Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দ্বিধার শঙ্খচূড়

রোখসানা ইয়াসমিন মণি
৩১ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:১২

সমস্ত হোস্টেল ফাঁকা। বৃহস্পতিবার এলে হোস্টেলটা ফাঁকা হয়ে যায়। কর্মজীবী হেস্টেলের মেয়েগুলো এই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। কখন অফিস ছুটি হবে আর বাক্স পেটরা নিয়ে বাড়িতে দেবে ভোঁ-দৌড়।

শুধু রুবির কোন তাড়া নেই। ওর কাছে সপ্তাহের সবদিন এক রকম। বৃহস্পতিবার অফিস শেষ করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরের দিন শুক্রবার। ঘুম ছেড়ে উঠতে উঠতে দিনের একটা বা দুটো বাজায়। তাও ইচ্ছে হলে, না হলে একবারে বিকেলে উঠে ¯œান সেরে কিছু খেয়ে টিভি দেখতে বসবে। আজ আর তাও বলে হবে মনে হয় না। দেয়ালে খটখট শব্দ । রুবি ঘুমঘুম চোখ মেলে দেখে, দিনা আপা শক্ত একটা পাথর দিয়ে দেয়ালে পেরেক ঠুকছে। দিনা আপার সত্যি কোনো কা-জ্ঞান নেই। এমন দিনে কেউ কাউকে বিরক্ত করে? সপ্তাহের ছয়দিন কাজ শেষে এই একটি দিন বিশ্রাম নিতে মন চায়। হঠাৎ দিনা আপার উৎপাত, একেবারেই অসহ্য।

বিজ্ঞাপন

রুবি কিছু না বলে বিছানার ওপাশে ঘুরে ঘুমাতে চেষ্টা করে এবং খানিক বাদে ঘুমিয়ে পড়ে। কতক্ষন ঘুমালো জানে না। ঘুম থেকে জেগে দেখে দিনা আপার সাড়শব্দ নেই। নিচে গেছে বোধহয়। রুবি বিছানায় শুয়ে ভাবলো, ভালোই হলো। দিনা আপা নেই। সারাদিন বিছানায় পড়ে থাকতে পারবে। নো খাওয়া-খাওই। নো টেনশন।

কিন্তু কয়েক মিনিট পর দিনা আপা কোথা থেকে এসে উপস্থিত। এসেই হৈচৈ শুরু করে, কীরে তুই এখনও বিছানায় শুয়ে আছিস? ছুটির দিন বলে এভাবে বিছানায় পড়ে থাকবি? উঠবি না? কয়টা বেজেছে জানিস? বারোটা।

রুবি যেমন ছিলো তেমন থেকেই বললো, বাজুক।

দিনা আপা আরো জোরে বললো, ওমা তুই জেগে আছিস? তাহলে তাড়াতাড়ি ওঠ।

না, উঠবো না।

মানে?

কোনো মানে নেই। উঠবো না, ব্যাস।

দিনার সহ্য হলো না। রুবিকে এক রকম জোর করে বিছানা থেকে টেনে নামিয়ে অভ্যাস মতো বকবক শুরু করে, আজকালকার মেয়েরা যেনো কেমন! বোঝা বড় দায়! সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নামায, কলমা করলে কী হয়? সপ্তাহের অন্যদিন না হয় বাদ, অন্তত এই দিনও কি একবার নামায পড়তে পারিস না? নাকি শুক্রবার বলে নামাযেরও ছুটি? চাকরি একা তুই করিস না, আমিও করি। নামায পড়ি, আল্লাহকে ডাকি। মরণের ভয়ে অস্থির থাকি। দিন দুনিয়া বেশিদিনের না বুঝলি?

বিজ্ঞাপন

দিনার এই দীর্ঘ লেকচারে রুবির বিরক্তি আসে। বকবকানিতে বিছানায় থাকার আর ইচ্ছে নেই। কিছু না বলে তোয়ালে ব্রাশ নিয়ে বাথরুমে চলে যায়।
রুবির পৃথিবীতে কেউ নেই। আত্মীয়-স্বজন যে ক’জন আছে ওদের থেকে বিচ্ছিন্ন। কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে থাকে। দিনাও কেউ নয়। চাকরীর সুবাদে একসাথে, একরুমে থাকা। একসাথে একই রুমে থেকে এই অনাত্মীয় মহিলার উৎপাত নিরবে সহ্য করে। মাঝেমাঝে যদি রাগ এসে যায় রুবি চেপে রাখে। প্রকাশ করে না। রুবির কেউ নেই। এই মহিলা ওকে খুব ভালোবাসে। শাসনও করে। মাঝে মাঝে শাসন অধিকার ছাড়িযে যায়। তখন তিনি রুবিকে বকাঝকা করতে করতে খেই হারিয়ে ফেলে। আসলে রুবি কিছু না বলতে বলতে প্রশ্রয়ের লতাটা দিনার দিকে থেকে বেড়েই চলেছে।

অতএব দিনার বকে যাওয়া আর রুবির শুনে যাওয়া, চলতে থাকে সমানে সমান।

দুজনেই নিরুপায়। একজন ভালোবাসা দেয়। আরেকজন ভালোবাসা নেয়। ভালোবাসা দিলেই হবে না, যে নেবে তারও নেয়ার ইচ্ছা থাকতে হয়। অতএব রুবি বিনা শর্তে দিনার সমস্ত ভালোবাসা কবুতরের আদার খাওয়ার মতো খুঁটে নেয়, এক বিন্দুও অপচয় করতে রাজী নয়। কারণ ভালোবাসার কাঙ্গাল।

বাথরুম থেকে রুবি বের হয়। অনেক দেরীতে বের হওয়ায় দিনা তাকায়, কীরে বাথরুমে ঘুমালি? এত তাড়াতাড়ি এলি কেনো? একেবারে ঘুম শেষ করে আসতি?

