উজ্জল জিসান-এর গল্প ‘তিথি’
৩ মে ২০২২ ১৪:০২
অন্ধকারে হঠাৎ সাদার ঝলকানি। নিমিষেই মিলে গেল। মা রত্না বেগম সন্দেহ করলে তনিমাকে ডাকতে যায় দাদির ঘরে। দাদীর ঘরে না পেয়ে তিথিকে ডাকলো- তোর বড় দিদি কোথায় রে?
তিথি বললো, মা তনিমা দিদি পালিয়েছে আপেল ভাইয়ের সাথে। আমাকে বলে গেল, আমি যেন ভালো থাকি। যত যন্ত্রণা আমার কপালে।
নিতু আপু জীবন ভাইয়ের সাথে পালালো সে কথাও আমাকে বলে গেল। দুই দিদি পালিয়ে বাঁচল, আর সারাক্ষণ আমাকে এর ডালপালা সহ্য করতে হবে।
তিথির বয়স মাত্র ৯ বছর। লিকলিকে চেহারা, ফর্সা গায়ের রঙ। মুখটা অনেক সুন্দর, মায়াবী। আধুনিক গ্রামের বেড়ে ওঠা নুপুর পায়ে ছোট এক বালিকা।
কষ্ট আমার একটাই। বড় হতে না হতেই বাস্তবতার নিষ্টুর যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হবে। বাবা প্রচণ্ড রাগী স্বভাবের আর মা খিটখিটে মেজাজের। আমার পরে কেউ নাই। একটি ভাই সেও আমার বড়। দাদা-দাদী আত্মীয়-স্বজন সবাই আমাকে ঘৃণার চোখে দেখে। আর একটু বড় হলে নাকি আমিও কারো হাত ধরে পালাবো। এসব শুনে মনের মধ্যে তালা লাগিয়েছি। কোনো প্রেমটেম আমার কপালে জুটবে না।
এক প্রতিজ্ঞাতেই জীবন পার করতে হবে। তিথি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত খুব ভালো ছাত্রী ছিল। এবং দেখতে তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে সেই বেশি সুন্দরী। নানান দুশ্চিন্তায় তার মেধা আস্তে আস্তে লোপ পেতে থাকে। সে ক্লাসে পিছিয়ে পড়ে আর এভাবে দশম শ্রেণী পর্যন্ত উঠে যায়।
আমি দেখেছি তাকে অপরূপ সাজে। ঘনকালো উরুলিমায়। নিতান্তই চেয়ে থাকে অপলক পানে। ভাবে, কেন এতো সুন্দর করিলে মোরে। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বসন্তের কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে এই রূপময় সৌন্দর্য দেখে অনেকেই কবি হতে চেয়ে পারেনি।
টেস্টে রেজাল্ট খারাপ করার পর আবার জাদুর ছোঁয়ায় পাশ করবে এমনটি ভেবে ফরম পুরণ করে। মহাযুদ্ধ করে পড়তে হয় পাশ করার জন্য। কেননা তার পরিবারে একজনও ছিল না দশম শ্রেণির গণ্ডি পেরোনো।
তাই এ আমরণ যুদ্ধ। সবার ভাগ্যে জোটেনি। তিন তিনবার যুদ্ধ করে দিদিদের কপালে চিন্তার রেখা আর বড় ভাইয়ের অদৃষ্টে বাবার ছোঁয়া।
এসএসসি ফলাফল বের হলো। মাত্র ৪টি বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। তিথি ছাড়া সবাই স্বাভাবিক চলাফেরা করছে।
বাবা ভাবল এবার বিয়ের পালা। কে করবে বিয়ে, কোথায় পাবে বর। এই পরিবারে কেউ আসতে চায় না। মেয়ে সুন্দর হলে হবে কী, পরিবার দেখেই মূলত বিয়ে হয়।
এ ঘর আসে, সে ঘর আসে কেউ একে অপরকে পছন্দ করে না। মায়ের সিদ্ধান্ত অটল থাকলো। এবার এ নিয়ে আমার পালা। পরীক্ষ আবার দেওয়ার।
যথা নিয়মে প্রস্তুতি গ্রহণ এবং পরীক্ষা শেষ।
অনিন্দ্য সুন্দর উড়ু উড়ু মন নিয়ে সময় পার করছি। রাতের অন্ধকার যেন তার সঙ্গী হয়েছে। তিন রাত একাকাক্র হয়ে তার পিছে ঘুরঘুর করছি। আধুনিক যুগের ছোঁয়ায় তার মনটা প্রেমময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সবকিছু পরিকল্পনা আটকে যায় নিজের পরিবারের খেসারত দিতে।
না পারছি কাউকে ভালোবেসে প্রেমলীলায় মত্ত্ব হতে, কিংবা না পারছি একেবারেই শান্ত থাকতে। কষ্টের পর রেজাল্টের পালা। রেজাল্ট নিতে গিয়ে দেখে ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। কিন্তু সোজা পথে নয়, বাঁকা পথে। দুটো বিষয়ে মাত্র পাশ করেছে। কেন এই অবস্থা সেটা কেউ তার কাছে জানতে চায়নি।
