Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রবি বাবুর প্রেমে আমি


৮ মে ২০২১ ২০:২৯

শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা,
শুধু আলো-আঁধারে কাঁদা-হাসা ॥
শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুঁয়ে যাওয়া,
শুধু দূরে যেতে যেতে কেঁদে চাওয়া,
শুধু নব দুরাশায় আগে চ’লে যায়
পিছে ফেলে যায় মিছে আশা

এই আসা-যাওয়ার পথে যার সঙ্গে নিত্য প্রাণের দেওয়া নেওয়া তিনি আর কেউ নন, কবি নিজেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে শুধু আমি নই, প্রত্যেক মনেই তিনি রাজার আসন গ্রহণ করে বসে আছেন। কবে তাকে ভালবেসেছি বলতে পারব না। ছোটবেলায় বৃষ্টির দিনে মায়ের মুখে ‘পুরস্কার’ কবিতাটি শুনতে শুনতে, নাকি জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে পিতার কণ্ঠে- আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসিরও তুলনা.. শোনার কারণে(?) কিচ্ছুটি জানি না। জানি কেবল  তার সব কথাই মোর মনের কথা হয়ে যায়! যখন যেমন অনুভূতি মনে বিরাজ করে— সব, সব আছে তার সৃষ্টিতে! আমার একচ্ছত্র প্রেম চিরকাল তার সঙ্গেই ছিল, আজও তাহাতেই মন প্রাণ সঁপে দিয়ে নির্ভার হই। ব্যকুল মনে বলি— ‘আমার পরশ করে প্রাণ সুধায় ভরে তুমি যাও যে সরে…’।

বিজ্ঞাপন

পরিচয়ে তিনি বিশ্বকবি, কিন্তু সর্বৈবভাবে বিশ্ব প্রেমিকও বটে। তবে সেই প্রেম শুধু মানবের মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে বাতাসে  অন্তরীক্ষে। তিনি বলেছেনও, ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে…’।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তরে কোটি প্রাণে প্রেম উথলে উঠেছে কারণে অকারণে, কিন্তু কেবল সেই প্রেমেই তৃপ্ত তিনি নন, প্রকৃতিতেও সমর্পণ করেছেন নিজেকে। হ্যাঁ, কবিগুরুর সঙ্গে প্রকৃতির বাঁধভাঙা প্রেম সর্বজনবিদিত। কবির বর্ণনায় প্রকৃতি পেয়েছে নব নব রূপ। তার গানে, কাব্যে, রচনায় বারবার পাঠক অভিভূত হয়েছেন প্রকৃতির রস আস্বাদন করে। অনিন্দ্য বর্ণনায় রোজকার দেখা আকাশ, মাটি, বৃক্ষ লতা, নদী, জোছনা, অন্ধকার, ইত্যাদি যা কিছু ঈশ্বরের দান—সমস্তটাই অপার্থিব সৌন্দর্যে আমাদের নয়ন সম্মুখে উপস্থিত করেছেন তিনি পরম যত্নে। নিজেই বলেছেন, ‘এই লোকনিলয় শস্যক্ষেত্র থেকে ঐ নক্ষত্রলোক পর্যন্ত একটা স্তম্ভিত হৃদয়রাশিতে আকাশ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে, আমি তার মধ্যে অবগাহন করে অসীম মানসলোকে একলা বসে থাকি’। আবার ‘এই প্রসারিত আকাশ আর সুবিস্তীর্ণ শান্তির মধ্যে যদি কারও প্রতি দৃকপাত না করে আপনার গভীর আনন্দে আপনার কাজ করে যাই তা হলেই যথার্থ কাজ হয়’। এ থেকে প্রকৃতির প্রতি তার নিমগ্ন প্রেম খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞাপন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপাদমস্তক একজন প্রেমিক পুরুষ এবং তার জীবনে প্রেম ও প্রেমিকার আবির্ভাব প্রস্থান সবই আমাদের অবগত। একে একে যে নারীরা তার জীবনে এসেছেন কেউই প্রথমেই কিন্তু প্রেমিকা হয়ে আসেননি, সময়ের ঢেউয়ে ভেসে একেকটি প্রণয়ের সৃষ্টি। বলা চলে অনুরাগ থেকে প্রেমের সূত্রপাত। রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে হেমন্তবালা দেবী লিখেছিলেন, ‘আপনি আমার দেবতা, আমার কল্পলোকের রাজা। আমার দুর্ভাগ্য যে আমার পূর্ণ প্রেম আপনার চরণে দিতে পারছি না’।

