্বাদটুকুই পাওয়া যায়। এছাড়া পাওয়া যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও। শাস্ত্রীয় কিছু বিষয়-আশয় বা রীতিনীতির উপস্থিতি। এতে প্রমাণিত হয়, পুঁথিটি স্রেফ প্রণয়ভিত্তিক কাব্য হলেও, সমাজ-বাস্তবতার সামান্য ছোঁয়াও তাতে বিদ্যমান।

আরেফীন পণ্ডিতের এসব রচনা নিয়ে চট্টগ্রামের বলাকা থেকে তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন: ‘আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায়’ (২০০৬, পৃষ্ঠা:১১২, মূল্য: ১২০ টাকা ), ‘আস্কর আলী পণ্ডিতের দুর্লভ পুথি জ্ঞান চৌতিসা ও পঞ্চসতী প্যারজান’ (২০১০, পৃষ্ঠা:২৮০, মূল্য: ৩০০ টাকা) ও ‘আস্কর আলী পণ্ডিত: ৮৬ বছর পর’ (২০১৩, পৃষ্ঠা:১৬০, মূল্য: ২৫০ টাকা)। ‘আস্কর আলী পণ্ডিত: একটি বিলুপ্ত অধ্যায়’ ও ‘আস্কর আলী পণ্ডিত: ৮৬ বছর পর’ গ্রন্থদ্বয়ে পণ্ডিতের তিনশতাধিক গান-কবিতাসহ গবেষণাধর্মী আলোচনা স্থান পেয়েছে। ‘আস্কর আলী পণ্ডিতের দুর্লভ পুথি জ্ঞান চৌতিসা ও পঞ্চসতী প্যারজান’ গ্রন্থে পুঁথি দু’টি সম্পাদিত হয়েছে।

আস্কর আলী পণ্ডিতের রচনা সংগ্রহ করতে গিয়ে আরেফীন লক্ষ্য করলেন, এই পণ্ডিতের ভক্ত-অনুরক্ত ও অন্যান্য লোকসঙ্গীত প্রেমীদের কাছে আরও অনেক বিলুপ্ত লোককবির রচনা সংরক্ষণে রয়েছে। আরেফীন অনুভব করলেন, যে কোনো দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকবিশ্বাস, লোকসাধনা, লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির মধ্যে নিহিত থাকে সে দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল শক্তি। এসবের মধ্যে নিজস্বতাকে আবিষ্কার করাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফলে আরেফীন উক্ত বিলুপ্ত লোককবিদের রচনা উদ্ধারের দিকেও নজর দেন।

তিনি পটিয়ার শোভনদণ্ডীর মল্লপাড়ার মোহাম্মদ হোসেন থেকে লোককবি মনিন্দ্র দাস (১৯০০-২০০০, জন্মস্থান: চট্টগ্রামের চন্দনাইশ), মকবুল আহমদ পণ্ডিত (জন্ম-মৃত্যুসন অজ্ঞাত, জন্মস্থান: চট্টগ্রামের রাউজানের নয়াপাড়া) ও ক্ষেমেশ চন্দ্র রক্ষিতের (১৮৪৭-১৯২২, জন্মস্থান: চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থানার জোয়ারা); পটিয়াস্থ খরনার ফকিরপাড়ার হামিদ বখসু থেকে লোককবি সেকান্দর গাইনের (১৮৬০-১৯৪২, জন্মস্থান: চট্টগ্রামের পটিয়া); চন্দনাইশ উপজেলার মুরাদাবাদের নুরুচ্ছাফা, আবুল বশর ও পটিয়ার খরনার লালারখিলের ফজল ফকির থেকে লোককবি খায়েরজ্জমা পণ্ডিতের (১৮৭৬-১৯৫১, জন্মস্থান: চন্দনাইশের মুরাদাবাদ); চন্দনাইশের বৈলতলির রুহুল আমিন থেকে লোককবি মোয়াজ্জমের (উনিশ শতকে জন্ম ও মৃত্যু, সম্ভবত উত্তর বঙ্গের লোককবি); চন্দনাইশের উত্তর গাছবাড়িয়াস্থ বদুরপাড়ার আবুল কাসেম থেকে লোককবি মুন্সী আমিন শরীফ (১৮৯৮-১৯৬৬, জন্মস্থান: চট্টগ্রামের চন্দনাইশের মোহাম্মদপুর), আবুল খায়ের নক্সবন্দি (১৯০৮-১৯৭৩, জন্মস্থান: চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার পূর্ব বরিয়া) ও আতর আলীর (জন্ম-মৃত্যুসন ও জন্মস্থান অজ্ঞাত); চন্দনাইশের পশ্চিম এলাহাবাদের ছুফিয়া দরবার শরীফের শাহজাদা রেজাউল করিম থেকে লোককবি সাইদ মিয়া (১৮৮৯-১৯৬৬, জন্মস্থান: বরিশালের কোতোয়ালি বার থানার তাজকাটি), আতিকউল্লা শাহ্ (১২৯০-১৩৫৫ হিজরি, জন্মস্থান: বরিশালের আলেকান্দা এলাকার কালুখান বাড়ি) ও আবদুল আজিজ পণ্ডিতের (১৮৯৭-১৯৯৫, জন্মস্থান: বরগুনা জেলার আমতলী থানার ধানখালী); চন্দনাইশের হারলা নিবাসী মাস্টার নুরুল আলম ও প্রাগুক্ত রেজাউল করিম থেকে লোককবি শাহ্ আবদুল জলিল সিকদারের (১৮৫৭-১৯৩৪, জন্মস্থান: চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার মনেয়াবাদ); চন্দনাইশের দক্ষিণ গাছবাড়িয়া গ্রামের অছিয়র রহমান থেকে লোককবি মোরশেদ চাঁদ দরবেশ (জন্ম-মৃত্যুসন ও জন্মস্থান অজ্ঞাত), আবদুল্লাহ বাঞ্জরামপুরী (জন্ম-মৃত্যুসন অজ্ঞাত, জন্মস্থান: ত্রিপুরা বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্জরামপুর) ও করিম শাহার (জন্ম-মৃত্যুসন অজ্ঞাত, জন্মস্থান: নয়নপুরের অন্তর্গত বাগরা); নোয়াখালী জেলার হাতিয়া দ্বীপের চরকৈলাস গ্রামের বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন থেকে লোককবি আব্দুর রশিদের (১৮৯৯-২০০১/২০০২, জন্মস্থান: হাতিয়ার চরবাটা); চন্দনাইশ নিবাসী শাহীন নুপুরের মাধ্যমে লোককবি আবদুল লতিফ শাহ্-র (-১৯৮২, জন্মস্থান: মধ্যম চন্দনাইশ) অনেক দুষ্প্রাপ্য রচনা উদ্ধার করতে সক্ষম হন।