নিস্তব্ধ তিথি। কী করবে জানে না। নিজের অজান্তেই সে অনেক প্ল্যান করে যা বাস্তবে করা অসম্ভব। বাবাকে বললো, বাবা আমি পাশ করব। আমি আর গ্রামে থাকব না। আমি শহরের বাসায় চলে যাব। আমি মন দিয়ে সারাদিন রাত পড়লে পাশ করব। কোনো কাজে যাব না। কোনো প্রকার ছেলের সঙ্গে কথা বলব না। বাবা আমি একটা শেষ সুযোগ চাই বাবা। তুমি আমাকে একবার সুযোগ দাও। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি এসএসসি পাশ করেই ছাড়ব।
বাবা রাজি হয়ে তাকে শহরে পাঠালো। নতুন করে যুদ্ধ শুরু। যে স্কুলে সে ভর্তি হল সেই স্কুলের সুন্দর বলতে একমাত্র তিথি। নতুন করে পথচলা। নতুন নতুন বন্ধু পাওয়া। স্কুলের ক্লাস আর প্রাইভেট বন্ধুদের সংস্পর্শে তিথির জীবন অন্যরকম হতে শুরু করল। স্কুলের বড় ভাই, পাড়াতো ভাই আর প্রাইভেট বন্ধুদের অনেকেই তিথিকে ভালোবাসতে শুরু করল। অনেকে সরাসরি বলেছে, আবার অনেকে মাধ্যম দিয়ে বলিয়েছে।
তবে তিথি নিজেকে শক্তভাবে সামলে নিচ্ছে। কারণ তার কিছু করার নেই। সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তার সীমানা সামান্যটুকু।
একদিন আদিত্য নামে কলেজে পড়ে এক ছেলে তিথির রাস্তা আটকে দাঁড়ালো। তিথি তাকে চেনে না। কিন্তু আদিত্য তিথিকে অনেক দিন ধরেই চেনে। তিথির সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছে। এরমধ্যে সে তিথির প্রেমেও পড়েছে। নিরুপায় বেচারা। তাই সে তিথির পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। ভালোবাসবে কি না বল। তিথির সোজা উত্তর, ভাইয়া পথ ছাড়েন। আমি আপনাকে চিনি না। আমার ক্ষমতা অনেক ছোট। আমার ইতিহাস অনেক বড়। এসব প্রেমটেম আমাকে দিয়ে হবে না। আমি আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব।
এরপর আদিত্য তার পিছে লেগে থাকে। তিথির ইতিহাসটা আসলে কি। খুঁজে বের করতে হবে। আদিত্য অনেক সুন্দর। যেমন লম্বা তেমনি স্মার্ট ও স্লিম। তিথির সাথে প্রেম হলে খুব মানাতো। তিথিও এর আগে এত সুন্দর ছেলে কখনো দেখেনি। তিথিও মুগ্ধ আদিত্যর প্রস্তাব পেয়ে। তবে এ মুহূর্তে কিছুই করার নেই। তিথি রাতে পড়তে পারছে না। খেতে এমনকি ঘুমাতে পারছে না।
এর কয়েকদিন পর আবার দেখা। এবার আদিত্য খুব করে ধরেছে। তিথি বলো তো তোমার কি হয়েছে। তিথি খুলে বলে সব ঘটনা। সবকিছু শোনার পর আদিত্য সাহস দিয়ে বলে, অবশ্যই তুমি এসএসসি পাস করবে। তোমার স্বপ্ন আমি পূরণ করব। এরকম সাহস পেয়ে তিথির অসম্ভব ভালো লাগে। স্বপ্ন দেখে এগিয়ে যাওয়ার।
শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। দুজনের মেধা একজনকে পাস করাতে। ক্লাস, পরীক্ষা আর প্রাইভেট। এ ছাড়া সকাল বিকেল তো ডিসকাস আছেই। দুজনের দেখা হওয়া মানে পড়াশোনা। কোন বইয়ে কি আছে, সামনেই পরীক্ষায় কি আসবে। কোনো অঙ্কের উত্তর কত, এটি কিভাবে করতে হবে শুধু এসবি।
একদিন তিথি জ্বরে আক্রান্ত হলো। এ অবস্থায়ও বিকেলে স্কুল মাঠে বের হলো। সেখানে আদিত্য এলো। বলে আজ কী ডিসকাস করা হবে। অ্যানমনা হয়ে বসে আছে তিথি। আদিত্যর কথা শোনে তিথি অজোর ধারায় কাঁদছে।
