হাসান মাহবুব-এর ছোটগল্প ‘অধিবৃক্ষের কাছে’
২ মে ২০২২ ১২:৪০
(১)
রাত তখন ২টা। ইসমাইল আলি ঘুমাচ্ছিলেন। ঘুমের মধ্যে মাঝেমধ্যে অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ঘটে। এই যে ঢং ঢং করে ২টার ঘণ্টা বাজল তার দেয়ালঘড়িতে, তিনি দিব্যি শুনতে পেলেন। তার ঘুম গাঢ়। তাকে রাত ১১টায় ঘুমিয়ে সকাল ৬টায় উঠতে হয়। সাত ঘণ্টার টানা ঘুম। এটিই তার প্রতিদিনের জীবনের সবচেয়ে উপভোগ্য অংশ। তার স্ত্রীর থেকে বিছানা আলাদা করেছেন বেশ অনেকদিন হলো। বয়স তার ৪৭। স্ত্রী সঙ্গের আকুলতা বিগত হয়েছে পরবাসী মেঘের মতো। তার স্ত্রী এবং কন্যা একসাথে শোয়, তিনি পাশের ঘরে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে পারেন, এ নিয়ে তার গর্বের সীমা নেই।
একা একা শুতে সমস্যা নেই ইসমাইল আলির। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়ে নিজেকে বিপন্ন মনে হয় না। ঘুমের ঘোরে কাউকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হয় না। এই চমৎকার সময়টাতে তাকে শুধু সঙ্গ দেয় দেয়ালঘড়িটা। এখনকার সময়ে ঘণ্টা দেওয়া দেয়ালঘড়ি সাধারণত দেখা যায় না। এই বুড়ো সময়-কথককে তিনি শখ করে কিনেছেন। সময় প্রবাহিত হচ্ছে, এর চিহ্ন কোথাও না কোথাও থেকে যাওয়া উচিত বলে তার মনে হয়। দেয়ালঘড়িটা সেই কাজ নিষ্ঠার সাথে করে যাচ্ছে। ঘুমপাড়ানি গানের মতো, জোনাকবনের মায়ের মতো তাকে একরাশ নির্ভরতা উপহার দিয়ে দেয়ালঘড়িটা সময়ের জোয়াল টেনেই যাচ্ছে। রাত ৩টার ঘণ্টা বাজল, ৪টার ঘণ্টা বাজলো, ৫টার ঘণ্টা বাজল, ইসমাইল সাহেব কিছুই শুনতে পেলেন না। শুধু মাঝেমধ্যে কিছু সাদাকালো ছায়াচিত্র তাকে স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করে বিফল হয়ে হারিয়ে গেল নৈর্ব্যক্তিক প্রচ্ছন্নতায়।
সময়টা তখন ৫টা পনের থেকে তেতাল্লিশের মধ্যে হতে পারে। দূরে কোথাও ডেকে উঠল একটা একাকী তক্ষক। আর তখন ইসমাইল সাহেব অনুভব করলেন, তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন ঘোলাটে আঠায়। তার নড়াচড়ার শক্তি রহিত হলো। বুকের মধ্যে যেন চেপে বসেছে একশ প্রাচীন পাথর। অপেক্ষা করলেন কিছু মুহূর্ত এই অবশ অনুভূতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, মিলল না। ধীর-স্থির লক্ষ্য নিয়ে আরও জাঁকিয়ে বসল অশরীরী আতঙ্ক। ইসমাইল আলি হাল ছেড়ে দিলেন। ধরে নিলেন এটাই মৃত্যু। অপেক্ষা করতে লাগলেন স্থিরভাবে অতলে ডুবে যাবার।
একটু মন খারাপও হলো নিজের জন্যে। সাতচল্লিশ বছর বয়সেই চলে যেতে হচ্ছে তাকে নীল গ্রহের শক্তি উৎপাদনের যজ্ঞ থেকে! মৃত্যুর এই নারকীয় মূহূর্ত কেউ দেখবে না। বারো ঘণ্টা পরে তাকে কফিনে শোয়ানো হবে, নাকে গুঁজে দেওয়া হবে তুলো, আতরের গন্ধে মৌ মৌ করবে চারপাশ। তার গন্তব্য হবে মাটির গভীরে কিলবিলে কীটপতঙ্গের সাথে। আহা, কেউ যদি এসময় আসত পরিত্রাতা হয়ে! জাদুর কাঠি ছুঁইয়ে ভাঙিয়ে দিত এ অচলাবস্থা! আপনজনদের কথা মনে করার চেষ্টা করেন ইসমাইল আলি। যদিও দেয়ালঘড়িটা ছাড়া তার আর তেমন আপন কেউ নেই, তবুও গলিত স্থবির ব্যাঙেরও তো ইচ্ছা জাগে শেষ মুহূর্তে আরেকটু শ্বাস নিতে!
বুকের পাঁজরগুলো হিম হয়ে জমে গিয়ে হৃৎপিণ্ডকে কব্জা করে প্রায় থামিয়ে দিচ্ছে, সেই সময় ইসমাইল সাহেব নড়তে পারলেন। চোখের সামনে প্রস্ফূটিত হতে লাগল আধো-আঁধারে ডুবে যাওয়া বস্তুরা। সৃষ্টি করতে লাগল দৃশ্য। ঘটঘট করতে ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যান, বাতাসে দুলতে থাকা তাপ্পি মারা মশারি, বাতিঘরের সমগ্রতা বুকে নিয়ে অহংকারী লাল আলো বিলোতে থাকে সুইচবোর্ড, আর জানালার ওপাশে কংক্রিট অরণ্য তাকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে এলো।
কোনো এক কালে, যখন তার একটা মা ছিল, যখন তাদের বাসার চৌকাঠে চড়ুইয়েরা বাসা বাঁধত, যখন বাবা কোনো কোনো বিকেলে ফিরে আসতেন ফল আর মিষ্টি নিয়ে, সেই সময়ে সে শুনেছিল বোবায় ধরার কথা। গল্পটি যে বলেছিল, সে ছিল বাকপটু একজন প্রতিবেশিনী। তার উপস্থাপনার বৈশিষ্ট্যে বোবায় ধরার গল্পটি ভয়ের স্পন্দনে অনন্য হয়ে উঠেছিল। কিছুদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে তার মধ্যে ভয় কাজ করেছে। তারপর কেটে গেছে চৌত্রিশটি বছর। বোবায় যে ধরে, সেই প্রাণীটি ছাড়াও আরও অনেক ভয়ের উপাদান এসেছে তার জীবনে। আমে-দুধে মিশে গেছে ভয় আর জীবন। এখন জীবন থেকে কোনটা ভয় আর কোনটা আনন্দ, আলাদা করা খুব কঠিন। আর তাই ঘুমের মধ্যে এই ভয় পাওয়াটা তার জীবনে অনেকদিনের মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলেই গণ্য হবে।
জানলা থেকে সকালের আলো আসছে। সময় বহন করা যন্ত্রটির কণ্ঠ চিড়ে বের হয়ে এলো ৬টা বাজার আর্তনাদ। সাথে সঙ্গত জানাচ্ছে মুঠোফোনের সতর্কবার্তা। আজ অফিসে না গেলে কেমন হয়? ইসমাইল আলি সচরাচর অফিস বাদ দেন না। বাসায় তো করার কিছু নেই তার। স্ত্রীর সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা হয় না। কিশোরী কন্যা সর্বদা ভীতমুখে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। পরিবারের নারী সদস্যরা এতই সতর্ক যে বাসায় থাকা অবস্থায় তাদের কোনো ভুল ধরে বকাঝকা করারও সুযোগ মেলে না। এর চেয়ে অফিসে গেলে অধীনস্তদের ওপর নানা বিষয়ে খবরদারি করে তটস্থ রাখা যায়। আধা-সরকারি চাকরিটায় বিশ বছরের মধ্যে তিনি বেশ নিরাপদ একটা অবস্থায় এসে গেছেন। অফিসের বিনয় গদগদ, তোষামুদে কর্মচারীরা তার সময়কে করে তোলে অর্থবহ। অথবা, তারা আসলেই তা করে কি?
বাসা বা অফিস— কোথাও তার বোবায় ধরার গল্পটা বলার মতো কেউ নেই। এতে অবাক হবার কিছু নেই। এটাই স্বাভাবিক। এটাই বাস্তবতা। বন্ধুবান্ধব তার ছিল না— এমন না। তবে কথা হচ্ছে কী, এই সাতচল্লিশ বছর বয়সে সে যদি তার জিগরি বন্ধুদের সাথে খাতির বজায় রাখত এবং তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করত, তাহলে এতদিনে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করে মোটা অঙ্কের টাকা খুইয়ে বসত, অথবা একেক সময়ে একেক বিজনেস শুরু করা বন্ধুদের টাকা ধার দিতে দিতে নাকাল হয়ে যেত। ইসমাইল কারও সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। তার কারও কাছ থেকে টাকা ধার করার দরকার পড়ে না, কাউকে টাকা দেয়ও না। টাকা জমিয়ে রেখেছে অসুস্থ হলে বিদেশে গিয়ে ভালো চিকিৎসা নেবে বলে। তাদের বংশে লোকজন খানদানি রোগে হুটহাট মরে যায় অমুক বা তমুক মেডিকেলের আইসিইউতে। ইসমাইল আলি এত সহজে নিজের এ পরিণতি মেনে নেবে না। বুক ফাঁড়তে হলে যাবে চেন্নাই, কিডনি জুড়তে হলে যাবে ব্যাঙ্গালোর। কিন্তু বোবায় ধরার চিকিৎসা কী? এটা কি কোথাও গিয়ে সারানো যায়? ইসমাইল আলি চিন্তিত হয়ে পড়ল।
-তুমি এখনও শুয়ে যে? শরীর খারাপ?
ইসমাইল আলির বউ সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে উদ্বেগ। যান্ত্রিকতায় স্থির লয়ে ছেদ পড়লে প্রলয়ের অনুভূতি জাগে মানবীদের মনে। প্রবল পুরুষ ইসমাইলের মুহূর্তের জন্যে মনে হলো নিজেকে সমর্পণ করে দেয় সাবিনা ইয়াসমিনের আঁচলে। জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমি ভয় পেয়েছিলাম সাবিনা। খুব ভয়। আমি মরে যাচ্ছিলাম!’ পরক্ষণেই তা ঝেড়ে ফেলে বিছানা থেকে ওঠেন। প্রশ্নের জবাব না দেওয়ার অভদ্রতা করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত করে না। তবে তার ভীতিকর অনুভূতিটা নিয়ে তিনি কথা বাড়াতে চান না। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলেন।
– নাস্তা হয়েছে?
(২)
প্রথমবার বোবায় ধরার পর অনেকদিন কেটে গেছে। ইসমাইলের বয়স বেড়ে গেছে তিন মাস। দেয়াল ঘড়িটি কয়েক হাজার বার তার অস্তিত্ব জানান দিয়েছে। এর মধ্যে তার আরেকটি পদোন্নতিও হয়ে গেছে। এতে তিনি আনন্দিত হয়েছে কি না, বোঝা দায়। তবে তার গাম্ভীর্য আরও এক প্রস্থ বেড়ে গেছে। বাসায় তিনি কিছু জানাননি। জানাবার প্রয়োজন মনে করেন না কখনো এসব। সংসারটাও তার কাছে একটা সওদাগরি অফিসের মতোই। তিনি টাকা দিচ্ছেন, বিনিময়ে সেবা পাচ্ছেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে সে তার জমানো টাকাগুলো খরচ করতে কার্পণ্য করবেন না। এই শহরের দূষিত আবহাওয়া আর বিষাক্ত খাদ্য উপভোগের জের হিসেবে তিন জনের কারও না কারও বড় একটা অসুখ হবেই। তখন দেখা যাবে মাসের পর মাস চিকিৎসা চলছে, বেরিয়ে যাচ্ছে দশ-বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখ টাকা। তার বয়স আটচল্লিশ হতে যাচ্ছে, তার স্ত্রীর চুয়াল্লিশ। এত বছর তারা মোটামুটি স্বাস্থ্য বজায় রেখে থেকেছেন— এটা নিয়ে তার সন্তুষ্টি কাজ করে। আসন্ন স্বাস্থ্য দুর্ভোগ এড়ানোর জন্যে তিনি তাজা খাবার কেনার চেষ্টা করেন সবসময়। বাইরে বের হবার সময় মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছেন। এই কারণে মনে হয় তাদের ওপর বিষ আর বাতাস তেমন কাজ করতে পারছে না।
স্বাস্থ্যোজ্জ্বল পরিবার আর চাকরিতে পদোন্নতির সুবাদে ইসমাইল আলির দিনগুলো সন্তোষজনক কাটছিল যথেষ্টই। এই উপলক্ষে তিনি বাড়তি কিছু খরচও করেছেন। নতুন মশারি কিনেছেন, দেয়ালে চুনকাম করেছেন, জানালার পর্দা লাগিয়েছেন, সিলিং ফ্যানের ঘটর ঘটর শব্দটা ঠিক করেছেন, বাসাকে কীটপতঙ্গমুক্ত করার জন্যে পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসকে ডেকেছেন। এভাবে তিনি বাসায় তৈরি করেছেন সুখের আবহ। দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে বারবার সন্তুষ্টি জানিয়ে যায়। বোবাদানবটা হয়তো দূর থেকে এসব পরখ করছিল সতর্ক বেড়ালের মতো। তার মন কখন উচাটন হয়ে ওঠে, তা জানার উপায় ছিল না ইসমাইল আলির।
তিনি তাই দুশ্চিন্তাবিহীন এক সুখের দিনে, দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে অফিসে তার আরামদায়ক চেয়ারটায় হেলান দিয়ে শুয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন আর ভাবছিলেন— কেমন জব্দ করা গেল দানবটাকে! এই সময় তিনি মেপে মেপে ঠিক আধা ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতে পারেন। ঘুমিয়ে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে বোবায় ধরল। আগেরবারের মতো সেই একই অনুভূতি। তবে কিছুটা পার্থক্য আছে। তিনি তার হাতের আঙুল নাড়াতে পারছেন। ডান হাতের তর্জনীটি তাকে জানিয়ে দিচ্ছিল, এখনো কিছু আশা বাকি আছে। তিনি এখান থেকে কোথাও যাচ্ছেন না। নিশ্চল শরীরে উত্তপ্ত মস্তিষ্ক ক্রমাগত পাঠাচ্ছে ভয়ের বার্তা। জমাট বাধা সিমেন্টের টুকরোর মতো তিনি পড়ে আছেন অ্যাংজাইটির এঁদোগলিতে।
