ইতি তোমার মা
৯ মে ২০২১ ১৫:৩৪
সকাল বেলা একটা তাড়াহুড়ো লেগে যায়। অপু শিপ্রা দুজনেই অফিসে যাবে। শিপ্রা নাস্তা বানাতে গিয়ে দেখে, হাতের কাছে কিছুই নেই। আজ অবশ্য তেমন কিছু হয় নি। অপু রেডি হওয়ার আগেই শিপ্রা টেবিলে তার পছন্দের গরুর কালো ভুনা আর চালের রুটি রাখে। অপু চেয়ার টেনে বসে একটু রহস্যময় ভঙ্গিতে হেসে বলে, শোন, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
শিপ্রা ভ্রু কুচকায়। বার্থ ডে গিফট তো কাল রাতেই দিলে!
ওটাতো গিফট! আর এটা সারপ্রাইজ!
কি! কি! কি! বলো না!
এখন না। সন্ধ্যায়, অফিস থেকে এসে।
এতক্ষন আমি অপেক্ষা করব কিভাবে!
আরে, তোমার অফিসে যাবে না? অফিসে গেলে দেখবে, কাজের ভিড়ে ভুলে গেছ!
না, আজ ঠিক করেছি, অফিসে যাবো না। সারাদিন বাসায় থাকবো, নিজের মতো করে।
তাহলে আগে বলতে। আমিও ছুটি চেয়ে নিতাম।
ইশ! তোমার না কত জরুরি কাজ! এ্যাসাইনমেন্ট জমা, বিদেশী ডেলিকেট… তাছাড়া তুমি থাকলে তো আমার নিজের মত করে থাকা হবে না।
ওকে। তাহলে তো একটু অপেক্ষা করতেই হচ্ছে! নো ওয়ে!
অপু চলে গেলে শিপ্রা ঘর গুছাতে শুরু করে। রোজ অফিসের কারণে ঘরদোরের অবস্থা বেসামাল। ছুটির দিনটা আলসেমি আর প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটাতেই চলে যায়। তাই আজ জন্মদিনের বরাত দিয়ে ছুটি চেয়ে নিয়েছে। ড্রয়ারে কাপড় রাখতে গিয়ে তার মায়ের একটা ফটোগ্রাফ খুজে পায়। সে ওটা বের করে খানিকক্ষন তাকিয়ে দেখে। ধীরে ধীরে তার চোখ ভিজে ওঠে। ধরা গলায় বিড়বিড় করে বলে, হ্যাপি বার্থ ডে মা!
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে অপু দেখে, শিপ্রা ঘুমিয়ে আছে। সে তাড়া দেয়, জলদি মুখ হাত ধুয়ে রেডি হয়ে নাও।
শিপ্রা হাই তুলে বলে, রেডি হয়ে নাও মানে? বলেছি না, আজ আমি কোথাও যাবো না।
সারপ্রাইজের কথা ভুলে গেলে?
ভুলে যাবো কেন? সারপ্রাইজের সাথে রেডি হওয়ার কি সম্পর্ক?
অপু হাতঘড়ি দেখে বলে, সম্পর্ক আছে। যাও তো, জলদি রেডি হও। তোমরা মেয়েরা তো আবার দুঘন্টার আগে রেডি হতে পারো না।
দেখো, আমি কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি কোথায় যেতে চাচ্ছ?
আমি না, তুমি।
মানে?
তুমি একটা রেস্টুরেন্টে যাবে। তুমি চাইলে আমি তোমাকে পৌছে দিয়ে আসতে পারি। সেখানে তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছেন।
কে?
ধরে নাও, ইটস এ ডেট!
দেখো, আমার কিন্তু এসব হেয়ালি একদম ভালো লাগছে না।
এখন যদি তোমাকে বোঝাতে যাই, তাহলে সারপ্রাইজটা আর থাকবে না।
কিন্তু আমি বুঝতে চাই।
অপু আলতো করে শিপ্রার চিবুক ধরে। শিপ্রা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি জানি, যে তোমার জন্য ওখানে অপেক্ষা করছে, সেই মহিলাটিও তোমাকে ভালোবাসেন।
শিপ্রা অবিশ্বাস্য চোখে কয়েক মুহূর্ত্ত তাকিয়ে বলে, মা! অপু স্থির চোখে একটু তাকিয়ে মাথা নাড়ে।
অসম্ভব! তুমি তাকে পেলে কোথায়?