রুবি বললো, কী বলবে বলো?

আমি যাচ্ছি। এমনিতেই দেরী হয়ে গেছে। আলুভাজি চা, পরোটা করা আছে। একটু হাত লাগিয়ে খাস। সময় থাকলে নবাবজাদীকে ওটাও খাইয়ে যেতাম। পল্টুর কাছে যাচ্ছি। ওর বায়না আজ ওকে বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে। আমাকে নিয়ে ঘুরবে। সন্ধ্যার আগে ওকে আবার হোস্টেলে দিয়ে আসা। তোকে নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সম্ভব না। দেরী হয়ে গেছে। শোন, দুপুরে কষ্ট করে খেয়ে নিস। আমি রাতের খাবার নিয়ে আসবো । তোর রান্না করতে হবে না।

দিনা হনহন করে বেরিয়ে গেলো।

এখন একলা রুবি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। পাশের রুম থেকে আওয়াজ আসছে। কিছু রুম আবার খালি। বৃহস্পতিবার এলে অনেকেই বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শুধু ব্যতিক্রম ওরা এবং পাশের কয়েকটা রুম। কোথাও যেতে হয় না। ব্যস্ততার প্রয়োজন পড়ে না। ওদের কোন ঘরবাড়ি নেই। এই কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল হচ্ছে ওদের বাড়ি ঘর। ছোটবেলায় রুবির বাবা-মা এক্সিডেন্টে মারা যাবার পর একমাত্র মামার কাছে বড় হয়েছে। মামিটা ভালো না। এক সময় তার মামাও মারা গেলেন। রুবির জীবনে নেমে এলো ঝড়। বহুকষ্টে টিউশনি করে অনার্স কমপ্লিট করে। অনেক কষ্টে বন্ধুদের সহায়তায় একটা ফার্মে চাকুরী জুটিয়ে যায়। ভালো বেতন। চাকরিটা পাবার পর চিরদিনের জন্য মামাবাড়ি ত্যাগ করে। মামা যখন নেই, ¯েœহের শেষ চি‎হ্নটুকুর পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে এখন কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের বাসিন্দা। দিনার সাথে স্বামীর ছাড়াছাড়ির পর এই হোস্টেলে উঠেছে। দিনা বেসরকারী একটি কোম্পানিতে কো-অর্ডিনেটর হিসেবে আছেন।

একমাত্র ছেলে পল্টুকে একটি স্কুলের আবাসিকে রেখে পড়াচ্ছেন। প্রচুর খরচ। হিমশিম খায় দিনা। পল্টুর আবাসিকের ভাড়াটা রুবি নিজ থেকে দেয়। প্রথম প্রথম দিনা না-না করত। রুবি যখন বলল, আমি তোমার মেয়ে হতাম আর তুমি আমার মা হতে তাহলে কি নিষেধ করতে? জানো আপা! মা কীভাবে ডাকে আমি জানি না। মা ডাক শুনলে সন্তানের জন্য মায়ের কেমন অনুভূতি হয় আমি দেখিনি কখনো। মা দেখতে কেমন হয়, আপা? জানো, তোমাকে আমার মা ডাকতে ভীষণ ইচ্ছে করে। রুবি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।

দিনা রুবিকে কাছে টানে, ডাক- আমাকে মা ডাক। আমি কিছু বলবো না।

দিনা চোখ তুলে বললো, তা হয় নাকি? পল্টু যে আমাকে খালামণি ডাকে?

দিনা চলে গেছে। হঠাৎ অবাক নিরবতা রুমটায় নিস্তব্ধতা নেমে আসে। চারদিক শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করছে। কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই। রুবি আবার বিছানায় বসে। ইদানিং ওর কোনকিছুই ভালো লাগে না। একঘেয়ে আর একপেশে জীবন। চাকরি আর হোস্টেল এই দুই জিনিস ছাড়া ওর আর কোন জগৎ নেই। কত ঘরকুনো হয়ে গেছে ও।

কোথাও যেতে ভালো লাগে না। কোন কিছুই টানে না। আগে সামান্য আঘাতে বুক ভেঙ্গে যেতো। দীর্ঘশ্বাস ঝরতো অনবরত। এখন এসব কিছু আর নেই। দুঃখ কী জিনিসটাই ভুলে গেছে। একপেশে জীবন আর একাকীত্ব গ্রাস করে ওর সব বোধ নিয়ে গেছে। কোনো কিছুতে আর হাসি আসে না। কান্নাও পায় না। রাগও হয় না। নিরব গৃহবাসে স্বেচ্ছা নির্বাসন।

অনেক বেলা হয়ে গেলো। রুবি ভাবছে, একা একা রুমে বসে কী করবো ? ঘড়ি দেখে, প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। উঠলো। বাথরুমে যায়। স্নান করে। কেউ নেই যে বলবে, স্নান করে আয়। ভাত বেড়ে রেখেছি, ঠান্ডা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। খেলেই কি আর খেলেই কী! দুপুরে না হয় কিছু খাবে না। রুবি স্নান সেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে মুখে আলতো লোশন, পাউডার লাগায়। বহুদিন পর নিজেকে দেখছে আয়নায়। নিজেকে দেখে মনটা খুব ভালো হয়ে যায়। ওর খুব সাজতে ইচ্ছে করছে। ড্রয়ার থেকে কাজলের কৌটো বের করে কতক্ষণ ঘুরিয়ে দেখে ওটার ভেতর থেকে ব্রাশ তুলে হাতে নেয়। ব্রাশটা চোখের পাতায় রেখে চোখ আঁকতে থাকে। ওর চোখ দু’টি অসম্ভব সুন্দর। কাজল পরাতে আরও মায়াময় লাগছে। সবশেষে কপালে একটি ছোট্ট লাল টিপ পরে। আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। ব্যাস্! রুবি আয়নার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ও এত সুন্দর! এত মায়াময় রূপ আমার! শফিক ………… শফিক আমাকে ছেড়ে চলে গেলো? রুবি ওকে সত্যি ভালোবেসেছিলো। আর শফিক, সেও রুবির সবকিছু জানতো। সব জেনেশুনে শফিকই ওকে ভালোবাসার জন্য কত আকুতি প্রকাশ করেছে। শফিক পাবার জন্য বাজারের মোড়ে মোড়ে, ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার পথে দিনের পর দিন পথ চেয়ে থাকত। রুবি তো কোনদিন বলেনি, শফিক আমি তোমাকে ভালোবাসি।