এদের মধ্যে লোককবি শাহ্ আবদুল জলিল সিকদার সম্পর্কে বলতে হয়, তিনি উনিশ শতকের শক্তিমান লোককবি। তিনি জাহাঁগিরিয়া তরিকার শীষ্য ছিলেন। তিনি ‘প্রভু পরিচয়’ নামক সঙ্গীতগ্রন্থ ছাড়াও জাহাঁগিরিয়া তরিকার একজন মুর্শিদের জীবনী ও তাঁর ইন্তেকালের ঘটনা নিয়ে রচনা করেন ‘জাহাঁগির চরিত’ পুঁথি। তিনি নিজের জন্মস্থানের ইতিহাস নিয়ে ‘মনেয়াবাদের ইতিবৃত্ত’ রচনা করেন।

লোককবি মনিন্দ্র দাস সম্পর্কে বলতে হয়, তিনি বিশ শতকের বড় কবিয়াল হলেও লোকজ ঘরানার গান, কবিতা এবং গদ্যও রচনা করতেন। তার সেসকল গান, কবিতা এবং গদ্য অনেকগুলো পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। যেমন, চট্টল কবিগান শিক্ষা, গান্ধীজী শোকসঙ্গীত, মহাত্মা গান্ধী কবিতা, নিশ্চল গীত, ১৯৪৩ সনের কবিতা, কবিয়াল সমাজমঙ্গল, অবধূত গীতি, মহাযুদ্ধের কবিতা, অশ্রু বা হালকা গান, অবধূত বিধি, আজাদ হিন্দ ফৌজ গীত, কায়েদে আযমের কবিতা এবং নূরের ঝলক, বাউল সঙ্গীত, লীগের কবিতা প্রভৃতি। উল্লেখ্য, কবিগানে আবির্ভূত হওয়ার পূর্বে কলকাতায় থাকাকালেও তিনি লেখালেখি করেছেন। সেসময় তিনি লিখেছেন ‘ভাঙ্গার পূজারী, পরাধীনতার অভিশাপ, ব্রিটিশ খেদাবো, সাদা চামড়ায় আগুন, ব্রিটিশ বলি প্রভৃতি। অন্য পাঁচ জনের নামে ব্রিটিশ বিরোধী এসব গ্রন্থ ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তাদের জেল হয়েছিল।

শামসুল আরেফীন এসব লোককবি ছাড়াও আরও অনেক লোককবিসহ শতাধিক লোককবির বিলুপ্ত রচনা আবিষ্কার বা উদ্ধার করেন। এসব লোককবির অধিকাংশদের রচনা ও তাদের সম্পর্কে আলোচনা নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের বলাকা থেকে প্রকাশ করেছেন ‘বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য’-১ম খণ্ড (২০০৭, পৃষ্ঠা:১২৮, মূল্য: ১৫০ টাকা), ‘বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য’-২য়-৪র্থ খণ্ড (২০০৮, পৃষ্ঠা:২৪০, মূল্য: ২৮০ টাকা), ‘বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় লোকসঙ্গীত’-১ম খ- (২০১২, পৃষ্ঠা:৪৩২, মূল্য: ৪৫০ টাকা), ‘চট্টগ্রামের লোকগান: বিবিধ প্রবন্ধ’ (২০২০) প্রভৃতি। লোককবি মনিন্দ্র দাসকে নিয়ে তিনি বলাকা থেকে প্রকাশ করেছেন ‘কবিয়াল মনিন্দ্র দাস ও তাঁর দুষ্প্রাপ্য রচনা’ (২০১৮, পৃষ্ঠা:১৯০, মূল্য: ৩০০ টাকা)।

