জরিনার অন্যরকম ভালোবাসা
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৯:২১
আশির দশকের কথা। মাজহারুল ইসলাম। মাজহার হুজুর কিংবা হুজুর বলেই সম্বোধন করে গ্রামের মানুষ। উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলার তারাগঞ্জ থানার অধীনে শিমুলতলি গ্রাম। সেই গ্রামেই মাজহার অনেকটা ‘সুখের দূত’। মাজহারের বাড়ি নোয়াখালী। বাবার সঙ্গে প্রথম এসেছিল উত্তরবঙ্গে। বাবার দোয়া তাবিজের ব্যবসা। বাবার সহযোগী হিসেবে কাজ করত মাজহার। বছরখানেক আগে বাবা মারা গেছেন। তাই মাজহারই চালিয়ে যাচ্ছে সেই পৈত্রিক ব্যবসা। গ্রামের মানুষের কাছে বাবা কিংবা ছেলের আলাদা কোন পার্থক্য নেই।
না, সবসময় এই শিমুলতলিতে থাকে না মাজহার। বছরে মাত্র দুই মাস একগ্রামে তারপর আবার বাড়িতে ফিরে যাওয়া। বাড়ি থেকে ফেরার পর আবার নতুন কোনো গ্রাম, আবার দুই মাস। এইভাবে পুনরায় একটা গ্রামে ফিরতে প্রায় বছরখানেক লেগে যায় মাজহারের। তবে শিমুলতলির মানুষই মনে হয় সবচেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছে মাজহারকে।
এই গ্রামের মানুষজন মাজহারকে অন্য রকম এক অতিমানব মনে করে। তবে মাজহার জানে সে কোন পীর-ফকির কিংবা কামেল মানুষ নয়। মানুষ যা ভাবে, তা সবই মিথ্যে, সবই কাল্পনিক।
মাজহার অনেকটা পেয়িং গেস্ট এর মতো এক বাড়িতে থাকে। এ পর্যন্ত অন্তত চার-পাঁচ বার এসেছে এই গ্রামে এবং একই বাড়িতে উঠেছে। অবশ্য অনেকের মধ্যেই আকাঙ্ক্ষা দেখা যায় হুজুরকে তাদের বাসায় রাখার জন্য, তবে এখনও সেই সফলতা কেউ পায়নি।
মাজহার হুজুর যে বাসায় থাকে তার সামনেই রাস্তার পাশে একটু খালি জায়গা। এই জায়গাটিকেই মাজহার ব্যবসার জন্য বেছে নিয়েছে। মাত্র আধা কিলোমিটার দূরেই স্থানীয় হাট। এপথেই মানুষজন হাটে যাওয়া আসা করে।
আসরের নামাজের পরেই শুরু হয়ে যায় দোকান সাজানোর আয়োজন। প্রথমে চার কোণায় চারটি ছোট খুঁটি পোতা হয়, তারপর তিন দিক দিয়ে একটি লাল কাপড় খুঁটিগুলোতে আটকানো হয়। খুঁটি এবং কাপড়ের উচ্চতা মাত্র এক ফুট। অনেকটা ডিমার্কেসন এর মতন তবে লাল কাপড় ব্যবহারে ডিমার্কেসনটা বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ঘিরা দেওয়া জায়গার মাঝখানে একটা তিন ফুট বাই তিন ফুটের টেবিল। এই টেবিলটির উচ্চতাও এক ফুটের বেশি নয়। সুন্দর একটা সাদা টেবিল ক্লথ পাড়া হয় টেবিলে। এরপর এই টেবিলেই একরে পর এক তাবিজ, তসবিহ, আতর, সুরমা ও টুপি সহ আরও অনেক ধরনের ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত জিনিসের পসরা সাজানো হয়। দোকান সাজাতে সাজাতেই মাগরিবের সময় হয়ে যায়। এবার নামাজ পড়ে একটা হ্যচাক লাইট জালিয়ে (কেরোশিন তেলের বিশেষ ধরনের লাইট যার আলো বৈদ্যুতিক লাইটের মতন) টেবিলের ওপরেও রাখে মাজহার। না, তসবিহ, টুপি, আতর কিংবা সুরমার খুব একটা বর্ণনা প্রয়োজন হয় না। যাদের প্রয়োজন তারা চাহিদা অনুযায়ী কিনে থাকে