শফিকের ক্রমশ দুর্বলতা দেখে শেষপর্যন্ত রুবি একটু একটু পছন্দ করতে শুরু করে। সেই থেকে শুরু হলো ভালোবাসার যন্ত্রনাময় দিন। এখন এই গহীনে দুঃখ বেঁধে রুবি কোনরকম বেঁচে আছে। যেদিন থেকে শফিককে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে শুরু করে সেদিন থেকেই মৃত্যুপথে যাত্রা। শফিক এখন জীবনের দুঃসহ এক স্মৃতির নাম। স্বপ্ন হন্তারক এবং খুনী।

হঠাৎ রুবির কী যে হয়! তাড়াতাড়ি ড্রয়ার খুলে একটা লাল পেড়ে সবুজ জমিনের শাড়ি বের করে। সাথে লাল ব্লাউজ। আজকে আমি আমাকে সাজবো। মনের মত সাজবো। রুবি শাড়ি পরে। চুলগুলো একটু গুছিয়ে নেয়। নিজেকে আবার আয়নায় দেখে।

অপূর্ব! বহুদিন পর নিজেকে অমন দেখতে পেয়ে খুব ভালো লাগে রুবির। ঘড়ি দেখে, প্রায় সাড়ে চারটা বাজে। বাইরে যাবে। কোন একটা রেঁস্তোরায় বসবে। এই রুমটায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে খুব গরম। সিদ্ধ হয়ে যাবে শরীর। একটি সিএনজি নিয়ে অভিজাত রেঁস্তোরা নাইটিঙ্গেলে চলে আসে। অনেক বাছাই করে কর্ণারের একটি টেবিল দেখে ওখানে বসে।

রেঁস্তোরাটি সুন্দর। এসির ঠান্ডায় ওর শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। টেবিলের সামনে বড় একটি এ্যাকুরিয়াম। নানা রঙের মাছ। কী সুন্দর সাঁতার কাটছে। যেনো জলের ভেতর রঙিন প্রজাপতি। ওয়েটার এলো। রুবি চিকেন, ফালুদা আর সালাদ অর্ডার করে। সাথে কোল্ড ড্রিংকস্। খাওয়া শেষে বিল মিটিয়ে রুবি ভাবছে কী করবে? এখানে বসে থাকবে নাকি বাসায় চলে যাবে? বাসায় যাবার আগে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়? সন্ধ্যা হতে অনেক বাকী। রুবি ভাবলো নাগরিক থিয়েটারে গেলে মন্দ হয় না। সাধারণত এই সময়ে নাটক চলে। কিছু সময় ওখানে কাটিয়ে না হয় এখানে আবার ফিরে আসে। ওয়েটারকে ডাকে, এই যে শুনছেন?

ওয়েটার ঘুরে দাঁড়ায়,আমাকে বলছেন?

জ্বী,একটু শুনুন?

বলুন, কী বলবেন,ম্যাডাম?

রুবি বললো,আপনাদের এই রেঁস্তোরা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি যদি সন্ধ্যার পর এই ধরুন, সাড়ে ছয়টা বা সাতটার মধ্যে এখানে আসি তাহলে এই টেবিলটায় বসতে পারবো?

ওয়েটার অবাক হয়ে বললো, কেনো বলুন তো?

রুবি বললো, না, একটু দরকার আছে। ওয়েটার বললো, দেখুন ম্যাডাম, এই রেস্টুরেন্টের সব জায়গা সুন্দর। আপনি ইচ্ছে করলে যখনই আসুন যে কোনো একটিতে বসতে পারবেন। রুবি এবার ইতস্তত করে বললো, না মানে…এখানে আমার একটু দরকার আছে।

ওয়েটার বললো, ম্যাডাম, আমরাতো চাকরি করি। ডিসিপ্লিন বলে একটা কথা আছে। তাছাড়া কোন পাবলিক এসে যদি ওখানে বসতে চায় আমি নিষেধ করতে পারি না।

রুবি ব্যাগ থেকে দুইশত টাকা বের করে ওর হাতে দেয়, এটা রাখুন।

ওয়েটার আমতা আমতা করে বলল, ম্যাডাম একটা কথা ছিলো।

রুবি বললো, বলুন।

আপনি যদি এই সময়ের ভেতর আসতে পারেন, তাহলে আপনার জন্য আমি একটি উপায় বের করতে পারি। কিন্তু একটি কাজ করতে হবে।

কী কাজ?

