আল নাহিয়ান-এর গল্প ‘শব্দ নৈঃশব্দ’
৩ মে ২০২২ ১৭:৪৬
মেসটার নাম ‘ফার্স্টক্লাস কামরা’। কেউ একজন বহু আগে এই নাম দিয়েছিলো। অমি যখন প্রথম এই মেসে ওঠে তখন নামটা দেখে অবাক হয়েছিলো। দারুণ নামকরণ। যে এই নাম দিয়েছে তার কমনসেন্স প্রবল। পরে অবশ্য বইটই পড়ে জানতে পেরেছে নামটা সত্যজিৎ রায়ের একটা গল্প থেকে মেরে দেওয়া।
মেসের সদর দরজায় হলুদ কাগজের উপর লাল বলপয়েন্ট কালিতে লেখা। চারপাশে ফুল এঁকে ডিজাইন করা। সাধারণত মেসের দরজা বা দেওয়ালে একবার যা সাঁটানো হয় তা বছরের পর বছর অবিকল থাকে। দশ বছর আগের ক্যালেন্ডার পরম যত্নে ঝুলে থাকে। ভাতের আঠায় সেঁটে থাকা এক যুগ আগের কারিশমা কাপুর কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুবপাশের দেওয়ালে। এই মেসেও তেমন কিছু পুরনো জিনিস রয়েছে। সবচেয়ে পুরনো জিনিসটির নাম মো. দেলোয়ার তালুকদার। মেসের অনেক পুরনো দ্রব্য সামগ্রীর মতো তিনিও এখানে পরে রয়েছেন বছর বছর ধরে। মেসটাকে মেস না বলে হলঘরও বলা যায়। দুটো রুমের মাঝের পার্টিশন তুলে ফেলে রুমটাকে বড় করে দিয়েছেন মেসের মালিক। সাতজন সদস্যের প্রত্যেকে পনেরো’শ টাকা করে দিলেও দেলোয়ারকে দিতে হয় ষোলশ টাকা। বাড়তি একশ টাকা হলো তুলা কেনার জন্য। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ফার্মেসি থেকে তুলার রোল কিনে দায়িত্বটাও তারই। তুলা কেনা হয় রাতে কানে গোঁজার জন্য। দেলোয়ার ঘুমের মধ্যে উচ্চস্বরে নাক ডাকেন। সে শব্দে এক সময় রাতের বেলা মেসের কেউ ঘুমাতে পারতো না। একেকজন ফুলকপির মতো, মাথা জাগিয়ে বসে থাকতো। ঘুম-সংকট দূরীকরণের উদ্দেশ্যেই এই তুলা ব্যবস্থা। দেলোয়ার চাকরি করেন একটা ওষুধ কোম্পানিতে। এ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যাশিয়ার। আট বছর ধরে দৃঢ় সংকল্পের সাথে তিনি এই পদে আছেন। প্রোমোশন বা ডিমোশন নেই। স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকায় রাখার ইচ্ছে থাকলেও সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। গ্রামে রেখে খরচ চালাতেই খবর হয়ে যায় তার।
বেঁটে-হাড় জিরজিরে-পুষ্টিহীন গড়ন দেলোয়ারের। মুখে বারো মাসই খোঁচা খোঁচা কাচাপাকা দাড়ি। জগতের যাবতীয় বিষয়ে ওনার অসীম অনীহা। ভর দুপুরে কেউ ধোঁয়া তোলা গরম গরম বিরিয়ানী এনে দিলেও উনি শুকনো মুখে বলবেন- রেখে দাও পরে খাবো। কিংবা খেলা দেখতে গিয়ে সবাই যখন চিৎকার করছে উনি তখন ভাঙা আয়নাটা সামনে নিয়ে পাকা দাড়ি গুণছেন। এই ভিটামিনহীন লোকটির প্রতি তাই কারোরই খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই।
অমি যেদিন প্রথম এই মেসে ওঠে সেদিন দরজা খুলে দিয়েছিলো রণদ্বীপ। পুরো নাম রণদীপম দাশ। ঘরটা থেকে আগরবাতির গন্ধ আসছিলো। বোধয় কেউ জ্বালিয়ে রাখে রোজই। মেস ম্যানেজার বশির ভাইয়ের কাছ থেকে রণদ্বীপ এর আরেকটা পরিচয় পেয়েছিলো অমি। রণদ্বীপ হলো ‘বলদ’ এর সভাপতি। পরম বিস্ময়ে অমি জিজ্ঞেস করেছিলো
– বলদ কি?
– ‘বলদ’ মানে হলো বর্জ্য লঘু দল
– বর্জ্য লঘু দল কি?
– পেট খারাপ এর শালীন একটা নাম দিয়েছি ‘বর্জ্য লঘু’। রণদ্বীপ এর বারো মাসই পেট খারাপ থাকে।
বশির ভাইয়ের কথা শুনে চুপসে গিয়েছিলো রণদ্বীপ। ছেলেটা টয়লেট টিস্যুর মতো। একটুতেই গলে যায়। মেসে ওঠার পর বশির ভাইয়েরও আরেকটা পরিচয় পাওয়া গেছে। সে ‘পিসাচ’ এর প্রতিষ্ঠাতা।
– পিসাচ কি?
– পিয়ানো সাধনা চক্র। বশির ভাই বহু বছর যাবৎ পিয়ানো সাধনা করছেন। পিয়ানো বিষয়ক বহু বই ওনার সংগ্রহে আছে
– নিশ্চয়ই পিয়ানো খুব ভালো বাজান উনি!
– উনি শুধু বাজাতেই পারেন না। বাকি সব জানেন পিয়ানোর ব্যাপারে। ইতিহাস-রুপান্তর সব।
– বাদ্যযন্ত্রের ইতিহাস জেনে কি করবো? ইতিহাস কি মঞ্চে উঠে বাজানো যায়?
অমির কথা শুনে রণদ্বীপ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে লজ্জাজনক বিষয়টি তার সামনে ঘটেছে। এই ছেলেটির ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা আগে জানতে পারলে লজ্জাবতী লতার নাম হতো রণদীপম লতা।
শুক্রবার দুপুরে অমির পুরনো সহপাঠী মিলি এসে হাজির হলো ফার্স্টক্লাস কামরায়। দশ মিনিট ধরে কলিংবেল চাপছে সে। কেউ দরজা খুলছে না। পুরো মেসের অবস্থা হাইতির রাজধানী পোর্ট অব প্রিন্সের মতো হয়ে আছে। বিধ্বস্ত আর এলোমেলো। রণদ্বীপ খালি গায়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে। বশির ভাই কাপড় কাঁচছেন। টয়লেটের দরজা খোলা। উচ্চস্বরে গান গাইছেন তিনি।
সেকেন্ডহ্যান্ড জাওয়ানি
সেকেন্ডহ্যান্ড জাওয়ানি
সেকেন্ডহ্যান্ড জাওয়ানি।…
সম্ভবত গানটির এই একটি লাইনই তিনি মুখস্থ পারেন। মো. দেলোয়ার চিৎ হয়ে মুখ ডাকছেন। ইদানীং তিনি নাকের পাশাপাশি মুখও ডাকছেন। সর্দির কারণে নাক আটকে গেছে তার। গভীর রাতে বুড়ো বিড়াল কাঁদলে যেমন গোঁ গোঁ আওয়াজ হয়, দেলোয়ার সেই শব্দে মুখ ডাকছেন। পুরো মেসে কোনো খাট নেই। তোষক জাজিম পেতে বিছানা বানানো। অমি দেওয়ালে পেরেক ঠুকে হ্যাঙ্গার টাঙানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। চুন সুড়কী খসে পরছে। দেওয়ালের সুড়কীগুলো টিনএজ বালিকাদের অশ্রুর মতো। একটুতেই ঝরে পরে। মেসের মূল দরজায় সজোরে আঘাত করছে কেউ। মিলি এসেছে প্রায় পঁচিশ মিনিট। এতোক্ষণ কলিংবেলের সুইচ চেপেছে সে। ঘরে কোনো কলিংবেল না থাকায় মূলত তার আঙুলের ব্যায়াম ছাড়া আর কিছুই হয়নি। অমি দরজা খুলে দিলো।
– একটা কলিংবেল লাগাতে কতো খরচ হয়?
– জানি না রে। কখনো কলিংবেল কিনিনি। ভেতরে আয়
– আসছি। ভাংতি চল্লিশ টাকা নিয়ে নিচে নাম। রিকশায় ভাড়া দিয়ে আয়।
– আচ্ছা নামছি। কিন্তু তুই এখানেই দাঁড়া। আমি এলে ভেতরে ঢুকিস। মেসের অবস্থা যাচ্ছে তাই।
– আচ্ছা
নারীকণ্ঠ শুনে ইতোমধ্যেই মেসের চেহারা পালটে গেছে। বশির ভাই আগরবাতি জ্বালিয়েছেন। সিল্কের পাঞ্জাবির সঙ্গে সুতির গোলটুপি পরেছেন। কিন্তু হাত থেকে হুইল সাবানের গন্ধ যাচ্ছে না। এ নিয়ে তিনি কিছুটা চিন্তিত। রণদ্বীপ শার্ট গায়ে দিয়েছে। বোতাম লাগাতে পারছে না। খেয়াল করে দেখলো, শার্ট পরেছে উলটো করে। বুদ্ধি করে শার্টের উপর বিছানার চাদর জড়িয়ে চুপচাপ বসে আছে। আর এ্যাপ্লাইড কেমিস্ট্রির বই হাতে নিয়ে এ্যাডগার এলেন পো’র কবিতা পড়ছে
“And this maiden she lived no other thought
Than to love and be loved by me”
কচুরিপানার ডোবায় মৎসকন্যা থাকাটা যতোটা অস্বাভাবিক, মেসে নারী প্রবেশ ততোটাই অস্বাভাবিক। মেসটাকে আপাততভাবে ছিমছাম করা হয়েছে। নারী প্রবেশ করবে এখানে একটু পরেই। সবাই চুপচাপ। শুধু এক কোণায় শুয়ে দেলোয়ার মুখ ডেকে যাচ্ছেন। চাঁদের বুকেও কলংক থাকে। এই মেসের কলংক দেলোয়ারের মুখ ডাকার শব্দ। অমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। বশির ভাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
– কি ব্যাপার অমি, বান্ধবি চলে গেছে?
– হ্যাঁ। একটা কনটাক্ট নাম্বার নিতে এসেছিলো। আমার ফোন বন্ধ পেয়ে সরাসরি এখানে চলে এসেছে।
– গেস্টকে ঘরের বাইরে রেখেই বিদায় দিলে! এ কেমন অসৌজন্য!
– ঘরে ঢুকাবো কোন সাহসে? আপনার সেকেন্ডহ্যান্ড জাওয়ানি শুনাতে?
– দেশ থেকে কি মসলিন কাপড়ের মতো কমনসেন্সও বিলুপ্ত হয়ে গেলো নাকি? একটা গেস্টকে ঘরে বসিয়ে আমি টয়লেটের দরজা খুলে গান গাইবো এটা তুমি ভাবতে পারলে?
– আসলে তা না। ও ব্যস্ত। আরেকদিন আসবে বলেছে।
– শোনো অমি, এই দেশে ‘আরেকদিন আসবো’ আর ‘তদন্ত কমিটি গঠন’ এই দুটো জিনিসের কোনো ভিত্তি নেই।
– নাইস অবজারভেশন
– তাছাড়া আজ তোমার গেস্টকে জিলিপি খাওয়ানো যেতো। ঘরে জিলিপি ছিলো
– না থাক, বশির ভাই। তিনদিন আগের জিলিপি খাইয়ে ওকে বর্জ্য লঘু দল এর সাধারণ সম্পাদক বানাতে চাই না
বশির ভাই উঠে গিয়ে আগরবাতিটা নিভিয়ে দিলেন। রণদ্বীপ গায়ের চাদর সরিয়ে ফেলেছে। এ্যলেন পো’র কবিতা বাদ দিয়ে সে বোতল কাটতে বসে গেছে। বোতল কেটে কলমদানী বানানো হবে। মেসে সবচেয়ে উপকারী বস্তুর নাম বোতল। বোতলের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। কাটা বোতল দিয়ে এ্যাশট্রে, পানির গ্লাস, কলমদানী, ব্রাশদানী, ফুলের টব, ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট থেকে শুরু করে টয়লেটের বদনা পর্যন্ত বানানো সম্ভব। দেলোয়ার উচ্চ ডেসিবলে মুখ ডেকে চলেছেন। নিয়মিত বিরতিতে নাকও ডাকছেন অবশ্য। একবার শ্বাস নিয়ে নাক ডাকছেন। আরেকবার শ্বাস নিয়ে মুখ ডাকছেন। এই ডাকাডাকি নিয়ে প্রায়ই নানা ঘটনার জন্ম হয়। একদিন সকালে পাশের বিল্ডিংয়ের তোতামিয়া বশির ভাইকে ধরে জিজ্ঞেস করলেন
– বশির তোমরা কি প্রতি রাতে এ্যাডভেঞ্চার চ্যানেল দেখো? ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি এইসব?
– জ্বি না। আমাদের মেসে ডিশ লাইল নেই
– বিটিভি দেখো?
– জ্বি না, বিটিভি দেখি না। আমাদের মেসে টেলিভিশনই নেই।
– সেটা প্রথমবারেই বলতে পারতে। আচ্ছা যাই হোক, তাহলে তোমাদের রুম থেকে রোজ রাতে এ্যাডভেঞ্চার সাউন্ড আসে যে! বাঘের গর্জন, শেয়ালের ডাক এসব…
– হা হা হা। আমাদের দেলোয়ার ভাই নাক ডাকেন। ওই শব্দ।
এই জ্বালাতন বন্ধ করা প্রয়োজন। মসজিদে গিয়ে পানি পড়া নিয়ে আসা যেতে পারে। পানি পড়া খেলে নাক ডাকা বন্ধ হবে। এক জুম্মাবারে খতীব সাহেবের কাছে পুরো ব্যাপারটা বললো বশির ভাই। ইমাম সাহেব পানি পড়া দিলেন না। ধৈর্য ধরতে বললেন। শীতল চোখে বশির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– কোরান পাকে আছে ‘ফাসবিরু সাবরান জামিলা’ অর্থাৎ সুতরাং তুমি ধৈর্যধারণ করো পরম ধৈর্য। আপনারাও ধৈর্য ধারণ করুন। পারলে দেলোয়ার সাহেবকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। আমি দুয়া করি। এটাই আমার কর্তব্য।
বশির ভাই হতাশ হয়ে ফিরে এলেন। যেভাবেই হোক নাক ডাকার ব্যাপারটা থামাতে হবে। দেলোয়ার এই মেসের সবচেয়ে পুরানো সদস্য। তাকে বিদায় করে দেওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া মানুষটাও নীরিহ প্রকৃতির। প্রতি মাসে যাতায়াত থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে তিনি মুড়ি চানাচুর কিনে আনেন। সবাইকে ডেকে খাওয়ান। ঘর ঝাড়ু দেওয়ার দায়িত্ব মেসের সবার থাকলেও রোজ রাতে তিনি একাই কাজটা করে ফেলেন। কাজেই এই ধরণের অহিংস মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। গত সপ্তাহে অমিকে বারান্দায় ডেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলেন দেলোয়ার। তারপর বললেন, বুঝলে অমি, এই নাকডাকার কারণে আমার প্রথম বিবাহ প্রস্তাবটা ভেঙে গিয়েছিলো। মামার সঙ্গে গিয়েছিলাম ওনার শ্বশুরবাড়ি। মামার শ্যালিকার ছোট কন্যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। বিকেলে আমাকে বসার ঘরে থাকতে বলা হলো। আমার সঙ্গে একান্তে কন্যার কথোপকথন হবে। আমি তার জন্য অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করতে করতে বিছানায় শুয়ে ঘুম দিলাম। ঘুম ভেঙে কন্যার চাঁদমুখ দেখলাম না। দেখলাম মামার গোঁফমূর্তি। আমার দিকে চোখ নাক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কন্যা কই? মামা বললেন- এসেছিলো। নাক ডাকার শব্দে অভিমানী বুকে চলে গেছে। মামা অনেক কটু কথা শোনালেন। তার মধ্যে একটা ছিলো- তোর বাবাকে স্টিমার কিনতে বল। স্টিমারের হুইসেল কিনতে মানা করিস। তোকে সামনে বেঁধে ঘুম পাড়িয়ে দিলেই মামলা খালাস।
কথা শেষে আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দেলোয়ার। অমির প্রচন্ড হাসি পাচ্ছিলো। সে হাসলো না। কারো বেদনায় হাসা উচিৎ না।
অমি চাকরি খুঁজছে। পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করছে মিলি। মেয়েটা খুব পরোপকারী। রুপবতী মেয়েরা জটিল প্রকারের হয়। নিজেকে নিয়ে তারা বেশি ভাবে। মিলি তেমন না। সে সরল প্রকৃতির। অন্যকে নিয়েই চিন্তা বেশি তার। অমি সিগারেট ধরিয়ে এ্যাশট্রে খুঁজছে। ঘড়িতে বাজে সাড়ে আটটা। অমি জানে এখন কোনোভাবেই সাড়ে আটটা বাজে না। কমপক্ষে রাত একটা এখন। মেসের এই ঘড়িটায় গত দেড়মাস ধরে সাড়ে আটটা বেজে আছে। ব্যাটারির কথা সবাই ভুলে যায়। অবশ্য নিজের খাবারের কথাই যেখানে মনে থাকে না, সেখানে ঘড়ির খাবার নিয়ের ভাবার সময় কোথায়। অমির মোবাইলে কল এসেছে। মিলির কল-
– আজকের ইত্তেফাকটা কালেক্ট করে নিস। তোর জন্য সুইটেবল দু’টা ভ্যাকেন্সি দেখলাম
– তুই কালেক্ট করে রাখিস। আমার মাথায় থাকবে না
– আচ্ছা তোদের ওখানে গোলাগুলি হচ্ছে নাকি?
– উহু। দেলোয়ার ভাই নাক ডাকছেন
– বলিস কি!
ফোনটা রেখে কানে তুলা গুঁজে ঘুমাতে গেলো অমি। তার চেহারায় বিরক্তি ভাব স্পষ্ট।
ঘুম ভাঙলো রণদ্বীপের চিৎকারে।
– বশির ভাই, অমি ভাই জলদি উঠুন। দেলোয়ার ভাই কেমন যেন করছেন।
অমি হুড়মুড় করে উঠে দেলোয়ারের বিছানার দিকে গেলো। বুকে হাত দিয়ে চিৎ হয়ে আছেন দেলোয়ার। শ্যামলা চেহারা কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। মুখে কোন শব্দ নেই। চোখ অসম্ভব রকম বড় হয়ে আছে। দ্রুত কোলে করে হাসপাতালে নেওয়া হলো। দেলোয়ারের সাদাকালো স্ক্রিণের পুরনো মোবাইলটা থেকে তার মামাকে কল করা হলো। ঘন্টাখানেক পরে মামা এলেন। তার অফিসের একজন সহকর্মীও এলো, তবে চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে বিরক্ত।
আইসিইউতে আছেন দেলোয়ার। চিকিৎসক জানিয়েছে, ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক। হাসপাতালের ধকল শেষে পরদিন রাত দশটার দিকে রণদ্বীপ, বশির ভাই, অমি আর অন্যরা ফিরে এলো ফার্স্টক্লাস কামরায়। বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সবাই। কেউ ঘুমাতে পারলো না। কানে তুলা গোঁজার মতো কোন কারণ নেই।
ওনার স্ত্রী পরিজনের সঙ্গে দুয়েকটা কথা বলা দরকার। লোহার ট্রাংকটা খুলে লাল ডায়রিটা হাতে নিলো অমি। ডায়রির পাশেই এক প্যাকেট মুড়ি। আর এক প্যাকেট চানাচুর। এ সপ্তাহে সবাইকে খাওয়ানোর জন্য কিনেছিলেন বোধহয়। অমির ফোনে কল এলো। হাসপাতালে থাকা দেলোয়ারের মামা কল দিয়েছেন। ফোন হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো অমি। মামা কি বলবেন বোঝা যাচ্ছে না।
মেসের কারো চোখে ঘুম নেই। অথচ আজ সবার শান্তিতে ঘুমানোর কথা। আজ ফার্স্টক্লাস কামরা বড় নিরব।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
আল নাহিয়ান আল নাহিয়ান-এর গল্প ‘শব্দ নৈঃশব্দ’ ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ গল্প শব্দ নৈঃশব্দ সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২