কিন্তু তাবিজের তো একটু বর্ণনা লাগেই। বিভিন্ন রকম বালা-মুসিবত অসুখ-বিসুখের জন্য বিভিন্ন ধরনের তাবিজ দিয়ে থাকে মাজহার। তবে সে তার বাবার বর্ণনা অনুকরণ করে মাত্র। এ বপারে তার বাড়তি কোনো ধারণা বা জ্ঞান নেই। তাই বিবেকের তাড়নায়, সে নতুন দু’টি জিনিস যোগ করেছে বর্ণনার। প্রথমত, সে গ্যারান্টি সহকারে তাবিজ বিক্রির বিপক্ষে এবং অসুখ-বিসুখ হলে প্রথমেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। হ্যাঁ, তবে ডাক্তারি ওষুধ কাজ করার ক্ষেত্রে এই তাবিজ অবশ্যই উপকারে আসতে পারে। মানুষজন হাঁট থেকে ফেরার সময় চাহিদা অনুযায়ী একটা তাবিজ কিনে থাকে। সাথে তসবিহ, আতর কিংবা সুরমা। রাত ন’টার মধ্যে দোকান গুটিয়ে ফেলে মাজহার।
দিনের বেলা সাধারণত মালামাল সংগ্রহ এবং প্রস্তুত করতে ব্যস্ত থাকে মাজহার। তারাগঞ্জ থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে শহর থেকে মালামাল সংগ্রহ করতে হয়। মাজহারের একটা সাইকেল আছে, এই সাইকেলেই শহরে যাতায়াত অবলম্বন।
প্রথমেই মনোহারিপট্টিতে তাবিজের জন্য চেইন ও কালো সূতা, চেইন বড়দের ও কালো মোটা সুতা বাচ্চাদের তাবিজ পড়তে প্রয়োজন। এরপর বানিয়াতি দোকান, এখানে মরিয়ম ফুল, মৌচাকের মোম ইত্যাদি। মৌচাকের মোম দিয়ে তাবিজের মুখ বন্ধ করা হয় এবং মরিয়ম ফুল মহিলাদের সন্তান জন্মদানের সময় খুবই কার্যকর, বাবার কাছে শুনেছে। সবশেষ মানিকের দোকান, এখানে তাবিজ সংক্রান্ত সবই পাওয়া যায়। এই যেমন মাদুলি-তামা, লোহা, স্টিল। ছোট কিংবা বড়। গোল কিংবা চেপ্টা, সব ধরণের মাদুলি পাওয়া যায় এখানে। তাবিজে ব্যবহারের জন্য রেডিমেড ছাপানো দোয়াও পাওয়া যায় এখানে। কোন দোয়ায় কী কাজ— বাবার কাছে শুনেছে মাজহার, সেই অনুসারে বয়ান চলে মাজহারের। আতর, সুরমা, তসবিহ সব মানিকের দোকানেই পাওয়া যায়।
দুপুরের মধ্যেই গ্রামে ফেরে মাজহার। খাওয়া-দাওয়া ও নামাজের পরই শুরু হয় প্রক্রিয়া। তাবিজ তৈরির ছোটখাটো কারখানা বলা যেতে পারে। মাদুলির মধ্যে দোয়া, মরিয়ম ফুল ইত্যাদি ভরার পর মোম দিয়ে আটকানো, সবশেষ চেইন কিংবা সুতা। বিভিন্ন সমস্যার জন্য বিভিন্ন দোয়া। মূল্য অনুযায়ী ছোট বড় চেপ্টা ইত্যাদি। এভাবেই কেটে যায় দুই মাস তারপর বাড়ি ফেরা এবং নতুন কোনো গ্রামের সন্ধান। তবে শিমুলতলির মানুষ মিস করে মাজহারকে।
প্রায় বছরখানেক পর মাত্র ক’দিন আগে শিমুলতলিতে ফিরেছে মাজহার। সপ্তাহখানেক হলো দোকানও শুরু করেছে। মানুষের তো সমস্যার শেষ নেই, একবছরের জমানো সমস্যা। মাজহারের দিনকাল বেশ ভালোই কাটছে তবে তার মানটা খারাপ হয়ে যায় যখন দেখে সবাই তাকে অতিমানব ভাবছে। এই গ্রামে মাজহারের তেমন কোনো বন্ধু নেই। কাজের কাজ ছাড়া সামাজিকতার সুযোগ নেই মাজহারের। গ্রামের মানুষজন তাকে সেই আসনেই বসিয়েছে। আর বসাবে নাইবা কেন। যেমন সুদর্শন তেমনই বেশভূষা, গালভর্তি দাড়ি তো আছেই। আয়রন করা পাঞ্জাবি-পায়জামা, টুপি, দোকানে বসার সময় মাথায় পাগড়ি আর চোখে চশমা। মাত্র আঠাশ বছরের এই যুবকের বেশভূষা ও আচার-আচরণই তাকে অতিমানব করে তুলেছে। এই গ্রামে তো সাধারণত এমন ছিমছাম লোক চোখে পড়ে না সহজে।