আপনার হ্যান্ডব্যাগ আমার কাছে রেখে যান। আপনার ব্যাগ আমি এই টেবিলে রেখে দেবো। টেবিলে ব্যাগ দেখলে কেউ বসতে চাইবে না। ভাববে হয়তো কেউ আছে এখানে। আপনি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যেতে পারেন।

কয়েক মুহূর্ত ভাবে, ঠিক আছে। তাই হোক।

রুবির ব্যাগে তেমন কিছু ছিলো না। টাকা, ফোন, লিপস্টিক, লুজপাউডার বক্স, মিনি বডিস্প্রে আর ছোট্ট চিরুনি। ব্যাগ থেকে টাকা আর ফোন নিয়ে ব্যাগটা ওর কাছে দিয়ে বেরিয়ে যায়। মার্চের গনগনে গরম। রোদ নেমে গেছে। সারাদিন সূর্যটা পৃথিবীকে পুড়িয়েছে খুব। সেই আঁচ এখনো আছে। মানুষ ছুটছে আর ছুটছে। শরীরের গরম উষ্ণ নিঃশ্বাস, পৃথিবীকেও কম উত্তপ্ত করেনি। আকাশটা নীল। রোদে পুড়ে পুড়ে আকাশের নীলাভে কিছু সাদাটে আভা। সব মিলিয়ে ঝাঁঝালো সুন্দর। সূর্য হয়তো ওপারে কোথাও ডুব দেবে। দেখার উপায় নেই। ঢাকা শহরের আকাশ অট্টালিকার আবরণে ঢেকে আছে। প্রকৃতির নিসর্গ এখানে কল্পনা করা যায় না।

রুবি ঘড়ি দেখে সাড়ে পাঁচটার মত বাজছে। সময় কম। কিছু টুকিটাকি কাজ সারতে হবে। প্রথমে একটি ফুলের দোকানে যায়। কী সুন্দর থরে থরে ফুল দিয়ে সাজানো দোকানটা। এই ব্যস্ত নগরীর ভেতর ফুল দোকানটা দেখতে স্বর্গেও মত লাগছে। এত বাহারি ফুল! যেটা দেখে সেটাই সুন্দর। দোকানির সত্যি রুচি আছে।

ফুলের সৌন্দর্য আর সৌরভে মন জুড়িয়ে যায় রুবির। আহা! ফুলের মতো সব যদি সুন্দর হতো! রুবি তাজা দেখে কয়েকটি ফুল মিলিয়ে একটি বোকেটের অর্ডার করলো। আর খোঁপায় পরার জন্য রজনীগন্ধার মালা।

রুবি দোকানিকে টাকা পেমেন্ট করে বললো, ভাইয়া এগুলো আপনার কাছে রেখে দিন। আমি যাওয়ার পথে নিয়ে যাবো।

দোকাানি বললো, ঠিক আছে আপা।

রুবি এবার একটি কনফেকশনারী দোকানে ঢুকে দুই পাউন্ড ওজনের একটা কেক, একটি বড় মোমবাতি কেনে। কাজ শেষ করে ঘড়ি দেখলো। নাহ্, নগর থিয়েটারে যাওয়ার সময় নেই। অগত্যা রেঁস্তোরায় ফিরে যাওয়াই ভালো, ভাবে রুবি।

রুবিকে দেখে ওয়েটার অবাক। কারণ রুবি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফিরেছে। ওয়েটার এগিয়ে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে- ম্যাডাম, আপনার জন্য কী করতে পারি?

আপাতত এই কেক এবং ফুলদানীটা ওই টেবিলে রাখতে পারবেন?

পারবো, দিন আমাকে।

রুবি টেবিলে এসে ওয়েটারকে বলে, যদি কিছু মনে না করেন একটি কথা বলি?

ওয়েটার বললো, জ্বী ম্যাডাম, বলুন।

আপনার নামটা বলবেন কী?

জ্বী ম্যাডাম, সুমন ডাকতে পারেন আমাকে।

সুমন, আপনি আমার একটু উপকার করবেন? একটা কেক কাটবো। ছুরি হবে উইথ ম্যাচেস? সব এনেছি বাট এগুলো মনে ছিলো না।

অবশ্যই ম্যাডাম। সুমন চলে গেল।

রুবি ব্যাগ থেকে ফুলের মালা বের করে খোঁপায় গুঁজে নেয়। ব্যাগ থেকে ব্ল্যাক অর্কিডের ছোট্ট সুগন্ধি বের করে গায়ে মাখে। মিষ্টি ঘ্রাণে টেবিলের চারপাশ ভরে উঠে। নীল আলোর মাঝে লাল আর সবুজ শাড়ী হয়ে গেলো কমলা রঙের মতো। পাশে এ্যাকুরিয়ামে কমলা রঙের মাছগুলো রুবির বর্ণিল শরীরের মতো আরো রঙিন হয়ে উঠে। রুবিকেও তখন এ্যাকুরিয়ামের মাছের মত লাগছে। অপূর্ব, সুন্দর এক মোহনীয় মৎস্য নারী।

সুমন চলে গেলে রুবি বোকেটটি টেবিলের ওপর রেখে প্যাকেট থেকে কেক বের করে।

সুমন ছুরি ও দেয়াশলাই এনেছে। রুবি ঘড়ি দেখে। সাতটা বাজছে। নাহ্, আর দেরী করা যাবে না। মোমবাতি জ্বালিয়ে হাতে ছুরি নিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে একা একা কেক কাটছে। আর গাইছে, শুভ জন্মদিন, আজ রুবির শুভজন্মদিন। নিজেকে নিজে উইশ করে রুবি কেক কাটা শেষ করে। রুবি দেখে সুমন দাঁড়িয়ে আছে। রুবি ওকে দেখে বলে, ভালই হলো সুমন আপনি এসেছেন। নিন, কেক খান। আমার জন্মদিনের কেক।

সুমন হতভম্ব! চিন্তাও করতে পারে না কেউ একা একা এভাবে জন্মদিন পালন করে। ভীষণ অবাক হলো। সুমনকে চুপ থাকতে দেখে রুবি বলে, কী ভাবছেন? অবাক লাগছে তাই না? আসলে অবাক হবারই কথা। আচ্ছা, অবাক না হয় পরে হবেন। আগে আমাকে একটু উইশ করুন তো দেখি!

