কবিতার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
২ মে ২০২২ ১৯:০২
প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবি ও কবিতাকে ঠাঁই দেননি বলে আড়াই হাজার বছর ধরে কবিরা তাঁকে খুব কম গাল-মন্দ করেননি। লেখার কাজটি কবিরা হর-হামেশা করতে পারেন বলে অপরের নিন্দামন্দে তাদের জুড়ি নেই। কবিতার পক্ষে সাফাই কবিরা গাইবেন, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু কবিতার কাজটি অন্য আর দশটি কাজের চেয়ে কেন ভালো, কবিরা তার ব্যাখ্যা দিতে নারাজ।
কেউ লেখার কাজটি যখন প্রথম শুরু করেন তখন কাজটির ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই শুরু করেন। এমন একটি কর্মে তিনি উদ্বুদ্ব হন, যা করার জন্য বাইরের কোনো চাপ বা লাভক্ষতির হিসেবের প্রয়োজন হয় না। কাজটি না করলেও বাইরের জগতে তার ক্ষতি নেই। কিন্তু কাজটি সম্পাদনে ভেতরের যে তাড়া তাকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয় না। দ্রুত রাইটিং-প্যাডে কিছু একটা লিখে তবে-ই মুক্তি। এই লেখার সবটাই প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক জগতের মধ্য থেকে আসে না। সবটা তিনি ব্যাখ্যা করতে পারেন না। তবে উপলব্ধি এমন এক রূপলাভ করে যে সত্যকে উপেক্ষা করা যায় না। এইভাবে একই ধরনের বোধের বারংবার প্রকাশ তাকে কবি করে তোলে। তখন সে একটি কণ্ঠস্বর হতে চায়। নিজ ভাষার জনগোষ্ঠীকে তার বোধের কথা জানাতে চায়।
তবে কাজটি করার জন্য কি ধরনের যুক্তি তিনি সংগঠিত করেন তা কিছুটা তলিয়ে দেখতে পারি আমরা।
আসলে কবিতা এমন একটি কর্ম (আমরা শিল্প শব্দটি আপাতত বাইরে রাখতে চাই) একজন ব্যক্তি প্রথমে যে কাজটি তার নিজের সঙ্গে শুরু করেন। যদিও চূড়ান্ত বিবেচনায় কবিতা মূলত পাঠক মুখাপেক্ষী। অবশ্য কবিতা না বলে কাব্যখ্যাতি বলাই ভালো। কারণ কবিতা ও কাব্যখ্যাতি এক নয়। কবিতার সৃষ্টি প্রক্রিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতির দরকার হয় না। কিন্তু কবিতার অস্তিত্ব নির্ভরশীল তার পাঠকবর্গের মর্জির উপর। একটি কবিতার সমকালে বা অনাদিকালে কোনো পাঠক না জুটলে তাকে কেউ কবিতা বলবে না। কবিতা এমন একটা শিল্প যা করার জন্য কেউ বাধ্য কিংবা পূর্বমজুরী দিয়ে নিয়োগ করতে পারে না। আবার রচিত হওয়ার পরে কোনো পাঠক না পাওয়া গেলে ঐ কবিতার অস্তিত্ব বিফল হতে বাধ্য। এমনকি কবি নিজেও তার একই কবিতা পাঠে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। কবিতা লেখার প্রথম পর্যায়ে একজন কবি ভাব দ্বারা তাড়িত হন। বাইরের জগতের সঙ্গে তার ভেতরের জগতের যে দ্বন্দ্ব তাকে তিনি প্রকাশ করতে চান। আর এ সমস্যা সম্পূর্ণ তার নিজের। কিন্তু কবি যেহেতু ভাষা সৃষ্টি করেননি, ভাষা যেহেতু একটি ভাষাগোষ্ঠীর অভিন্ন অংশীদারিত্বে বিরাজমান সেহেতু সেই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে কবিতা একটি ক্রিয়াশীলতা তৈরি করতে পারে। কিন্তু কবি এবং কবিতার সর্বজনীন সংজ্ঞা না থাকায় কবির দাবি সব সময় নাকচ করা যায় না।
কবিতা এমন কোনো বিজ্ঞান নয়, যা মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যায়। আবার কবিতা এমন এক অধিবিজ্ঞান যার সঙ্গে ধর্ম কিংবা অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান যেমন তার হাইপোথিসিসের মধ্যে এমন ইঙ্গিত রেখে যায়, যার ব্যতিক্রম হলে পুরো প্রকল্পটি বাতিল হতে বাধ্য। কিন্তু কবির পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রাচীনকালে আমাদের নাম না জানা কবিরা যে কবিতা লিখতেন, এমনকি আমরা যাদের কথা জানি যেমন হোমার কিংবা বাল্মীকি, কালিদাস কিংবা ইউরিপিদিস, চন্ডীদাস কিংবা চসার, রুমি কিংবা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা বোদলেয়ার এঁদের সবাইকে আমরা কি করে একই মাত্রায় কবি নামে অভিহিত করি? বিষয় ও আঙ্গিক; ব্যক্তি ও কালকে আমরা এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কিভাবে সামন্যিকরণ করি? এর একটি কবিতা হলে, অন্যটির সম্ভাবনা সামান্যই থাকে। মহাকাব্যের বিষয় এবং আঙ্গিকের সঙ্গে গীতিকবিতার বিষয় ও আঙ্গিককে আমরা কিভাবে সরলীকরণ করতে পারি?