আজ শুক্রবার, তারাগঞ্জের বড় হাঁট। প্রচুর লোক সমাগম ঘটে এই হাঁটে। আজ মাজহারের ব্যবসাও বেশ ভালো। প্রতিদিন রাত ন’টায় দোকান বন্ধ করলেও আজ দশ’টা বেজে গেছে। প্রতি শুক্রবারেই সাধারণত এমনই হয়, তবে ইতোমধ্যে দোকান বন্ধের আয়োজন শুরু করে দিয়েছে মাজহার। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে অন্তত ঘণ্টাখানেক লাগবে। ধীরে ধীরে মানুষজন কমে আসছে রাস্তায়। মাঝে মধ্যে দুই-একজন চোখে পড়ছে, তারাও কোনো না কোনো বস্তুর পসরা বসিয়েছিল হাটে, এখন বাসায় ফিরছে।
হঠাৎ মাজহারের সামনে এক তরুণী হাজির। হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, হুজুর তাড়াতাড়ি বাসায় চলেন, এক্ষুনি, আমাদের খুব বিপদ।
মাজহার হতবাক। কে এই তরুণী, কিসের বিপদ, আমিই বা কী করতে পারবো তার বিপদে। এবার মাজহার নিজেই পড়ে গেল বিপদে, কী করবে ভেবে পাচ্ছেন না। এই মেয়েটিকে একটু চেনাচেনা লাগলেও কোথায় দেখেছে, মনে করতে পাছে না।
এবার মেয়েটি বলল, হুজুর আমার নাম জরিনা, আপনি যে বাসায় থাকেন সে বাসার মেয়ে, শেফালি আমার বান্ধবি। আপনি তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় না গেলে মহা বিপদ হয়ে যাবে।
মাজহার কিছুটা আস্থা পায়। না, তার নিজের বিপদের সম্ভাবনা নেই, সে এই মেয়েকে শেফালির সাথে দেখেছে।
মাজহার হুজুরের দোকান গোছানোর কাজ মোটামুটি শেষ পর্যায় ছিল। কোনোমতে মালামালগুলো ঘরের উঠানে রেখেই চললেন জরিনার সাথে। মনে কৌতূহল ঘুরপাক খেতে লাগলো, কী বিপদ? কিসের বিপদ? আমিই বা কী করবো? না, কিছুই জানেন না মাজহার হুজুর, তবে জরিনার ব্যকুলতা দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করার অবকাশ নেই।
শেফালিদের বাসা থেকে জরিনার বাসার দূরত্ব মাত্র পাঁচ মিনিটের। জরিনা হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় প্রবেশ করল। মাজহারকে দেখে যেন জরিনার বাবা-মা আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। বাবা, তুমিই পারো এতো রাতে আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে। কৌতূহল বাড়তে লাগলো মাজহারের, তার সাথে অসহায়ত্ব। ইতোমধ্যে আন্দাজ করেছেন, জটিল কোনো সমস্যার সমাধান আশা করছে পরিবারটি, যা হয়ত আমার ক্ষমতার বাইরে।
এক ধাত্রী দৌড়ে এলো, আপনারা কি করছেন, এখনই কিছু না’করলে জামিলাকে বাঁচানো যাবে না। আমার আওতার বাহিরে। আমি কিছু করতে পারব না।
বিষয়টি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে মাজহারের কাছে। জামিলা সন্তানসম্ভবা, ধাত্রীকে ডাকা হয়েছে সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে ধাত্রী অসহায়।
মাজহার বললেন, আপনারা হাসপাতালে জাননি কেন?
