মাইয়াফোয়া’র কহন— রোহিঙ্গা সমাজের গল্প
২৮ মার্চ ২০২১ ১৭:৫০
ফাহমি ইলার সম্প্রতি প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘মাইয়াফোয়া’র কহন’ পড়লাম। এটি তার প্রথম বই। বইটিতে মোট ছয়টি গল্প রয়েছে এবং সবগুলোই কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের পুনর্বাসনে নিয়োজিত নারীকর্মীদের অভিজ্ঞতার আলোকে লিখিত। লেখক তার জীবনের কিছুটা সময় এদের নিয়ে কাজ করেছেন, খুব কাছে থেকে দেখেছেন, ফলে রোহিঙ্গা সমাজের অনেক গভীরের বিষয় ও সত্যকথন উঠে এসেছে গল্পগুলোতে। যা আমার জানা ছিল না। হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
ধর্মাশ্রিত রোহিঙ্গা সমাজ পুরোপুরি পুরুষ নিয়ন্ত্রিত। ধর্ষণ, খুনের মতো ঘটনা অনেকটাই স্বাভাবিক। স্ত্রী পেটানো, শিশু কন্যাদের বিয়ে তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। প্রায় আদিমতম এই সমাজে নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও, তবে তাদের ক্ষমতা সীমিত। তাদের আপস করতে হয় অনেক কিছুর সঙ্গে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি পর্যন্ত। অনেক সময় কোনো নারীকে রক্ষার জন্য তাদের কাজ করতে হয় চুরি করে, রোহিঙ্গা পুরুষদের আড়ালে আবডালে, এমনকি সরকারি কর্মকর্তাদের থেকেও লুকিয়ে। রোহিঙ্গা সমাজচিত্রের বাইরে এগুলোও উঠে এসেছে ইলার গল্পগ্রন্থ ‘মাইয়াফোয়ার কহন’-এ।
সত্য ঘটনাকে একেবারে হুবহু বর্ণনা করে আত্মজীবনী জাতীয় গ্রন্থ লেখা এক কথা, আর তাকে আশ্রয় করে গল্প বা উপন্যাস লেখা একেবারেই ভিন্ন কিছু এবং সম্ভবত সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন বিষয়ের একটি। এদিক দিয়ে আমি বলব মাইয়াফোয়ার কহন-এ লেখক দু’টো গল্প নির্মাণে পুরোপুরি সার্থক হয়েছেন। বিশেষ করে বইয়ের প্রথম গল্পটা আমাকে অভিভূত করেছে। যে ধারায় গল্পটি আগাচ্ছিল, তাতে শেষটা আমার প্রত্যাশার একেবারেই বাইরে ছিল। গল্পটি পড়া শেষেই আমি লেখককে নক করতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ আমার জানতে ইচ্ছে করছিল যে এরকম ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল কিনা।
বাকি চারটা গল্পও যে খারাপ হয়েছে, তা আমি বলছি না, তবে যেটা ওপরে বলেছি যে সত্য ঘটনা অবলম্বনে গল্প লেখা কঠিন, কারণ যেসব বাস্তবের চরিত্ররা এখানে উপস্থিত, তাদের দিকটাও ভাবতে হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার সেই রক্তমাংসের মানুষগুলো এসে ভিড় করে লেখকের চোখের সামনে। হয়তো তাদের কথা ভেবেই সত্য থেকে বিচ্যুত হয়ে কল্পনার আশ্রয় নেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে লেখকের কাছে।
সাহিত্য সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন একটু ভিন্ন ধরনের। একটা সার্থক ছোটোগল্প লেখাকেও আমি বিরাট কিছু মনে করি। একটা বইয়ের সবগুলো গল্পই সমান হয় না বা সবগুলোই সুন্দর হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা একটা হিট গান দিয়ে একটা এ্যালবামকে হিট হতে দেখি, তাহলে একটা সুন্দর ছোটো গল্পের জন্য একটা বই জনপ্রিয় হতে দোষ কী? মাইয়াফোয়া’র কহন বইয়ের প্রথম গল্পটা সেরকমই একটা গল্প। গল্পটিতে রুকাইয়ার যে গল্প লেখা হয়েছে, সে তো রুকাইয়ার একার নয়, এরকম রুকাইয়া রয়েছে হাজার হাজার এবং তা কেবল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নয়, আমাদের বাঙালি সমাজেও আছে অগণিত। দ্বিতীয় গল্পে শরিফার যে চোখের জল সে একা শরিফার নয়, এরকম শরিফাদের খুঁজে পাওয়া যাবে সারা দেশজুড়ে। আমিনের মতো তারাও পালিয়ে যায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে।
সাহিত্য প্রসঙ্গে বলতে গেলে হয়তো সমালোচনা করার মতো আরও অনেক কিছুই আছে, কিন্তু আমি আসলে সমালোচনা লিখতে বসিনি। তবে একটা বিষয় একটু দৃষ্টিকটু লেগেছে আমার কাছে। সেটা হলো বাংলা লেখায় দেদারসে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার। তবে এটা আমাদের অনেক পাঠককে বরং সন্তুষ্টই করবে। একথা বলছি, কারণ আমার উপন্যাস ‘অপুংসক’ পড়ে একজন আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন কেন আমি এত কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছি, তার চেয়ে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলেই তো পারতাম।
বইয়ের গল্পগুলোর সেই অর্থে কোনো নামকরণ করা হয়নি; লেখার মধ্য থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লাইন দিয়ে প্রতিটি গল্পের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, অনেকটা সংবাদপত্রের শিরোনামের মতো। বিষয়টায় সম্ভবত নতুনত্ব রয়েছে। আরেকটা বিষয়ও সম্ভবত নতুন। রোহিঙ্গা ও চাটগাঁইয়া ভাষার ডায়লগগুলোর পাশেই বাংলা অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে।
সত্যি বলতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আমার নিজস্ব জানাশোনা একেবারেই কম। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে স্বকৃত নোমানের ‘বেগানা’ উপন্যাস পড়েছিলাম কিছুদিন আগে। তিনি মূলত মিথ বা লোককাহিনী ভিত্তি করে লিখে থাকেন, যা পরিলক্ষিত হয় তার অন্য উপন্যাসগুলোতেও। তাই সেটাতে যা কিছু জেনেছি, তার ভেতরে সত্য ও তথ্যের বেশ সুন্দর মিশেল ছিল। ফাহমি ইলার মাইয়াফোয়া’র কহন পড়ে আরেকটু সমৃদ্ধ হলাম। আশা করি আরও দুয়েকজন লেখক রোহিঙ্গাদের নিয়ে লিখবেন এবং আমরা আরও বেশি জানতে পারব।
যারা রোহিঙ্গা সমাজ তথা বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর চিত্র জানতে চান এবং একইসাথে সাহিত্যের স্বাদ পেতে চান, তারা বইটি পড়তে পারেন।
লেখকের জন্য শুভ কামনা।
বইমেলায় বইটি পাওয়া যাচ্ছে গ্রান্থিকে।
স্টল নং: ৩১৭-৩১৮।