সুমন কেক হাতে নিয়ে বললো, শুভজন্মদিন আপা। শুভ জন্মদিন। এবার সুমন রুবিকে আর ম্যাডাম বলছে না। অনেকটা সহজ হয়ে বলছে, আপা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

করুন।

আপনি এখানে কেন? আপনার কেউ নেই?

সুমনের এই কথায় রুবি ধাক্কা খেলো। হঠাৎ বুকের অতল থেকে একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। জবাব দিতে পারে না। সুমনের কথাটি কানে ভাসছে, আপনার কেউ নেই? কী ছিল এই কথাটিতে?

সুমনের প্রশ্ন শোনার সাথে সাথে হাজার সমুদ্রের ঢেউ ওর বুকে আঁছড়ে পড়ছে। রুবির চোখ ছল ছল করে ওঠে। সুমন বলে, আপনি কাঁদছেন কেন?

রুবি আবারও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, হুঁ, একটু ভিজে গেলো চোখ।

আমরা তো কেউ নেই। তাই এখানে এসেছি। আমার মতো করে জন্মদিন উদযাপন করতে। কেমন হয় জন্মদিনের উৎসব? তা একটু অনুভব করা আর কি!
মা-বাবা আত্মীয়হীন এই জীবনটা উদযাপন করে দেখা, কেমন লাগে জীবন! দেখুন না এই মুহূর্তে যদি মরে যাই এক ফোঁটা চোখের জল ফেলার মতো বা কোথায় আছি জিজ্ঞেস করার মতোও কেউ নেই। শুধু একজন অনাত্মীয় আছেন। সেই দিনা আপাকে আশ্রয় ভেবে বাঁচার সাহসটা জেগে আছে।

সুমনের খুব কষ্ট হচ্ছে সামনের এই মেয়েটার জন্য। এত সুন্দর একটা মেয়ে, কাঁদছে! সুন্দর মেয়েরা কাঁদে কেন? ওদেরতো কাঁদতে নেই। ওরা হাসবে, শুধু হাসবে আর পৃথিবীকে হাসবে। সুমন রুবির কালো চোখ দু’টোর ভেতর বেদনার এক গভীর সমুদ্র দেখতে পায়। আর মনের অজান্তে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, কী বিচিত্র মানুষের জীবন! বাইরে থেকে মানুষকে দেখে চেনার কোন উপায় নেই। কে কতটুকু সুখী বা কে কতটুকু দুঃখী।

কেকের পর্ব শেষ। রুবি ইচ্ছে করলেই দিনা আপার সাথে জন্মদিন পালন করতে পারতো। কিন্তু আজ ওর জন্মদিন জানতো না রুবি। স্নানের পর একাকী রুমে ভাল লাগছিল না। একা একা কী করবে ? এই ভেবে ড্রেসিং টেবিলে দাঁড়ায়। একটু সাজে। চোখে কাজল পরে। কাজল পরার পর থির দৃষ্টিতে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ সত্যি সুন্দর। নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে কতবার নিজের প্রেমে পড়েছে, হিসেব নেই। আবার কেঁদেছেও। মনের ভেতর দুমড়ানো মোচড়ানো কষ্টে যখন ভেঙে পড়তো তখন আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চোখ সাজাতো। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত। এক সময় বাষ্পে ঢেকে যেতো চোখ। সেই চোখ ছাপিয়ে অশ্রু নদীর মতো বয়ে যেত বুক গড়িয়ে নিচ থেকে আরো নিচে। চোখ মিইয়ে এলে আয়নায় হাত বুলাতো।

আজও এমন করে সেজে ডানহাত আয়নার ওপর রাখলো। ঠিক চোখের ওপর। চোখগুলোকে ছোঁয়, গভীর মমতার সঙ্গে ছোঁয়। সামনে ঝুঁকে চোখগুলো যে বরাবর ছিলো সেখানে দু’ঠোঁট রাখে। চুমু খায় চোখে। অদ্ভুত এক শিহরণ কাজ করে ওর শরীরে। ভোঁতা অনুভূতির ভেতর এক কষ্টের অনুভব নিয়ে চোখের মাঝে পুরনো এক স্পর্শ নতুন করে খোঁজে। একদিন শফিক ওই চোখে চুমু খেয়েছিলো। স্পর্শের ঘোরে শিহরিত রুবি সেদিন মেঘের ঘুড়ি হয়ে সুতো কেটে

শফিকের হৃদয়ে চুপে চুপে বলেছিলো, স্বপ্ন দাও, আমাকে তুমুল স্বপ্ন দাও, শফিক।

সেই ভালোলাগার ঘোর ছাপ মেরেছিল ওর ভেতরে বহুকাল।

রুবি ঝরঝর করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের কালোরঙ জলের সাথে মিশে তৈলরঙ হয়ে যায়। ওগুলো চোখের পাপড়িতে লেপ্টে গেলে চোখের পাতা অন্যরকম হয়ে ওঠে। যেন মায়াবী চোখের ভেতর এক সুক্ষ্ম বেদনার প্রলেপ। চিকন সুতার মত পাপড়িগুলো কচকচে শলাকার মতো হয়ে ওঠে। ওহ! কী অসাধারণ সৌন্দর্য! রুবির কান্নাভেজা চোখ তখন বৃষ্টি শেষে পাতার শরীর থেকে ধুলো সরে যাওয়া তরতাজা এক সবুজের ক্যানভাস।

কান্না শেষে রুবি ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দেয়। লিপস্টিক দেয়ার পর ওকে আর চেনাই যায় না। যেন একটা পরি। বহুদিন পর ইজেল খুলে দাঁড়ালে একজন চিত্রকরের কাছে যেমন লাগে ঠিক রুবিকেও তেমন লাগছে। এই কর্মজীবী হোস্টেলের একাকী এক রুমে নিজেকে দেখতে পেয়ে হঠাৎ জন্মদিনের স্মৃতি মনে পড়ে। জন্মদিনের স্মৃতি মনে পড়তেই সিদ্ধান্ত নেয়, আজ আমি আমার জন্মদিন পালন করবো। এমন লাগছে কেনো? হঠাৎ মনের ভেতরে টানপোড়েন। যন্ত্রণা! যন্ত্রণা! কিছু আঁকড়ে থাকার যন্ত্রনা। কিছু হাতছাড়া হয়ে যাওয়ারর যন্ত্রনা। হঠাৎ আকাশে ঘুর্ণি ওঠে। মেঘের ঘুর্ণি। রুবি ঘুর্ণি থেকে নেমে আসতে চায় কিন্তু কিছুতেই পারে না। মনে হলো সে এক নির্জীব পদার্থ। যার সবকিছু শেষ হয়েছে মিথ্যে স্বপ্নের চোরাবালিতে পড়ে। কিন্তু এরপরও কে তাকে টানছে? কিসের জন্য?বুকের ভেতর হঠাৎ কেনো সে সাত সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছে? এই বিষাদী গর্জনগুলো কেনো তাকে স্মৃতির দুয়ার টেনে নিচ্ছে? কেনো?

ফিসফিসিয়ে আপনা-আপনি বলে, হায় বিষন্ন স্মৃতি! তুমি আমাকে জাগাচ্ছ কেন? আমি যে সেসব ভুলে গেছি।

কবেই! ওসব মন থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি। এখন আবার কেন আমাকে ডাকছে? কেনো? হঠাৎ রুবির শফিককে মনে পড়ে। বিষন্ন সব স্মৃতিরা হৃদয় থেকে গলে পড়ছে কেক এ মেশানো ক্রীমের মত। বহু বছর বুকের ভেতর চেপে থাকা যাতনাগুলো ওকে জাপটে ধরতে চাইছে। উড়ে আসছে ওরা ধুলির ঝড়ের মতো, ঘিরে ধরছে ওকে অক্টোপাসের মতো, ভেঙে দিচ্ছে রুবিকে নদী ভাঙনের মতো। হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে ওর পৃথিবীর আর সব ব্যর্থ প্রেমিকের মতো রুবি অস্ফুটে উচ্চারণ করলো, শ …….. ফি …….. ক? কেনো এমন করলে আমার সাথে?

শফিক স্মৃতির ক্যানভাসে দাঁড়িয়ে। আজ স্মৃতির ক্যানভাস থেকে উঠে আসা এক ঝড়ো হাওয়ার নাম। রুবি আর দেরি করে না। মুহূর্তে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দেয়। সিদ্ধান্ত নেয় এখন এই মুহূর্তে বেদনার শফিককে একটা চিঠি লিখবে। একটি দীর্ঘ চিঠি। কারণ, আজ ওর কোনো দ্বিধা নেই। কোন সংকোচ নেই। দ্বিধাহীনচিত্তে কাগজ কলম নিয়ে বসে।

শফিক!

অবাক হচ্ছো তাই না, আমার চিঠি পেয়ে? অবাক হওয়ারই কথা। কত বছর পর লিখতে বসলাম। প্রথমে লিখতে চাইনি। মনে অসংখ্য দ্বিধা ছিলো। সব দ্বিধা ছেড়ে বসলাম একটু কাগজ কলম নিয়ে। জানো? জীবনে এই প্রথম আমার জন্মদিন পালন করছি এবং এখান থেকেই তোমাকে লিখছি। একটি চেয়ার, একটি টেবিল আর একটা রেস্টুরেন্টের নিয়ন আলোর নিচে বসে উদযাপন করছি আজ আমাকে।

অবশ্য আরেকজনও সাথে ছিল। এই রেস্টুরেন্টের ওয়েটার- সুমন। খুব অবাক লগাছে, না? সত্যি, জীবনে কিছু কিছু দিন আসে অবাক হওয়ার জন্যই। আমিও কম অবাক হইনি, শফিক? আমার সবকিছু জানার পরও এতিম, অসহায় এই রুবিকে তুমি ভালোবেসেছিলে। আমি নাকি ছিলাম তোমার পৃথিবী।
আমার দু’চোখ ছিল তোমার আকাশ।

আমাকে একদিন দেখতে না পেলে সেই দিন তোমার অচল হয়ে যেতো। এমনটিইতো বলতে তুমি আমাকে, তাই না? যে চোখগুলোয় তুমি আলো দেখতে সেই চোখে যখন তুমি রাতের আঁধার নামিয়ে দিলে তখন আমিও কী কম অবাক হয়েছি, বলো? সেই অবাক হওয়ার দিনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ব্যথা- বেদনায় বিমূঢ় আমার পাথরচোখে জল ছিলো না এক ফোঁটাও। কিন্তু যেটুকু শক্তি দিয়ে কথা বলতে পারতাম সেটুকুও মাঝখানে হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে ভালোবেসে। তবে কী জানো? যেদিন আমাকে ছেড়ে চলে গেলে, সেদিন থেকেই চেষ্টা করেছি তোমাকে ভুলে যেতে। অসম্ভব রাগ এবং ঘৃণা তোমাকে ভুলে যেতে আমাকে সাহায্য করেছিলো। অবশ্য মূল কারণ ছিল আমার দারিদ্র। বড়লোক মামার বাড়িতে ঠাঁই যার নেই সেতো গরিবই হয়। আমার দারিদ্র্য এত করুণ যে তোমাকে মনেই রাখতে দিল না। কারণ গরীব বলো আর ধনী বলো সবারই পেটে ক্ষুধা আছে। ক্ষুধায় পেটে যখন হাহাকার ওঠে সেখানে প্রেম-ভালোবাসা কী খুব গুরুত্বপূর্ণ? এত কথা বলে কী লাভ বলো? আমাকে ছেড়ে যখন চলে যেতে পারলে তখন অভিশাপ করিনি। কারণ ভালোবাসার মানুষকে কি অভিশাপ দেয়া যায় বলো?

আমাকে ছেড়ে চলে গেলে কেন, এই কৈফিয়তও তোমাকে আমি কোনোদিন করিনি। কী লাভ হবে বলো? ভালোবাসার মানুষকে আটকে রাখার চেষ্টা বোকামি। আর আটকেই বা রাখতে হবে কেনো? যে থাকার কথা সে এমনিই থাকবে। আর যে যাবার সে এমনিতেই চলে যাবে। আমি অসহায় ছিলাম। আমার যে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আমার কি সেই সামর্থ্য ছিল যে তোমাকে বেঁধে রাখি? দিনদিন মনের ভেতর প্রচন্ড রাগ, অভিমান নিয়ে তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করলাম। কখন যে এই ঘৃণা মনটাকে দখল করে নিল তাকে আর কিছুতেই সরাতে পারিনি। হয়তো ভাবছ, আমার এই জীবনে আর কেউ আসেনি। এসেছে। পাত্তা দেইনি। ওই যে বললাম না, ঘৃণা ?

শফিক, আমাকে তুমি ভালোবাসা শেখাতে না পারলেও ঘৃণাটা ঠিকই শিখিয়ে দিয়ে গেলে। কীভাবে পুরুষের মিষ্টি কথাকে ঘৃণা করতে হয় তা আমার চেয়ে বোধহয় কেউ ভালো জানে না। হয়তো ভাবছো আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি। দ্বিধাহীনভাবে বলছি, তোমার ধারণা ভুল। আজ এত বৎসর তোমাকে আমার একটি দিনের জন্যেও মনে পড়েনি। কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি মনের অজান্তে সাঁতার কাটে। আজ এই রেস্টুরেন্টের নীল আলোর জলে ভেসে আমার কান্নাগুলোও নীল বেদনার রঙে ডুবে যাচ্ছিলো। আমি এই কান্নার উৎস খুঁজে পেলাম না। কেনো হঠাৎ বুকভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাস আমাকে আকুল করছে? আচমকা উৎসুক মন আমাকে বিষন্ন অতীতে নিয়ে গেলো। আমার অতীত বলতেও তেমন কি কিছু আছে, এক তোমার স্মৃতিতে পোড়া ছাড়া? সেই পোড়াস্মৃতিতে আজ একটু আগুনের আঁচ পেলাম। দেখলাম, সেখানে তুমি। তোমার মুখ আমার মনে পড়ে না। আমিও চাই, ওই মুখ যেনো কখনো আমার দুঃস্বপ্নের ভেতরও মনে না পড়ে।

তবে ভয় হয় কী জানো, তোমার সাথে আর কখনো যদি দেখা হয়! জানোতো পৃথিবী গোল। বিজ্ঞানের থিওরি অনুযায়ী গোলাকার পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত ধরে হাঁটলে আমাদের আবার পুনরায় দেখা হওয়ার কথা। এই পৃথিবীর দোহাই দিয়ে বলছি, এর বুকে হাঁটতে হাঁটতে যেনো কোনদিন তোমার সাথে আমার আর দেখা না হয়।

কিছুক্ষণ পরে এই চিঠি পোস্ট করব। জানি তুমি এটা পাবে। পেলে তুমি এটা পড়বে কিনা আমি জানি না। ইচ্ছে হলে পড়তে পারো বা ছুঁড়ে দিতে পারো।

তবু আজ এই কথাগুলো বলতে পেরে আমার খুব ভালো লাগছে। দ্বিধাহীনচিত্তে বলতে পারছি তোমাকে আমি ভুলে খুব ভালো আছি। সত্যিই বেশ আছি। অবশেষে ভালো থেকো।

ইতি,
তোমার পরিচিত।

রুবি চিঠি শেষ করে। ঘড়ি দেখে রাত আটটা। না আর দেরী করা ঠিক হবে না। বাসায় ফিরতে হবে। দিনা আপা এতক্ষণে এসে গেছে বোধহয়। ফোনটাও বন্ধ রেখেছে। আপা ফোনে না পেলে চিন্তা করছে। নির্ঘাত বকা শুনতে হবে। ইচ্ছে করে রুবি বকা শুনবে। কারণ, ওকে শাসন করার আদর করার এই একটি মানুষই আছে। শুধু এই একটি মানুষ থেকে আদর এবং শাসন দু’টো পাওয়ার জন্যে কী ব্যাকুল হয়ে থাকে। দিনা আপা যখন তাকে আদর করে মনে মনে বলে, আমাকে চিরদিন তোমার বুকে আগলে রেখো আপা! আমাকে ছেড়ে কোথাও যেও না। আমার যে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। আর যখন দিনা রুবিকে শাসন করে সে ইচ্ছে করেই দিনাকে ্আরো ক্ষেপিয়ে তোলে। কারণ, শাসনও তার চাই। সে ইচ্ছে করেই তার বকা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। মন থেকে বলে, আপা, আরো বকা দাও আমাকে। আরো আরো! আমার পৃথিবীতে তুমি ছাড়া যে আর কেউ নেই।

রুবি ওঠে। সুমন আসে। ফ্যালফ্যাল করে রুবির দিকে তাকিয়ে থাকে। রুবি জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবেন সুমন?