মানুষের সংগঠনকালে মহাকাব্যের কবিরা যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন; বর্তমানকালের গীতি কবিদের সে প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কিনা সে বিতর্ক হতেই পারে। তাছাড়া রবীন্দ্র-নজরুল-উত্তর কবিতাকে যে গীতি কবিতা বলা যায় না; অন্তত তার গীত না হওয়ার ক্ষমতা দেখে যে কেউ সে কথা বলবেন। আমরা জানি, সব ভাষা সাহিত্যের আদি মাধ্যম কবিতা। ফলে এই মাধ্যমের উৎসের গভীরতা নিয়ে ভাবনা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। আমরা বলতে পারি না আদি যুগে মানুষ সাহিত্যের এই শাখাটি কেন বেছে নিয়েছিল। তবে বেছে নিতে হলে আরও বিকল্পের দরকার হয়। অন্য কোনো বিকল্প প্রাচীন কবিদের কাছে ছিল কি-না তা আমাদের জানা নেই। তাই অনেক বিকল্পের মতো একটি বিকল্প তারা গ্রহণ করেছিলেন এমন নয়। আমার মনে হয়, মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার প্রাথমিক প্রবৃত্তির উপর কবি হওয়ার বিষয়ও নির্ভরশীল ছিল।
মানুষ পৃথিবীতে এমন একটি প্রাণি যাকে অর্জন করতে হয়েছে সব কিছু। আর এই অর্জনের সেতুবন্ধ রচনা করেছে তার ভাষা। মানুষের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি ভাষার মাধ্যমে কাল থেকে কালান্তরে, জন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে। আর অতীত থেকে আহরিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সংযোজনের কাজটি করে চলেছে ভাষা। এই প্রবাহমানতা মানব অস্তিত্ব ও প্রবৃত্তির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কেন মানুষের মধ্যে এ ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছিল। অধিকাংশ প্রাণি-ই যোগাযোগের জন্য সীমিত কিছু শব্দ ও সংকেত ব্যবহার করে। সেই শব্দ ও সংকেতগুলোর নিয়মতান্ত্রিক উৎকর্ষ তারা করতে পারে না। এমনকি দু’একটি শব্দ তারা আয়ত্ত করতে পারলেও অর্থের জটিলতা অতিক্রম করতে পারে না। ফলে প্রাণিজগতের বিকাশ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি তাড়িত নয়। ‘মানুষ’ নামক আমরা যে ধারণাটি বয়ে নিয়ে চলছি- তার অস্তিত্বের প্রায় সবখানি নির্ভর করছে এই ভাষার উপর। যদিও মানুষ প্রাণি হিসেবে অতিরিক্ত প্রবৃত্তিগত সুবিধা পেয়েছে তার ভাষার মাধ্যমে। আর এই ভাষা তাকে প্রাত্যহিক যোগাযোগ ছাড়াও অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত একটি অবিচ্ছেদ্য সেতু রচনা করে দিয়েছে। কিন্তু লিপি ও কাগজ আবিষ্কারের আগে ভাষার এই চিরকালীন সুবিধাটি ব্যবহারে মানুষের কি উপায় ছিল? কারণ আমার মনে হয়, এই প্রশ্নের মধ্যেই কবিতা সৃষ্টির রহস্য লুকিয়ে আছে। অর্থাৎ মানুষ তার প্রবৃত্তিগত জৈবিক জীবনের বাইরেও একটি চিরকালীন ভাবের জগৎ গড়ে তুলেছে আর সে জগৎ দাঁড়িয়ে আছে ভাষার উপর।