আমি তাকে পাই নি। তিনিই আমাকে খুজে নিয়েছেন। কদিন আগে তিনি আমার অফিসে আসেন।
তোমার অফিসে? কই, আমাকে তো কিছু বলো নি।
তোমাকে বলি নি, আজকের দিনটার জন্য। আজকের দিনটার কথা ভেবে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছি।
কেন এসেছিল মা? কি বলেছে?
অপু মৃদু চোখ বুজে একবার মনে করে নেয় সেদিনের কথা। রোজকার মত কাজ করছিল সে। এসময় তিনি আসেন। তাকে দেখে অপু চমকে উঠে দাড়ায়। আপনি!
তিনি বলেন, তুমি হয়তো আমাকে চিনবে না! আমি…
আপনি শিপ্রার মা।
মা অবাক হন।
অপু একটু ধাতস্থ হয়ে বলে, শিপ্রাকে যে চেনে আপনাকে তার না জেনে উপায় কি! সরাসরি আপনাকে না দেখলেও শিপ্রার কাছে আপনার ছবি দেখে, কথা শুনে এমন হয়েছে, হাজার ভিড়ের মধ্যে থাকলেও আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারতাম! প্লিজ, বসুন না!
মা বসে জানতে চান, কেমন আছে ও? হয়তো এই প্রশ্নটা করার কোন যৌক্তিকতা বা অধিকার আমার নেই কারণ তোমাকে দেখে আমি বুঝতে পারছি, তুমি ওকে খারাপ থাকতে দেবে না।
অপু মৃদু হেসে বলে, কি খাবেন বলুন?
কিছু না। প্লিজ… আমি এসেছি অনুরোধ নিয়ে…আমি জানি, বাবা, আমার ওপর হয়তো তোমারও খানিকটা ক্ষোভ কাজ করে…
দেখেন, আপনি যা ভাবছেন, একদমই তা নয়। বরং একটা অপরাধবোধ আমাকে সবসময় তাড়া করে ফেরে। মনে হয়, একজন মায়ের কাছ থেকে আমি তার যক্ষের ধনকে কেড়ে নিয়েছি।
না বাবা, ভুলটা আমারই ছিল। আমি এখন বুঝি, এতোটা কঠোর হওয়া আমার উচিত হয় নি।
এক কাজ করি। শিপ্রাকে ফোন দিয়ে জানাই, আপনি এসেছেন। ও যে কি খুশি হবে!
না, না, এটা করো না।
কেন?
আমার ধারণা, ও ঠিক আমার সাথে স্বাভাবিক হতে… তাছাড়া ফোনে…
আচ্ছা, বেশ, তাহলে আমার সাথে বাসায় চলুন। ও অফিস থেকে ফিরে কি যে সারপ্রাইজড হবে!
আসলে এতদিন পর এভাবে ওর সাথে দেখা করাটা… আমি বুঝতে পারছিনা ও কিভাবে নেবে… কিন্তু ওর সাথে আমার দেখা হওয়াটাও খুব জরুরি…
অপু তুড়ি বাজায়। আইডিয়া!
কি?
আমি বুঝতে পারছি, আপনি অস্বস্তিবোধ করছেন। হয়তো শিপ্রাও করবে। আমি ভাবছি, আপনাদের এই দেখা হওয়ার দিনটাকে আরেকটু মেমরেবল করে রাখলে কেমন হয়? আপনি জানেন, আর কদিন পর ওর জন্মদিন… একই দিনে আপনারও… এরমধ্যে আপনিও একটু সময় পেলেন স্বাভাবিক হতে… আমিও কিছু বলবো না শিপ্রাকে… ও ভয়ংকর চমকে যাবে…
অপুর কাছে সব শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না শিপ্রা। দুনিয়া ভেঙে যেন কান্না আসে তার। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মা কেন এতদিন পর তার ইগো ছেড়ে…
মায়ের মমতার কাছে ইগো হেরে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
তুমি আমার মাকে চেনো না বলেই একথা বলছ। মা একবার যা বলে তা থেকে কোনদিন এক চুল নড়ে না।
তোমার কাছ থেকে শুনে তাকে যতটা চিনেছি, তাতে ওরকমই মনে হয়েছিল আমার। কিন্তু সেদিন তাকে অফিসে দেখে আমার মনে হয়েছে, তার মনটা অনেকটা নারকেলের মতো। বাইরে থেকে ভীষণ শক্ত। কিন্তু ভেতরটা বড্ড নরম। শিপ্রা, তুমি একবার তার সাথে দেখা কর। তাহলেই বুঝবে, উনি কতটা ব্যাকুল হয়ে আছেন তোমার সাথে দেখা করার জন্য।
ব্যাকুল তো আমিও। তোমাকে বিয়ের পর এমন একটা দিন যায় নি, যে, মার কথা ভেবে আমি কাদি নি। কতবার অফিস ছুটির পর মনে হয়েছে, ছুটে যাই তার কাছে, অন্তত একবার। আমাকে দেখে মা হয়তো ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু তার শেষ কথা গুলো মনে হতেই আমি…
ওসব রাগের মাথায় যা বলেছেন….