অনুরাগের সঙ্গে ভক্তি মিশেও প্রেমের সূচনা হয়েছে। বস্তুত কবির জীবনে যেসব নারীরা এসেছেন তাদের সকলেই কম বেশি তার কাব্য অনুরাগী ছিলেন।বৈষ্ণব পদাবলীর পরে বাঙালি বা বাংলা সাহিত্য প্রেমানুভূতি সবচেয়ে বেশি খুঁজে পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। রবি ঠাকুর প্রেমের ব্যাপারে ছিলেন বিশুদ্ধবাদী। বহুল বিচারে প্রেমের ক্ষেত্রে মনই প্রাধান্য পেয়েছে তার কাছে। শরীরকে বরাবরই গৌণ মনে করতেন কবি। তবু নানাভাবে প্রেমের ঘোরে মগ্ন থেকেছেন, মত্ত হয়েছেন, ব্যথা পেয়েছেন প্রেমে, সুখ-সন্তাপ সবই লালন করেছেন মনের সবটুকু আবেগ দিয়ে। সেই প্রেমের নাগাল পাওয়া সাধারণের পক্ষে সহজ নয়, খুব বেশি হলে অনুভবে সেইসব ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমরা বেঁচে থাকার সুখ আস্বাদন করতে পারি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করতেন, কাঙ্ক্ষিত মানুষটি যদি কল্পনা থেকে বাস্তবের মধ্যে চলে আসে, কল্পনার অসীম থেকে সংসারের সীমার মধ্যে চলে আসে, তখন প্রেম আর থাকে না। কারণ ‘অনন্ত আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না’। সেইভাবে ভাবতে পারলে প্রেম না পাওয়া কষ্টের তীব্রতা কমে যায়। তার মতে অপ্রেমের চেয়ে প্রেমহীন হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ানোয় ঢের আনন্দ। গতানুগতিক, আবেগময়, দখলবাজ, আত্মহারা, বৈষয়িক, সাধারণ মানুষের প্রেম রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয়। প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, নৈসর্গিক আত্মার সম্পদ এবং ঐশ্বরিক, দেহের সীমায় একে ধরা যায় না। সেই প্রেম বুঝতে হলে ডুব দিতে হবে অন্তরের গহীন কোণে।

‘আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব‘ বা ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি তোমায়’, আবার ‘কেন মেঘ আসে হৃদয়ও আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না’ কিংবা ‘তোমারে দাও আশা পুরাও তুমি এসো তুমি কাছে’— এরকম অজস্র গান কবি রচনা করেছেন। এইসব গানে বা কবিতায় তিনি মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছেন, নিজেকে সমর্পণ করেছেন ঈশ্বরের কাছে। কী অপূর্ব উচ্চারণ! যা চিরকালীন মানুষের মনের প্রগাঢ় আবেগ, অবিনশ্বর। এখানেও তিনি প্রেমিক, এই প্রেম আত্মশুদ্ধির জন্য, ঈশ্বরকে একাগ্রচিত্তে ভালোবেসে নিবিষ্ট মনে নৈবেদ্য দান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বোঝা সহজ কাজ নয়, বুঝতে হলে অন্তরে ধারণ করতে হবে, আত্মস্থ করার চেষ্টা করা যেতে পারে কেবল। তাকে নিয়ে আমার মতো সামান্য মানুষের কিছু বলতে যাওয়া ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে জানি। তবুও এই নিবেদন আমার ভালবেসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করবার নিমিত্তে। প্রণতি লও হে কবি, ক্ষম মোর অপরাধ।

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর