এক আফগান রানীর গল্প
১ মে ২০২২ ২১:১৭
বাবা মাহমুদ বেগ তর্জি ছিলেন সাংবাদিক। আফগানিস্তানের সাংবাদিকতার জনক বলা হয় তাকে। সম্রাট আব্দুল রহমানের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়। আশ্রয় নেন সিরিয়ায়। সেখানেই ১৮৯৯ সালের ২৪ নভেম্বর জন্ম হয় কন্যা সুরায়ার। হাবিবুল্লা খান সম্রাট হওয়ার পর তর্জিকে ডেকে পাঠান। সপরিবারে দেশে ফিরে আসেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। অপরূপা সুন্দরী সুরায়ার প্রেমে পড়েন যুবরাজ আমানউল্লাহ। তারপর বিয়ে। ১৯১৩ তে। অর্থাৎ মাত্র ১৪ বছরে।
১৯১৯ সালে আমানউল্লাহ সম্রাট হওয়ার পর সুরায়া হন রাজরানী। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এই নারী তার স্বামীকে বাধ্য করেন পশ্চাদপদ আফগানিস্তানে ব্যাপক সংস্কারের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে। তিনি নিজে শিক্ষামন্ত্রী হন। শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশি জোর দেন। বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসেন স্কুল কলেজের জন্য। ১৯২৭ সালে কাবুল কৃষি কলেজে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে যান তরুণ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী। তিনি তার ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে লিখেছেন কিভাবে পুলিশ পাঠিয়ে প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করান আমানউল্লাহ। সুরায়া প্রথম আফগান রানী যিনি প্রকাশ্যে সম্রাটের সঙ্গে বেড়াতেন। সম্রাটের সঙ্গে সারাদেশ চষে বেড়িয়েছেন। সুরায়া বাবা আমানউল্লাহর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। এই আধুনিক মানুষটি আমানউল্লাহকে ভূমি ও সামাজিক সংস্কারে উদ্বুদ্ধ করেন।
সম্রাট আমানউল্লাহর সময় মেয়েদের জোর করে বিয়ে দেওয়া, এক পুরুষের একাধিক বিয়ে, ১৬ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়। মেয়েদের শিক্ষা এবং ভোটদানের অধিকারও দেন আমানউল্লাহ। সকল শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের জন্য জেলায় জেলায় আবাসিক স্কুল খোলা হয়।
১৯২১ সালে কাবুলে প্রথম মেয়েদের জন্য মাসতুরত প্রাথমিক স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন সুরায়া। পরবর্তীকালে মেয়েদের জন্য একাধিক স্কুল খোলেন তিনি। ১৯২৮ সালে ওই সমস্ত স্কুল থেকে বাছাই করা ১৫ জন পড়ুয়াকে উচ্চশিক্ষার জন্য তুরস্ক পাঠায় আমানউল্লাহ সরকার।
কিন্তু কিছু অতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কারণে আমানউল্লাহ ও রানী সুরায়া নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনেন। ১৯২৮ সালের ২৯শে আগস্ট আমানউল্লাহ তার উন্নয়ন কর্মসূচি জনপ্রতিনিধিদের পরিষদ লয়া জিগরায় পাস করার জন্য উপজাতীয় প্রধানদের ডাকেন। সেখানে এগার’শ প্রতিনিধির সকলকে পাশ্চাত্য পোশাক পরে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেটা নিয়ে হাস্যকৌতুকময় বর্ণনা পাওয়া যায় সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’ বইতে।
সেই অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমানউল্লাহ বলেন, ‘ইসলামে নারীদের শরীর ঢেকে রাখার বা কোন বিশেষ ধরনের পর্দা ব্যবহারের কথা বলা হয়নি। তাই নারীদের হিজাব বা বোরকা ব্যবহার করা উচিত নয়।’ বক্তৃতার শেষ পর্যায় এসে রানী সুরায়া তার হিজাব ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর তিনি বোরকা ছাড়াই একটি হ্যাট পরে ঘুরে বেড়াতেন।
