দীপু মাহমুদ-এর গল্প ‘তিন চাকার সাইকেল ’
১২ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৯:০৫
গহর ঘাড় ঘুরিয়ে সাইকেল দেখল। তার ভ্যানের ওপর পঞ্চাশটা সাইকেল আছে। তিন চাকার সাইকেল। এই সাইকেল সে নিয়ে এসেছে নবাবপুর থেকে। নিয়ে যেতে হবে উত্তরায়। ফজরের আজানের সময় ভ্যানে সাইকেল নিয়ে রওনা হয়েছে।
সূর্য ওঠেনি এখনো। বাতাসে হালকা ঠান্ডা ভাব। গহর দরদর করে ঘামছে। সকাল হওয়ার আগে মালগুলো পৌঁছে দিতে হবে দোকানে। বেলা উঠে গেলে পুলিশ এই রাস্তা দিয়ে ভ্যান নিয়ে যেতে দেবে না। মেইন রোডে ভ্যান চালানো নিষেধ।
টগরের কথা মনে হয়ে গহর আবার সাইকেলের দিকে তাকাল। টগর তার ছেলে। বয়স সাড়ে তিন বছর। ছেলে থাকবে বাবার শাসনে। চোখ বড়ো করে তাকলে দৌড়ে পালাবে। গহর বাড়িতে গেলে টগর ছুটে আসে। লাফ দিয়ে কোলে ওঠে। তার কথা খুব স্পষ্ট। বলে, তুমি কী এনেছ আমার জন্য? চকলেত এনেছ?
সে চকলেট বলতে পারে না। বলে চকলেত। গহর ছেলেকে জাপটে ধরে বলে, ঘামে গা জবজব করছে। কোল থেকে নাম।
টগর নামে না। গহর জামার পকেট থেকে চকলেট বের করে টগরের হাতে দেয়। ছেলে চকলেট মুখে নিয়ে পুরো বাড়ি লাফিয়ে বেড়ায়।
সেদিন টগর বলল, বাবা তুমি কোথায় যাও?
গহর বলল, কাজে যাই।
কী কাজ?
ভ্যান চালাই।
কী ভ্যান?
রিকশা ভ্যান।
কী রিকশা?
তিন চাকার রিকশা।
টগর বলল, বাবা, আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে, তোমার ভ্যানের মতো, তিন চাকার সাইকেল?
গহর বলল, দেব।
সে কিছু না ভেবেই বলেছে। তিন চাকার একটা সাইকেল কেনার সামর্থ গহরের নেই। ভোরবেলা ভ্যান নিয়ে বের হয়। নবাবপুরে গিয়ে ভ্যানে নানান কিসিমের মাল তোলে। সেই মাল জায়গামতো পৌঁছে দেয়। তবে অন্য মাল টানতে তার কষ্ট হলেও তিন চাকার সাইকেল নিতে কেন জানি কষ্ট হয় না। সাইকেলগুলোকে সে যতœ করে ভ্যানে তোলে। গুছিয়ে দড়ি দিয়ে বাঁধে। আলতো করে সাইকেল ছুঁয়ে আদর করে দেয়। মনে হয় সে বুঝি টগরের গাল ছুঁয়ে আদর করছে।
নবাবপুর থেকে মাল নিয়ে দোকানে পৌঁছে দেওয়ার পর প্রায় সারাদিন আর কাজ থাকে না। তাতে যে কয় টাকা পায় তাই দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে।
এই কথা টগর বোঝে না। গহর বাড়ি ফিরলে টগর তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে, বাবা আমার তিন চাকার সাইকেল কই, দেবে না?
গহর বলে, দেব বাবা।
গহর ছেলেকে সাইকেল কিনে দিতে পারে না। তার ভ্যানের ওপর এখন পঞ্চাশটা সাইকেল। এখান থেকে একটা সাইকেল সরিয়ে ফেললে কেউ বুঝতে পারবে না। উত্তরায় যেখানে সে সাইকেল নিয়ে যাচ্ছে সেই দোকানদারের নাম আয়াত আলি। বিশেষ ভালো মানুষ। আয়াত আলি কখনো সাইকেল গুনে দেখে না। গহর ভ্যানের দড়ি খুলে সাইকেল নামায়। দোকানের পেছনে গোডাউনে সাজিয়ে রাখে। আয়াত আলি বলে, গহর, সাইকেল আছে কয়টা?
