বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র
৭ এপ্রিল ২০২১ ০০:২০
এদেশে, বাইরের পরিমণ্ডলে খ্যাতিমান অধ্যাপক ও ঋদ্ধ গবেষক ড. আবুল বারকাত লেখার জগতে এক বিশিষ্ট নাম, অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্ব। তার প্রতিটি লেখা পাঠক মনে অপরিসীম শ্রদ্ধা জাগায়। সম্প্রতি তার অনন্যসাধারণ ও পক্ষপাতহীন লেখা ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ গ্রন্থ জগতে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজনা। এ গ্রন্থে তিনি বলেছেন, আজ নানান কারণে, নানান স্তরে, নানান বিষয়ে বিশ্ব, দেশ ও সমাজ বিভাজিত। এ বিভাজন কেন ও কোন অস্থিরতার কারণে তারও অনুসন্ধান করেছেন তিনি। এ কথা বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না, এটি এ দেশ, সমাজ এবং সাধারণ ও কোভিড-১৯ আক্রান্ত-বিপর্যস্ত মানুষের জন্য লেখকের সমগ্র গবেষক জীবনের উৎসর্গিত শ্রেষ্ঠ নৈবেদ্য, যা তিনি সাজিয়েছেন ভাবনার নানান উপাচারে। তিনি বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আজ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন শোভন দেশ ও সমাজ বিনির্মাণে একটি ঐতিহাসিক ও প্রসারিত দৃষ্টিকোণ, পরিশীলিত সমাজ, সমৃদ্ধ আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা এবং নিষ্কলুষ ব্যক্তি-মনন।
সময়ের দর্পণে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নানা আঙ্গিকে তিনি পরিস্ফুট করেছেন এই গ্রন্থের সর্বমোট ১২টি অধ্যায়ে। এতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে তার বলিষ্ঠ, আদর্শিক অভিমত, চিন্তা-চেতনা এবং করোনাভাইরাসের মহা বিপর্যয় থেকে কিভাবে আমরা পরিত্রাণ পাবো, কোন পথে সন্ধান পাবো শোভন বাংলাদেশের সেই দুর্লভ দিক নির্দেশনা। বিগত কয়েক শতাব্দীতে এদেশে সংঘটিত নানা বিপর্যয়, সংকট নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে লেখা তার প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটি বাস্তব অবস্থার এক সুগভীর, অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। এতে নানা সময়ের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, আমাদের রুগ্ন মানসিকতা এবং অশোভন সমাজব্যবস্থার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সমগ্র গ্রন্থে তার অনুসন্ধানী মন ঘুরে বেড়িয়েছে এক শোভন সমাজের সন্ধানে। তিনি সবকিছু দেখেছেন বড় পর্দায়।
তার মতে, সমসাময়িক সমাজ ও অর্থনীতি ব্যবস্থা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই উত্তরোত্তর অধিক হারে বহুমাত্রিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে— রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এসবে প্রভাবক। এসবের ভিত্তিতে কাজ করছে আর্থিকীকরণকৃত পুঁজির বাহক রেন্ট সিকার-পরজীবী-লুটেরা-অনুৎপাদক গোষ্ঠী; এরাই অর্থনীতি-সমাজ-রাষ্ট্র-সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মহামন্দা, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা, জলবায়ু ও পরিবেশ বিপর্যয়। যুদ্ধ ও যুদ্ধাবস্থা এদেরই কারণে। এর সাথে এখন যোগ হয়েছে সুস্থজীবনের প্রতিপক্ষ মহাভাইরাস কোভিড-১৯। এ দু’য়ের সম্মিলনে সৃষ্টি হয়েছে একুশ শতকের সাম্প্রতিক মহাবিপর্যয়। এ থেকে মুক্তির সহজ পথ একটিই—তা হলো আলোকিত পথে সামনে এগিয়ে চলা। শোভন সমাজ গড়ে তোলা।
লেখকের অন্তর্নিহিত ভাবনার জগৎ, পরিমণ্ডল আলোয় আলোকময়। আলোচ্য গ্রন্থে তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রকে এতকাল আমরা দেখেছি ছোট পর্দায়-খণ্ডিত, আংশিক ও কামরাভুক্তভাবে। ফলে বিকাশের মর্মবস্তু বুঝতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এসবের বিপরীতে সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রকে দেখতে হবে বড় পর্দায়। মানুষকে দেখতে হবে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে। কিন্তু উল্টোটাই এতকাল আমাদের ভাবনাজগৎ ও কর্মকাণ্ড জগতে নিয়ামক-নির্ধারক ছিল। সে কারণেই ‘শোভন’ কোনো সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র বিনির্মিত হয়নি। শোভন সমাজ শোভন অর্থনীতি শোভন রাষ্ট্র হলো শেষ বিচারে বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও উচ্চ নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন আলোকিত মানুষের জীবনব্যবস্থা। এসব গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি এও লিখেছেন, ‘বর্তমান অসহনীয় অবস্থার বিপ্রতীপে আজকে ‘বড় পর্দার প্রকৃতির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য-আস্থা-সম্মানভিত্তিক নতুন এক জীবনব্যবস্থা– ‘শোভন সমাজব্যবস্থা’ আলোকিত মানুষের বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার চাহিদা অনিবার্য। এ পথে হাঁটা ছাড়া অশোভন পৃথিবী থেকে শোভন পৃথিবীতে উত্তরণ সম্ভব নয়। পথটা দেখাবে শোভন রাজনীতি।’
কৃতজ্ঞতার শুরুতেই লেখক বলেছেন: ‘কখনও কখনও কোনো কোনো বিষয়ে নির্মোহ ভাবনা সহজ নয়, ততোধিক কঠিন লিখিত ভাষ্যের মুদ্রিত প্রকাশ। এসবের সবকটিই ঘটে যখন বিষয়বস্তু হয় জটিল ও স্রোতবিরুদ্ধ, আর একইসাথে যদি সময়টা হয় প্রতিকুল। এই গ্রন্থের ক্ষেত্রে এসবের সবটুকুই প্রযোজ্য।’
গ্রন্থকার কৃতজ্ঞতা অংশের পরিসমাপ্তি টেনেছেন জ্যাঁ-জ্যাক রুশোর কথা দিয়েই: “আমি খুব ভালো করেই জানি, এসব জানার কোনো আগ্রহ পাঠকের নেই। কিন্তু আমার আগ্রহ আছে তাদের বলার।” তিনি অগ্রিম কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাদের প্রতি‒ যারা এই গ্রন্থটি পাঠ করবেন, ভাববেন, গঠনমূলক সমালোচনা করবেন, এবং নির্মোহ জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শোভন সমাজ বিনির্মাণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবেন।
গ্রন্থটি উৎসর্গ ও বিনম্র শ্রদ্ধাভরে সমর্পণ করেছেন জ্ঞান তাপস ও মহাদার্শনিক সক্রেটিস, সেনেকা, গিওর্দানো ব্রুনো, আলেন্দে গসসেনস, শেখ মুজিবুর রহমান, প্যাট্রিস ইমেরি লুমুম্বা, চে-গুয়েভারা, কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, বার্ট্রান্ড রাসেল, নোয়াম চমস্কি এবং শোভন সমাজ প্রতিষ্ঠায় ব্রতী বর্তমান ও ভবিষৎ প্রজন্মকে। সাড়া জাগানো এ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনার যৌথ উদ্যোগে। প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অলঙ্করণ করেছেন সব্যসাচী হাজরা। মুদ্রণ ও বাঁধাই আগামী প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং কোং। লেখক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত এ গ্রন্থের মূল্য ১,৫০০ টাকা মাত্র। সর্বার্থে, গ্রন্থটি পাঠক সমাজকে নতুন ভাবনা-চেতনায় বহুকাল আবিষ্ট করে রাখবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।