ছাপাখানা, লিপি কিংবা আজকের দিনের সংরক্ষণ যন্ত্র ছাড়া ভাষার জ্ঞানকে টেকসই করা আর কিভাবে সম্ভব ছিল? লিপি তৈরির আগেও মানুষ ভাষাগোষ্ঠীর বিশেষ জ্ঞানকে সংরক্ষণ করেছিল তার স্মৃতির মাধ্যমে। মানুষ তার চাক্ষুষ জ্ঞান ছাড়াও অন্য কারো কথিত ভাষা হুবহু স্মৃতিতে সংরক্ষণ করতে পারে। তবে মস্তিষ্কায়ন প্রক্রিয়ার একটি নিজস্ব ব্যাকরণ রয়েছে। সে ব্যাকরণ কিভাবে তৈরি হয়েছে মানুষ তা জানে না। এই ব্যাকরণ জানার জন্য সোস্যুর থেকে চমস্কি পর্যন্ত সবাই চেষ্টা করছেন।
আমার মনে হয়, যে আকাঙ্ক্ষা থেকে ভাষা সৃষ্টি হয়েছিল কবিতা সে আকাঙ্ক্ষার অতিরিক্ত কিছু বহন করে। যেভাবে মানুষ তার বংশ-পরম্পরা রক্ষা করতে চায়। আর এই রক্ষার কারণ বোধ হয় প্রাণের নশ্বরতা। প্রজন্ম রক্ষার মাধ্যমে মূলত সে নিজেকেই রক্ষা করতে চায়। এই বোধ তার অস্তিত্বের সমান্তরাল। মানুষ অস্তিত্বকে নিরাপদ করতে বহুমুখী কর্মকা- পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু মানুষের সামগ্রিক অস্তিত্ব তার জৈবিকতার উপরে নির্ভর নয়। তার জৈবিক অস্তিত্বের পাশাপাশি চিন্তা ও উপলব্ধির অস্তিত্বও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মানুষ তার জৈবিক উত্তরাধিকারের মতো চিন্তার উত্তরাধিকারও রেখে যেতে চায়। কিন্তু লিপি আবিষ্কারের আগে তা সম্ভব ছিল না। তখন একমাত্র ভরসা ছিল মানুষের স্মৃতি। আর স্মৃতিতে ভাষাচিত্র চিরস্থায়ী হওয়ার জন্য একটা নিয়ম মেনে চলতে হয়। অপেক্ষাকৃত ছন্দ ও অনুপ্রাসযুক্ত বাক্য ও বাক্যসমূহ মানুষ সহজে মনে রাখতে পারে। মানুষের মনে যখন স্মরণযোগ্য চরণের আবির্ভাব হয়, মানুষের মস্তিষ্কের গ্লান্ডগুলো তখন ভিন্ন মাত্রায় উদ্দীপ্ত হয় এবং মানুষ বাক্যের এমন একটি স্টাইল গড়ে তোলে যা তার প্রাত্যহিক কথাবার্তার সঙ্গে মেলে না। বাক্যের এই পর্যায়কে আমরা কবিতা বলে অভিহিত করতে পারি। আর কবিতা যে প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়, তাকে আমি ভাষার আদি ছাপাখানা বলতে চাই। যে কারণে ছাপাখানা ও কাগজ তৈরির আগের পর্বে সবভাষার অধিকাংশ রচনা কবিতা বা অনুপ্রাসযুক্ত।
এটা মানুষ কীভাবে শিখেছিল, এ প্রশ্নের জবাব ভাষা আবিষ্কারের মতো জটিল ও অমীমাংসিত। ভাষা এমন একটি মাধ্যম যা মানুষের শরীরের মধ্য থেকে উদ্গত হয়। কিন্তু শরীরের বাইরে বা ভেতরে তার বস্তুগত অস্তিত্ব স্পর্শ করা যায় না। আবার এই অদৃশ্য শব্দবস্তু শরীরবৃত্তিক দুজন মানুষের মধ্যে সেতু রচনা করে দেয়। একজনের ইচ্ছে অন্য জন্য বুঝতে পারে। শরীর ছাড়া যেমন ভাষার অস্তিত্ব নেই। আবার ভাষার কোনো স্পর্শযোগ্য শরীরী কাঠামো নেই।
তবে এটা ঠিক মানুষ ছন্দজ্ঞান নিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেনি। মানুষ তার বাণীর চিরন্তন রূপদানের মূহূর্তে ছন্দ তার মধ্যে সহজাতভাবে কাজ করেছে। ফলে প্রাচীনকালে মানুষের কাহিনি কাব্য, নীতিবোধ, আইন সংক্রান্ত বিষয়াদি ও ইতিহাস কবিতাকারে প্রজন্ম পরম্পরায় চলে এসেছে। এই পর্বে আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মহাকাব্যের কথা জানি যা বিভিন্নকালের কবিকূল দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল। কিংবা শক্তিশালী কোনো কবির হাতে হয়তো আমাদের জানা আজকের রূপে সংগঠিত হয়েছে। এই কবিতাগুলোকে আমরা মানুষের চিন্তার সর্বাধিক বিকাশ হিসেবে লক্ষ্য করি। কারণ যা প্রাত্যহিক তা সবার সংরক্ষণের যেমন দরকার হয় না। তেমন বিশাল সংরক্ষণভান্ডার মানুষের মস্তিষ্কে থাকা সম্ভবও নয়। তাই প্রাচীন যুগের মহাকাব্যে এমনসব রূপকল্প উপমা এমনকি কল্পনার তুঙ্গ স্পর্শ করেছে যা বাস্তবের চেতনার সঙ্গে মেলে না এবং অনেক সময় আমাদের ভাবতে হয়, কি ধরনের বাস্তবতা তাদের এই কল্পনাকে সম্পর্কযুক্ত করেছে। বিশেষ করে প্রাচীন মিথ ও মিথের চরিত্রসমূহের বাস্তবতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে এবং আমাদের বস্তুগত চেতনা সব সময় তার তল খুঁজে পায় না। তবে একেবারে কল্পনায় ভর করে সে সব লিখিত হয়েছে, এমন হওয়ার কারণ নেই। আর তা যে হয়নি তৎকালীন সমাজ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার অনুপুঙ্খ বিবেচনায় আমরা বুঝতে পারি। গ্রিক মিথের চরিত্রগুলো থেকে যদি কিছুটা সরে সক্রেটিসের যুগে আসি তাহলে দেখব ইউরিপিদিস বা সফোক্লিস যে সব নাটক রচনা করছেন তার সঙ্গে বাস্তবতার একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে এমনকি ইডিপাস কমপ্লেক্সও বাস্তবতার ভূমি স্পর্শ করে পল্লবিত হয়েছে। এই সব নাট্য নির্মাতা ও কবিদের কাছ থেকে সক্রেটিস কিংবা তাদের শিষ্যরাও রেহাই পাননি। একই ভাবে ভারতীয় মিথের কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ; যাদব ও রঘু বংশের কোন্দলও ইতিহাস বিবর্জিত নয়। তবে রাক্ষস হুনুমান, দেব-দৈত্য তার বাস্তবতা কি ছিল, তা আমরা একইভাবে ব্যাখ্যা করতে না পারলেও বুঝতে পারি, এমন কিছু যা ব্যাখ্যাতীত এমনকি আজকের যুগের হিস্পানিক লেখকরা ব্যাখ্যার বাইরে যে যাদু-বাস্তবতার সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন তার সঙ্গে আমাদের বাস্তবতার মিল না থাকলেও অনাত্মীয় বলতে পারি না।
মানুষ এমন একটি প্রাণি যে পুরোপুরি বাস্তবের জগতে বসবাস করতে পারে না। বাস্তবতার জগত কল্পনার আবরণে মোড়ানো না হলে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। মানুষের মধ্যে তখন হনন ও আত্মহননের প্রবণতা ভর করে। ফলে মানুষ নিজেকে সর্বদা একটি অবিনশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়। আর এই অবিনশ্বরতাই তার কবিতা ও শিল্পবোধ। এই অবিনশ্বরতাকে