সবাই নিরুত্তর। সবার ধারণা, মাজহার অতিমানব, দ্রুত কিছু একটা করে ফেলবেন। সবাই আশা করেছিল মাজহার হুজুর কোনো একটা তাবিজ দিয়ে কিংবা পানি পড়া দিয়ে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন পরিস্থিতি। না, মাজহার কিছুই করলেন না। বললেন, আপনাদের আশেপাশে কোনো ভ্যানগাড়ি থাকলে দ্রুত ডাকুন, হাসপাতালে নিতে হবে ওনাকে। যতক্ষণ ভ্যান আয়োজন হচ্ছে, ততক্ষণ আমি কিছু দোয়া পড়ছি, আপনারাও পড়েন, যে যা জানেন।
মাজহারের সামনে একগ্লাস পানি হাজির করা হলো। মাজহারের বুঝতে বাকি রইল না যে, দোয়া পড়ে ফু দেওয়ার জন্যই উপস্থাপন করা হয়েছে গ্লাসটি। মাজহার যেটুকু দোয়া-দুরুদ পড়েছেন তা দিয়েই ফু দিলেন গ্লাসটিতে। পানিটি দ্রুত খাওয়ানো হলো জামিলাকে। না, মাজহার বলেননি খাওয়াতে। তিনি অসহায়, তিনি যেন তার বিবেকের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছেন না। পরিচালিত হচ্ছেন উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতি অনুযায়ী। ধাত্রী চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। মাজহার আসাতে তিনিও একটু বাড়তি সাহস পাচ্ছেন। ভ্যান এসে গেছে। হঠাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজ।
ধাত্রী দ্রুত ছুটে এসে খবর দিলেন, ছেলে হয়েছে, আনন্দের বন্যা বয়ে গেল মুহূর্তেই। বাড়ির সকলে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটির চেয়ে মাজহারকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বেশি।
মাজহার বললেন, আমার কোনো অবদান নেই। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আপনারা, নিশ্চয়ই কোনো পুণ্য করেছেন বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেছেন। কাল সকালেই, জামিলা এবং নবজাতক দুজনকেই ডাক্তার দেখাবেন।
এবার মাজহারের বিদায়ের পালা। সকলে কৃতজ্ঞতার নিদর্শন-স্বরূপ দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন মাজহারকে, জরিনা অরও একটু পথ এগুলো মাজহারের সাথে।
সারারাত ঘুমোতে পারেনি মাজহার, ভেবেছে জরিনা’র কথা, জামিলা’র কথা, সর্বোপরি শিমুলতলি গ্রামের কথা। শিমুলতলির মানুষের মাঝে বাস্তবতার অভাবের কথা।
শেফালিদের বাসায় জরিনার আনাগোনা বেড়ে যায় হঠাৎ। না, শেফালির জন্য নয়, জরিনার আকর্ষণ মাজহারের ব্যবসা, তাবিজের ব্যবসা। জরিনা একটু স্বাবলম্বী হতে চায়। নিজে কিছু রোজগার করতে চায়। সে তো অন্য কোনো কাজ শেখেনি। শেফালির সাথে মাঝে মাঝে মাজহারের ঘরেও যায়। মাজহার তার তাবিজ তৈরির প্রসেস প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেকটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে জরিনার সাথে।
জরিনার বয়স বাইশ, মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামের মজিদ আলীর ছেলে কামরুলের সাথে। মাত্র এক বছরের মাথায় ট্রাক্টর চাঁপায় মারা যায় কামরুল। নিজ জমিতে হাল চাষ করছিল, হঠাৎ উল্টে যায় ট্রাক্টর। আঘাত গুরুতর ছিল না, তবে মাথায় আঘাত লাগায় মৃত্যু।
মজিদ আলী ভালো মানুষ। পুত্রবধুকে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জরিনার বাবা মেয়েকে নিয়ে এসেছেন নিজ বাড়িতে।
জরিনা স্বাবলম্বী হতে চায়, বাবাকে আর্থিক সহযোগিতা করতে চায়, কিন্তু কিভাবে? তাই তার তাবিজের ব্যবসাটা শেখা খুবই প্রয়োজন। তৈরির প্রক্রিয়া অনেকটা জানা হয়ে গেছে, এবার মালামাল ক্রয় সংক্রান্ত জ্ঞান।
না, মাজহার বিষয়টা মোটেও আঁচ করতে পারেনি। সে ভেবেছে সবই কৌতুহল। জরিনা একদিন বায়না ধরে, সে এবং শেফালি তার সাথে শহরে যাবে। মাজহার যেন আকাশ থেকে পড়ল। ইতোমধ্যে, জরিনার জীবনের গল্প জানা হয়ে গেছে মাজহারের। না, জরিনা কিছুই বলেনি, শুনেছে শেফালির কাছে।
শেফালির মা রহিমা খাতুনের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে মাজহার। জরিনার স্বপ্ন অনেকটা সফল হতে চলেছে।
শহরে শেফালি বেশ আনন্দ পাচ্ছে, কিন্তু জরিনার আগ্রহ মালামাল ক্রয়ের দোকান। মাজহার দোকানের বাইরে দুজনকে দাড় করিয়ে মালামাল ক্রয় করার চেষ্টা করে, জরিনা বলে আমাদের ভয় করে, আমরাও যাব দোকানে। একে একে সবই কেনা শেষ। আজ জরিনার আনন্দের দিন। তাবিজ ব্যবসা শেখার কোর্স সমাপ্ত।
আজকাল জরিনার আগমন খারাপ লাগে না মাজহারের। বলতে গেলে একরকম অপেক্ষাই করে। জরিনার কথা ভাবলে একরকম শিহরণ অনুভব করে মাজহার। বেশ ভালো মেয়েটি। মা, গেল বার বলেছিলেন, বাবা এবার বিয়ে কর, আমি তোকে বিয়ে দিয়ে বাড়িতেই রাখতে চাই। আর দেশ-বিদেশে ঘুরতে হবে না।
শেফালির মা রহিমা খাতুন। এই গ্রামে মাজহারের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত মহিলা। তিনি অনেকটা নিজের ছেলের মতোই স্নেহ করেন মাজহারকে। পেয়িং গেস্ট হলেও মুরগির রান কিংবা মাছের মাথাটাই দিয়েছেন মাজহারের পাতে সবার আগে।
মাজহার সাহস করে রহিমা খাতুনকে বলে, চাচী, মা আমার বিয়ের কথা ভাবছে। জরিনাকে বিয়ে করা কেমন হবে।
রহিমা বেগম অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে বললেন, বাবা এটাতো খুবই ভালো কথা। তুমি যদি জরিনাকে বিয়ে কর তাহলে বিরাট এক পুণ্য হবে বাবা। মেয়েটির জীবনে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, শুনেছো নিশ্চয়।
মাজহার বলল, হাঁ, আমি সবই জানি।
-কিন্তু তোমার মা রাজি হবেন কি-না?
-মায়ের বিষয়টা আমি দেখবো, মাজহারের সোজাসাপটা জবাব।
রহিমা খাতুন জরিনার মা-বাবাকে বিষয়টি জানাবেন বলে মাজহারকে আশ্বস্ত করলেন। আর কয়েকদিনের মধ্যেই মাজহার চলে যাবে তার বাড়িতে, নোয়াখালীতে।
পরদিন সকালে মালামাল ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বের হবে মাজাহার, এমন সময় পোস্টম্যান হাজির। চিঠি। এ বাসায় চিঠি শুধু একজনেরই আসে, মাজহারের। তাই ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইল না মাজহারের। মায়ের চিঠি। অন্যরকম এক উৎকণ্ঠা কাজ করছে , দ্রুত খামটা খুলে, পড়া শুরু করল মাজহার।
‘বাবা আমি খুবই অসুস্থ, তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়, নাহলে হয়তো দেখাই হবে না। আর একটা কথা, তোর বাবাতো নেই, আমি কার কাছে রেখে যাবো তোকে, তাই ভাবছি তোর বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি পারি সম্পন্ন করতে চাই।
ইতি তোর মা।’
চিঠিটি লিখেছে মাজহারের চাচাতো বোন, সে নিচে আলাদাভাবে লেখে দিয়েছে, ‘ভাইজান চাচীর শরীর বেশ খারাপ, চিঠি পাওয়া মাত্রই বাড়িতে আসার চেষ্টা করো।’
মাজহার আজই বাড়ি যাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রহিমা চাচী সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। শেফালি উধাও। সম্ভবত জরিনাদের বাসায় গেছে, খবর দিতে। মুহূর্তেই জরিনাসহ শেফালি হাজির।
রহিমা খাতুন জরিনাকে জানালেন, মা মাজহারের মায়ের অবস্থা ভালো না, ও এক্ষণই চলে যাচ্ছে।
মাজহারের মা এবার তার বিয়ে দিতে চান। মাজহার তোমাকে পছন্দ করেছে, আমি তোমর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলবো। তুমি কী বল?
জরিনা তো হতবাক। মাজহারের মতন সুদর্শন যুবক তাকে বিয়ে করবে। এ তো মেঘ না চাইতে পানি। জরিনা তো সেই প্রথম দিনই মাজহারকে পছন্দ করেছে। জরিনা লজ্জা পায়। বেরিয়ে পড়ে মাজহার।
ইতোমধ্যে জরিনা মায়ের কাছ থেকে এক হাজার টাকা ধার নিয়ে শুরু করে দিয়েছে তাবিজের ব্যবসা। শুধু তাবিজের ব্যবসা তো নয়, সমাজসেবা কিংবা সমাজ সচেনতার অভিযানও বলা যেতে পারে। সুন্দর একটা পোশাক পরে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে যায় জরিনা। জরিনার মনে পড়ে মাজহারের সেই কথা, জামিলার সন্তান জন্মদানের সময়কার কথা, ‘হাসপাতালে জাননি কেন আপনারা, এক্ষনি ওনাকে হাসপাতালে নিতে হবে’।
প্রত্যেককেই সমস্যা অনুযায়ী হাসপাতাল, কিংবা স্কুল কলেজ, থানা, ইউপি মেম্বার, যে যেখানে গেলে সমাধান পাবে, সেই পরামর্শ দিয়ে থাকে জরিনা, সাথে একটা তাবিজ। জরিনার কথাগুলো মানুষের মনে গেঁথে গেলেও তাবিজের প্রতি আকর্ষণের যেন কমতি নেই। না, তাবিজের জন্য কোনো টাকা পয়সা চায় না জরিনা। গ্রামের সবাই খুবই পরিচিত আপনজন। টাকা চাইতে লজ্জা পায় জরিনা, তবে গ্রামের অবস্থা-সম্পন্ন মানুষজন ৫০/১০০ টাকা দিয়ে থাকেন এবং গেরস্তরা ধান, চাল ডিম এবং অনেকে গাছের ফলও দিয়ে থাকেন। বাবার সংসারে অবদান রাখা শুরু হয়ে গেছে জরিনার পাশাপাশি গ্রামে বাড়তি সম্মান। যারা বিধবা হিসেবে এড়িয়ে চলতো জরিনাকে, তারাও এখন সম্মান করা শুরু করে দিয়েছে। অল্পদিনের মধ্যেই জরিনা হয়ে ওঠে গ্রামের এক ‘সুখ-দূত’।
না, মাজহারের আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। যাওয়ার সময় রহিমা বলেছিলেন, বাবা তোমার মায়ের শারীরিক অবস্থা জানিয়ে চিঠি দিও। মাজহারের যাওয়ার প্রায় দেড় মাস পর চিঠি। রহিমা খাতুনের নামে। চিঠি পড়ার দায়িত্ব শেফালির। ইতোমধ্যে জরিনাকে ডেকে এনেছে শেফালি। দারুণ উৎকণ্ঠা।
চাচীজান সালাম নিবেন
আমি মায়ের সাথে শুধুমাত্র কুশল বিনিময় করতে পেরেছিলাম। মা, বলেছিলেন পাশের গ্রামের সোলেমান আলীর মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। অমি হয়তো বিয়েটা সম্পন্ন করতে পারলাম না। এই শেষ কথা। না, জরিনার কথা বলার আর সুযোগই হয়নি। মায়ের মৃত্যুর পর একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। পরে আমার চাচা বিস্তারিত জানালেন।
সোলেমান আলী আমাদের বাসার সম্মুখভাগেই একটি দোকান সাজিয়ে দিয়েছেন। স্টেশনারি দোকান। কাছেই একটা বড় মাদ্রাসা আছে, দোকানটা চলবে ভালোই। আমি চাচাকে জরিনার কথা জানিয়েছিলাম কিন্তু চাচা সোলেমান আলীকে বোঝাতে সক্ষম হননি। সোলেমান আলীর পরিষ্কার কথা, আপনার ভাইপোর যদি অন্য জায়গা পছন্দ থাকে তাহলে আমাদের কথা দিলেন কেন। আমার দোকান সাজানোর খরচ কে দেব। গ্রামের সকলেই একরকম বাধ্য করেই আমাকে সোলেমান আলীর মেয়ের সাথে মায়ের ঠিক করা তারিখেই বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার বউ সালমা খুব ভালো মেয়ে। আমি তাকে জরিনার কথা বলেছিলাম তবে বিয়ের আগে বলার সুযোগ হয়নি। সালমা বলেছিল আগে জানলে সে বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করতো।