তাদের দুজনের মধ্যে দু’মাস থেকে পরিচয়। এখনও কোনোদিন বসে প্রেমের কথা হয়নি। পড়ার চাপে সুযোগি হয়নি। আদিত্য তিথিকে প্রচণ্ড রকম ভালোবাসে। তিথিও ভালোবাসে তবে প্রকাশিত নয়। নিজের পড়ালেখা ভুলে গেছে আদিত্য। দিনরাত শুধু তিথির স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করছে।
-আচ্ছা আদিত্য, কয়েকদিন পর পরীক্ষা শেষ, আমি গ্রামে চলে যাব। তুমি তখন কী করবে? তোমার সাথে আমার তো দেখা হবে না।
-রেজাল্টের পর তো দেখা হবে। তাছাড়া মোবাইলে কথা হবে।
– না, মোবাইলে কথা বলা সম্ভব না। আর তিন মাস পর রেজাল্ট শেষে দেখা হবে কি না তাও জানি না। কারণ পরিবার আমাকে বিয়ে দিতে পারে।
-বিয়ে করে ফেলবা।
-আদিত্য, তুমি না আমাকে ভালোবাসো?
– তো কি হয়েছে। আমি বাসলে হবে? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো না।
– কে বলেছে আমি তোমাকে ভালোবাসি না? আদিত্য আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। কিন্তু আমি কী করব।
পরীক্ষা শেষে তিথি গ্রামে চলে গেল। সময় কাটেনা। ভালো পরীক্ষা হয়েছে। এবার সে ভালো রেজাল্ট করবে। পরিবারের লোকজন পাত্র দেখছে বিয়ে দেওয়ার জন্য।
তিথি কী করবে বুঝতে পারছে না। কয়েকদিন ধরে আদিত্যর সঙ্গে কথাও হচ্ছে না। একদিন দাদীর ঘরে গিয়ে চুপ করে মোবাইলে কথা বলল। ফোন পেয়ে আদিত্য মহাখুশি। এবার মনে হয় তিথি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে।
-আচ্ছা তিথি তুমি কি সত্যি আমাকে ভালোবাসো।
-ভালোবাসি কি না জানি না। তবে কয়েকদিন ধরে তোমাকে খুব মিস করছি। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য মনটা আনচান করছিল। তাই চুরি করে তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলছি।
-আচ্ছা তোমার সাথে কবে দেখা হবে?
-জানি না।
-প্লিজ শপিংয়ের নাম করে একদিন আসো না।
-না, পারব না। আমাকে বের হতেই দেবে না। আর কী বলে বাইরে যাব। কে যেন আসছে, ফোন রাখলাম।
উপস্থিত হতাশ হলেও আদিত্য মনে মনে অনেক খুশি। তিথি ভালোবাসতে শুরু করেছে। তার জন্য মন কাঁদে। এটাই ভালোবাসা।
এদিকে আদিত্যর সামনে এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা। গত কিছুদিন তিথিকে সময় দেওয়ার জন্য পড়াশোনা ঠিকমত করতে পারিনি। বিজ্ঞানের ছাত্র সে। না পড়লে পরীক্ষায় লিখবে কি করে। আর পড়াশোনা করে পাশ করতে না পারলে তিথিকে বিয়ে করবে কিভাবে। অন্যদিকে পড়াশোনা করেও যদি তিথিকে জীবন সঙ্গি বানাতে না পারে তাহলে লাভ করে। সব ভেবে শেষে পড়াশোনায় মন দেয় আদিত্য।
সে মাসের মাঝামাঝি আদিত্যর পরীক্ষা শুরু হলো। একটা বারও পরীক্ষায় দেখতে এলো না তিথি। আদিত্যও মন খারাপ করেনি। কারণ প্রায় দিনি তিথি মোবাইলে খোঁজ নেয়।
এবার স্বপ্ন উচ্চশিক্ষায় যেতে হবে ঢাকা। কারণ বাবা একমাত্র ছেলে আদিত্য। পরিবারের সবাই চায় ঢাকায় গিয়ে সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করুক। মাঝখানে তিথির প্রেমে পড়ে জীবন থমকে দাঁড়িয়েছিল। যাহোক, সবদিক ভেবে আদিত্য ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আর এ জন্য তিথিকে রাজিও করালো। তবে এসবে আদিত্যর চেয়ে তিথির বেশি মন খারাপ হলো।
তিথি চারদিকে বাধা। পরিবারের বাইরে কিছু করতে পারছে না। পরীক্ষার রেজাল্টও হচ্ছে না। আদিত্যও ঢাকা চলে যাচ্ছে। কোনো কিছুই যেন তিথির ভালো লাগছে না। মনে আদিত্যর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আদিত্যর তো উচ্চশিক্ষার দরকার আছে।
-আচ্ছা আদিত্য- ঢাকা গেলে তুমি কি আমাকে ভুলে যাবে?
-আরে না। পৃথিবীর শেষপ্রান্তে গেলেও না। জনম জনম আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। -না, শুনেছি ঢাকা গেলে সবাই পরিবর্তন হয়। তুমিও কি তাই হবে? ঠিক আছে তুমি যাও। ভালো করে পড়বা। আমাকে ফোন দিবা। আমার রেজাল্ট হলে কলেজে ভর্তি হবো। ভালো রেজাল্ট হলে হয়তো বাবা বিয়ে নাও দিতে পারে।
আদিত্য ঢাকা গেল কোচিংয়ে ভর্তি হতে। নতুন পরিবেশে মানাতে কষ্ট হচ্ছিল তার। ভাল লাগছিল না। তারপরেও থাকতে হবে।
জুন মাসের শেষের দিকে তিথির রেজাল্ট বের হলো। ভালো রেজাল্ট হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত এ প্লাশ। সবার আগে সে আদিত্যকে জানালো। অনেক খুশী সবাই। ঢাকায় আদিত্য মিষ্টি বিতরণ শুরু করল।
-আরে খাও সবাই খাও। আমার গার্লফ্রেন্ড এ প্লাস পেয়েছে। তার পেছনে অনেক শ্রম দিয়েছি।
তিথির পরিবারেও অনেক আনন্দ বইছে। সারা গ্রামে মিষ্টি দেওয়া হচ্ছে। পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করেছে। বাবা অনেক খুশী। তাকে বিয়ে দেব না। মেয়েকে কলেজে ভর্তি করাব। মেয়ে আমার অনেক ভালো।
-আদিত্য জানো, বাবা আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেবে। বিয়ের গান মাথা থেকে সরিয়েছে।
-কলেজে ভর্তি হও, কিন্তু আমাকে ভুলে যেও না।
-ধ্যাত, তোমাকে ভুলতে যাব কেন? আমার পেছনে তুমি না খাটলে আমার যে কি হতো, জানি না।
-আমার কপাল। আমি কলেজ ছেড়ে এলাম, আর তুমি সেই কলেজে ভর্তি হচ্ছ। দেখিও ছেলেদের নজর যেন না লাগে। তুমি যে সুন্দরী, সবাই মজনু হয়ে যাবে।
-আদিত্য। তুমি তো আমার মজনু। এক মজনু থাকতে আর কেউ মজনু হতে আসবে না। তুমি কবে আসবা? আমি তোমাকে ছাড়া ভর্তি হব না। তুমি আমাকে ভর্তি করে দিবা।
আদিত্য এলো। দুজনে কলেজে গিয়ে ভর্তি হলো। তিথিকে অনেক বেশি সহযোগিতা করল আদিত্য। তারা দুজন রিকশায় কিচ্ছুক্ষণ ঘুরলো।
আগামীকাল আদিত্যর রেজাল্ট। অনেক বেশি আশা পাস করলেই ঢাকায় ভর্তি হবে। এজন্য কোচিং করেছে। মনে মনে ভয়ও কাজ করছিল। না জানি কি হয়। রাতভর আশির্বাদ কামনা করল তিথি। আদিত্যর রেজাল্ট যেন ভালো হয়।
-বিকেলের দিকে কলেজে গেল। সবাই হই হই করছে, কেউ এ প্লাস পেয়েছে। ছোটাছুটি করছে। কেউ গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। আদিত্যর রেজাল্ট কেউ বলতে পারছে না।
রেজাল্ট শিতে নাম ও রোল নম্বর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে কলেজের আয়া এসে বলল, আদিত্য তুমি পাস করেছ। এ গ্রেড পেয়েছ।
-কই কই, আমি তো খুঁজেই পাচ্ছি না।
-প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে গেলে পাবা।
