Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাইফ ইমন-এর সায়েন্স ফিকশন ‘কেউ একজন’


৩ মে ২০২২ ১৮:১৩

শহরের মাঝখানে এই মুহূর্তে একটা বিশাল ভিড় জমে আছে।

মহান চিত্রশিল্পী জিটা ক্যাথরিনের কিছু বিস্ময়কর পেইন্টিং-এর প্রদর্শনী চলছে। কয়েক যুগ আগেই এক অজানা দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন জিটা। আজ এতো বছর পরও তাকে নিয়ে মানুষের প্রবল আগ্রহ। প্রতি বছর এই দিনটিতে তার পেইন্টিং-এর প্রদর্শনী হয়। তার আঁকা পেইন্টিংগুলো দেখতে শহরে প্রায় অর্ধেক মানুষ চলে এসেছে। মানুষদের চেহারায় এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। এদের মধ্যে বেশ কিছু তরুণ-তরুণী আবার হাত ধরাধরি করে মহান চিত্রশিল্পী জিটা ক্যাথরিনের ভাস্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করছে। অনেকেরই ধারণ, জিটা ক্যাথরিন ধর্মযাজক ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কখনও স্বীকার করেননি বা আদি পৃথিবীর ধর্মযাজকদের মতো ধর্ম প্রচারে নেমে পড়েননি। বাস্তবে তিনি নিভৃতচারী মানুষ ছিলেন। অনেকেই তাকে বড় মাপের দার্শনিক বলে অভিহিত করেন। তার চরিত্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতা, যখন যা মনে চাইতো তাই করতেন। আর এর জন্যই হয়তো তার জীবনে উল্লেখযোগ্য কিছু সাফল্য রয়েছে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়েতে শিক্ষকতা করেন। গণিতবিদ ছিলেন। এসময় তিনি বেশ কিছু গবেষণা করেন। তার আবিষ্কৃত জিটা ফাংশন গণিত জগতে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। তিনি মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এ বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা পত্রও তৈরি করেন। এভাবে বেশ চলছিল সবকিছু। তারপর হঠাৎ একদিন তার মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। তিনি শিক্ষকতা, গবেষণা, সব ছেড়ে ছুঁড়ে ছবি আঁকার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পরবর্তীতে আত্মপ্রকাশ ঘটে একজন মহান চিত্রশিল্পীর। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, জিটা ক্যাথরিনের আঁকা সব পেইন্টিংই স্পেস সম্পর্কিত। তিনি স্পেস নিয়ে অদ্ভুত সব ছবি এঁকে গেছেন এবং তাকে যখন প্রশ্ন করা হতো- আপনি গবেষণা ছেড়ে হঠাৎ ছবি আঁকার প্রতি ঝুঁকলেন কেন? তিনি সঙ্গে সঙ্গেই বলতেন, আমার প্রতিটা পেইন্টিংই একটা গবেষণাপত্র। পরবর্তীতে তার বিভিন্ন সময় আঁকা পেইন্টিংগুলোর ব্যাখ্যা এক একজন একেকভাবে করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় মানুষের আগ্রহ। জনশ্রুতি আছে, তার আঁকা পেইন্টিংগুলো খুব উন্নত প্রজাতির ভিনগ্রহের প্রাণীর দেয়া ধারণা থেকে নেওয়া কিংবা তার সঙ্গে অতিপ্রাকৃত কোনো কিছুর যোগাযোগ ছিল।

বিজ্ঞাপন

একটা বাচ্চা ছেলে প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝেই ঠেলেঠুলে এগিয়ে এসে একেবারে ইরনের পাশে এসে দাঁড়াল। ইরন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে মহান চিত্রশিল্পী জিটা ক্যাথরিনের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘অদৃশ্য হাত’ এর সামনে। প্রথমবার দেখে ছবিটার কিছুই বুঝতে পারেন না তিনি। একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেন। দেখা যায় আসলে ক্যানভাসে বেশ কিছু সংখ্যক লেয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। আরও একটু মনোযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন ইরন। হঠাৎ করেই তিনি বিষয়টা ধরতে পারেন। এখানে কিছু সংখ্যক নয়, অসীম সংখ্যক লেয়ার সৃষ্টি করা হয়েছে। ভালোভাবে বলতে গেলে দুইটি আয়না পরস্পরের দিকে মুখ করে একই সমান্তরালে বসিয়ে দিলে যেমন দেখা যায় সেখানে অসীম সংখ্যক জগত সৃষ্টি হয়েছে। ঠিক তেমনি রঙের ভিতর রঙ ব্যবহার করে অসাধারণ একটি পেইন্টিং তৈরি করেছেন মহান এই চিত্রশিল্পী। কিন্তু এই পেইন্টিং-এর সাথে অদৃশ্য হাত নামকরণের সার্থকতা কোথায়। আচ্ছা, এই লেয়ারগুলো কি একেকটা একেক জগত নির্দেশ করেছে? এর মাঝেই লুকিয়ে থাকতে পারে কোনো অদৃশ্য হাত। যদি অদৃশ্য কোনো হাত থেকেই থাকে, তাহলে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য একবারের জন্য হলেও দৃশ্যমান হতে হবে। ইরন দ্রুত চিন্তা করতে থাকে। তাহলে অবশ্যই লেয়ারগুলোর মাঝখানে একটা যোগসূত্র থাকতে হবে। চিন্তা ভাবনার এই পর্যায় ইরন বুঝতে পারল তার পাশে একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে এবং অর্থপূর্ণভাবে একটু পরপর চোখের কোণ দিয়ে ইরনকে লক্ষ্য করছে। ইরনের চিন্তায় বাধা পড়ল এবং কিছুটা বিরক্ত বোধ করল। বাচ্চা ছেলেটি কি তাকে চিনতে পেরেছে? এই শহরে যে অল্প কয়জন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আছে ইরন তাদের মধ্যে একজন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন জার্নালে তার ছবি ছাপা হয়। তাই লোকজন যখন তাকে চিনতে পারে এবং সমীহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তখন খুব বিব্রতবোধ করে ইরন। ইরন লক্ষ্য করে, মায়াকাড়া চেহারার বাচ্চা ছেলেটি তাকে কিছু বলতে চায়। তাই ইরন ভণিতা না করে সরাসরি বলে ফেলে,

বিজ্ঞাপন

তুমি কি কিছু বলবে?

ছেলেটি এবার পূর্ণদৃষ্টিতে তাকায় ইরনের দিকে। চোখেমুখে একধরণের বিস্ময়, আমার নাম রাশা।

আচ্ছা, রাশা, কিছু বলবে?

আমি বিভিন্ন বইপত্রে পড়েছি যে তুমি অনেক বড় বিজ্ঞানী। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি। কিন্তু তোমার বাসার নিরাপত্তা কর্মী রোবটগুলো আমাকে ঢুকতে দেয়নি। আমার অনেক রাগ হয়েছিল। ইচ্ছে করছিল মেটাকোড ব্যবহার করে বোকা রোবটগুলোকে অকেজো করে দেই কিন্তু এটা বেআইনি। তাই মেটাকোড ব্যবহার করিনি।

একটু চমকে গেল ইরন। বলে কী এই ছেলে, সে মেটাকোড জানে! অবাক ব্যাপার! ইরন বলল, তুমি মেটাকোড জানো? কিন্তু কিভাবে?
তোমার বাসার ওই তৃতীয় মাত্রার নিরাপত্তা কর্মী রোবটগুলোর মূল ডিজাইনে কিছু ত্রুটি আছে। তাদের কপোট্রনের বাইরের সেল দুটো ক্রস কানেক্টেড এবং আমি সহজেই রোবটগুলোর মেটাকোড বের করে ফেলেছি।

ইরন একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল ছেলেটির দিকে। এই বাচ্চা ছেলেটি সামনে আর কী কী বিস্ময় উপহার দেবে তার জন্য অপেক্ষা।

ছেলেটি বলতে থাকে, আমার কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এ খুবই আগ্রহ। আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে মজাদার সব বৈজ্ঞানিক গেম তৈরি করার চেষ্টা করছি। সেদিন আমার বন্ধুটি একটি গেমের আইডিয়া জানায় কিন্তু সেখানে একটু সমস্যা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে দুইটি বই ‘ঠ’ আকৃতিতে রাখলে সেখানে যে খাঁজ তৈরি হয় তার মাঝে বেশ কয়েকটা মার্বেল রাখলে একপাশ থেকে একটা মার্বেল ঠোকা দিয়ে গড়িয়ে দিলে অন্য পাশ থেকে একটা মার্বেল বের হবে। এভাবে দুইটি দিয়ে ঠোকা দিলে দুটি, তিনটি ঠোকা দিলে তিনটি মার্বেল বের হবে। কিন্তু এর লজিকটা ধরতে পারছি না। তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?

এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে বাচ্চা ছেলেটির কথা শুনছিল ইরন। বাচ্চা ছেলেটি যে খেলার কথাটি বলছে তা আসলে একটি ছোট খাটো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা। কিন্তু পরীক্ষা ক্ষুদ্র হলেও এর থেকে পদার্থ বিজ্ঞানের দুটি বিখ্যাত সূত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়। আর তা হলো ভরবেগ ও শক্তির কোনো ক্ষয় নেই। ইরন একটু চিন্তা করে বলতে শুরু করে, এক্ষেত্রে তোমাকে দুটি জিনিস জানতে হবে আর তা হলো ভরবেগের নিত্যতাসূত্র আর শক্তির নিত্যতাসূত্র। ভরবেগের নিত্যতাসূত্রটি হলো একাধিক বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো বল কাজ না করলে কোনো নির্দিষ্ট দিকে তাদের মোট ভরবেগের কোনো পরিবর্তন হয় না। মনে কর, একটা মার্বেল দিয়ে ঠোকা দিয়ে তুমি দুটি মার্বেল বের করেছ। এক্ষেত্রে মার্বেলের ভর ‘স’ এখানে শুরুতে বেগ হবে ‘া’ এবং বের হওয়া মার্বেল দুইটির গতিবেগ ‘া’। ভরবেগের নিত্যতার সূত্র অনুযায়ী সেটি পরিবর্তিত হবে না, কাজেই, সা=(স+স) ঁ. এখান থেকে পাওয়া যায় ঁ=া/২, প্রথমে একটা মার্বেল গতিশক্তি সা২/২, পরে দুটো মার্বেল মোট গতিশক্তি হয় (স+স)ঁ২/২। এখন ঁ এর জায়গায় া/২ বসালে মোট গতিশক্তি হয় সা২/৪, যা আগের গতিশক্তির অর্ধেক। যা শক্তির নিত্যতাসূত্রের বিরোধী। দেখা যাচ্ছে, ভরবেগের নিত্যতাসূত্র সত্যি হলে শক্তির নিত্যতাসূত্র সত্যি হতে পারছে না। কাজেই একটি মার্বেল দিয়ে কখনই দুটি মার্বেল বের করতে পারবে না।

ছেলেটি মাথা নেড়ে জানালো যে সে বুঝতে পেরেছে।

এসময় ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন মহিলাকে ছুটে আসতে দেখা যায়। মহিলাটি এসে রাশাকে বলল, রাশা, তুমি কিন্তু অনেক দুষ্টু হয়েছে। কথা দিয়েছিলে তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। এই শর্তেই তোমাকে আজ এখানে নিয়ে এসেছি।

রাশা উত্তেজিত হয়ে বলল, মা আমি তোমাকে কতবার বলেছি যে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না। দেখো আমি কার সাথে কথা বলছি। তখন মহিলাটি রাশার পাশে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞানীদের একজন, মহামান্য ইরন।

মহিলাটি উত্তেজিত হয়ে বলল, আমার নাম টিনা, রাশা আমার ছেলে। রাশা তাহলে ঠিকই বলেছিল যে আজ আপনি এখানে আসবেন। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যই রাশা আমাকে প্রায় জোর করে নিয়ে এসেছে।

এবার ইরনের অবাক হওয়ার পালা। সে আজ এখানে আসবে এটাতো এই বাচ্চা ছেলেটির জানার কথা নয়। অবস্থা বুঝতে পেরে টিনা নামের মহিলাটি আবার বলতে শুরু করে, আসলে আমার ছেলেটির বিজ্ঞানের প্রতি প্রচুর আগ্রহ। আর সেখান থেকেই আপনার প্রতি ওর আগ্রহ জন্মায়। তার ধারণা আপনার সাথে দেখা হলেই নাকি আপনি ওর সব সমস্যার সমাধান করে দেবেন। আমি বেশ কিছুদিন আগে কথায় কথায় বলেছিলাম যে, আপনি স্পেস সমীকরণ নিয়ে কাজ করছেন। আর মহান চিত্রশিল্পী জিটা ক্যাথরিনও যেহেতু স্পেস নিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন। তাই থেকে রাশা ধারণা করে নিয়েছে আজ আপনি এখানে অবশ্যই আসবেন।

অকাট্য যুক্তি মেনে নিয়ে ইরন প্রশ্ন করে, আমি স্পেস সমীকরণ নিয়ে কাজ করছি এ কথা তোমাকে কে বলল?

আমি পেশায় সাংবাদিক। তাই আমাকে অনেক কিছু জানতে হয়।

আচ্ছা, আচ্ছা। তোমার ছেলেটি অসম্ভব বুদ্ধিমান আর মেধাবী। আমি যে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সির কম্যুনিকেটর ব্যাবহার করি তার কোড নাম্বার দিয়ে যাচ্ছি। এখন রাশা যখনই চাইবে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।

টিনা ও তার ছেলে রাশা খুবই খুশি হলো। তারা ইরনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এই সময় ইরনের ব্যক্তিগত বাইভার্বালটি এসে থামল। তিনি বাইভার্বালটিতে উঠে বসলেন। সাথে সাথেই সবুজ আলো জ্বালিয়ে বাইভার্বালটি চলতে শুরু করে।

দুই.