প্রাচীনপন্থী উপজাতি নেতারা প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা না করলেও ভেতরে ভেতরে তেতে উঠেন। তারা নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে রাজপরিবারের বেলাল্লাপনার নিন্দে করতে লাগলেন। পত্রিকায় তখন প্রায় ছাপা হত রানী পাশ্চাত্য পোশাকে ইউরোপ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সাহেবরা তাকে হস্তচুম্বন করছে। বিদেশী পুরুষদের সঙ্গে বসে ডিনার করছেন। উপজাতি নেতারা একে আফগান সংস্কৃতি, ধর্ম এবং মহিলাদের সম্মানের সঙ্গে স্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা বলে ঘোষণা করেন। অনেকে রানীকে ব্রিটিশদের স্পাই বলে প্রচার করতে থাকে।
১৯২৭ সালে দেশের প্রথম নারী পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেন যার নাম ‘এরশাদ-ই-নিসওয়ান’, বা ‘নারীদের জন্য নির্দেশিকা’। তিনি বলতেন স্বাধীনতা আমাদের সকলের। তাই দেশ গঠনে নারীদের অংশগ্রহণে অধিক জোর দেওয়া উচিত।
১৯২৮ সালে আমানউল্লা-সুরায়া ইউরোপ সফর থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভ চূড়ান্ত রূপ নেয়। কারণ রানী দেশে ফেরার পরই সারা দেশে কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায় রানী নগ্ন পায়ে হাঁটছেন। আসলে রানী ডাক্তারকে দেখানের জন্য পা অনাবৃত করেছিলেন। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তা সংগ্রহ করে ছড়িয়ে দেয়। উপজাতি নেতারা একাত্ম হয় রাজশাসনের অবসান ঘটাতে। জালালাবাদ থেকে একদল বিদ্রোহী রাজধানীর দিকে অগ্রসর হলে সেনাবাহিনী প্রতিরোধের বদলে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জানুয়ারী আমানউল্লাহ খান তার ভাই এনায়েতউল্লাহ খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটিশ ভারতে পালিয়ে যান। এর তিনদিন পর বিদ্রোহীরা এনায়েতউল্লাহ’র কাছ থেকেও ক্ষমতা কেড়ে নেয়।
এই বিদ্রোহী দলের নেতা ছিলেন সেনাবাহিনীর সাবেক এক পানিবাহক। নাম হাবিবউল্লাহ কালাকানি। কাবুলের আর্গ প্রাসাদ দখল করার পর কালাকানি ৭,৫০,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ডের সন্ধান পান। এ থেকে সৈনিকদের বেতন দেয়া হয়। তিনি প্রাসাদ থেকে ফুলের গাছ তুলে সেখানে সবজি রোপণের নির্দেশ দেন। তিনি নারীদের বিদ্যালয় ও পশ্চিমা শিক্ষকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেন।
কিন্তু কালাকানিও বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। নাদির খান ১৯২৯-এর ৩১ অক্টোবর কাবুল দখল করেন। পরের দিন কালাকানিকে আরো দশ অনুসারীসহ ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।
এদিকে স্বাধীনচেতা আমানউল্লাহ বেশিদিন ব্রিটিশ ভারতে থাকতে পারেননি। সস্ত্রীক ইতালি চলে যান। ১৯৬০ সালে রোমে আমানউল্লাহ মারা যান। ঠিক তার ৮ বছর পর সুরায়া। মজার বিষয় কি, দুজনের বয়সের ব্যবধানও ছিল ৮। শেষ হয়ে গেল এক বিপ্লবী রানীর গল্প।
কিন্তু এ হচ্ছে প্রকাশ্য ব্যাপার। অন্তরালে ছিল ভয়ানক ভূ-রাজনীতি। আফগান ইতিহাসবিদ হাবিবুল্লাহ রাফি জানান, বারবার ব্রিটিশ আক্রমণে ভীত হয়ে পড়া আমানউল্লাহ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ১৯২১ সালে একটি মৈত্রী চুক্তি করেন। এতেই বিচলিত হয়ে ওঠে ব্রিটেন। আফগানিস্তানকে অনুসরণ করে ভারতও যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সন্ধিতে চলে যায় তাহলে তাদের সবচেয়ে লাভজনক উপনিবেশটি হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই আমানউল্লাহকে সরিয়ে দেয়া জরুরি হয়ে ওঠে।
কিন্তু প্রায় শতবছর পরেও রানী সুরায়াকে ভুলে যায়নি বিশ্ববাসী। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী টাইম ম্যাগাজিন তাকে “most influential women of the past century” এবং “women who were often overshadowed” অভিধায় অভিধিত করে।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ এক আফগান রানীর গল্প জয়দীপ দে সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২