মা যা বলেছিল, ঠান্ডা মাথায়। আমার স্পষ্ট মনে আছে তার সেদিনের প্রতিটা কথা….
শিপ্রা মনে করতে না চাইলেও নাটকের দৃশ্যের মতো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মায়ের কাঠোর সেই মুখটা। শিপ্রা বিয়ের শাড়ি পড়ে মাথা নুয়ে দাড়িয়ে ছিল। মা একটা লাগেজে শিপ্রার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ভরে তার সামনে রাখে। এরমধ্যে তোমার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আছে। আরো যদি কিছু নিতে চাও, নিয়ে যেতে পারো। কিন্তু আজকের পর আর কোনদিন তোমাকে আমি এবাড়িতে দেখতে চাই না।
মা!
আমার কথা যদি তুমি একবার চিন্তা করতে, তাহলে আমার অমতে ঐ ছেলেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে না!
মা, অপু খুব ভালো ছেলে। তুমি জাস্ট একবার ওর সাথে মিট করো।
না। নেভার। আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি যদি আমার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করতে চাও, তার দায় তোমাকেই নিতে হবে। স্রেফ তোমাকেই।
মা, আমি বাচ্চা নই। আমার ভালো আমি বুঝতে পারি। ছোটকাল থেকে তোমার কোন্ সিদ্ধান্তটাকে আমি অগ্রাহ্য করেছি? আজ একটা মাত্র সিদ্ধান্ত, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন একটা সিদ্ধান্ত আমি কি নিতে পারি না?
কেন পারবে না? যেহেতু তোমার সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছ, তোমার জীবনও তোমার মত করেই বেছে নাও।
শিপ্রা কাতর হলায় বলে, আমার জীবনে তো তুমিও আছো মা। তোমাকে ছাড়া আমি ….
মার মুখে ততোধিক কঠোর অভিব্যক্তি। ছিলাম। তোমার জীবনে আমি ছিলাম। কিন্তু এখন থেকে তুমি ধরে নেবে, তোমার জীবনে আমার কোন অস্তিত্ব নেই। আমি মরে গেছি। আমিও তাই ধরে নেব।আশা করি, তুমি বুঝতে পেরেছ আমি কি বলেছি?
তুমিও তো ভালোবেসে বাবাকে বিয়ে করেছিলে মা! তোমার নিজের সিদ্ধান্তে।
তার মাশুল আমাকে দিতে হয়েছে। তোমার বাবার সাথে ডিভোর্সের পর আমি কিন্তু একটাবারের জন্যও তোমার নানাবাড়িতে ফিরে যাই নি। নিজে চেষ্টা করে একটা চাকরি নিয়েছি। এই শহরে মাথা গোজার জন্য একটা বাসা ভাড়া করেছি। তোমাকে মানুষ করেছি।
কিন্তু নানাভাই সবসময় চেয়েছে, আমাদের নিয়ে যেতে।
হ্যা, চেয়েছে। কিন্তু যে ভুল আমি করেছি তোমার বাবাকে বিয়ে করে, তার প্রায়শ্চিত্য আমি একাই করতে চেয়েছি।
বাবাকে বিয়ে করে তুমি ভুল করো নি মা। তুমি ভুল করেছো, তোমার ইগোকে বড় করে দেখে। তুমি সবসময় চেয়েছো, বাবার ওপর খবরদারি করতে। তুমি ভুলে গিয়েছিলে, বাবাও একজন আলাদা মানুষ। তারও একটা আলাদা মত থাকতে পারে।
মা শ্লেষ ভঙ্গিতে হাত তালি দেয়। বাহ! অনেক কথা শিখেছ দেখছি!
