কমরেড ফরহাদের জীবন অনুপ্রাণিত করুক
৯ অক্টোবর ২০২১ ১৯:১৭
এক.
এখন সকাল। রোদ-বৃষ্টির একটি মিথস্ক্রিয়ার সকাল।
আমি যখন কম্পিউটারের কিবোর্ডে হাত রাখছি, ১৯৮৭ সালের সেই মুর্হূতটার দৃশ্য চোখের সামনে আনার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমি ওইদিনের ধারে-কাছেও ছিলাম না। বিভিন্নজনের লেখায় আমি এটা কল্পনা করতে পারছি, সেই দিন তার সম্মানে এসেছিলেন হাজার হাজার মানুষ, তাদের মধ্যে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, দেশের বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পীরা। অগুণতি মানুষ। যারা সবাই শোকাভিভূত। এ দৃশ্য কল্পনা করেই যাচ্ছি।
একজন কমিউনিস্ট নেতার জন্য এ সম্মান নিঃসন্দেহে গৌরবের।
দুই.
মুক্তিযুদ্ধ ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ। বাংলাদেশের একনিষ্ট কমরেড। আকণ্ঠ পিয়াসী বিপ্লবী। ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে মারা যান তিনি। প্রতিবছর এ দিনটি আসে, আবার তার ভূমিষ্ট হওয়ার দিন ৫ জুলাইও আসে। এ দিনগুলোতে মোহাম্মদ ফরহাদের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধাঞ্জলি, স্মরণসভা আয়োজন হয়। তাতে আমরা কী করি, ফরহাদ সম্পর্কে কতোগুলো স্তুতিবাক্য আউড়াই। এগুলোতে আমরা আমাদের ‘মহান কর্তব্য’ বলে মনে করে যাচ্ছি, আমাদের কথামালায় মোহাম্মদ ফরহাদকে ‘অতিমানব’ হিসেবে তুলে ভুলভাবে উপস্থাপনে অপলাপ করি। বরং যে কীর্তি তিনি রেখে গেছেন, কমিউনিস্ট পার্টি এবং যে শ্রদ্ধার আসনটি তিনি অধিকার করেছিলেন, সেই নির্মোহ আলোচনাটুকু আমাদের নিবিঢ়ভাবে করা উচিত। এবং অনেক বেশি ছড়িয়ে দেয়া উচিত। প্রয়াণের ৩৪ বছরে জাতিসত্ত্বার বিকাশের নানা প্রয়োজনে মোহাম্মদ ফরহাদ অনুভূত হওয়া প্রাসঙ্গিক।
তিন.
আদতে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ হারিয়ে যাচ্ছেন, একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখি, বোঝা যাবে কথাগুলো সত্য কিনা। কিভাবে তিনি হারিয়ে যাচ্ছেন, সেই আলোচনাটা এ পরিসরে হয়তো করবো না। এ আলোচনায় আমার যথেষ্ট আড়ষ্টতা আছে। তার যে লড়াই-সংগ্রাম, কিংবা তার ধ্যানজ্ঞান ও সাধনার প্রধান ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তার জাতীয় নেতা হয়ে উঠা আলোচনাগুলো তরুণ প্রজন্ম, তৃণমূল পর্যায়ে অধরা থেকে যাচ্ছে। কীভাবে একজন মোহাম্মদ ফরহাদ একজন ‘কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ’ হয়ে উঠেছেন, এ চর্চাগুলো আমাদের মাঝে নেই। থাকার কথা নয়, চারিদিকে এতো কাল্ট চর্চার মধ্যে তাদের কাছের মোহাম্মদ ফরহাদ অনেকটাই অচেনা কিংবা বেমানানও লাগতে পারে। ‘বিপ্লবের জন্য আরো পাঁচটি বছর কাজ করে যাবার’ অদম্য ইচ্ছে বা আকাঙ্খাগুলো ক্রমশ অপসৃয়মান। এ দুঃখ আমরা কোথায় রাখবো? কমরেড ফরহাদের সমসাময়িক কিংবা যারা তার সান্নিধ্য পেয়েছেন, ফরহাদের আকাঙ্খা বাস্তবায়নে এতোবছরেও সেই সঠিক দিশা দেখাতে পারেন নি, তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন বিভিন্নভাবে। হয়তো এ কথাতে সৌন্দর্য্যহানি হবে, কিন্তু বলতে হয়, তারা কেটে পড়েছে।
চার.
যে যুবকটি আজ যারা সমাজতান্ত্রিক লড়াইয়ে সামিল হচ্ছে, তার কাছে প্রশ্ন করে দেখা যেতে যারে, কমরেড ফরহাদ সম্পর্কে কতটুকু জানে সে। মোটেরও উপর সে হয়তো বলতে পারবে, তিনি কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন। ব্যস, অতোটুকুই, এর বেশি কিছু বলতে পারবে না। দোষ তার নয়। এ না-জানার দায়টা আমাদেরকেই নিতে হবে।
কমরেড ফরহাদের ৫২ বছরের জীবন একটি বিপ্লবী জীবন, পরিপূর্ণ কমিউনিস্টের জীবন। নিজ চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের জোরে বাম বৃত্তের চৌহদ্দি পেরিয়ে নিজেকে অন্যতম রূপকার হিসেবে তৈরি করেন। কমিউনিস্ট আন্দোলনে তিনি ছিলেন দুই প্রজন্মের চল্লিশ দশকের পথিকৃৎ কমিউনিস্ট বিপ্লবী মণি সিংহ, বারীণ দত্ত, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি ও জ্ঞান চক্রবর্তীদের প্রজন্ম এবং সত্তর ও আশির দশকের তরুণ কমিউনিস্ট প্রজন্মের মধ্যে সেতুবন্ধন স্বরূপ। দুই প্রজন্মের মধ্যেই তিনি ছিলেন সমানভাবে সমাদৃত।
জাতীয় রাজনীতি, একই সঙ্গে ছাত্র, শ্রমিক, নারী, যুব, ক্ষেতমজুর, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নানা কর্মকাণ্ড এবং নাগরিক সমাজের তৎপরতা ও পেছনে ছিলো কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ। ঐক্যবদ্ধ জাতীয় এবং বিভিন্ন শ্রেণিপেশার আন্দোলন এবং সংগঠন, অসাম্প্রদায়িক-প্রগতিশীল সমাজচেতনা ভিত্তিক বিস্তার সাধনে অনেকের বিবেচনা তা তুলনারহিত, এবং তা গড়ে তোলার পেছনেরও তিনি অনুঘটকের নৈপথ্য ভূমিকা। তার অকাল প্রয়াণ তার স্বপ্নযাত্রায় অনেকটা শ্লথ হয়ে গেছে। সেটিকে গতিশীল করার জন্য যে দৃষ্টি দেয়ার দরকার ছিলো, কিংবা তাকে অধিকতর চর্চার ভেতর দিয়ে হয়তো এতোদিনে এ নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের একটি অন্য চেহারা দেখতে পারতো।
পাঁচ.
কমরেড ফরহাদ দেশে একটি শোষণ, বঞ্চনা, ভেদ, বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেই স্বপ্ন ছড়িয়েও দিয়েছেন। আবারও এই কথাটাই বলতে হয়, সেই স্বপ্নকে বিকশিত করার যে মহান এবং বলিষ্ঠ দায়িত্ব পালন করার কথা সেখান থেকে আমরা অনেক দূরে চলে গিয়েছি। কমরেড ফরহাদের মতাদর্শ লড়াই, সেই লড়াই থেকে বাইরে চলে যাচ্ছি। ফের অন্তর্মুখী জীবনে তাকাচ্ছি।
কিন্তু কমরেড ফরহাদের কথা বার বার বলতে হবে। পুনরাবৃত্তি করতে হবে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তার দর্শন, মতাদর্শকে রাখতে হবে। তাহলে আমরা আরো সুসংহত হবো। শক্তি বৃদ্ধি করতে পারবো। মানবমুক্তির বিপ্লবের পথে এগিয়ে চলতে আমাদের সেই লক্ষ্য, সেই সাহস, সেই শক্তি অর্জনে মোহাম্মদ ফরহাদের জীবন আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করুক।
মোহাম্মদ ফরহাদ একনিষ্ট নিরলস কাজের এক অভাবনীয় দুর্লভ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। রাতের পর রাত তিনি জেগে থেকেছেন। কীভাবে সকাল হয় তিনি দেখেছেন। তার দিনমান গেছে রাজনীতি, সংগঠনে। একদিনের জন্যও তিনি থামেননি। বিপ্লবের আকণ্ঠ পিপাসা নিয়েই তার মৃত্যু হলো। সে জন্যই এ জীবন। এ মৃত্যু এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
চিরঞ্জীব কমরেড ফরহাদ, লাল সালাম!
লেখক: রাজনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
কমরেড ফরহাদের জীবন অনুপ্রাণিত করুক প্রবন্ধ সাহিত্য হাবীব ইমন