আমি ধর্ম ও ধর্মের ঈশ্বর বোঝাতে চাচ্ছি না। এই বোধ নিজেই একটি অবিনশ্বর চেতনা। যে চেতনা বাতাসে ঘাই খেয়ে শূন্যে মহাকাশে দ্রুত ধাবমান আলোক রশ্মির সঙ্গে এক মহাকাশ থেকে অন্য মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের চেতনায় ‘আমি থাকব না’ এ এক ভয়াবহ বিলাপ। মেসোপটোমিয়ার সেই আদিকাব্য গিলগামেশ এবং যুধিষ্ঠিরের সশরীরে স্বর্গারোহন একই বেদনার ফসল ভিন্ন কি? তাই বলে মানুষ মরণের ভয়ে মরণকে মহিমান্বিত করার জন্য কাব্য রচনা করেছেন তা মোটেও নয়। কিন্তু বাণীর যে অবিনশ্বরতা সে তৈরি করতে চায় সেখানেও তো বাণীর মধ্যে কবির থেকে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা উপ্ত থাকে। এমনকি বোদলেয়ারের নরক ও সিফিলিসও তো এন্টিগোনিস্টিক চেতনার ফল। কোথাও এমন কিছু আছে তাকে চ্যালেঞ্জ করা কিংবা তার কাছে অভিমান প্রকাশ এসব রচনার গূঢ়ার্থ।
সে যাই হোক, আমরা লক্ষ্য করেছি লিপি আবিষ্কারের পরে কবিতার রচনারীতির পরিবর্তন হয়েছে। তবে সে পরিবর্তন রাতারাতি আকাশ পাতাল হয়নি। কারণ লিপি তৈরিই মানুষের চেতনার ভাষা সংরক্ষণ নয়। কারণ, কিছুদিন আগেও মানুষের লিপির অধিকার অবাধ ছিল না। লিপি আবিষ্কারের পরেও লেখ্য সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতার কারণে লেখা স্মৃতির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে তখনো মানুষকে প্রধানত স্মৃতির উপর নির্ভর করতে হয়েছে। এই সংকট দু’শ বছর আগেও হ্যালহেডের ছাপাখানার পূর্বে এদেশে ছিল না। প্রকৃতপক্ষে ছাপাখানা আবিষ্কার তো খুব বেশি দিন আগের নয়। তবে ছাপাখানা আবিষ্কারের সঙ্গে লেখা সংরক্ষণের উপায় সহজ হয়ে পড়ে এবং চাইলেই বইয়ের পাতা থেকে তা দেখে নেওয়া যায়। লেখা সংরক্ষণের জাতীয় দায়িত্ব বই ও ব্যক্তির উপর অর্পিত হয়। ছাপাখানা আবিষ্কারের আগে কবিতা ছিল গণের। একজন কোনো রকম পড়তে জানলেই হলো, অন্যদের শ্রোতা হিসেবে তার রসাস্বাদনে বাধা থাকল না। কিন্তু ছাপাখানা কবিতাকে গণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কবিতা হয়ে পড়েছে একান্ত ব্যক্তিগত। কবিতার অনুপ্রাস আর বাধ্যবাধকতার মধ্যে বন্দি থাকল না। কবিতা যেহেতু ব্যক্তিগত হয়ে পড়ল সেহেতু কবিতার বিষয় কেবল জাতির মহত্তম বিষয়-কেন্দ্রিকতা হারালো। তুচ্ছকে কবিতা করার দক্ষতা দেখাতে থাকল কবিরা। সেই সঙ্গে কবিতা হারিয়ে ফেলল সমষ্টিকে তৃপ্তি দানের ক্ষমতা। এমনকি এতদিন যে সব নিরক্ষর লোক কবিতা থেকে আনন্দ লাভ করতো ছাপাখানার ব্যাপক আগ্রাসনে তারা কবিতার রস থেকে বঞ্চিত হলো। কবি আর পাঠকজনতার মুখাপেক্ষী রইল না। যে কবিতাকে নিয়ে কবিকে এতদিন পাঠকের দোরগোড়ায় যেতে হতো, এখন এক ইমপ্রেসনে সহস্রাধিক বই ছাপিয়ে বই বিক্রেতার কাছে পাঠিয়ে দিলেই হলো। যদিও সে বই পড়ে কিনা সেটা অন্য বিতর্ক। ছাপাখানার আগে মূলত সামগ্রিক কাব্যবৃত্ত সম্পন্ন হতো কবি ও শ্রোতার যৌথ প্রয়াসে। এখন কবির কাছে পাঠক অন্তত সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। কিংবা কোনো কবিতা রচনার পরে তা সংশোধনের আর সুযোগ থাকে না।
কবিতা রচনার আদিপর্ব ছিল মানুষের জ্ঞান উপলব্ধি ও স্মৃতিকে বয়ে নিয়ে চলা। কবিতার মাধ্যমে মানুষের সফলতা ও ব্যর্থতা এক কাল থেকে অন্য কালে মানুষ বয়ে নিয়ে যেতো। এখন তার সম্পূর্ণ দরকার ফুরিয়েছে। তাই কবিতা হয়ে উঠেছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। আমরা বাংলা কবিতা থেকে যদি দু’একটি উদাহরণ দিই, তবে এই প্রস্তাবনার পক্ষে যুক্তি দেয়া যাবে। যেমন, চর্যাপদের যে যৎসামান্য উদাহরণ আমাদের কাছে আছে তাতে আমরা দেখতে পাই এসব কবিতার মধ্যে কবির ব্যক্তিগত কোনো আকাঙ্ক্ষার স্থান নাই। কবিতাগুলো মূলত মানুষ যখন মহাসংঘের অংশ হিসেবে নিজেকে ভাবতে শুরু করেছিল, সেই মহাসংঘের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনই ছিল এই কবিতাগুলোর মূল আকাঙ্ক্ষা। এসব কবিতায় যা বর্ণিত হয়েছে তাতে ব্যক্তি মানুষের কোনো ব্যথাবেদনা স্থান পায়নি। ধর্ম ও সামগ্রিক জীবনযাপনের যে উপাদান এই কবিতাগুলো তা-ই ধারণ করেছে। মধ্যযুগের প্রায় আটশো বছরের ইতিহাসে কবিতা গঠনের কিছু পরিবর্তন হলেও বিষয় বৈচিত্র্যের পরিবর্তন তেমন আসেনি। কিন্তু বিষয়ের যে সর্বজনীনতা ছিল যা এ যুগের কবিতাগুলোকে অমরত্ব দিয়েছে। বলা হয় মহাকাব্যের কবিরা নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তাদের আত্মা রেখে যান ধূলার পৃথিবীতে। মহাকাব্য মানুষের সংগঠনযুগের কাহিনি। যখন যূথবদ্ধতার বেশি প্রয়োজন ছিল। চর্যা-পরবর্তী মঙ্গলকাব্যের যুগেও দেবতার কাহিনি ছিল মূলত মানুষের বাঁচার কাহিনি। এমনকি বৈষ্ণব পদাবলীর গীতি কবিতাগুলোও সব মানুষের দেহের মধ্যে একই আত্মার কান্না। এই কবিতাগুলোর কাহিনি মানুষ যুগের পর যুগ বহন করেছে তাদের সংগ্রাম ও দর্শনের চেতনায় জারিত করে।
কিন্তু আমি বুঝতে পারি না, আজকের কবিরা কেন অমরতার স্বপ্ন দেখে? তারও চান, তাদের কবিতাগুলো মানুষ বুঝুক, তাদের উপলব্ধি ও ভাষাগুলো কবির সঙ্গে মিলিয়ে নিক। বর্তমান সময়ের কবিদের এ এক কাণ্ডজ্ঞানহীন আকাঙ্ক্ষা। ইতিহাসের জ্ঞানের অভাব, শ্রেণিপাতের সম্পর্কহীনতা এ ধরনের চিন্তাকে উসকে দেয়। মনে রাখতে হবে, বর্তমান সময়ের কবি কেবল কবিতা লেখেন তার নিজের এবং তাঁর সংখ্যালঘু শ্রেণির জন্য। যদিও শ্রেণি বললে, এখানে পুরোটা পরিষ্কার হয় না। কারণ বর্তমান সময়ে মানুষ যা হারিয়েছে, তাহলো শ্রেণি। অর্থনৈতিক এবং ভোগাকাঙ্ক্ষার একটি শ্রেণি গড়ে উঠলেও উপলব্ধির চেতনা হয়েছে বহুমুখী। আজকে কবি যে উপলব্ধি করেন, তা একান্ত তার নিজের অন্যের সঙ্গে মিলে গেলে বলতে হয় এটি তার চিন্তার সামান্যিকরণ। তাই আধুনিক কবিকে জানতে হলে কবির ব্যক্তিগত জীবন জানা জরুরি হয়ে পড়ে। এটিই ছিল আধুনিকতার শিক্ষা। কিন্তু একজন হোমার কিংবা শেক্সপিয়ার, আলাওল কিংবা ভারতচন্দ্রের জীবন জানার দায় পাঠকের উপর বর্তায় না। পাঠক তার নিজের অভিজ্ঞতাকে শাণিত করতে, কাহিনির মধ্যে আনন্দ পেতে, জগতের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের সূত্রগুলো এসব কবিতা পাঠের মাধ্যমে জেনে নিতে পারত। সমষ্টির কাছে ব্যাস্টির জীবন সেখানে তুচ্ছ। হ্যামলেটের লেখক ঘোড়ার সহিস কিংবা নাটকের যোগানদার হলে দোষ নেই, ইলিয়াডের লেখক কানা হলে দোষ নেই, রামায়নের লেখক ঋষি হলে দোষ নেই। তারা নিজেদের রচনার মধ্যে উপস্থিত থেকে তাদের বর্ণিত পরিধি ছোট করে আনেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পড়তে হলে জানতে হবে তার শানে-নুজুল, এলিয়ট পড়তে হলে জানতে হবে ইতিহাস-মিথ। কারণ তারা কেউ নিজেদের উপর দাঁড়িয়ে নেই। তাদের পা অন্যের মাটিতে, তাদের পাঠক কেবল তথ্যের জগতে। কবিতার সঙ্গে সম্পর্ক না রেখেই তার শ্রেণির মানুষ দিব্বি চালিয়ে দিচ্ছে। কবিতা হয়ে যাচ্ছে পরম প্রান্তিক। তবু কবিতা নিয়ে কবির মধ্যে এই হাপিত্যেশ কেন? যে কারণে মানুষের মধ্যে কবিতার চেতনার উদ্ভব হয়েছিল; আজকে তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাচ্ছে। কবিতা বিবর্তনে বিলুপ্ত অঙ্গের মতো মানুষের চেতনার সঙ্গে এখনো শোভা পাচ্ছে। যাদের কবি চেতনা দুর্বল তারা দ্রুত টেলিভিশনের স্ক্রিপ্ট রাইটারে পরিণত হচ্ছে। কেউ বা অপন্যাস রচনায় কেউ-বা ঘনঘন ছাপাখানার দারস্থ হয়ে প্রসববেদনা দূর করছে। আবার কিছুই হলো না বলে, কেউ দাম দিল না বলে সীমান্ত পেরিয়ে যেয়ে ছাপ্পামারাদের কাছ থেকে কবিখ্যাতি কিনে আনছে।
তবু কবিতা এখনো জয়ী। মানুষের সমাজ যে এখনো রোবটরা দখল করে নেয়নি তা জানতে হলে দেখতে হবে এখনো কেউ কেউ কবিতা লিখছেন কিনা। অবশ্য সেই কবিতার ছন্দ, শব্দ ও বাক্যের বিন্যাস কম্পিউটারের গনণ যন্ত্র দিয়ে মাপা নয়। সেই কবিতা সুযোগ পেলেই এলোমেলো করে দেবে নিশ্চিত সব ভালো থাকা। সেই কবিতা হবে নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াই। প্রথাগত ছন্দ ও অলঙ্কার; গদ্য ও মিশ্র কবিতার বাইরের লোকজনের কবিতা নিয়ে কথা বলার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন কবিতা মানে চিন্তা; চিন্তা মানে উপলব্ধি আর সে উপলব্ধি যেভাবেই প্রকাশ করা হোক না কেন কবিতা ছাড়া যার অন্য কোনো নাম নেই।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ কবিতার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রবন্ধ মজিদ মাহমুদ সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২