মা, আই এ্যাম সরি।
না, তুমি কেন সরি হবে? তুমি তো ভুল করো নি। সব ভুল আমার। তবে আমার ভুল নিয়ে আমি কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।
মা, তুমি একবার অপুর সাথে…
আমি তো বলেছি, আজকের পর থেকে তোমার সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই। আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে আমি মরে গেলেও তুমি আমার কোন খোজ জানতে না পারো। তোমার সাথেই যেহেতু কোন সম্পর্ক নেই তুমি কাকে বিয়ে করেছ তার সাথে কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। নাউ ইউ গেট লস্ট।
শিপ্রা কোনমতে কান্না সামলে শুধু এটুকুই বলতে পেরেছিল, তুমি যখন আমাকেই বের কর দিচ্ছ মা, এবাড়ি থেকে আমি কিছুই নিয়ে যেতে চাই না।
অপু গাড়ি ড্রাইভ করছে। পাশের সিটে বসেছে শিপ্রা। তার মনে হচ্ছে চারপাশে একটা ঘোর। খানিকবাদে ঘ্যাচাং করে ব্রেক কষলেই সবকিছু যেন ভেঙে যাবে। আচ্ছা, মা কি আগের মতই আছে? যেমন ছবিতে দেখেছো?
অপু শিপ্রার দিকে একটু তাকিয়ে বলে,৫ বছর তো কম সময় না। বয়সের একটু ছাপ পড়েছে। তবে দেখলে সাথে সাথে চেনা যায়।
আমার না কেমন জানি লাগছে!
ফিলিং সিক?
ঠিক তা না। আচ্ছা, তোমার কি মনে হয়, মা আমাকে ক্ষমা করেছে?
ক্ষমা না করলে উনি কি আসতেন?
আচ্ছা, মা সত্যি আসবে তো?
আমাকে বলেছে, উনি আসবেন।
কিন্তু রেস্টুরেন্টে কেন? তুমি তাকে বাসায়…
আমি তাকে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি রাজি হন নি। হয়তো অস্বত্বি বোধ করবেন, ভেবেছেন। তাই আমিও আর জোর করি নি।
কিন্তু মায়ের সেই রাগি চেহারাটা… সেই রাগ… মা যদি রেস্টুরেন্টে সবার সামনে রেগে যায়?
তুমি তাকে এত ভয় পাও কেন বলো তো? আমার কিন্তু তাকে দেখে তেমন রাগি মনে হয় নি।
জানি না, কেন পাই। হয়তো ছোটকাল থেকেই ভয় পেতে পেতে একটা অভ্যাস হয়ে গেছে…
সময়… সময় মানুষকে বদলে দেয় শিপ্রা। তিনিও বদলে গেছেন।
তুমি আমার সাথে থাকবে প্লিজ?
তুমি বললে আমি অবশ্যই থাকবো। কিন্তু আমার মনে হয়, এই বৈঠকে তোমরা দুজন থাকাই ভালো।
শিপ্রা হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে বলে, সর্বনাশ!
কি?
এতদিন পর মার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি! খালি হাতে যাবো?
তাইতো ! কি নেয়া যায়, বলো তো?
কাঠালচাপা। কাঠালচাপা মার খুবই পছন্দ। যখন আমি ছোট ছিলাম, বাবা রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে মার জন্য কাঠাল চাপা নিয়ে আসতো!