সুমন ইতস্তত করে বললো, আপা, যদি কিছু মনে না করেন, ই …… য়ে,

বলুন!

একটু দাঁড়ান। আমি আসছি। একটু পরেউ হাতে একটি প্যাকেট নিয়ে আসে।

রুবি প্রশ্ন করে, কী এটা?

আপনার জন্যে।

মানে?

আজ থেকে আপনি আমার বোন। জন্মদিনে এই গরীব ভাইয়ের পক্ষ থেকে বোনকে একটি ছোট্ট উপহার। গ্রহণ করলে খুব খুশি হব, আপা।

রুবি এবার সত্যি দ্বিধায় পড়ে যায়। কী করবে বুঝতে পারছে না । উপহার গ্রহণ না করলে ছেলেটি কষ্ট পাবে। অর গ্রহণ করলে …… রুবির কেমন যেন লাগছে।

সুমন এসব করতে গেলেন কেনো?

রুবিকে দ্বিধায় পড়তে দেখে সুমন বললো, আপা এই রেঁস্তোরায় কত মানুষ দেখেছি। আরো দেখবো। কিন্তু আজ আপনাকেও দেখলাম। পৃথিবীর এত মানুষের ভিড়ে সত্যিকার অর্থে একজন মানুষ মনে হলো আপনাকে। আপা, আমি গরীব। আমার মা বাবা সব আছে। আজ থেকে ভাববেন আপনার একটি ভাইও আছে। আমার মা-বাবা আজ থেকে আপনার মা-বাবা। আমরা দুই ভাই। আমার বোন নেই। এই নিন আমার কার্ড। আর প্যাকেটটি দয়া করে বাসায় খুলবেন। ওখানে আমার ঠিকানা দেয়া আছে। আমায় আপনি তুমি করে বলবেন। আমি আপনার ছোট হবো। আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো। আজ থেকে আপনি আমার বড় বোন।

রুবি বিদায় নিলো। গাড়ি চলছে। গন্তব্য কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল। ইচ্ছে করলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারতো। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। মনের অলক্ষ্যে দেখছে, ওর অপেক্ষায় কেউ ছটফট করছে। পেরেশান হচ্ছে। হয়তো এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। একে ওকে জিজ্ঞেস করছে, এই তোমরা রুবিকে দেখেছো? ও তিনটার পর থেকে হোস্টেল ছেড়ে কোথায় চলে গেছে। ওর ফোনটাও বন্ধ। রুবি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

না, ওর অধিকার নেই, এই মানুষটিকে কষ্ট দেয়ার। অন্তত একটি বন্ধন আছে। হয়তো সেখানে রক্তের কোনো সর্ম্পক নেই। কিন্তু অপূর্ব এক আত্মার, ভালোবাসার বন্ধন আছে যা এড়িয়ে চলা অসম্ভব। রুবি ভাবছে, আমি কখনোই পারবে না। কোন কিছুর বিনিময়ে কখনোই পারবো না প্রিয় মানুষটিকে কষ্ট দিতে। যেখানে আমার আশ্রয়, ঠিকানা, বেঁচে থাকা, পৃথিবী সব … সব সব আমার দিনা আপা । শুধু কি দিনা আপা? আর কেউ নেই? হুঁ, আরেকজন পেয়েছি। রেস্তোরার ছেলেটা, সুমন। কানে ভেসে আসা সেই শব্দগুচ্ছ “আজ থেকে আপনি আমার বড়বোন”।

সত্যিই! রুবি কি আজ থেকে কারো বড় বোন?

রুবি প্যাকেটটি নাড়াচাড়া করে। কী যেন একটা পেতে চায় ওখানে। একটি ঘ্রাণ খোঁজে । মমতার একটি ঘ্রাণ। রুবি অবাক। যারা আপন ছিলো, রক্তের একটি সর্ম্পক ছিলো যাদের সাথে, ওরা আমাকে ফেলে দিয়েছে। আত্মার একটি অংশ ছিলো শফিক। আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। অথচ আরেক প্রান্তে যারা আমার কেউ নয় ওরা আমাকে আপন করে নিয়েছে ভালোবাসা, মমতার সঙ্গে। মমতার আজীবন কাঙ্গাল রুবি এদের ভালোবাসাকে স্বীকার করে নেয়। বিষাদের পায়ের তলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে চায় রুবি। এতবড় পৃথিবীর কোথাও না কোথাও আমার জন্য কিছু মানুষ আছে ভেবে নিজেকে আশ্বাস দেয়।

সংকোচ আর অবজ্ঞা দূরে রেখে অবশেষে দ্বিধাহীনচিত্তে সুমনকে উদ্দেশ্য করে বললো, সুমন! আজ থেকে আমি তোমার বড় বোন। আজ থেকে তোমরা আমার আপন। আমি আর একা নই। শব্দগুলো আনমনে বলে রুবির বুকের গভীরে দীর্ঘশ্বাস মার্চের অন্তরীণ রাত্রির বুকে ভাসিয়ে দেয়। রুবি নামে রিকশা থেকে। ভাড়া মিটিয়ে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। শহরের আলোর ঝলকে আকাশে তারা দেখা যায় না। রুবি ওখান থেকে হাতড়ে হাতড়ে সাতটি তারা বের করে, তারাগুলোর নাম দেয় দিনা, পল্টু, রুবি, সুমন নাম না জানা আরো একটি ভাই ও ওদের বাবা-মা।

আকাশকে বলে, আকাশ দেখো- সাতটি তারার তিমির নিয়ে এই পৃথিবীতে আমার গড়া সপ্তর্ষিমন্ডল। বেঁচে থাকতে হলে আমার আর কী লাগে বলো?

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

দ্বিধার শঙ্খচূড় রোখসানা ইয়াসমিন মণি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর