উড়াও শতাবতী (৯) মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন
১৬ এপ্রিল ২০১৮ ১৫:৫৯
এবার গর্ডন পুরোই একা। একপা- দুপা করে ফের দরজার কাছে এগিয়ে গেলো। স্ট্রবেরি-নেকো ঝুঁকে থাকা ঘাড়ের উপর থেকে মাথা তুললেন, আর চোখাচোখি হয়ে গেলো গর্ডনের সঙ্গে। দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে নিলেন। বানচাল হয়ে গেলো একটি চেষ্টা। আসলে লোকটি তখন এডগার ওয়েলসের কপিটি পকেটে চালান করে দেওয়ার চেষ্টাই করছিলেন। প্রিন্স অব ওয়েলসের ঘড়িতে সোয়া তিনটার ঘণ্টা বাজলো।
ডিং ডং! তিনটা বেজে পনের। আলো জ্বলবে সাড়ে তিনটায়। পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত দোকান-পাটের ঝাঁপ নামিয়ে ফেলার সময়। সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত রাতের খাবার খাওয়া যাবে। পকেটে দুই পেন্স হাফ পেনি। কাল মিলবেনা সামান্য তামাকটুকুও।
হঠাৎ তীব্র অদম্য তামাকপানের ইচ্ছা চেপে ধরলো গর্ডনকে। ঠিক করে রেখেছিলো আজ বিকেলটা সিগারেটে একা ফুঁকও দেবে না। মোটেই চারটে শলাকা আছে। সেগুলো আজ রাতের জন্য জমিয়ে রাখতে হবে। যখন সে কিছু লিখতে যায়, তখন নিঃশ্বাসের জন্য বাতাস না থাকলে ক্ষতি নেই, কিন্তু তামাক ছাড়া একদমই চলে না।
যাইহোক, একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলাই সাব্যস্ত করে ফেললো সে। প্লেয়ার্স ওয়েটস-এর প্যাকেট থেকে খর্বাকায় সিগারেটগুলোর একটি বের করে আনলো। স্রেফ বোকামি ছাড়া কিছু নয়; এখন একটা সিগারেট খেয়ে ফেলা মানেই হচ্ছে রাতের লেখালেখিতে অন্তত আধাঘণ্টার ছেদ। কিন্তু তা ছাড়া আর উপায়ই কী? নিলর্জ্জ পরমানন্দে সিগারেটে এক লম্বা টান দিয়ে নিকোটিনসম্মৃদ্ধ সবটুকু ধোঁয়া ফুসফুসে চালান করে দিলো। নিজের ধূসর বেদনার্ত চেহারার প্রতিবিম্ব নিজের চোখের সামনেই ভেসে উঠলো গর্ডনের। গর্ডন কমস্টক, মাইস’র লেখক। বয়স ত্রিশ পেরোয়নি, এরই মধ্যে ঘুনে ধরা শরীর। বত্রিশপাটি দাঁতের ছাব্বিশটি অবশিষ্ট। তবে তাতে কি! ভিলন (কবি ফ্রাঙ্কোইজ ভিলন) তো এই বয়সে গুটি বসন্তে মরতে বসেছিলেন। ঈশ্বরের এইসব ছোট ছোট অনুকম্পাতো আমরা পেয়েই থাকি। তা-ও কি কম ধন্যবাদার্হ্য!
কিউ.টি. সসের বিজ্ঞাপনের পোস্টার থেকে ছিঁড়ে ঝুলে যাওয়া টুকরোটি তখনো বাতাসের ঘুর্ণাবর্তে। সেদিকেই চোখ নিবিষ্ট গর্ডনের। আমাদের সভ্যতাটি মরে যাচ্ছে। এর মৃত্যু অনিবার্য। তবে সে মৃত্যু যে শয্যায় শুয়ে শুয়ে হয়ে যাবে তা নয়। জঙ্গিপ্লেনগুলো উড়ে উড়ে আসবে….শো শো… জুম…ভুম… ধুম করে বিকট শব্দ হবে। এভাবে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব এক বিকট বিষ্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
ধীরে ধীরে আঁধার নেমে আসছে রাস্তায়। মুখমণ্ডলের একটা ধুসর প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে কাচের ভেতর, আর সড়ক দিয়ে অপেক্ষাকৃত আবছা হয়ে আসা দেহগুলো হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। অনেকটা স্বগোতক্তির মতোই তার মুখে উচ্চারিত হলো-
এই যে অর্থ, কোণার টেবিলটি, এসবই আসলে সেই উড়োজাহাজের মোষগোঙানো শব্দ আর বোমার বিকট বিষ্ফোরণ।
গর্ডন চোখ তুললো উপরের আবছা আকাশে। উড়োজাহাজগুলো আসছে। যেন কল্পনার দিব্য দৃষ্টিতে সে দেখতে পাচ্ছে এখনই সাঁই সাঁই ছুটে আসছে আকাশদানোগুলো। একটার পর একটা, একগুচ্ছের পর আরেকগুচ্ছ জঙ্গিবিমান। আর সেই সব দানবের মেঘে ঢাকা পড়েছে গোটা আকাশ। জিহ্বা দাঁতের সঙ্গে লাগিয়ে মুখে একটা শব্দ করলো সে আর তখনই জানালার শার্শি থেকেও কানে এলো বাতাসের শো শো শব্দ, যা বিমানপোতের শব্দের মতোই, ঠিক এমনই একটি শব্দ সে শুনতে চাইছিলো।