দৌড়ে গেলো আদিত্য প্রিন্সিপালের কাছে। একবারে মাঝামাঝি অবস্থানে আদিত্যর নাম খুঁজে পাওয়া গেল। শেষে আনন্দ নিয়ে আদিত্য বেরিয়ে এলো। মোবাইলে পরিবারের সবাইকে জানালো। তিথিকেও বললো। সবাই খুশী। কিন্তু তিথি না। তার পেছনে সময় ব্যয় না করলে আদিত্যর রেজাল্ট আরও ভালো হতো।
যাইহোক, কয়েকদিন পরেই ভর্তি শুরু। তাই ঢাকা যেতে হবে তাড়াতাড়ি। তিথি কয়েকদিন ধরে বলছে, কয়েকটা দিন থেকে যেতে।
আদিত্য ঢাকা চলে গেল। কোচিংয়ে ক্লাস চলছে। লুবনা নামে যশোরের এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। স্মার্ট সুন্দরী তিথির চেয়ে কম না। মেয়েটি আদিত্যকে শুরু থেকে চিনলেও কিছু জানে না। লুবনা ইতিমধ্যে আদিত্যকে ভালোবেসে ফেলেছে। আদিত্যর কাছে আসে, কথা বলে। নোট নেয়। আদিত্য খুব একটা পাত্তা দেয় না। বেশিরভাগ ভার্সিটির পরীক্ষা শেষ হলো। রেজাল্টও হয়ে গেল। লুবনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্স পেলেও আদিত্য পেল না। শেষে আদিত্য ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে বেসরকারিতে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলো। উত্তরা বিএমইউ ইউনিভার্সিটিতে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ভর্তি হয়ে গেল। এর মধ্যে তিথির সঙ্গে কিছু দিন যোগাযোগ হয়নি। কে কেমন আছে কেউ জানে না। তিথিকে ফোন দেয় আদিত্য। রিং শুধুই বাজে, ফোন কেউ ধরে না। এভাবে তিন ধরে ফোন দিচ্ছে সে।
আদিত্যর সবকিছু যে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তিথি তুমি ফোন ধরছো না কেন। একবার হলেও ফোন ধরো।
চার দিনের মাথায় তিথি ফোনটা ধরল। তিথি না, তার বাবা। তিথি নেই, আমাকে বলেন, কে বলছেন। যা বলার বলেন। তিথির বিয়ে সামনে।
আদিত্য আকাশ থেকে পড়ল। সামান্য কয়েকদিন যোগাযোগ হয়নি তাই এ অবস্থা। এখন আমি কি করবো। তিথি এ বিয়েতে রাজি হয়েছে। সে তো রাজি হওয়ার কথা না। সে বলেছে, পড়াশোনা করবে। কি যে করি।
একটা বুদ্ধি করল। সে সরাসরি তিথিদের বাসায় চলে গেল। তিথির বাবার সঙ্গে সাক্ষাত করল। নিজের পরিচয় পেশ কলো। পরিবারের বিস্তারিত পরিচয় দিলো। তিথির বাবা উত্তরে কিছুই বললো না। তাকে কিছু আপ্যায়ন করতে না দিয়েই চলে যেতে বললো। আদিত্য চলে গেল। পরিবারে বলতে চায় কিন্তু ভয়ে বলতে পারে না। এখনও সে ছোট। মাত্র অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।
তিথিকে তার বাবা জিজ্ঞাসা করল, আদিত্য নামে কাউকে চেনো? তুমি তার সঙ্গে একইসঙ্গে চলাফেরা করেছি। তোমাদের মধ্যে কি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে?
তিথি কোনো কথা বলে না।
এতে তার বাবা আরও ক্ষেপে যায়। তুমিও আবার দুটোর মতো একই পথ বাড়ালে। তোমাকে নিয়ে অনেক আশা ছিল সব আশা তুমি মাঠি করে দিলে। পড়াশোনা বাদ দাও। বিয়ের কথা হচ্ছে। না করো না।
তিথিও আদিত্যর মতো ভেঙে পড়ল। সাহস নিয়ে বাবাকে বোঝাতে গেল। বাবা তুমি বিশ্বাস করো, আমি আদিত্যর সঙ্গে প্রেমে জড়াইনি। এসএসসির পরীক্ষার সময় সে আমাকে সহযোগিতা করেছিল। এ প্লাস পাওয়ার পেছনে তার অনেক অবদান রয়েছে। তাকে ভালো লাগে। তার মানে এই নয় যে, তার সঙ্গে আমার বিয়ে না হলে আমি মরে যাব। এরকম কাজ করিনি আমি। সে তোমার কাছে প্রস্তাব দিয়েছে। ভালো মনে করলে বিয়ে দিবা। না করলে দিবা না। তুমি আমার বিয়ে যেখানেই দিবা আমি সেখানেই রাজি।
এদিকে আদিত্য একমাত্র ছেয়ে হওয়ার তার বাবা মা বিয়ে দেওয়ার জন্য পাত্রী যোগাড় করছে। তারই খালাত বোনের সঙ্গে। কিন্তু আদিত্য খালাত বোনকে বিয়ে করবে না। এ সুযোগে মাকে তিথির কথা বলেই ফেললো। বাবা মা খুব একটা রিয়াঅ্যাকশন করল না। আদিত্যর কথা মতো বাবা সব শুনে রাজি হলেন না। কারণ আদিত্য এখনও কিছু করে না। তাছাড়া সে কেবল ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।
পরিবার অন্য মেয়ে দেখা শুরু করল।তিথির বাবাও ছেলে দেখা শুরু করল। এভাবে বছর কেটে গেল। তিথিও অনার্সে পড়ছে। আর আদিত্যও ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করল। এর মধ্যে তিথি ও আদিত্যর ফোনে কথা হয়নি। আদিত্য ভেবেই নিয়েছে তিথি তাকে ভুলে গেছে। অন্যদিকে তিথি ধরে নিয়েছে, আদিত্য এখন অন্য মেয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে।
এত কিছু ভেবেও তিথির বাবার কাছে আরেকবার যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো আদিত্য। তিথির বাবা অন্য এক বড়লোকের ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে। তিথিকে ডাকা হয়েছে রঙপুর থেকে। তিথিকে দেখে বরপক্কের পছন্দ করেছে। বরপক্ষ চলে গেল। কয়েকদিন পর বিয়ের তারিখ ঠিক হবে।
রাতে বাবা শুয়ে আছে। তিথি ভেতরে প্রবেশ করে বাবার পাশে বসল। অঝোরে চোখের পানি পড়ছে তিথির।
-আচ্ছা বাবা বিয়েতে রাজি হলে তুমি খুশী হবে? আমার খুশির কথা কথা বাদ দাও, নিজের খুশির কথা ভাবলে আগেই আপুদের মতো পালিয়ে যেতাম। কিন্তু আমি প্রমাণ করব, আমি কেন ওরকম করব না।
বাবা তিথির অবস্থা দেখে গলে যায়। বাবার মনে একটা অনুভূতি কাজ করে। ঠিকই তো। তিথি আমাদের না জানিয়ে পালিয়ে যেতে পারত। তিথিকে বলে, আচ্ছা তোমার ওই বন্ধু তো এখনও আছে। সে বিয়ে করেনি তো? তোমার অপেক্ষায় কি সে আছে?
বাবা আমি জানি না। গেল তিন বছর থেকে তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি। এমনকি মোবাইলেও কথা হয়নি। তবে আমার বিশ্বাস বিয়েটা হয়নি ওর।
এদিকে কিছুদিন পর তিথিদের বাসায় এসে হাজির হয় আদিত্য। তিথির বাবাকে বলে, আবারও এসেছি ভালোবাসার দাবি নিয়ে। আমি আপনার মেয়েকে অনেক ভালোবাসি। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে হয়েও তিথির জন্য এখনও বিয়ে করিনি। এবার যদি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে না পারি, তাহলে নিজেকে শেষ করে দেব।
তিথি এ কথা শুনে দৌড়ে এসে আদিত্যর কাছে দাঁড়ায়। আদিত্য চলো বাবাকে জড়িয়ে ধরি, বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত বাবাকে ছাড়ব না। অবশেষে ধুমধাম করে তিথি-আদিত্যর বিয়ে দিতে রাজি হলো বাবা।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ উজ্জল জিসান উজ্জল জিসান-এর গল্প ‘তিথি’ গল্প তিথি সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২