খতিয়ানে শিল্প
১৪ মার্চ ২০২১ ১৬:৪১
খতিয়ান—শব্দটি কানে এলেই যেন কিছু হিসাব-নিকাশ, কিছু সংখ্যা বা গুটিকয়েক জটিলতার কথা ঘুরে ফিরে আসে। খতিয়ান হলো হিসাবের পাকা বই বা ভূমির পাকা হিসাব। কিন্তু অন্য অনেকভাবেই তো হিসাব হতে পারে। হতে পারে হিসাবের ভাষাও। খতিয়ান কেন কিছু সংখ্যা, কিছু কাগজের মধ্যে হতে হবে—তা হতে পারে একটি দেশে কাল, ধর্মান্ধতা, রাজনৈতিক পাওয়া না পাওয়ার হিসাব। এমনই হিসাবে মত্ত এবং হিসাব কষার ভাষাকে বদলে ফেলেছেন শিল্পী নিসার হোসেন।
তিনি তো শিল্পী, তিনি তো হিসাব কষবেন রঙ, তুলি ক্যানভাসের ভাষায়। ব্যবহারও করেছেন সেই ভাষা, কষেছেন হিসাব। প্রতিটি ক্যানভাসের কোনায় কোনায় খতিয়ানে ঠাসা। হিসাব তো যাপিত জীবনের নয়, সুন্দর পেলবতায় নয়, তা দেশের জন্ম। তার জন্ম সম্মুখের নানা ক্ষতস্থান, এবং তা কত ধর্মান্ধতায় ঠাসা তার সূক্ষ্ম খতিয়ানও তিনি কষেছেন, এক বা দুই দিনের নয় ষাট বছরের এ খতিয়ান।
শিল্পের খতিয়ান তো প্রদর্শনীর মধ্যে দিয়ে দেখতে হবে, তাই তো শিল্পী গ্যালারি চিত্রকের দেওয়ালে নিজের হিসাব কষা খতিয়ানগুলো পরতে পরতে দেখিয়েছেন, খানিকটা নিজেকে হালকা করা, এত হিসাব তো একা বয়ে বেড়ানোর নয়, আত্মচিন্তায় ভারি হয়ে যাওয়া মজ্জা তো খানিকটা নুয়ে পড়ে, পড়তেই পারে, তা একটু পরিশ্রান্ত করার জন্য তিনি ষাট বছরের খতিয়ানকে সামনে এনেছেন।
শিল্পী নিসার হোসেনের খতিয়ান দেখলে বোঝা যাচ্ছে কতটা বলিষ্ঠ, স্পষ্টবাক, কতটা পরিপক্ব। শিল্পের ভাষায় সৌন্দর্যের পাথেয় না হয়ে তিনি পোড়া গন্ধের গল্পগুলোকে দগদগে করে দেখিয়েছেন, আত্ম চিৎকারের শব্দ স্পষ্ট পুরো গ্যালারি জুড়ে।
মগজহীনতায় পরিণত হওয়া ও সেই মগজহীন জীবজন্তুর মগজের চিড় তিনি খতিয়ান রূপে ক্যানভাসে পরতে পরতে দেখিয়েছেন। নিজে পুড়েছেন, ও পোড়া ছাইকে ক্যানভাসে পুরোটা লেপন করেছেন। গ্যালারি বা ক্যানভাস কোনোটায় পুরাপুরি সক্ষম নয় এই খতিয়ান বহনে।
কেন জানি মনে হচ্ছে তিনি নিজেকে ভাঙচুর করে আবার গড়ছেন নতুন খতিয়ানের জন্য। সংশয় তৈরি হয় কিন্তু তা উপেক্ষা করার জন্য যথেষ্ট ব্যকুলও তিনি, কারণ নিজেকে অতিক্রম করার জন্য সংশয়বাদীতাকে চিতায় তুলেছেন বারংবার। প্রকৃতির পুড়ে যাওয়া এর থেকে আলাদা নয়, সেই পুড়ে যাওয়ার ছাই ও গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা শিল্পীর আত্মা পুড়ে যাওয়ার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার।
একলা চলতে হলে প্রয়োজন আত্মবলিষ্ঠতার, নির্ভীকতার তা শিল্পীর দৈর্ঘ্য খতিয়ান দেখলে বোঝা যায়, একটুও ছাড় দিতে রাজী নন তিনি এ হিসাবে। তিনি খতিয়ানের হিসাব একার জন্য কষছেন তা নয়—দেশ, কাল, সময়ের অশুভ শক্তি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এক সু-জগতের জন্য হিসাব কষে চলেছেন।
আমরা কতটুকুই শুনতে পারছি তার চিৎকার যা কিনা গ্যালারি ছাড়িয়ে দেশকে অতিক্রম করে চলেছে, কতটুকু গন্ধ আমরা পাচ্ছি যা আমাদের চারপাশ পুড়াচ্ছে। খতিয়ানের হিসাব চলবে, তবে তা শুধু শিল্পীর একার নয়, ক্যানভাসের জমিন ছাড়িয়ে আমাদের মজ্জাগত হলেই এই খতিয়ানের জের টানা যাবে হয়তোবা।