অপু যে রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করে রেখেছে সেটা বারো তলা একটা বিল্ডিংএর ছাদে। সেখান থেকে নিচে তাকালে নিয়নের আলোয় ঢাকা শহরটাকে অনেক ঝলমলে লাগে। শিপ্রা অস্বস্তি নিয়ে চারপাশে তাকায়। অনেক মানুষের ভিড়ে তার সেই প্রিয় মুখটাকে খুজে পায় না। অপু তাকে ড্রপ করে অন্য একটা কাজে গেছে। অপু থাকলেই হয়তো ভালো হত। আবার মনে হয়, মায়ের সাথে এই দেখা হওয়াটা একান্তই তার। সে টেবিলে বসে হাতের ফুলগুলোর দিকে তাকায়। প্রত্যেক জন্মদিনে সে তার মাকে এমন এক তোড়া ফুল দিত। মা কিন্তু তাকে এভাবে কিছু দিতে পারতেন না। তিনি বরাবরই চাপা স্বভাবের। তাই গোপনে শিপ্রার বিছানার বালিশের নিচে রেখে আসতেন উপহার। শিপ্রা প্রথম প্রথম খুব বলতো, কেন মা এমন করে? হাতে হাতে দিলেই তো হয়। পরে অভ্যাস হয়ে গেছিল। বিশেষ কোন দিন এলই নিজেই অজান্তে হাত চলে যেত বালিশের নিচে। বিয়ের পরেও কতবার এমন করেছে! যদি দৈবক্রমে কোনভাবে কিছু পেয়ে যায়! পেয়েছে কেবল শূন্যতা! চোখ আবারও জ¦ালা করে ওঠে শিপ্রার। কিন্তু মা এখনো আসছে না কেন? তাহলে কি তিনি আসবেন না? শেষমুহূর্ত্তে সিদ্ধান্ত বদলেছেন? না, না, তা কি করে হয়! মা যখন কথা দিয়ছে নিশ্চয়ই আসবে!
শিপ্রা!
শিপ্রা ঘোর ভেঙে চমকে তাকায়। শিপ্রা মা বলে উচ্চারণ করতে যায়। কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। শিপ্রা তার আনা ফুলগুলো টেবিল থেকে নিয়ে মার হাতে দিতে গিয়েও পারে না। কেমন এক আড়স্টতা! পরিবেশ হালকা দায়িত্ব মা-ই নেন। ভালো আছিস তো? একটু মোটা হয়েছিস মনে হচ্ছে!
তুমি কিন্তু বেশ শুকিয়ে গেছ। অনিয়ম করো খুব, তাই না?
একদম না! মাস দুয়েক আগে রিটায়ার্ড করেছি। সারাদিন ঐ বাসাতেই।
ডায়াবেটিসটা নিয়মিত চেক করাও তো?
হ্যা রে! করাই। তোর যে মাইগ্রেনের ব্যথাটা ছিল, ওটা এখনো হয়?
মাঝেমাঝে। নাই বললেই চলে।
মা মৃদু হাসে। এসময় ওয়েটার এসে দুজনকে দুটো মেনু কার্ড দিয়ে যায়।
শিপ্রা মাকে বলে, মা, কি নেবে?
তুই কিছু একটা পছন্দ করে বলে দে।
না, না, আজ তোমার পছন্দে খাবো।
মা মেনু কার্ড দেখে ব্যাগ খুলে চশমা বের করতে যায়। কোথায় রাখলাম!
কি খুজছ?
চশমাটা। এসব লেখা এত ছোট ছোট আজকাল আর চশমা ছাড়া পড়া যায় না। চশমাটা বোধহয় ভুলে ফেলে এসেছি…
আচ্ছা, আমি পড়ে শোনাচ্ছি তেমাকে।
শিপ্রা পড়ে শোনাতে থাকে। মা শুনে মৃদু হাসে। নষ্টালজিক হাসি। শিপ্রা পড়তে গিয়ে খেয়াল করে। তুমি হাসছ কেন?
তুই যখন ছোট ছিলি , আমাকে মেনু পড়ে শোনাতে হত।
এখন তাহলে সময় এসেছে আমার পড়ে শোনাবার। আর তোমার আরাম করে শুনবার। কথাটা বলে মা মেয়ে দুজনেই হেসে ওঠে। খেতে খেতে আরেকটু সহজ হয়ে ওঠে দুজনে। সেই পুরনো মা মেয়ের সম্পর্ক যেন ফিরে পায় তারা। তাই এক চামচ সালাদ মুখে দিয়ে শিপ্রা বলে, জানো মা, তুমি নিষেধ করার পরও একদিন অফিস ছুটির পরে আমি গিয়েছিলাম তোমার ওখানে। তুমি বাসাটা ছেড়ে দিয়েছিলে। চাকরিটাও।
হ্যা, কেন জানি ভালো লাগছিল না। সবকিছু থেকে পালাতে চাচ্ছিলাম হয়তো।
পেরেছ মা?