শামসুল আরেফীন আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকিরের (১৭৫৯-১৮৩৭) দুই শতাধিক গান এবং ‘সৃষ্টিপত্তন’ নামে একটি পুঁথিও উদ্ধার করেন। চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার ওসখাইন গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই আলী রজা সম্পর্কে বলা দরকার, তিনি আঠারো শতকের শক্তিমান কবি। তিনি জীবদ্দশায় অনেক পুঁথি রচনা করেন। তার ‘জ্ঞানসাগর’-সহ এ পর্যন্ত ৩০টি গ্রন্থের নাম পাওয়া গেছে।

১. জ্ঞানসাগর ২. আগম ৩. ষটচক্রভেদ ৪. ধ্যানমালা ৫. সিরাজ কুলুপ ৬. যোগকালন্দর ৭. শাহনামা (প্রথম ও দ্বিতীয় খ-) ৮. রাগতাল নামা ৯. ইসলাম নামা ১০. খাবনামা ১১. সৃষ্টিপত্তন ১২. হাতেম তাঈ ১৩. তাওফায়ে হেদায়তুল এজাম ১৪. আওরাদে আছানি ১৫. ছালাতুল মোক্তাদি ১৬. রফিকুচ্ছালেকীন ১৭. কিতাবে জরুরে মুকাল্লেদ ১৮. কিতাবে তাজহিজে তাকদ্বীন ১৯. আহকামুচ্ছালাত ২০. তাওফায়ে মকবুল ও ফজায়েলে রাসুল ২১. কিতাবে চেহেল হাদিছ ও মছায়েল ২২. খোতবায়ে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা ২৩. বয়ানে শবে বরাত ও শবে ক্বদর ২৪. রাহাতুর রুহ্ ২৫. তারিফে রাসুল ২৬. যোগ সাধন ২৭. তনের বিচার ২৮. জ্যোতিষ নামা ২৯. রাগনামা ৩০. অমরসিং।

 

শামসুল আরেফীন আলী রজার অধিকাংশ বংশধরের কাছ থেকে তার রচনা উদ্ধারে কোনো সহযোগিতা না পেলেও কোনো কোনো বংশধর ও আবুল বশর নামে আলী রজার একজন ভক্তের সহযোগিতায় প্রাগুক্ত রচনা, অর্থাৎ দুই শতাধিক গান এবং ‘সৃষ্টিপত্তন’ পুঁথি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। আবুল বশর চন্দনাইশের কাঞ্চননগরস্থ নগরপাড়া নিবাসী ছিলেন। শামসুল আরেফীন আলী রজা সম্পর্কে আলোচনা ও তার কিছু গান নিয়ে বলাকা থেকে প্রকাশ করেছেন ‘আঠারো শতকের কবি আলী রজা ওরফে কানুফকির’ (২০১৭, পৃষ্ঠা:১২০, মূল্য: ২৫০ টাকা) গ্রন্থটি।

আরেফীন লোককবি আবদুল গফুর হালীকে নিয়েও আলোচনা করেন। ২০০৪ সালের ০৩ ডিসেম্বর, দৈনিক আজাদীতে তিনি হালীকে নিয়ে ‘ড. হানস হারডারের গবেষণায় আধ্যাত্মিক গানের সাধক আবদুল গফুর হালী’ শিরোনামে আলোচনা করেন। বাংলাদেশের কোনো পত্রিকায় গফুর হালীকে নিয়ে এটা ছিল প্রথম গবেষণাধর্মী আলোচনা। পরবর্তীতে ‘বাংলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য’-২য়-৪র্থ খণ্ড গ্রন্থে আলোচনাটি অন্তর্ভুক্ত হয়।

শামসুল আরেফীন নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে বর্তমান পর্যন্ত চট্টগ্রামের পথে-প্রান্তরে পায়ে হেঁটে, এছাড়া ব্যক্তিগত খরচে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লোককবিদের সন্ধানে ঘুরছেন। কোনো আর্থিক সহযোগিতা এক্ষেত্রে তিনি কোনভাবে কখনো পাননি। ইতিমধ্যে তিনি নিযুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন প্রজেক্টের গবেষক হিসেবে। এ পর্যন্ত তার সকল গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে চট্টগ্রামের বলাকা থেকে।

লোকগবেষণা শামসুল আরেফীন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর