জ্যোছনাগন্ধা গেরামে যেদিন গন্ধগুলো সব হারিয়ে গিয়েছিলো
২ মে ২০২২ ১৮:৫৩
জ্যোছনাগন্ধা নামে যে গেরামটা আছে কিংবা ছিলো কিংবা কখনো থাকিবে সুখি নদীর পাড়ে- সেই গেরামে যখন কোনো এক সকালে গভীর কমলা রঙের সূর্য উদিত হইলো আর পাখিরা ডাকিলো কুহু কুহু কুহু কুহু রবে আর ফুলেরা প্রস্ফূটিত হইলো আপন গৌরবে আর পাতায় পাতায় বাতাস বহিয়া বাজিলো বাঁশির সুর আর কিষাণেরা কাস্তে হাতে শস্যক্ষেত্রে নামিলো ফসলের তরে আর কিষাণীরা বক্ষ উন্মুক্ত করিয়া সন্তানদিগেরে দুগ্ধ দিতে দিতে সংসারের সকল কর্মে মনোনিবেশ করিলো, যখন হাঁড়িতে ভাত উতলাইলো- সেইরকম এক মনোরম সকালে জ্যোছনাগন্ধা গেরামের বাসিন্দা মানবেরা অবাক হইয়া খেয়াল করিলো তাহাদের নাকে এখন আর কোনো গন্ধ আসিতেছে না!
ব্যাপারটা সকলের আগে প্রথম খেয়াল করিলো কদম আলী। বাড়ির উঠানে সে একদা শখ করিয়া একখানা গেন্দা ফুলের বৃক্ষ রোপন করিয়াছিলো। এক সুপ্রভাতে সে দেখিলো সেখানে হলুদ ফুল ফুটিয়াছে। তাহার খুব আনন্দ হইলো, সে ছুটিয়া গেলো ফুলের নিকটে। সে ফুলের রেণু কপোলে মাখিলো, আদর করিলো। কিন্তু আটখানা আহ্লাদ শেষে একসময় সে খেয়াল করিলো ফুলে কোনো গন্ধ নাই! সে তখন গাছের সবুজ পাতা ছিঁড়িয়া বাম হাতের তালুতে রাখিয়া ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়া আচ্ছামতো দলাই মলাই করিলো, নাকের কাছে নিলো, কিন্তু খেয়াল করিলো পাতারও কোনো গন্ধ নাই। অথচ তাহার স্পষ্ট মনে আছে, তাহারা যখন বালক ছিলো, যখন তাহারা মাঠে ফুটবল খেলিতো, তখন পা কাটিয়া গেলে তাহারা গেন্দা ফুলের পাতা ডলিয়া সেই রস মিশায়ে দিতো ক্ষতস্থানের রক্তের সঙ্গে। ক্ষত তৎক্ষণাত সারিয়া যাইতো। আর তখন তাহারা খেয়াল করিতো গেন্দা ফুলের পাতা হইতে খুব তেজ একটা ঘেরান বাহির হয়। কিন্তু এক্ষণে সে কোনো ঘেরান বা গন্ধ পাইলো না। সে চিন্তিত হইলো।
গন্ধের সন্ধানে সে তখন ছুটিলো শিউলী বৃক্ষের পানে। বৃক্ষ হইতে কমলা বোঁটার শ্বেত ফুল ঝরিয়া পড়িয়া রহিয়াছে শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর। কদম আলীর মনে আছে শিউলীর গায়েও গন্ধ ছিলো একদা। সে শিউলীর কাছে নাক ঠেকায়ে আকুল কণ্ঠে কহিলো, ‘ওগো ফুল গন্ধ দাও’। কিন্তু শিউলীও তাহাকে কোনো গন্ধ দিতে পারিলো না। একে একে সে গেরামের হেথায় হোথায় যতো পুষ্পবৃক্ষ ছিলো, সবগুলোর নিকটে গেলো। বলিলো ‘ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো’। কিন্তু কোনো পুষ্পই তাহাকে গন্ধ বিলোতে পারিলো না। তখন সে চিন্তিত হইলো। তাহলে কি ফুলগুলো গন্ধ হারায়ে ফেলছে? নাকি সে নিজেই হারায়ে ফেলছে গন্ধ গ্রহণের ক্ষমতা?
সমস্যাটা সে তখন প্রকাশ করিলো জ্যোছনাগন্ধা গেরামের বিদ্যালয় শিক্ষক গোকুলনাথের নিকটে। গোকুলনাথ পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত, বিস্তর তাঁর জ্ঞান। নানাবিধ বিষয়ে পরামর্শ জানিতে সকলেই সকলের প্রথমে তাহার নিকটেই ছুটিয়া যায়। অতএব কদম আলীও গেলো। সকল বিত্তান্ত শুনিয়া গোকুলনাথও তখন ফুলেদের পানে ছুটিলো, ফুল হতে ফুলান্তরে ছুটিলো, কিন্তু তাহার নাকেও গন্ধ জুটিলো না!
