অবাক হচ্ছেন? কি লিখেছি? এ কোন ভাষা?
হ্যা, এটা বাংলা।
উনিশ’শ ষাট সালের দিকে আমাদের বাড়ির পঁয়ষট্টি বছরের কাজের বুয়া এভাবেই মুসলমানদের তিনটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে চিহ্নিত করতো! সিমারিদ অর্থাৎ সিমাইয়ের ইদ, ইদ-উল ফিতর, গোস্তেরিদ অর্থাৎ গোস্তের ইদ, ইদ-উল আজহা (ইদ-উল আজহা) আর রুটিরিদ অর্থাৎ রুটির ইদ, শব-ই বরাত।
আমার প্রথম যে ইদ-উল ফিতরের কথা মনে পড়ে সেটা সম্ভবত ১৯৫৪ কি ১৯৫৫ সালের কথা। আমরা তখন কলকাতার বালিগঞ্জ ও পার্ক সার্কাসের মধ্যবর্তী এলাকার তারক দত্ত রোড-এর ‘৮বি নম্বর’ বাসায় থাকি। আমাদের বাড়িওয়ালার নাম কাজী আবদুল ওদুদ! হ্যা, তিনিই সাহিত্যিক গবেষক কাজী আবদুল ওদুদ! আব্বা তার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। সেই সুবাদে কাজী আবদুল ওদুদ সাহেব আব্বাকে বেশ কম টাকায় তার নিচতলার তিনটি ঘর ভাড়া দিয়েছিলেন। আমরা ওদুদ সাহেবকে ‘নানা’ বলে ডাকতাম। আমি তার ঘরের বইয়ের আলমারি ঘাঁটতাম, তিনি কিছুই বলতেন না। তিনি আব্বাকে বলতেন, সিদ্দিক বই ঘাঁটে, আমার যে কি ভালো লাগে দেখতে। আমার ছেলেরা তো গোমুর্খ। কাজী আবদুল ওদুদ সাহেবের বড় ছেলে বিশাল ইঞ্জিনিয়ার বোম্বাইয়ে খুব বড় চাকুরী করতেন আর ছোট ছেলে ডাক্তার!
সে বছর প্রচন্ড ঠাণ্ডা পড়েছিল। ভোরবেলা আব্বা আমাদের ডেকে তুললেন, ফজরের নামাজ পড়তে বললেন। ততক্ষণে মা একটা বালতি চুলায় পাথুরে কয়লা ঠেসে আগুন জ্বালিয়ে বড় পাতিলে পানি বসিয়ে দিয়েছেন। ফজরের নামাজ পড়ে এসে দেখি বাইরের বারান্দায় একটা জলচৌকিতে একটা সাবানদানিতে নতুন একটা সাবান আর পাশে একটা নতুন গামছা রাখা আছে।
পানি গরম হয়ে এলে আব্বা, বড় ভাই ও আমি পর্যায়ক্রমে বালতিতে ফুটন্ত গরম পানি ঢেলে তাতে ঠাণ্ডা পানি মিশিয়ে গায়ে-মাথায় ভাল করে সাবান ডলে গোছল করলাম। তারপর ঠাণ্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে পরিষ্কার করে কাচা, ইস্ত্রি করা পাজামা-পাঞ্জাবী পরলাম। একটা সোয়েটার পরার পর ঠান্ডা কিছুটা কম বোধ হল।
মা একটা বড় বাটিতে করে ফিরনি (আজকাল যাকে লোকে পায়েস বলে) নিয়ে এসে চামচে করে সবাইকে, মানে আমি, বড় ভাই ও আব্বাকে খাইয়ে দিলেন। ফিরনি রাঁধা হয়েছে তিন সের দুধের ভেতর সুগন্ধযুক্ত আধা সের পোলাওয়ের চাল জ্বাল দিয়ে। মা দুধে চাল দিয়ে ক্রমাগত নাড়ছিলেন। তিন সের তরল যখন অর্ধেক হয়ে গেল আর চালগুলো একেবারে গলে গিয়ে দুধের সাথে মিশে গেল, তখন মা সেই মিশ্রণে চিনি, গোলাপ পানি আর বাদাম কুচি করে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের মুখে মা যে ফিরনি দিলেন, সেটা দইয়ের মতো ঘন পেস্ট। এর মধ্যে আব্বা আমাদের পাঞ্জাবীতে আতর মাখিয়ে দিলেন, আমাদের টুপি ঠিক করে দিলেন, জায়নামাজ হাতে ধরিয়ে দিলেন।
আমরা দল বেঁধে ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লাই লাহা ইল্লাল্লাহু ওয়ালিল্লাহিল’ হামদ তকবির দিতে দিতে মসজিদের দিকে রওনা হলাম। কলকাতায় কেবল গড়ের মাঠ ও এর সংলগ্ন রেড রোডে বিশাল ইদের জামাত হতো। আব্বা বড় জামাতে নামাজ পড়তে যেতেন না। তবে একবার কাজী নানা (কাজী আবদুল ওদুদ) আমাদের নিয়ে গেলেন গড়ের মাঠে নামাজ পড়তে।
সে সময়ে আমাদের মুসলমানদের মধ্যে একটা কালচার ছিল, আত্মীয়-স্বজন, তা সে যত দূরের হোক, বয়সে বড় হলে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হবে। এমন কি অনাত্মীয় আব্বার অফিসের অফিসাররা বাসায় আসলে আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। নামাজ হয়ে গেলে সবাই পরষ্পরের সাথে কোলাকুলি করতো। আমরা দুই ভাই আব্বাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। আমি আমার চার বছরের বড় ভাইকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম।
বাসায় ফিরে মা ও আপাকে আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। মা ও আপা আব্বাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেন। তারপর খাওয়ার পালা। বড় ভাই কিন্তু বাইরে বেরিয়ে যেত বন্ধুদের খোঁজে। খাওয়ার তালিকায় পোলাও, গরুর গোস্ত ভুনা, খাশির রেজালা, মুরগীর কোরমা, জর্দা সেমাই, দুধ সেমাই, লাউয়ের পায়েস, নিসাস্তার হালুয়া আরও অনেক রকম হালুয়া, পায়েস রান্না হত, এক এক বছর এক এক রকম রেসিপি।
আমি খুব একটা বাইরে যেতাম না!
বিকাল থেকে আব্বার অফিসের সহকর্মীরা আসতেন বসের ‘বড় ভাই’য়ের দেখা করতে। মা তাদের আপ্যায়ন করতেন। কলকাতায় থাকতে এমন অনেক ইদ গিয়েছে, বাসা এতো অভ্যাগত আসতেন, যে তাদের আপ্যায়নের পর রাতে খেতে বসে আমরা ভাতের সাথে কেবল ঝোল দিয়ে ভাত খেতাম। একবার মা গরুর গোস্তের সাথে গাজর ও বিট দিয়ে রান্না করেছিলেন। সেবারও হাড়িতে এক টুকরা গোস্ত অবশিষ্ট ছিল না, আমরা কেবল ঝোল দিয়ে পোলাও খেয়েছিলাম। অবশ্য তাতে আমাদের মনে কোনও দুঃখ হয়নি।
মনে পড়ার মতো ইদানিংকালের একটা ইদের জামাত পড়ি আমি ২০০৮ সালের অক্টোবর মাসে। তার অল্প কদিন আগে আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলাম ওর ক্যান্সারের গতি প্রকৃতি জানতে।
ইদের দিন আমি আর আমার ছেলে সায়েম মাহমুদ, বাসার নিচের মসজিদের পাশে রাস্তায় জায়নামাজ পেতে বসেছিলাম। আমার ছেলেটা মাঝে মাঝে ডান হাত তুলে বাম কাঁধের কাছটা স্পর্শ করছিল। ওখানে ওর ক্যান্সারের যন্ত্রণাময় ক্ষতটা ছিল।
আমি আমার ছেলের পাশে চুপ করে বসে ছিলাম। কোনো কথা বলছিলাম না। কারণ মাস্টার্স পড়া ছেলেটা জানতো ওর রোগের ভবিতব্য কি, আমিও জানতাম। ওকে সান্ত্বনা দেওয়া বা কোন উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলার কোন শক্তি আমার ছিল না!
আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর ইদ সেটাই!
সে বছর ইদে আমাদের বাসায় কেউ আসেনি।