আপনি যে কয়টা চেয়েছিলেন।
পঞ্চাশটার কথা বলেছিলাম।
গহর দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। একটা সাইকেল সরিয়ে ফেলে সে কেমন করে বলবে, ওই পঞ্চাশটাই আছে!
মনে মনে ভাবল এবার বলবে, পঞ্চাশটাই দিয়েছে মহাজন।
তাহলে মিথ্যা বলা হবে না। এই ভাবনা মাথায় আসার পর গহরের ভালো লাগে। আয়াত আলি পঞ্চাশটা সাইকেলের চালানে ‘বুঝিয়া পাইলাম’ লিখে স্বাক্ষর করে দেবে। সেই চালান নিয়ে গিয়ে গহর নবাবপুরে মহাজনের কাছে বুঝিয়ে দেবে।
মহাজনের নাম মাজুল মিয়া। বয়স ষাট বছরের কাছাকাছি। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। নাকের নিচে চওড়া গোঁফ পুরো সাদা হয়ে গেছে। মাজুল মিয়া বলে, উত্তরা দেখতে কেমন, গহর?
গহর অবাক হয়। বলে, আমাকে এই কথা জিগ্যেস করেন, আপনি উত্তরা দেখেননি?
সেই কবে ছোটবেলায় বাপ হাতে ধরে এনে গদিতে বসিয়ে দিল। নবাবপুরের বাইরে আর গেলাম কোথায়! এয়ারপোর্টের সামনে দিয়ে যাস তুই?
জি বড়ভাই।
প্লেন দেখিস?
আকাশে উড়লে দেখি।
মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্লেন দেখিসনি?
রাস্তা থেকে দেখা যায় না।
বাপ আমাকে প্লেন দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। তখন এয়ারপোর্ট ছিল তেজগাঁ। বাপ বলল, মাজুল প্লেন দেখ। আমি মাটিতে দাঁড়ানো প্লেন দেখলাম। সে কি বিশাল প্লেন রে। একবার প্লেনে চড়ার ইচ্ছা আছে।
সকাল হয়ে আসছে। সূর্য ওঠার আগে দোকানে চলে যেতে হবে। সামনে জসিমউদদীন মোড়। মাঞ্জুর সাইকেল সারাইয়ের দোকান ওখানে। এত সকালে সে দোকান খোলে না। গহর হাঁপাচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ একটা সাইকেল সরাবে। সেই সাইকেল মাঞ্জুর দোকানে রেখে যাবে। পরে মহাজনের কাছে চালান বুঝিয়ে দিয়ে সাইকেল নিয়ে যাবে। তিন চাকার সাইকেল পেয়ে টগরের মুখ আনন্দে আলো হয়ে উঠবে।
হর্ণ বাজছে। পেছন থেকে বাস হর্ণ দিচ্ছে। গহর আস্তে করে ভ্যান রাস্তার বামদিকে চাপিয়ে দিল। খারাপ লাগছে গহরের। মাথা ঝিমঝিম করছে। এতদিন ধরে সে নবাবপুরের মহাজনদের মাল টানছে। এখন পর্যন্ত কোনোদিন কারও জিনিসের কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি। আজ সে কেমন করে সাইকেল সরিয়ে ফেলবে!
কপাল থেকে ঘাম এসে পড়েছে চোখের পাতায়। গহর চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। টগর দৌড়ে আসছে। তার দৌড়ে আসা থপ থপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘামে গহরের গায়ের জামা ভিজে আছে। টগর লাফ দিয়ে গহরের কোলে উঠে বসেছে। গলা জড়িয়ে ধরে বলছে, তিন চাকার সাইকেল দিলে না, বাবা?
টগরের গলা কাতর শোনাচ্ছে। এমন আদর মেশানো গলায় কথা বলে ছেলেটা! কথা শুনেই বুক জুড়িয়ে যায়। গহর চোখ মেলে তাকাল সামনে মাঞ্জুর দোকান। মাঞ্জু দোকানে বসে সাইকেল মেরামত করছে।
গহর রাস্তার পাশে ভ্যান থামাল। দড়ি খুলে একটা সাইকেল বের করে নিল। আবার শক্ত করে দড়ি দিয়ে সাইকেলগুলো বেঁধে ফেলল।
সাইকেল হাতে গহর গিয়ে দাঁড়াল মাঞ্জুর দোকানে। মাঞ্জু মুখ তুলে বলল, ঘটনা কী?
গহর বলল, তুমি এত সকালে দোকান খুলেছ? তোমার তো দোকান খুলতে বেলা হয়ে যায়!
মাঞ্জু বলল, গতরাতে এক ঘটনা ঘটেছে। আমি দোকান বন্ধ করছি। তখন এই সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এক ছেলে এসে হাজির। ধরো তার বয়স দশ কি বারো বছর। চেহারা দেখে বড়লোকের ছেলে মনে হলো। সে আমাকে বলে আংকেল। কাঁদতে কাঁদতে ছেলে বলল, আংকেল রাস্তার পাশে ধাক্কা খেয়ে সাইকেল ভেঙে ফেলেছি। আব্বু দেখলে খুব রাগ করবে। আমি আব্বুকে ভীষণ ভয় পাই। রেগে গেলে খুব জোরে চড় মারে। আপনি আমার সাইকেল সেরে দেন। আমি বললাম, দোকান বন্ধ করছি। ছেলে কাঁদতে শুরু করল। বলল, কাল সকালে ইশকুলে যাওয়ার আগে পেলেই হবে। আমি কাছেই থাকি। ভোর বেলা এসেছি সেই ছেলের সাইকেল ঠিক করতে।
গহর হাতের সাইকেল সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, এইটা তোমার দোকানে রেখে দাও। সারাইয়ের দরকার হবে।
মাঞ্জু বলল, কী হয়েছে?
গহর বলল, দুপুরে এসে বলব।
আয়াত আলি এখনো দোকান খোলেনি। গহর দোকানের সামনে ভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখল। দোকানের সাটারে হেলান দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। তার ভেতরে ছটফটানি ভাব চলে এসেছে। বারবার মনে হচ্ছে সাইকেল সরিয়ে সে ঠিক করেনি। আজ যদি আায়াত আলি নিজে সাইকেল গুনে নেয়? আবার টগরের আনন্দে ভরা মুখ ভেসে উঠছে মনে। গহরের অস্থির লাগছে।
আয়াত আলি এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। গহর দুই হাঁটুতে চাপ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার দুই হাঁটু ভার হয়ে আছে। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। আয়াত আলি বলল, তোমার তো সূর্যি মামা জাগার আগে উঠব আমি জেগে অবস্থা। আমার দোকান বন্ধ করতে রাত বাজে বারোটা। বাড়িতে যাই কখন, কখন ঘুমাই আর কখন ঘুম থেকে জেগে দোকানে আসি?
গহরের হাত কাঁপছে। সে ভ্যানে বাঁধা সাইকেলের দড়ি খুলছে। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতরের সেই আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যাবে। আয়াত আলি দোকানের পেছনের গোডাউনের দরজা খুলে দিল। সে দোকানে পানি ছিটিয়ে ধূপ জ¦ালিয়েছে।
গহরের সাইকেল নামানো শেষ হয়েছে। আয়াত আলি চালানে ‘বুঝিয়া পাইলাম’ লিখে স্বাক্ষর করতে করতে বলল, ট্রাফিক ঝামেলা করেনি তো? সকাল-সকাল তাদের তো আবার দুই টাকা, পাঁচ টাকা না পেলে দিন ভালো যায় না।
গহর কিছু বলল না। ‘বুঝিয়া পাইলাম’ স্বাক্ষর করা চালানের কাগজ নিয়ে রওনা হয়ে গেল।
মহাজন দোকানে বসেছিল। গহরকে দেখে বলল, মুখ শুকনো কেন, পুলিশ ধরেছিল নাকি? সকালে খেয়েছিস কিছু, নাকি উপোস আছিস?
গহর চালানের কাগজ এগিয়ে দিয়ে মহাজনের পাশে দোকানের ফ্লোরে বসে পড়ল। মাজুল মিয়া বলল, টাকা কি এখন নিবি না একবারে রাতের বেলা?
গহর বলল, আচ্ছা বড়ভাই, একটা কথা জিগ্যেস করি?
মাজুল মিয়া বলল, কর।
গহর বলল, ধরেন কোনোদিন যদি আপনি শোনেন আমি আপনার সাইকেলের লট থেকে একটা সাইকেল সরিয়ে ফেলেছি। তখন আপনার কেমন লাগবে?
মাজুল মিয়া ডানেবামে তাকাল। দোকানে কেউ নেই। বল্টু নামে দশ বছরের একজন ছেলে থাকে দোকানে। ফুটফরমাশ খাটে। তার আসল নাম বাদল। সবাই বল্টু বলে ডাকে। কেন ডাকে কেউ জানে না। সে গেছে চা আনতে।
মাজুল মিয়া হাসছে। তার মুখ হাসিহাসি। হাসলে তাকে সুন্দর দেখায়। মাজুল মিয়াকে সুন্দর দেখাচ্ছে। তার চোখ গভীর। চোখমুখে সরল ভাব। হাসতে হাসতে মাজুল মিয়া বলল, এই কাজ তুই কোনোদিন করতে পারবি না। নবাবপুরে মানুষ চরিয়ে খাই। আমি মানুষ চিনি।
গহর কিছু বলল না। উঠে পড়ল। তাকে মাঞ্জুর দোকানে যেতে হবে। তারপর আয়াত আলির সঙ্গে দেখা করবে।
মাঞ্জুকে দোকানে পাওয়া গেছে। সাইকেল হাতে তুলে নিয়ে গহর বলল, মহাজন সাইকেল নিয়ে যেতে বলেছে। সে বলল মেরামতের দরকার নেই।
আয়াত আলি খরিদ্দার সামলাচ্ছে। দুপুরবেলা দোকানে খরিদ্দার কম থাকে। আজ একসঙ্গে কয়েকজন এসেছে। গহর বলল, একটা সাইকেল নাকি গুনতিতে কম ছিল। মহাজন পাঠিয়ে দিল। রেখে গেলাম।
আয়াত আলি কিছু বলল না। সে টাকা গুনে ক্যাশে রাখছে। আরেকজন খরিদ্দার জিনিসের দাম কমানোর জন্য জোরাজুরি করছে।
গহরের বাড়ি ফিরতে বিকেল হয়ে এল। তাকে আনন্দিত দেখাচ্ছে। টগর ছুটে এসেছে। সে লাফ দিয়ে বাবার কোলে উঠে পড়ল। গহর বলল, আমার কাঁধে উঠে আয়।
টগর কাঁধে উঠল। গহর ছেলেকে কাঁধে নিয়ে দুইপাক ঘুরে এল পুরো বাড়ি। টগরকে বলল, এখানে দাঁড়া।
টগর কাঁধ থেকে নেমে পাশে দাঁড়াল। গহর হাঁটু মুড়ে দুই হাত সামনে দিয়ে ঘোড়া হয়ে বসল। বলল, আমার পিঠে উঠে পড়।
টগর লাফিয়ে গহরের পিঠে উঠে বসল। কাঁধ খামচে ধরে বলল, আমার বাবা ঘোড়া।
গহর বলল, আমিই তোর ঘোড়া। আমিই তোর তিন চাকার সাইকেল।
গহরের পিঠে বসে আছে টগর। চার হাতপা দিয়ে গহর ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। গহর জানে না এই কান্না আনন্দের না কষ্টের।