বিয়ের পনের দিন পর আমি শশুর বাড়ি যাচ্ছিলাম ভ্যানগাড়িতে, পিছন থেকে মাইক্রোবাস ধাক্কা দিলে আমরা দুজনই আঘাত পাই। তাৎক্ষণিক তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। দাওয়াত খেয়ে ফেরার পর হঠাৎ সালমার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। ডাক্তার বললেন, ব্রেন ইনজুরি। বড় হাসপাতালে নিতে হবে। পরে জেলা শহরের বড় হাসপাতাল, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি, না শেষ রক্ষা হয়নি, চাচী। দুই দিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সালমা।
সোলেমান আলী তার দ্বিতীয় মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব করেন কিন্তু বিয়ের আগের দিন এক বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে যায় মেয়েটি। এখন সোলেমান আলী তার ইনভেস্টমেন্ট ফেরৎ চান।
চাচী, এই পরিস্থিতিতে কি জরিনা গ্রহণ করবে আমাকে? আমার এখানে এক চাচা ছাড়া কেউ নেই, তিনিও খুব বৃদ্ধ। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না।
চিঠি পড়ার পর সকলেই নীরব, কেউ কথা বলছে না। রহিমা খাতুনের চোখে জল, শেফালি ও জরিনা ভারাক্রান্ত।
না মাজহার টিকতে পারেনি বাড়িতে, অল্পদিনের মধ্যেই চাচাও চলে গেলেন এ পৃথিবী ছেড়ে। সোলেমানের অত্যাচার বাড়তে থাকে। অবশেষে ভিটে-মাটি বিক্রি করে সোলেমানের টাকা পরিশোধ করার পর শিশূলতলিতে চলে আসে মাজহার।
রহিমা খাতুন ধুমধাম করে বিয়ে দেন জরিনা-মাজহারের।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পরলোকগমন করেন রহিমা খাতুন। শেফালির বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন। শেফালির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্বামী প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার।
পাঁচ বছর পর
আজ সোমবার। বাইরে বৃষ্টি। অল্প বৃষ্টিতেই রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে যায় এই গ্রামে। না আজ আর আহলামকে স্কুলে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আহলাম সবে মাত্র প্রি-প্রাইমারিতে ভর্তি হয়েছে। খেলাধুলার মাধ্যমেই চলছে পড়াশোনা। দুই-এক দিন না গেলেও তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
এদিকে আহলাম রেডি, শুধু নাস্তা করেই বেরুনোর পালা। না, জরিনার উঠতে ইচ্ছা করছে না আজ। রিম-ঝিম বৃষ্টিতে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা হচ্ছে না জরিনার। আহলামের ডাকেও তেমন সাড়া নেই। জরিনা বলল-বাবা আজ খুব বৃষ্টি, ঘরের মধ্যেই খেলাধুলা কর, আজ স্কুল যেতে হবে না। আহলাম মহা খুশি। ঘরের কোণেই খেলা শুরু করে দিল আহলাম।
শহরের উদ্দেশে ভোরেই বেরিয়ে পড়েছে মাজহার, মালামাল কিনতে। দুপুরের আগেই হাজির, বিরাট এক ইলিশ নিয়ে। আজ বৃষ্টি আজ হবে ইলিশ পোলাও।