মা মৃদুু হেসে বলেন, নতুন চাকরিটা পেয়ে যখন মফস্বলে পোস্টিং নিয়ে গেলাম, মনে হয়েছিল, পেরেছি। কিন্তু… মৃদু থেমে কি ভেবে বলেন, অপু ছেলেটা আসলেই ভালো। আমার কথামত ওকে বিয়ে না করলে তুই আসলেই ঠকতি!
কিন্তু ও যে এত নাটকপ্রিয়, এটা জানতাম না। সে তোমার কথা বলেছে, আজ সকালে।
আমিই ওকে বলতে নিষেধ করেছিলাম। ভালো কথা, ওকে আনলি না কেন?
ও আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। বলল, কি যেন জরুরি কাজ…
খুব পরিশ্রমী ছেলে। অনেক ওপরে যাবে, বোঝা যায়। তুইও ভালো জব করছিস শুনলাম।
মেয়েদের নিজের পায়ে দাড়াবার শিক্ষাটাতো তোমার কাছ থেকেই পেয়েছি মা।
কিন্তু এখন তো নিজের জীবনের পাশাপাশি ফ্যামিলিটাকেও সাজিয়ে তোলা দরকার। দ্যাখ, ব্যাপারটা তোদের একান্তই ব্যক্তিগত। তারপরেও বলছি, তোরা বেবির কথা ভাবছিস না?
হ্যা, অপু বলছিল… আমিও ভাবছি… আসলে এতদিন কেরিয়ার.. ব্যস্ততা.. সবমিলিয়ে… তাছাড়া সন্তান জন্ম দিলেই তো হবে না। মানুষ করতে হবে।
আমি করিনি?
তোমার মত কজন পারে, বলো মা? তুমি একসাথে সন্তান, সংসার, চাকরি সব সামলেছ। একজন সফল মা। একজন সফল মানুষ।
তিনি একটা দীর্ঘনি:শ^াস ছেড়ে বলেন, না রে, জীবনের এপর্যায়ে এসে পেছনে তাকালে মনে হয়, আমি কেবল হেরেই গেছি। যাকে জয় ভেবে সামনে এগিয়েছি, আসলে তাই ছিল পরাজয়। আমার জীবনবোধ, অনুশাসন, অহংকার আমাকে কেবল পেছনের দিকে টেনে নিয়ে গেছে আমার অজান্তেই।
শিপ্রা মায়ের হাতের ওপর একটা হাত রাখে। একথা বলো না মা। কে না ভুল করে! তেমনই তোমারও হয়তো কিছু ভুল ছিল। তাই বলে গোটা জীবনটাতো আর ভুল হতে পারে না। ভুল আমিও করেছি। হুট করে অপুকে তখনই বিয়ে না করে তোমাকে বোঝাতে পারতাম। কিন্তু সে চেষ্টাটাও করি নি। জেদের মাথায়…
থাক এসব।
আমারও তাই মনে হয়। তবে এখন আর আমার সন্তান মানুষ করার চিন্তা নেই। তুমি আছো না?
মা মৃদু হাসে। এসময় ওয়েটার বিল দিয়ে যায়। মা ব্যাগের দিকে হাত বাড়ায়। শিপ্রা বলে, মা, প্লিজ, আজকে আমি তোমাকে মেনু কার্ড পড়ে শুনিয়েছি। তাই আমি তোমার হোস্ট।
এটা কিন্তু চিটিং হচ্ছে!
হোক।
বিল দিতে পারিস এক শর্তে। এরপরের বার কিন্তু আমি তোদের খাওয়াব। রাজি?
শিপ্রা খুশিতে মাথা নাড়ে। শিপ্রা বিল দিয়ে উঠে দাড়ায়। মাও উঠে দাড়ায়।
তুই কিন্তু এখনো আমার ওপরে রেগে আছিস।
কি বলছ মা? রেগে থাকব কেন?