ক্রমেই জ্যোছনাগন্ধা গেরামের সকলেই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হইলো। গেরামের সকল নারী ও নরেরা, শিশু ও বৃদ্ধেরা, বালিকা ও বালকেরা, তরুণী ও তরুণেরা, যুবতী ও যুবকেরা সকলেই তখন গন্ধের খোঁজে বৃক্ষদের নিকট সমর্পিত হইলো। তাহারা ফুলেদের নিকট সমর্পিত হইলো, ফলেদের নিকট সমর্পিত হইলো, ফসলের নিকট সমর্পিত হইলো- কিন্তু ফুল, ফল কিংবা ফসল কেহই তাহাদের নাকে গন্ধ দিতে পারিলো না!
তখন তাহারা পরষ্পরের কানে কানে ফিসফিস হয়ে উঠিলো হতাশার মতো, তখন তাহারা কপালের ভাঁজে ভাঁজে ফুটিলো চিন্তার মতো, তখন তাহারা হাতের স্পর্শে নখরের ক্ষতের মতো রক্তিম হলো, কিন্তু তথাপিও কোথাও কোনো গন্ধ তাহারা লভিতে পারিলো না।
অথচ তাহারা প্রত্যেকেই স্মরণ করিতে পারিলো যে তাহাদের নাকে একদা গন্ধ বাহিত হইতো। তাহারা প্রত্যেকেই তখন স্মরণ করিতে পারিলো তাহাদের গেরামেরও একখানা গন্ধ ছিলো একদা। তাহারা স্মরণ করিতে পারিলো তাহাদের চুলায় যে আগুন জ্বলিতো, তাহাতে যে কাঠ পুড়িতো, সেই কাঠেরও একটা পোড়া গন্ধ ছিলো। তাহারা স্মরণ করিতে পারিলো তাহাদের গেরামে প্রথম বৃষ্টির পর মাটি থেকে যে ভাঁপ উঠিতো, সেখানেও একটা সোঁদা গন্ধ রহিতো। তাহারা স্মরণ করিতে পারিলো তাহাদের শিশুদের দুধভারাক্রান্ত ঠোঁটে আছিলো আদরের গন্ধ। তাহারা স্মরণ করিতে পারিলো তাহাদের রমনীদের চুলে ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতো গন্ধরাজ। তাহারা স্মরণ করিতে পারিলো তাহাদের পুরুষেরা যখন ঘর্মক্লান্ত হতো, সেই ঘামেও একদা ছিলো সুবাস!
হাহাকার আর ফিসফিসের বদলে তাহাদের হতাশা কান্নায় নিমজ্জিত হইতে হইতে তাহারা জানিলো, তাহাদের কোথাও এখন আর কোনো সুবাস নাই।
তখন ফুলবানু পরামর্শ দিলো দুর্গন্ধ খুঁজিতে। তখন তাহারা পাগলের মতো ছুটিলো মাঠে মাঠে, যেখানে গরুজনেরা গোবর ত্যাগ করিয়া রাখিতেন, তাহারা গোবর ছানিয়া গন্ধ আনিতে পারিলো না। তখন তাহারা ছুটিলো ভাগাড়ের পানে, জগতের সকল ময়লা আবর্জনা তাহারা ছানিয়া টানিয়া লইলো আপনার শরীরে, অতঃপর তাহারা পরষ্পরের শরীরে শরীরে নাক গুঁজিয়া গন্ধ খুঁজিলো, কিন্তু হায়- তাহারা দুর্গন্ধও পাইলো না কোনো।
তখন তাহাদের হৃদয়ের নিভৃত কোনে অতিশয় সংশয় উপস্থিত হইলো। তাহাদের কেবলই মনে হইতে লাগিলো তাহাদের পৃথিবীতে কোনোকালে কোনো গন্ধ ছিলো না বুঝি। তাহাদের সংশয় উপস্থিত হইলো তাহারা কোনোকালে কোনো ফুলের নিকট হইতে সুবাস পাইয়াছিলো কি না। তাহাদের সংশয় উপস্থিত হইলো তাহাদের ফসলে কোনোকালে কোনো গন্ধ ছিলো কি না। তাহাদের সংশয় উপস্থিত হইলো তাহাদের হৃদয়ে কোনোদিন কোনো সুবাস ছিলো কি না!
তখন তাহারা তর্ক জুড়িলো, কাইজ্যা করিলো, ফ্যাসাদ ফাঁদিলো। কিন্তু বস্তুত কোনো সমাধানে তাহারা পৌঁছাতে পারিলো না। তখন তাহারা ছুটিলো জ্যোছনাগন্ধার প্রাচীণজন মলয় ঠাকুরের নিকটে।
গেরামের সীমান্তে বিস্তীর্ণ যে বটবৃক্ষটি, যাহার ডালগুলি ক্রমশ সাম্রাজ্য বিস্তার করিতে করিতে চলিয়াছে সীমাহীন, সেই বটবৃক্ষের বয়স বেশি নাকি মলয় ঠাকুর তাহার চেয়েও প্রাচীন- এই তথ্য জ্যোছনাগন্ধার মানুষেরা কোনোদিন ঠাহর করিতে পারে নাই। তাহারা কোনোদিন নিঃসংশয় ছিলো না মলয় ঠাকুরের জন্ম কি পৃথিবী তৈরির আগে নাকি পরে? কারন তাহারা সকলেই জন্মের পর হইতে মলয় ঠাকুরকে এইরূপে চুপটি করিয়া বসিয়া থাকিতেই দেখিয়াছে কেবল। আর তাহারা তাহাদের পূর্ব পুরুষদের নিকট কিচ্ছা শুনিয়াছে মলয় ঠাকুরের নানাবিধ জীবনের। সেই পূর্ব পুরুষেরাও সেইসকল গল্প শুনিয়াছে তাহাদেরও পূর্ব পুরুষেদের নিকট। এইভাবে পূর্ব পুরুষ পরম্পরায় অতীতের পথে যেতে যেতে তাহারা কোনোদিন কূল খুঁজিয়া পায় নাই।
কিন্তু আজ তাহারা বেআকূল হইয়া সুবাসের কূল কিনারা খুঁজিতে হাজির হইলো মলয় ঠাকুরের নিকটে। ঠাকুর মনযোগের সহিত সকলের সকল কথাই শ্রবণ করিলেন। অতঃপর তিনি বলিতে লাগিলেন পৃথিবীর সকল গন্ধের কথা। অতঃপর তিনি বলিতে লাগিলেন পৃথিবীর সকল সুবাসের কথা। যে সুবাসে ফুলেতে আসে ভ্রমর, নারীতে গমন করে নর, সকলে মিলে পরষ্পর। যে সুবাসের টানে পৃথিবী জাগিয়া রহে, বাঁচিয়া রহে, ঘোরে সূর্যেরও চতুর্পাশ।
সেইসকল গল্প শুনিয়া জ্যোছনাগন্ধার সকল নারী ও পুরুষেরা, বালিকা ও বালকেরা, তরুণী ও তরুণেরা, যুবতী ও যুবকেরা, বৃদ্ধা ও বৃদ্ধেরা মনে করিতে লাগিলো পৃথিবীতে একদা সত্যিই বোধহয় গন্ধ ছিলো। কিন্তু পৃথিবীর সকল গন্ধরা আজ কোথায় গেলো? কেন তাহাদের ত্যাগ করিয়া তাহারা পলাইয়া গেলো? কোথায় তাহারা গেলো? কোনোদিন কি আর তাহারা আসিবে ফিরিয়া?
পরষ্পরে এইসব প্রশ্ন করিতে করিতে তাহারা নিজেদের গৃহে গৃহে ফিরিলো। সূর্যের অবসানে রাত্রি জাগিলো। চন্দ্র উদিত হইলো, আহা গভীর জ্যোছনার রাত। জ্যোছনাগন্ধা গেরামে জ্যোছনার আলো বিরাজ করিতে লাগিলো সগিরুদ্দিনের জানালার কপাটে, আছিয়া বেগমের ললাটে, ভেজা পুকুরের ঘাটে। জ্যোছনার সে আলো ঢেউ তুলিলো সুখি নদীর জলে আর গৃহদাহের খাটে। নারীরা মিলিলো নরের শরীরে। কিন্তু তাহারা বুঝিলো, তাহাদের পরষ্পরের স্পর্শে কোনো আনন্দ তৈয়ার হইতেছে না। তখন তাহারা পোশাক ছাড়িয়া তাহাদের সন্তানাদির নিকটে গেলো, স্পর্শ করিলো, কিন্তু সেই স্পর্শে কোনো সম্পর্ক তৈয়ার হইলো না। তখন তাহারা হাহাকার করিয়া ছুটিয়া বাহিরিয়া গেলো জ্যোছনাগন্ধার প্রবল জ্যোছনাবিজড়িত মাঠে। তাহারা চিৎকার করিয়া কান্না জুড়িলো, স্পর্শে স্পর্শে বিভোর হইলো, কিন্তু প্রাণের কোনো স্পন্দন পাইলো না। অতঃপর তাহারা নিজ নিজ কবরের মতো গৃহে ঠাঁই নিলো পুনরায়।
অদূরে ফুলেদের বনে তখন ভ্রমরেরা গাহিতেছিলো রবিঠাকুরের কোনো গান।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ গল্প জ্যোছনাগন্ধা গেরামে যেদিন গন্ধগুলো সব হারিয়ে গিয়েছিলো নজরুল সৈয়দ সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২