চকিতে মনে পড়ল লকড-ইন সিন্ড্রোমের কথা। ফ্রান্সের একজন সাংবাদিকের হয়েছিল এ অসুখ। শুধু চোখের পাতা নাড়াতে পারতেন। এমনকি চোখের পাতা খুলে-বন্ধ করে সংকেত দিয়ে একটা আস্ত বইও লিখে ফেলেছিলেন। চোখের পাতা নাড়ানোর বদলে ডান হাতের তর্জনি নাড়াতে পারার সুবিধা কী? এই চিন্তাটা জমাট বাঁধার আগেই ইসমাইল আলি মুক্তি পেলেন আতঙ্কের চোরাবালি থেকে। গত অনেক বছরের মধ্যে এই প্রথম তার ভয়ংকর রকম নিঃসহায় লাগতে শুরু করল। প্রথমবার বোবায় ধরার পর তিনি ভেবেছিলেন, ওটা হঠাৎ করে হয়ে গেছে। আর ফিরে আসবে না। কিন্তু এখন তিনি বুঝতে পারছেন, এই নিঃশব্দ অশরীরী আতঙ্ক কখন আসবে, আগে থেকে জানার কোনো উপায় নেই। রাস্তায় চলার সময় একটা বিশালদর্শন ট্রাকের মুখোমুখি হলে তাও পথ কেটে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই বোবা দানবের লিপ্সা থেকে নিজেকে কীভাবে রক্ষা করবেন তিনি? মাথা নাড়িয়ে অসম্মতির মাধ্যমে অপটু প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি মাফলার আর কোট গলায় জড়িয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন।
বাসায় তাকে আগেভাগে ফিরতে দেখে ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার স্ত্রী ও কন্যা। এরকম তো কখনো হয় না! তার কি শরীর খারাপ করেছে? অথবা অফিসে অচিন্ত্যনীয় কোনো দুর্যোগ ঘটে গেছে?
ইসমাইল আলি আশ্বাস দেন তাদের, ভয়ের কিছু নেই। বাসায় তাড়াতাড়ি এসে পড়ায় যে সময়টা বেঁচে গিয়েছিল, তা তিনি পূরণ করেন নষ্ট হয়ে যাওয়া দেয়ালঘড়িটার ঘণ্টা ঠিক করতে। অবশেষে সন্ধ্যা ৬টায় ঘড়িটা ছয়বার বাজলে ইসমাইল আলির প্রকৌশলবিদ্যার প্রশংসা করার মাধ্যমে গুমোট ভাবটা কেটে যায়।
(৩)
দিন যায়। ইসমাইল আলির সম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ে। দেশের সরকার বা রাজাধিরাজ শহরে একটি বিশেষ দিবস উপলক্ষে অবারিত উন্নয়নের উদযাপন করার নির্দেশ দেয়। তার সাথে জড়িয়ে যায় ইসমাইল আলির নাম। শহরের বাণিজ্য বিষয়ক সংগঠনগুলোর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইসমাইল আলি তার পরিবারকে নিয়ে যান সেখানে। ডায়াসে উপবিষ্ট অতিথিদের মধ্যে তাকেই সবচেয়ে সন্তুষ্ট এবং আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। তার স্ত্রী ও কন্যা সামনের সারিতেই বসার জায়গা পায়। অনেকদিন পর ঘরের কোণ থেকে বের হয়ে আলোয় ভরা অডিটোরিয়ামে এসে তারা ছিল উচ্ছ্বসিত। তাদের ধারণা ছিল এখানে অনেক আনন্দ হবে। কিন্তু প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের নিরাবেগ উন্নয়ন আলোচনা তাদের সময়কে করে দেয় স্থবির। মাঝেমধ্যে নৃপতিকে উপলক্ষ করে রচিত গান ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার হলে তারা আরও মিইয়ে যায়। তারা মূলত অপেক্ষা করেছিল কখন ইসমাইল আলি ভাষণ দেবেন। এর আগে তারা তাকে বক্তব্য রাখতে দেখেনি। তাই তাকে নিয়ে কিছুটা উৎকণ্ঠাও কাজ করছিল।
ইসমাইল আলি অবশ্য বেশ উপভোগ করছিলেন। বক্তব্য দেওয়া নিয়ে তার কোনোরকম উদ্বেগ কাজ করছিল না। তার কর্মক্ষেত্রে তাকে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ব্যাপারে বক্তব্য দিতে হয়েছে। কারও বিদায়, কারও আগমন, বার্ষিক কার্যবিবরণী, এসব নিয়ে বিধিবদ্ধ বক্তব্য দেওয়ার অভ্যাস তার আছে। আজকে যেটা দিতে হবে, সেটাও এক ধরনের বিধিবদ্ধ বক্তব্যই। ওপর মহল থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কী কী বলতে হবে। এসব বলতে তার এমনকি একটু মহড়া দেবারও প্রয়োজন হয় না। তাকে ডাকা হবে উন্নয়ন বিষয়ক একটি ছোট্ট প্রামাণ্যচিত্র শেষ হবার পরেই। তিনি প্রামাণ্যচিত্রটি উপভোগ করার চেষ্টা করলেন।
কিছুক্ষণ পর সেই পালা এলো। ইসমাইল আলি দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে গেলেন ডায়াসের দিকে। মাইক্রোফোনে সঠিকভাবে শব্দ আসছেন কি না পরীক্ষা করে দেখলেন। সমস্যা বোধ হওয়ায় কারিগরি কাজের ছেলেটিকে ডাকলেন। সবকিছু ঠিক করার পর তিনি সন্ধ্যার শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য শুরু করলেন। ঠিক তখনই বোবা দানবটা তাকে এসে খাবলে ধরল।
সেই একই অনুভূতি। শরীর অসার হয়ে গেছে। শুধু পার্থক্য হলো— এর আগে তাকে বোবায় ধরেছিল ঘুমের ভেতরে, আর এখন তিনি সম্পূর্ণ জাগ্রত। এর আগেরবার তিনি শুধু আঙুল নাড়াতে পেরেছিলেন, এখন দুই হাতই নাড়াতে পারছেন। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দও বের হচ্ছে। আর চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ঝাপসা কাঁচের ভেতর দিয়ে নিশ্চল প্রেতমুখগুলো। ধীরে ধীরে মুখগুলো আরও ঝাপসা হতে লাগল। চারপাশের শব্দ-রঙ-গন্ধ বিয়োজিত হয়ে তাকে আটকে ফেলল এক চৌকোনো পরাবাস্তবতায়। বিপজ্জনক ঘুম, নিরাপদ মৃত্যু আর লজ্জাস্কর বাস্তবতাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার প্রবল যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। তার দিকে ছোঁড়া হচ্ছে আন্ধারের ঢেলা, ব্লটিং পেপারের মতো গলা থেকে শুষে নেওয়া হচ্ছে নিঃশ্বাস।
ইসমাইল আলি মরে যাচ্ছেন— এই অনুভূতির ভয়াবহতার পাশাপাশি এতগুলো মানুষের সামনে অপদস্থ হতে হচ্ছে, এই লজ্জাবোধও তাকে হীনবোধে লীন করে ফেলছে। তাই তিনি তার প্রস্তুতি নিয়ে আসা বক্তব্য বলে যেতে লাগলেন। বলতে লাগলেন তার সংগ্রামের কথা, আনুগত্যের কথা। বলতে লাগলেন দেশের অধিকর্তার স্বপ্নের কথা, বলতে লাগলেন অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং মহাপ্রকল্পের কথা। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো জলকে বশ আর আগুনকে অবশ করার শক্তিমত্তা অর্জনের আশাবাদ। তার সামনে কয়েকশ মুখ কার্টুনের চরিত্রের মতো বেঁকেচুড়ে তার দিকে ঘৃণা নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে বলে তার মনে হলো। তবুও থামলেন না তিনি। থামলেই সব থমকে যাবে। তার মস্তিষ্কের এলোমেলো সংকেত কণ্ঠ অবধি গিয়ে যে উপজাত সৃষ্টি করল, এটা হয়তো গর্দভের ক্লেদের চেয়েও নোংরা, তবুও তিনি থামলেন না। বলতে বলতে তার গলা শুকিয়ে এলো শিরীষ কাগজের মতো, কণ্ঠার হাড় এই বুঝি গেল মরাৎ করে ভেঙে! আর পারছেন না তিনি। হাল ছেড়ে দিলেন। আঁশটে আবছায়া তাকে ঘন সিরার মতো জাঁপটে ধরল। অবাস্তবতার চৌকোণে আবদ্ধ হয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন বোবা দানবের এই প্রলম্বিত অত্যাচার শেষ হবার।
এবং অন্যবারের মতো আবারও তিনি ফিরে পেলেন চলৎশক্তি, দৃষ্টি এবং বেঁচে থাকার আদিম স্বস্তি। চোখ মেলে তাকালেন দর্শকদের দিকে। নিশ্চয়ই সবাই তার দুরবস্থা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়বে! নিশ্চয়ই তাকে নিকৃষ্ট ভাঁড় আখ্যা দিয়ে জুতো ছুঁড়বে। কিন্তু কী অবাক কাণ্ড! সবাই হাত তালি দিচ্ছে। সবার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে খুঁজতে লাগল তার নারী দুইজনকে। তারাও তালি দিচ্ছে, তবে অন্যদের মতো শীতল পুতুল হয়ে না। তাদের চোখে-মুখে গর্ব আর আনন্দ।
পাশে চলে এসেছে উপস্থাপক। মৃদু হেসে অপেক্ষা করছে তালি শেষ হবার জন্যে। সেটা শেষ হলে পরে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সে ইসমাইল আলিকে ধন্যবাদ জানাল চমৎকার বক্তব্যের জন্য এবং আসনে ফিরে যেতে অনুরোধ করল।
ইসমাইল আলি এবার একটা ভুল করে ফেললেন, যা তার সাথে খুবই বেমানান। তিনি প্রধান ও বিশেষ অতিথিদের জন্যে সংরক্ষিত আসনে ফিরে না গিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে লাগলেন। তিনি যাচ্ছেন দর্শক সারির দিকে, যেখানে বসে আছে তার স্ত্রী ও কন্যা। উপস্থাপক ও মঞ্চের অন্যান্য কুশীলবেরা তাকে বারকয়েক ডেকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে বিব্রত হলো। ইসমাইল আলি হেঁটে যাচ্ছেন। বরাবরের মতো দৃঢ় পদক্ষেপে নয়, কুঁজো বুড়োর মতো নুয়ে এবং ধীর পায়ে।
ইসমাইল আলি হাঁটছেন ধীর পায়ে। মঞ্চে ছুটছে কথার তুবড়ি। আরও একটা বক্তব্য শেষ হলো। আবারও পাথরমানবেরা করতালি দিলো। মঞ্চে যে বা যারা আছে তারা জ্ঞানী নাকি ভাঁড়, নাকি অবতার, তারা কী বিষয়ে বলছে, কীসের আশাবাদ দিচ্ছে তাতে দর্শকদের কারও কিছু এসে যায় না। তারা দম দেওয়া পুতুলের মতো করতালি দিয়ে যায়। বক্তব্য, বিবমিষা, করতালি, ঘোষণা, অভ্যর্থনা আর আশাবাদকে ঠেলে-গুঁতিয়ে সরিয়ে দিয়ে ইসমাইল আলি যেতে থাকে মঞ্চের বিপরীত দিকের গন্তব্যে।
*
দূরে কোথাও একটা বুড়ো দেয়ালঘড়ি ঘণ্টা বাজানোর সংকেত দিয়ে যাচ্ছে। যে সংকেতকে ইসমাইল আলি এতদিন মনে করত নিয়মবইয়ের একটা হিসাবমাত্র, তার মধ্যে লুকিয়ে আছে জীবনকৌটোর এত উপঢৌকন— তা সে এতদিন পরে জানল!
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
অধিবৃক্ষের কাছে ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২ হাসান মাহবুব হাসান মাহবুব-এর ছোটগল্প ‘অধিবৃক্ষের কাছে’