তাহলে একবারো আমাকে জড়িয়ে ধরলি না যে! আগে তো বাইরে থেকে এসেই সবসময়…
শিপ্রা এবার গভীর আবেগে মাকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ ছল করে ওঠে। আই লাভ ইউ মা। আই লাভ ইউ সো মাচ।
তিনি বরাবরই চাপা স্বভাবের। তাই প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারেন না। শুধু চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে।
রাতে বাসায় ফিরে শিপ্রা খুবই উত্তেজিত মুখে অপুকে শোনায়, আজ তার মায়ের সাথে কি কি কথা হয়েছে। তাকে দেখে মনে হয়, দুনিয়ার সবচেয়ে সুখি আজ সে। অপু মুগ্ধ চোখে তাই দেখছিল। হঠাৎ শিপ্রার চোখ ছলছল করে ওঠে। অপু যাতে শিপ্রার চোখে পানি দেখতে না পারে তাই সে অন্যদিকে তাকায়। কিন্তু অপু খেয়াল করে। এ্যাই শিপ্রা, কি হয়েছে?
শিপ্রা না বোধক মাথা নেড়ে চোখ মোছে।
বল। বল আমাকে, প্লিজ!
শিপ্রা চোখ মুছে বলে, আচ্ছা, তুমি এত ভালো কেন আমাকে বলবে? আরেকটু কম ভালো হলে কি এমন ক্ষতি হত?
অপু শিপ্রার চিবুক ধরে কোমল গলায় বলে, এই প্রশ্নটা আমি তো রোজ তোমাকে করি, মনে মনে। দেখাও তো আরেকটা মেয়ে, যে, একটা অনাথ ছেলের জন্য তার গোটা পৃথিবী ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে? ভালো কথা, মাকে বলতে, আমাদের এখানে এসে থাকতে।
বলেছিলাম একবার। কিন্তু মা রাজি হলেন না।
হুমম… ইন্ডেপেন্ডেন্ট!
কদিন পর। শিপ্রা অফিসে কাজ করছে। ম ফেলবার সময় নেই। এসময় অপুর ফোন। শিপ্রা ফোন রিসিভ করেই বলে, এ্যাই, এখন তোমার সাথে কথা বলতে পারবো না। একটু পরেই ডেলিকেট আসছে। এখনও প্রপোজাল ফাইলই রেডি হয় নি। দুবার বসের ঝাড়ি খেয়েছি।
শিপ্রা শোন, আমি তোমাকে নিতে আসছি। এক্ষন। তুমি জলদি সব গুছিয়ে নাও।
শিপ্রা চমকায়। কি হয়েছে, বলবে তো বাবা!
মা হাসপাতালে। তার পাশের ফ্ল্যাটের মহিলা রোজকার মতো নক করছিলেন দরজায়। ভেতর থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায় সন্দেহ হয়। তারপর দরজা ভেঙে… উনিই এম্বুলেন্সে খবর দিয়ে… তারপর ডায়রিতে আমার নাম্বার দেখে…
শিপ্রার চারপাশের আলোগুলো যেন নিভে আসতে থাকে। হাসপাতালে গিয়ে সরাসরি ডাক্তারের চেম্বারে ঢোকে তারা। ডাক্তার জানতে চান, আপনারা পেশেন্টের কি হন?
শিপ্রা ধরা গলায় বলে, আমি তার মেয়ে।
ডাক্তার মৃদু মাথা নেড়ে জানায়, আমি তো আগেই তাকে সাবধান করেছি। যেকোন সময় এরকম একটা ম্যাসিভ এ্যাটাক হতে পারে, এটা আমরা জানতাম।
কই? মা তো আমাকে কিছু বলে নি।
তাহলে বোধহয় উনি ইচ্ছে করেই… আপনাদের টেনশানে রাখতে চায় নি বলে…
ডাক্তার, প্লিজ আমার মাকে বাচান। যত টাকা লাগে… দরকার হলে বিদেশে…
দেখেন, কখনো কখনো এমন হয়, চিকিৎসার সব রকম ফ্যাসিলিটিজ, টাকা থাকা সত্ত্বেও আমরা একজন রোগীকে জীবন দিতে পারি না। জীবন দানের মালিক যিনি তিনিই পারেন এখন কিছু একটা করতে।
শিপ্রা ডুকরে কেদে ওঠে। অপু শিপ্রার কাঁধে হাত রাখে।
তাঁকে রাখা হয়েছে আইসিইউতে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক পড়ানো। চোখ বোজা। দেখে বোঝার উপায় নেই কদিন আগেও যথেষ্ট সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন তিনি! শিপ্রা এই মাকে চিনতে পারে না। তবু গলা বেয়ে একদলা কান্না উঠে আসতে চায়। কোনমতে মুখে আঙুল চেপে সে নিজেকে সামলায়। তারপর হাত বাড়িয়ে মায়ের একটা হাত ধরে। হাত ধরা মাত্র মা ক্লান্ত ভঙ্গিতে মৃদু চোখ খোলে। ঠোট নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করে। কিন্তু বলতে পারে না। শিপ্রা ফুপিয়ে ওঠে। মা! মাগো… তুমি আমাকে কেন বলো নি… কেন… তোমার কিছু একটা হলে আমি কি নিয়ে… মা, আমার কথা ভেবে একবারও কি তুমি….
শিপ্রা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কোন বাক্যই সম্পূর্ন করতে পারে না। কতকিছু ভেবেছি আমি তোমাকে নিয়ে মা…. আমার সন্তানকে মানুষ করবে তুমি, তোমার আদর্শে… তোমার কিছু হলে কে মানুষ করবে ওকে?… বলো মা, বলো… শিপ্রা উত্তেজিত হয়ে হড়বড় করে বলতে থাকে। একসময় তার মনে হয়, তার হাতে ধরা মায়ের হাতটা নিশ্চল হয়ে গেছে। সে টের পাওয়া মাত্র হাতটা ধরে নাড়া দেয়। কোন সাড়া নেই। মা! .. মা!
জীবন বহমান। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে একটু থমকে গেলেও ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে সবকিছু। সকাল বেলা একটা তাড়াহুড়ো লেগে যায়। অপু শিপ্রা দুজনেই অফিসে যাবে। শিপ্রা নাস্তা বানাতে গিয়ে দেখে, হাতের কাছে কিছুই নেই। এসময় কলিংবেল বেজে ওঠে। শিপ্রা আটা মাখা হাত কপালে মুছে বিরক্ত মুখে বলে এই সাত সকালে আবার কে এল? অপু পাশের ঘর থেকে চেচায়। আমি দেখছি।
অপু দরজা খোলে। দরজার ওপাশে দাড়িয়ে আছে এক যুবক। সে রেস্টুরেন্ট থেকে এসেছে। সেখানে দুজনের জন্য একটা বিল পে করা আছে। তারা চাইলে যেকোন সময় এই অফারটা নিতে পারেন। অপু ভ্রু কুচকায়। আমাদের নামে কে বিল পে করবে? এতোক্ষনে শিপ্রাও এসে দাড়িয়েছে। যুবকটি একটা খাম তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, যিনি বিলটা পে করেছেন, এটা তার। অপু খামটা হাতে নেয়। যুবক সালাম দিয়ে চলে যায়। অপু দরজা আটকে খামটা ছিড়ে একটা চিঠি বের করে। প্রথমে চিঠিতে চোখ বোলায়। শিপ্রা আর উত্তেজনা ধরে রাখতে পারে না। কার চিঠি? কি লিখেছে? অপু চিঠিটা বিড়বিড় করে পড়ে-
আমি এই বিলটি অগ্রিম পে করে দিয়েছি। জানি না, তোমার সাথে আবার সেখানে যেতে পারতাম কিনা! যাইহোক আমি দুই জনের খাবারের দাম দিয়েছি – একটা তোমার আরেকটা অপুর জন্য। তুমি কখনই বুঝবে না মা, সেই রাতটা আমার জন্য কত বিশেষ ছিল। আমি সবসময় ভেবেছি, ছেলেমেয়েদেরকে শাসনের মধ্যে রাখলে তারা ভালো থাকে। তাই সবসময় আমার অনুশাসন, রাগেরই প্রকাশ দেখেছ তুমি। কিন্তু এখন কেন জানি মনে হয়, রাগের প্রকাশ করতে পারলে ভালোবাসার প্রকাশটাও খুব জরুরি। জরুরি প্রিয় মানুষকে সময়মত ভালোবাসি কথাটা বলতে পারা। তাকে সাপোর্ট দিয়ে বোঝানো, ভয় নেই, পাশে আছি তোমার। সেটা পারি নি বলেই আজ নিজেকে বড্ড ব্যর্থ মনে হয়। ভালো থাক তোমরা ভালোবাসায়। ইতি তোমার মা।
(একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
সারাবাংলা/এএম