ইরনের বাড়িটা প্রকাণ্ড এবং শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা চারপাশ। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচুর গাছপালা। ইরন নিঃসঙ্গ। তার এই সুবিশাল বাড়িতে তিনিই একমাত্র মানুষ। হঠাৎ একদিন কবুতর পোষা শুরু করলেন। তার সংগ্রহে প্রায় দু’হাজার কবুতর আছে। যখন খুব মন খারাপ থাকে তিনি কবুতরগুলোর কাছে চলে আসেন। প্রায় দুই হাজার কবুতর তাকে ঘিরে উড়তে থাকে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় কবুতরগুলো ইরনকে নিয়েই উড়ছে। তার মন ভালো হয়ে যায়। এই বাড়িতে পাঁচটি রোবট আছে। সবগুলোই কর্মী রোবট। এদের মধ্যে দুটি রোবট নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত হয়। আর দুটি রোবটের একটি রোবট ব্যবহৃত হয় রান্নার কাজে। অপর একটি রোবট কবুতরগুলোর দেখাশোনা করে। এদের সবার বুদ্ধিমত্তা নিচুস্তরের। এছাড়াও একটি রোবট আছে, নাম কার্বোডো। তাকে আনা হয় ইরনের সহকারী হিসেবে। কার্বোডোকে বেশ পছন্দ করেন তিনি। এই রোবটটি খুব গুছিয়ে কাজকর্ম করে। সারাক্ষণ ইরনের কাছাকাছি থাকে। বুদ্ধিমত্তা উঁচুস্তরের। তবে একটু ছেলেমানুষি ভাব আছে রোবটটির মাঝে।

লোহার ভারি গেট দিয়ে প্রবেশ করলেন ইরন। কার্বোডো ছুটে এসে কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু তিনি সে সুযোগ দিলেন না। সরাসরি চলে গেলেন শোবার ঘরে। জামা-কাপড় পাল্টে রাতের পোশাক পরলেন। খাবার পাঠিয়ে দিতে বললেন এবং কড়া গলায় হুকুম দিলেন, কেউ যেন আজ রাতে তাকে বিরক্ত না করে। যথা সমেয় রাতের খাবার শেষ করে তিনি প্রবেশ করলেন লাইব্রেরি ঘরে। এই ঘরেই তিনি রাতের পর রাত জেগে গবেষণা করেন। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন স্পেস সমীকরণ নিয়ে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একই সাথে খুবই সরল এবং খুবই জটিল। জটিল অংশ দিয়ে শুরু করলে দেখা যায় শেষ হয় এক সরল রেখায়। আবার সরল অংশ দিয়ে শুরু করলে ক্রমাগত জটিল হয়ে আসে বিষয়বস্তু। এই মুহূর্তে তিনি জটিল অংশে আছেন এবং আশা করছেন সরল রেখায় পৌঁছানোর। তিনি স্পেস সমীকরণ সমাধানের খুব কাছাকাছি আছেন। অবচেতন মনের কাছে সমাধান চলে এসেছে। তিনি বুঝতে পারছেন মস্তিষ্ক প্রচুর কাজ করছে। খুব শীঘ্রই সমাধানটি তার চেতন মনের কাছে চলে আসবে। চলমান সময়ের ক্ষেত্রে স্পেস সমীকরণের সাধারণ একটি সমীকরণ আছে, আর তা হলো

ী=অ(ী)+ই(ঁ)
ু=ঈ(ী)+উ(ী)

এখানে লিনিয়ার সিস্টেমে অ, ই এবং ঈ হচ্ছে ম্যাট্রিক্স। আর উ হচ্ছে মহাকাশের সকল ধরনের বস্তুকণা থেকে ক্রমান্বয় পাওয়া তরঙ্গ। এই তরঙ্গ সংখ্যা অসীম হওয়ায় এতদিন উ এর মান শূন্য ধরা হয়েছে। কিন্তু ইরন প্রতিনিয়ত বিচ্ছুরিত হওয়া এই বিভিন্ন দৈর্ঘ্যরে তরঙ্গগুলো ফুরিয়ার সিরিজ দিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্টিকেলে ভাগ করেন। যেহেতু প্রতিটি তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য আলাদা আলাদা, এখানে তিনি জিটা ফাংশন ব্যবহার করেন এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, এখানে একটি সূক্ষ্ম যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। তখন তিনি উ এর মানের ক্ষেত্রে ঝওঝঙ সিস্টেম নিয়ে আসেন। মূল সমীকরণটির ু এবং ঁ স্কেলার রাশি এবং লেন্থ ী হচ্ছে ভেক্টর রাশি। সেই সাথে যেই নতুন সমীকরণটি দাঁড়ায় সেখানে উ-এর মান আর শূন্য থাকে না। কিন্তু ইরন অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন বর্তমান সমীকরণটি সম্পূর্ণ উ বর্জিত।

তিনি দ্রুত চিন্তা করতে লাগলেন। এরকম হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি যেখান থেকে শুরু করেছিলেন। সেখানেই এসে থেমেছেন। কোথাও একটা বড় ভুল হচ্ছে এবং এই ভুলের জন্য অবশ্যই তিনি দায়ী নন। তবে কে দায়ী! তার অজান্তে কি কেউ এই ঘরে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়। না কি তিনি নিজের অবচেতন মনেই ভুলটা করেছেন। অনেক ভেবেও যখন কোনো কুল কিনারা করতে পারলেন না, আবার নতুন করে শুরু করলেন। হঠাৎ করেই তার মনে হলো। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বলে আসলে কিছু নেই, স্পেস বলতে কিছু নেই। ইরন নামের একটি মানুষের দেহে আটকা পড়ে রয়েছে তার আত্মা। এই বিশ্ব জগত পুরোটাই এক ধরনের ভ্রম, মায়ার জগত। ঠিক এভাবেই চিন্তা করতেন জিটা ক্যাথরিন। সবাই বসবাস করছে শূন্যের ভেতর। তাহলে এই সৃষ্টির জগতের উদ্দেশ্য কী। ক্রমান্বয়ে অস্থিরতা বাড়ছে ইরনের। তিনি এই অস্থিরতার ধরন জানেন। এ অন্যরকম অস্থিরতা। তিনি কি ঔষধ খেয়ে নিজেকে শান্ত করবেন? না, তার প্রয়োজন নেই। অস্থিরতার প্রয়োজন আছে। বিজ্ঞানের একটি বড় আবিষ্কারের মুখোমুখি তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। স্পেস সমীকরণের সমাধান। এর ফলাফল কি শুভ হবে? মানবজাতি কি উপকৃত হবে? না কি এই বিশ্ব জগত ধ্বংস হয়ে যাবে? এই মুহূর্তে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তিনি দ্রুত সমীকরণ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ঠিক এই সময় বিকট শব্দে আশ পাশে কোথাও একটা বজ্রপাত হলো। হঠাৎ করেই তুমুল ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শো শো শব্দে ঝড়ো বাতাস বইছে। আচ্ছা, কবুতরগুলো কি ঘরে ফিরেছে।
ইরনের ভ্রু কুঞ্চিত হলো।

তিন.

সাদা মলাটের চারশ পৃষ্ঠার একটি ডায়েরি। মহান চিত্রশিল্পী জিটা ক্যাথরিনের নাম সই করা রয়েছে মলাটের উপর। ইরন হাতে তোলে নিলেন ডায়েরিটি। তিনি এখন অবস্থান করছেন জিটা ক্যাথরিন স্মৃতি জাদুঘরে। জিটা ক্যাথরিন একসময় এই বাড়িতেই বসবাস করতেন। তার মৃত্যুর পর বাড়িটিকে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জিটা ক্যাথরিন ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা হয়েছে বাড়িটিতে। তার সম্পর্কিত একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ঝুলানো হয়েছে মূল ফটকের সামনে। এই স্মৃতি জাদুঘরটি পরিচালনা করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইরন সেই কমিটির কাছে আবেদন করে জিটা ক্যাথরিনের ব্যক্তিগত ডায়েরিটি কিছুদিনের জন্য চেয়ে নিয়েছেন। ইরন ছাড়া অন্য কেউ চাইলে কখনই কমিটি সায় দিত না। কিন্তু ইরনের কথা আলাদা। ডায়েরিটি হাতে নিয়ে ইরন বের হয়ে আসেন স্মৃতি জাদুঘর থেকে। নিজের বাসায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই কার্বোডোর সাথে দেখা হয়ে যায় ইরনের।

কার্বেডো বলল, মহামান্য ইরন, একটা দুঃসংবাদ আছে। আপনি অনুমতি দিলে বলতে পারি।

কি দুঃসংবাদ?

গতরাতের ঝড়ে বাগানের দুটি গাছ পড়ে গেছে।

ও আচ্ছা।

আমি নগর কেন্দ্রে যোগাযোগ করেছিলাম। সেখান থেকে কিছু রোবট পাঠাবে বলেছে।

যা ইচ্ছা হয় করো। আমাকে এর মধ্যে জড়াবে না। এই বলে ইরন সরাসরি তার লাইব্রেরিতে চলে গেলেন।

কার্বেডো আরও কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু ইরনের তাড়াহুড়ো দেখে আর কিছুই বলতে পারল না। সে চুপচাপ বাগানের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল।

ইরন যেই উত্তেজনায় লাইব্রেরিতে প্রবেশ করেছিলেন। এখন তারচেয়েও বেশি মুষড়ে পড়েছেন। মাত্র গতরাতেই সে সবকিছু ঠিক ঠাক করে নতুনভাবে শুরু করেছিলেন। এখন এসে দেখেন কিছুই ঠিক হয়নি। সব ভুলে ভরা। আবার নতুনভাবে সমীকরণটি শুরু করতে হবে। এ কী হচ্ছে তার সাথে। আর কেনই বা এমন হচ্ছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না ইরন। তিনি শোবার ঘরে চলে গেলেন। এই মুহূর্তে তার মেজাজ আকাশে চড়ে রয়েছে। স্পেস সমীকরণের সমাধানের আগে তাকে এই রহস্যের সমাধান করতে হবে। আর তা না হলে কখনো স্পেস সমীকরণের সমাধান করা যাবে না। ইরনকে প্রায় উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে এখন। চোখে কেমন যেন ঘোর লাগা দৃষ্টি। হঠাৎ অসুস্থ বোধ করলেন তিনি। স্মৃতি জাদুঘর থেকে আনা ডায়েরিটা হাতে নিয়ে শুয়ে পড়লেন।

চার.

ইরন একমনে পড়ে যাচ্ছেন ডায়েরিটি। বাক্যে প্রচুর অলংকার ব্যবহার করা হয়েছে। মূলভাব অনেকটা রূপক ভাষায় লেখা। জিটা ক্যাথরিন তার গবেষণার প্রায় সম্পূর্ণ অংশটুকুই তোলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে তিনি তার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। বেশ স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন তিনি স্পেস সমীকরণ সমাধান করতে গিয়ে বারবার বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছেন। একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজের উপর। কোনো এক অজানা কারণে সারা জীবন নাস্তিক থাকার পর হঠাৎ করেই ধর্মকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি বেশ প্রাচীন কিছু ধর্মগ্রন্থের কথা উল্লেখ করেন। পুরো ডায়েরিটার মাঝে মাঝেই সেসব ধর্মগ্রন্থের অংশবিশেষ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কোথায় যেন একটা জট পাকিয়ে গেছে। ইরন কিছুতেই তা ধরতে পারছেন না। তবুও তিনি চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। আচ্ছা, এমনকি হতে পারে যে পুরো বিষয়টাই অত্যন্ত সরল। কিন্তু তিনি জটিলভাবে চিন্তা করছেন। আর যদি তাই হয়। তাহলে মূল বিষয়টা তিনি ধরতে পারবেন না। ইরন আবার প্রথম থেকে পড়া শুরু করলেন। ডায়েরিটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রকৃতি’। তা নিম্নরূপ,
‘প্রকৃতি’

‘…প্রকৃতি অপার রহস্যের আঁধার।
ক্ষুদ্র কীটের গোলক ধাঁধা রয়েছে চারপাশে।
এই জাল ছিন্ন করা অসম্ভব এর মাঝে রহস্যের সৃষ্টি।
এর মাঝেই রহস্যের শেষ। প্রকৃতি অপার রহস্যের আঁধার।
রহস্য অনাবৃত নয়। চিরকাল তাই থাকবে।
এখানে যুক্তিবিদ্যা কার্যহীন।
অতীত, ভবিষ্যত, বর্তমান একই বিন্দুতে সৃষ্টি।
একই বিন্দুতে শেষ।
অসীম থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিন্দু আবার তা অসীমেই ফিরে যাবে।
প্রকৃত অপার রহস্যের আঁধার।
রহস্য প্রকৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
এখানে যুক্তিবিদ্যা কার্যহীন।
রহস্য অনাবৃত নয়।
যুক্তিবিদ্যা রহস্য দ্বারা আবৃত…’

এই জায়গায় এসে তিনি গভীরভাবে মনোযোগ দিলেন। এখানে যুক্তিবিদ্যার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে যুক্তি থেকে। বলা হচ্ছে, যুক্তিবিদ্যা রহস্য দ্বারা আবৃত। তার মানে হচ্ছে যুক্তির মাঝে রহস্যের বাস কিংবা রহস্যের মাঝেই যুক্তির বাস। তা হলে এখানে প্রকৃতির স্থান কোথায়? তিনি আবার পড়লেন, প্রকৃতি অপার রহস্যের আঁধার। রহস্য প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে প্রকৃতি রহস্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আবার রহস্যর মাঝেই যুক্তির বাস। তার মানে কি এই যে যুক্তির সৃষ্টি হয়েছে রহস্য থেকে আর যেহেতু রহস্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে প্রকৃতি। তাহলে বলা যায় যুক্তিবিদ্যা প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জিটা ক্যাথরিন লিখেছিলেন স্পেস সমীকরণের সমাধান করতে গিয়ে তিনি বার বার বাঁধা প্রাপ্ত হয়েছেন। এই বাঁধা তাহলে কে সৃষ্টি করেছে? ইরনের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ব্যাপার হচ্ছে। তিনি বাঁধা প্রাপ্ত হচ্ছেন। সম্পূর্ণ অজানা কারণে স্পেস সমীকরণ নিয়ে ভুলের দিকে এলিয়েছেন। প্রতিবারই তাকে নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। তার মানে কী এই যে তার সকল যুক্তি, চিন্তা ভাবনা কারোও দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কেউ একজন আছে যে চায় না স্পেস সমীকরণের রহস্য সমাধান হোক। বলা হয়েছে রহস্য অনাবৃত নয় এবং চিরকাল তাই থাকবে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত একই বিন্দুতে সৃষ্টি এবং একই বিন্দুতে শেষ। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে বিন্দু থেকে, বিগব্যাং- এর মাধ্যমে। তাহলে কী এই বিন্দুকে স্পেস বলা হচ্ছে। আরও বলা হয়েছে অসীম থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিন্দু এবং তা অসীমেই ফিরে যাবে। অসীমকে যদি শূন্য ধরা হয় তাহলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকে এবং তা শূন্য দিয়েই শেষ হবে। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে। কেউ একজন চাচ্ছে না স্পেস সমীকরণের সমাধান হোক। চাচ্ছে না যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ হোক এই মহাবিশ্ব বলতে আসলে কিছু নেই, সবই শূন্য এবং শূন্য দিয়েই ঘেরা। সেই সঙ্গে স্পেস সমীকরণের কৃত্রিম ভুল তৈরি করছে বারবার।
এই কেউ একজনটা আসলে কে, সে কি প্রকৃতি!

ধীরে ধীরে সকলে রহস্যের জট খুলতে শুরু করছে। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। ঘোর কেটে যাচ্ছে। পরিষ্কার হয়ে হয়ে আসছে চিন্তা ভাবনা। তিনি ঠিক করলেন কার্বোডোকে আসতে বলবেন। এই মুহূর্তে তার ভীষণ কফি পান করতে ইচ্ছা করছে, তিনি কার্বোডো কে কফি নিয়ে আসতে বললেন। কিছুক্ষণের মাঝেই কার্বোডো কফি নিয়ে আসলো। কার্বোডোর ভেতর তেমন কোন মানবিক অনুভূতি দেওয়া হয়নি। যদি তা থাকতো তাহলে সে খুবই আনন্দিত হতো। শুধুমাত্র অপ্রয়োজনীয় কিছু অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ করেছে তার। প্রসেসরটি এভাবেই প্রোগ্রামিং করা হয়েছে। তার সীমাবদ্ধ অনুভূতি দিয়েই সে কাজ চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রায়ই জায়গামতো সঠিক অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। দেখা যাচ্ছে মহামান্য ইরন এখন তার সাথে আলোচনা করতে চাচ্ছেন, এই বিষয়টি সে উপভোগ করে। এসময় তার আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে মহাবিরক্ত। প্রাণপণে চেষ্টা করে যেতে থাকে বিরক্তিটা ধরে রাখার।

কার্বোডোর অবস্থা বুঝতে পেরে ইরনের হাসি পেয়ে যায়। মহামান্য ইরনের হাসি দেখে কার্বোডো সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যায় সে ভুল জায়গায় ভুল অনুভূতি প্রকাশ করেছে। প্রায়ই তাকে এ রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অসহায় বোধ করতে থাকে সে।

ইরন কফির মগে চুমুক দিয়েই আনন্দিত গলায় বললেন, বাহ্ আজকের কফিটাতো অসাধারণ হয়েছে।

ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের কফি। কৃত্রিম নয়। তা ছাড়া আমাদের ক্রিকি খুব ভালো কফি বানায়।

ক্রিকি কে?

স্যার আপনার জন্য রান্নাবান্না করে যে রোবটটি, তার নাম ক্রিকি। আপনি প্রতিবারই ওর নাম ভুলে যান। এতে ক্রিকি মনে মনে কষ্ট পায়।

বাজে কথা বলো না। ওর অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ নেই।

তা, নেই। কিন্তু কিছু একটা হয়। যা হয়তো অনুভূতি নয়। অন্যকিছু।

অন্যকিছু! এই অন্যকিছুটা কি?

তা আমি জানি না স্যার। আমার জানার কথা নয়।

তা ঠিক। তোমার জানার কথা নয়।

স্যার আপনি কি স্পেস সমীকরণ সমাধান করে ফেলেছেন?

না, এখনও শেষ করিনি। তবে খুব শীঘ্রই শেষ করবো। আর শুধু অল্প কিছু সিঁড়ি বাকি। যেকোনো মুহূর্তেই আমি সিঁড়িগুলো টপকে যাব।

আমি ভেবেছিলাম। আপনি স্পেস সমীকরণ সমাধান করে ফেলেছেন।

তোমার এরকম মনে হলো কেন?

কারণ, আপনি যখন কোনো বিষয় নিয়ে কাজ শেষ করেন। তখনই আমাকে কাছে ডেকে নেন এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এসময় আপনি আনন্দিত ভঙ্গিতে কফি খেতে পছন্দ করেন। আমি আপনার সঙ্গে অনেকদিন থেকেই আছি। তাই আমি এ সকল লক্ষণের সঙ্গে পরিচিত।

বাহ্ তুমিতো খুব গুছিয়ে কথা বলো।

ধন্যবাদ স্যার। কিন্তু এ কথা আপনি আমাকে বহুবার বলেছেন,

তাই নাকি! আশ্চর্য তো আমার একটুও মনে নেই।

স্যার আমার মনে হয় আপনার মাথায় এখন স্পেস সমীকরণ ঘুরছে। তাই অন্যকিছুকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

হ্যাঁ, আমি স্পেস সমীকরণ নিয়েই ভাবছি। প্রচুর ভাবছি। তুমি এই ডায়েরিটা নাও। মহান চিত্রশিল্পী জিটা ক্যাথরিনের ব্যক্তিগত ডায়েরি। পড়ে কি বুঝলে আমাকে বলো। কার্বোডো ডায়েরিটা নিয়ে পড়তে শুরু করে। রোবটের বই পড়ার প্রক্রিয়াটি খুবই বিচিত্র। মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় কার্বোডো বইটি শেষ করে বলল, এখানে প্রকৃতিকে ঈশ্বর বলা হয়েছে।

প্রকৃতিকে ঈশ্বর কোথায় বলল?

রূপকের মাধ্যমে বলেছে। ঈশ্বর না হয়ে কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর কথাও তো বলতে পারে। যারা অনেক বুদ্ধিমান। অনেক উন্নত।

হতে পারে স্যার আমার জ্ঞান সীমাবদ্ধ।

এমনও তো হতে পারে তুমি যাকে ঈশ্বর বলছো আমি যাকে বলছি উন্নত মহাজাগতিক প্রাণী, দু’জনে একই।

সেই সঙ্গে এটাও হতে পারে যে সে নিয়ন্ত্রণ করছে এই মহাবিশ্ব।

কার্বোডো, তোমার বুদ্ধি ভালো। বেশ ভালো। কিন্তু আমরা যেভাবে চিন্তা করছি তা না হওয়ারও সম্ভাবনা আছে। মহামান্য জিটা ক্যাথরিন এ ব্যাপারে একটি পেইন্টিং করে গেছেন, নাম অদৃশ্য হাত। সেখানে চমৎকার রঙের ব্যবহারে অসীম সংখ্যক লেয়ার সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিটি লেয়ার নির্দেশ করছে একেকটি স্বতন্ত্র জগত। তখন আমি ‘অদৃশ্য হাত’ নামক পেইন্টিংটার কিছুই বুঝিনি। এখন অনেক কিছুই স্পষ্ট হয়ে আসছে। একটি লেয়ারের ভিতর আরেকটি লেয়ার এভাবে অসীম সংখ্যক লেয়ার। ঠিক তেমনি একটি জগতের ভিতর আরেকটি জগত এভাবে অসীম সংখ্যক জগত কি হতে পারে না? দুটি আয়না পাশাপাশি সমান্তরালে রাখলে ঠিক এই ব্যাপারটি ঘটে। এমন কি হতে পারে একটি জগত নিয়ন্ত্রণ করছে তার ভেতরে অবস্থিত জগতটিকে। আবার ঠিক এই জগতটি নিয়ন্ত্রণ করছে তার ভেতরে অবস্থিত আরেকটি জগতকে। যে কারণে পেইন্টিংটির নামকরণ করা হয়েছে ‘অদৃশ্য হাত’।

একইসঙ্গে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে।

তুমি ঠিকই বলেছ। বেশ কয়েকটি সম্ভাবনা। তুমি কি বুঝতে পারছো আমি কী করতে যাচ্ছি।

আপনি কী ক্যাটাসট্রপি থিওরির কথা বলছেন।

হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি ক্যাটাসট্রপি থিওরির কথাই বলছি। যেখানে বিচ্ছিন্ন সরবরাহকৃত তথ্য থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তর পাওয়া যায়। বীজগাণিতিক অন্তরক ট্রপলজি ও গতিময় সিস্টেমতত্ত্ব মিলে একটি সমন্বয় সৃষ্টি করা যায়। আবার শক্তির মতো আপেক্ষককে গ্র্যাডিয়েন্ট হিসেবেও দেখা যায়। কার্বোডো, আমি স্পেস সমীকরণ সমাধানের খুবই কাছাকাছি।

এমন সময় ইরনের কম্যুনিকেটরে কেউ একজন যোগাযোগ করে। অপরিচিত ফ্রিকোয়েন্সি। ইরনের চিন্তায় বাঁধা পড়ে। তিনি বিরক্তি নিয়ে কম্যুনিকেটরটি হাতে তুলে নিলেন।

আমি রাশা বলছি।

কী ব্যপার রাশা তুমি কেমন আছ?

ভালো। আমি কি তোমাকে বিরক্ত করলাম।

কিছুটাতো করেছই। কিন্তু এখন তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভালোই লাগছে।

আগামীকাল আমার জন্মদিন। তুমি যদি আমার বাসায় আসো আমি খুবই খুশি হব এবং এটা হবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ জন্মদিন।

তাই। খুবই ভালো কথা রাশা। কিন্তু আমিতো কারও বাসায় কখনও যাই না। তাছাড়া আমি একটা কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত আছি। এটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না ঠিক করেছি, আর কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

রাশার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়,

-তুমি যদি আগামীকাল না আসো তবে আমি সারাদিন না খেয়ে থাকব।

-বুঝতে চেষ্টা করো রাশা। আমি আগামীকাল আসতে পারব না। আমার পক্ষে এখন কোথাও যাওয়া প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। তোমার প্রতি জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইল।

রাশা হয়তো আরও কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু তার আগেই ইরন কম্যুনিকেটরটা বন্ধ করে দিলেন। তার পর পরই ইরনের মনে হলো বাচ্চা ছেলেটির সঙ্গে এমন আচরণ না করলেই পারতেন। বেচারা কত আশা নিয়ে তাকে জন্মদিনের নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল। অথচ তিনি উল্টো ছেলেটির মন খারাপ করিয়ে দিলেন। এছাড়া তার কিছু করারও ছিল না। তিনি এসব চিন্তা আপাতত বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সকল চিন্তা কেন্দ্রীভূত করতে চাইছেন শুধু একটি বিষয়ের উপর।

স্পেস সমীকরণের সমাধান।

পাঁচ.

ইরন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছেন দুই হাজার তলা একটি বিল্ডিংয়ের রাশার এপার্টমেন্টের মূল দরজার সামনে। রাশার বাসা খুঁজে পেতে কষ্ট হয়েছে। তিনি চাইলেই যে কারও সাহায্য নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। নিজেই কষ্ট করে খুঁজে বের করেছেন। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন একটি নতুন তৃতীয় মাত্রার রোবট। কিছুক্ষণ আগেই একটি নামকরা রোবটিক্স কোম্পানির কাছ থেকে কিনেছেন রোবটটিকে। রাশাকে জন্মদিনের উপহার দেবার জন্য। রোবটটির বিশেষত্ব হচ্ছে এটি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ব্যবহার উপযোগী। তার উপর রোবটটি গণিত ও বিজ্ঞানে এক্সপার্ট। রাশা চাইলেই গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে যে কোনো কিছু জেনে নিতে পারবে। এ ধরনের রোবটগুলোর লজিক ইউনিট বেশ উন্নত। রাশা নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। হঠাৎ এপার্টমেন্টের দরজাটা খুলে গেল এবং সেখান থেকে একটি মুখ বেরিয়ে এলো।

অপূর্ব সুন্দর একটি মেয়ে বলল, কেমন আছো ইরন?

ইরন এতক্ষণ ভালোই ছিল কিন্তু এখন এই মেয়েটিকে দেখার পর থেকেই তার মনের অবস্থা বড়ই নাজুক। মেয়েটিকে চিনতে পেরেছে সে। মেয়েটির নাম ফ্রিয়া। ছিপছিপে গড়নের অপূর্ব সুন্দর মেয়েটি একটু মিষ্টি হেসে আবার প্রশ্নটি করল। ইরন থতমত ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে চাইছেন। আজ এতোবছর পর ফ্রিয়ার সঙ্গে দেখা হবে তিনি কোনদিনই ভাবেননি।

-ভালো। তুমি কেমন আছ?

-ভালো।

-ভেতরে এসো।

-আমি আসলে রাশা নামের একটি ছেলের বাসায় এসেছিলাম।

-তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছ। রাশা আমার বোনের ছেলে।

-ও আচ্ছা।

বাসার ভেতরটা বেশ পরিপাটি করে সাজানো এবং কিছুটা নির্জন। তিনি ভেবেছিলেন রাশার জন্মদিনে তার অনেক বন্ধুবান্ধব নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু তেমন কাউকে দেখা গেল না। ভালোই হলো তিনি নির্জনতা পছন্দ করেন। আজ এখানে মোটেও আসার কথা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই মনে হলো বাচ্চা ছেলেটির জন্য তার মন খারাপ লাগছে একেবারে শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আসবেন। স্পেস সমীকরণের সমাধান কিছুটা পরে হলেও তো কোনো ক্ষতি নেই। আর তিনি আজ আসাতেই তো ফ্রিয়া নামের চমৎকার মেয়েটির সঙ্গে আবার দেখা হলো। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। সেই সময় মেয়েটির প্রতি এক ধরনের দুর্বলতা অনুভব করতেন। কিন্তু কোনো দিন তার ভালো লাগার কথা বলতে পারেননি, একধরনের ভয় কাজ করত। বহুবার তিনি ফ্রিয়ার কাছে বলতে গিয়েছিলেন, শেষ মুহূর্তে দেখা যেত তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। পুরো পৃথিবীটা চোখের সামনে ঘুরতে শুরু করেছে। একবার তো তিনি মাথা ঘুরে পড়েই গেলেন। সবাই ছুটে এসে তাকে ধরাধরি করে ইউনিভার্সিটির স্বাস্থ্য ইউনিটে নিয়ে গেল। কী ভয়ংকর পরিস্থিতি। লজ্জায় ফ্রিয়ার দিকে তাকাতে পারছিলেন না তখন। সহপাঠীরা এরপর থেকে দেখা হলেই আঙুল নিয়ে মনে করিয়ে দিত ব্যাপারটি। তাও আবার ফ্রিয়ার সামনেই। ফ্রিয়া হাসি মুখে অন্য পাশে সরে যেত। তখন শুধু মনে হতো পৃথিবীটা এত নিষ্ঠুর কেন? যুবক বয়সের সেই প্রেমের সমাধি ঘটেছে অনেক আগেই। একসময় ইউনিভার্সিটির পড়াশোনা শেষ হলো। সবাই সবার মতো ব্যস্ত হয়ে গেল। ফ্রিয়া চলে গেল।

ভালোবাসি কথাটি কখনই আর বলা হলো না। আচ্ছা, ফ্রিয়া কি বিবাহিত। তার কি ছেলে মেয়ে আছে। ধুর কী সব ভাবছেন। ফ্রিয়া বিবাহিত হলেই কি আর না হলেই কী এখন আর কোন কিছুতেই কিছু যায় আসে না।

রাশা খুবই খুশি হলো রোবটটি পেয়ে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো সে তার জন্মদিনের কথাটি ভুলেই গেছে। এখন তার সব মনোযোগ রোবটটিকে ঘিরে। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু যন্ত্রপাতি খুলে ফেলেছে। ইরন রোবটটির প্রতি কিছুটা মায়া অনুভব করলেন। অদূর ভবিষত রোবটটির জন্য কষ্টদায়ক, কারণ রাশা প্রায়ই রোবটটির দেহের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পরীক্ষা নিরীক্ষা করবে আবার জোড়া দেবে। ফ্রিয়া এবং টিনা এই মুহূর্তে খাবার টেবিলে ইরনের মুখোমুখি বসে রয়েছে। ফ্রিয়া ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়কার বিভিন্ন কথা টিনাকে বলছে। ফ্রিয়া একটা সাদা গাউন পরেছে। চুলগুলো মুখের একপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। অপূর্ব সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। ফ্রিয়া সেই সময়কার সব কথাই বলছে কিছুই বাদ যাচ্ছে না যে কোন মুহূর্তে ওই বিশেষ ঘটনাটা বলে ফেলতে পারে। এই ভেবে ইরন একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। কিন্তু দেখা গেল ফ্রিয়া খুব সাবধানে ওই বিশেষ ঘটনা এড়িয়ে যাচ্ছে।

মনে মনে ফ্রিয়াকে ধন্যবাদ দিলো ইরন। জানা গেল ফ্রিয়া তুন্দ্রা অঞ্চলের একটি ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করে। একটি কনফারেন্সে যোগ দিতেই এই শহরে এসেছে সে। আর এখানেই থাকে ফ্রিয়ার বোন টিনা ও তার ছেলে রাশা।

রাত বেশি হয়ে গেছে। ইরন বাসায় ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াল। ফ্রিয়া সাথে সাথে উঠে এলো ইরনকে বিদায় জানানোর জন্য এবং মূল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ইরন শেষ মুহূর্তে হঠাৎ পিছনে ফিরে বললেন,

ফ্রিয়া তুমি কি বিবাহিত?

ফ্রিয়া অবাক হয়ে তাকায় ইরনের দিকে,
না, আমি বিবাহিত নই।

ইরন দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে এলেন। নিজের উপর রাগ হচ্ছে। শুধু শুধু এই কথা বলার প্রয়োজন ছিল না।

ছয়.

ইরন তার পোষা কবুতরগুলোর পাশে এসে দাঁড়ায়। চমৎকার সব কবুতর। যখন খুব মন খারাপ থাকে তখন তিনি কবুতরগুলোর সঙ্গে সময় কাটান। কিন্তু আজ তার মন খারাপ নয়। কেন যেন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না। তিনি লক্ষ্য করলেন, কার্বোডো একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করছে। তিনি কার্বোডোকে কাছে আসতে বললেন। কার্বোডো সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে ইরনের কাছে এসে বলল,

-স্যার আপনার মনটা কি খারাপ?

-না। ঠিক তা নয়। কেমন যেন অস্থিরবোধ হচ্ছে।

এই অস্থিরতার কারণ কি ফ্রিয়া ম্যাডাম?

ইরন চমকে উঠে কার্বোডোর দিকে তাকালেন। তার অস্থিরতার কারণ ফ্রিয়া কিনা তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। কিন্তু এই সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যাচ্ছে না। তিনি কার্বোডোকে বললেন, তুমি ফ্রিয়াকে জান?

আপনি একটি পুরনো ক্রিস্টালে ফ্রিয়া ম্যাডাম সম্পর্কিত কিছু তথ্য লিখে রেখেছিলেন। একদিন আপনার লাইব্রেরি ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে আমি ক্রিস্টালটি খুঁজে পাই এবং সেখান থেকে ফ্রিয়া ম্যাডাম সম্পর্কিত অনেক তথ্য সংগ্রহ করি।

ইরন অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ক্রিস্টালটির কথা ভুলেই গিয়েছিলেন।

স্যার আপনার পছন্দ ভালো। আপনি ফ্রিয়া ম্যাডামকে বিয়ে করে ফেলেন।

এর মানে কী?

ফ্রিয়া ম্যাডাম খুবই সুন্দর এবং মাধুর্য আছে।

হাঃ হাঃ হাঃ। তুমি মাধুর্য কী জিনিস জান?

আমি জানি, বলব?

বলো, আমি শুনছি।

বস্তুর সাধারণ পরমাণুর মধ্যে থেকে নিউক্লিয়াস যার মধ্যে রয়েছে একটি প্রোটন এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে থাকে ইলেকট্রন। এছাড়াও কিছু বস্তুকণা পাওয়া গিয়েছে যাদের বৈশিষ্ট্য অপ্রত্যাশিত। এদের বলা হয় লেপটন ও হেড্রন। হেড্রনের সংখ্যা শতাধিক এবং তারা আরও মৌলিক উপাদান দিয়ে গঠিত যাদের বলে কোয়ার্ক। আপ কোয়ার্ক ও ডাউন কোয়ার্ক- এর সঙ্গে আরও কিছু কোয়ার্ক কল্পনা করা হয়। এদের বলা হয় স্টেঞ্জ কোয়ার্ক। একইভাবে মাধুর্য কোয়ার্ক কল্পনা করা হয়েছে। যার মাধুর্য আছে কিন্তু স্টেঞ্জনেস নেই। এই বস্তুকণা প্রোটনের ভরের তিনগুণ বেশি ভারি।

থাম, থাম। তুমি বিজ্ঞানের ভাষায় মাধুর্য বর্ণনা করছ। বিজ্ঞানের মাধুর্য আর মনের মাধুর্য এক জিনিস নয়।

ও, আচ্ছা আমার জ্ঞান সীমাবদ্ধ। আমি দুঃখিত।

তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছুই নেই। তোমাকে এভাবেই প্রোগ্রামিং করা হয়েছে। আর আমি ফ্রিয়াকে আসলেই বিয়ে করতে চাই। কিন্তু কিভাবে তা বলব বুঝতে পারছি না। ওর সামনা সামনি হলেই তো কেমন যেন হয়ে যাই। আমার চিন্তাভাবনা ওলট পালট হয়ে যায়। ঠিকমতো গুছিয়ে কথাও বলতে পারি না।

স্যার, এক কাজ করলে কেমন হয়। আপনি ফ্রিয়া ম্যাডামকে নিয়ে কোনো এক ভালো রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে যেতে পারেন। তখন সুযোগ বুঝে কথাটা বলে ফেললেন।

তা করা যায়। কিন্তু ফ্রিয়া কি রাজি হবে?

আমার মনে হয় হবে। আপনি একজন প্রথমশ্রেণীর বিজ্ঞানী। পৃথিবীর মানুষ আপনাকে প্রচণ্ড পরিমাণে শ্রদ্ধা করে।

সমস্যা তো এখানেই। মেয়েরা জীবনসঙ্গী হিসেবে বিজ্ঞানীদের পছন্দ করে না। একেবারে নির্বাধ বেকার মানুষকেও দেখা যায় কোনো না কোন মেয়ে ভালোবাসে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের বেলায় দেখো। বেশিরভাগ বিজ্ঞানী চিরকুমার। কেউ কেউ বিয়ে করেছিল কিন্তু কিছুদিন পরেই সম্পর্ক ভেঙে যায়।

-আমার মনে হয় আপনার বেলায় তা হবে না।

-তোমার কেন এরকম মনে হলো?

-কারণ আপনি সবার চেয়ে আলাদা। আপনার জীবনধারাও আলাদা।

-তুমি এতোটা জোর দিয়ে কিভাবে বলছো?

-আমি মোটেই জোর দিয়ে বলছি না। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি চেষ্টা করতে দোষ কোথায়। সম্ভাবনা কিছু হলেও আছে।

-তা ঠিক। চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

এই বলে ইরন তার কম্যুনিকেটর হাতে নিলেন। আসলে তিনি ফ্রিয়ার সাথে যোগাযোগ করতেই চাইছিলেন। কিন্তু কোথায় যেন একটা শঙ্কা কাজ করছিল।

তাই অন্য কারও কাছ থেকে সমর্থন চাইছিলেন। হঠাৎ কম্যুনিকেটরে কেউ একজন যোগাযোগ করল। ইরন, আমি ফ্রিয়া বলছি?
ইরন খুবই অবাক হলেন, ফ্রিয়া, তুমি কেমন আছ?

-ভালোইতো তোমার খবর বল। কি করছিলে? বিরক্ত করলাম নাতো?

-না, না। বিরক্ত হব কেন।

এই কথা বলে ইরন থেমে গেলেন। কারণ, তিনি কিভাবে বলবেন যে তিনি এতক্ষণ ফ্রিয়াকে নিয়েই ভেবেছেন। কী ভাববে মেয়েটা।

-এই, বললে না কী করছিলে?

-তেমন কিছু না। কার্বেডোর সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।

-তুমি কম্যুনিকেটরটা কার্বোডোর কাছে দাও।

-ইরন তাই করল। কম্যুনিকেটরটি সরল বিশ্বাসে কার্বোডোর কাছে দিলো।

-কার্বোডো তুমি কেমন আছ?

-ম্যাডাম আমি সবসময় ভালোই থাকি।

-তোমাদের কত সুবিধা সবসময়ই ভালো থাকো। কখনও মন খারাপ হয় না। ইরনের সহকারী হিসেবে কতদিন আছ?

-ছয় বছর সাত মাস নয় দিন এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড।

-হুম, তাহলে তো অনেক দিন। তোমার স্যার এতক্ষণ কি নিয়ে আলোচনা করছিল, স্পেস সমীকরণ?

-না, ম্যাডাম। স্যার এতক্ষণ আপনাকে নিয়েই আলোচনা করছিল।

ওপাশ থেকে ফ্রিয়া কী বলল ইরন তা আর শুনতে পেল না। তার কানে যেন এমুহূর্তে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে। চোখমুখ ক্রমান্বয়ে লাল হয়ে উঠেছে। গাধা রোবটটা এটা কী করল। এটার সাথে আলোচনা করাটাই ভুল হয়েছে। বিরাট বোকামি হয়েছে। ইরনের কেন যেন মনে হচ্ছে সে দ্বিতীয়বারের মতো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এটা ঘটলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হবে। ইরন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। কার্বোডো কম্যুনিকেটরটি ইরনের হাতে দেয়। ফ্রিয়া তার কণ্ঠে কৃত্রিম অভিমান ফুটিয়ে বলে, ইরন তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছো।

-না, আমি মিথ্যা বলিনি। শুধু বলেছি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।

-তুমি বলতে চাইছ আমি তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই?

-অবশ্যই তুমি গুরুত্বপূর্ণ একজন। এই মুহূর্তে আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি হচ্ছো তুমি। ইরন মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছে। এখন আর কিছুই করার নেই। ফ্রিয়া ইরনের কথা শুনে নিঃশব্দে হেসে বলে, আমি আজ রাতে তোমার সঙ্গে ডিনার করতে চাই।

ইরন অবাক হয়ে যায়। এই কথাটা তার বলার কথা ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আগেই ফ্রিয়া বলে দিল। ইরন থতমত খেয়ে বলল, তুমি আমার সঙ্গে ডিনারে যাবে?

-তুমি উল্টো আমাকে প্রশ্ন করছো। ছেলেদের মুখে এভাবে কথা বলা মানায় না।

-তাহলে কিভাবে বলব?

-চেষ্টা কর।

ইরন চেষ্টা করে বলতে চেষ্টা করলেন, চলো আজ রাতে ডিনারে যাই।

-হয়নি, আবার বলো?

-ইরন এবার একটু থেমে যান। চোখ দুটো বন্ধ করলেন। হঠাৎ মনে একধরনের জোর পেলেন তিনি। সেই জোরের উত্তাপ তার কণ্ঠে কিছুটা ছড়িয়ে পড়ে,
আমি আজ রাতে ডিনারে যাচ্ছি, তুমি চাইলে আমার সঙ্গে যেতে পারো। এই তো হয়েছে। আমি অবশ্যই যাব। তোমার সঙ্গেই যাব। ফ্রিয়া ইরনকে কোথায়

দেখা করতে হবে তা জানিয়ে যোগাযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

সাত.

পুরো এলাকাটি সত্যিই খুব সুন্দর। পাহাড়ের পাদদেশে একটি চমৎকার হৃদ। আকাশে বেশ বড়সড় একটি চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় হৃদের পানি চিক চিক করছে। চারদিকে একটা আলো আঁধারির খেলা। মাঝে মাঝে নিচু হয়ে একটি-দুটি বাইভার্বাল উড়ে যাচ্ছে, এছাড়া কোনো যানবাহন নেই। হৃদ থেকে হালকা শীতল বাতাস বইছে। ইরন রাস্তা দিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকে। সবমিলিয়ে পরিবেশটি ভারি মধুর মনে হয় ইরনে কাছে। এর আগেও সে কয়েকবার এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছে। তখন বিশেষ কিছু মনে হয়নি। কিন্তু আজ তার অসম্ভব ভালো লাগছে। অবশ্য ভালো লাগার আরেকটি কারণও আছে। ফ্রিয়া তার জন্য অপেক্ষা করছে। হৃদের পাশেই একটা উন্নত মানের একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ফ্রিয়া তাকে সেখানেই যেতে বলেছে। ইরন বড় রাস্তাটি থেকে সরে গিয়ে গাছপালায় ঢাকা একটি ছোট রাস্তা ধরে এগুতে থাকে।

রেস্টুরেন্টের ভিতর সারি সারি চেয়ার টেবিল সাজানো। মানুষজন নিচুগলায় পরস্পর কথা বলছে। ফ্রিয়াকে দেখা গেল কোনার দিকে একটি টেবিলে চুপচাপ বসে আছে। ইরন সেদিকে এগিয়ে যায়। ফ্রিয়া মিষ্টি একটা হাসি উপহার দেয় ইরনকে। হাসলে মেয়েটিকে আরও সুন্দর দেখায়। ইরন টেবিলের একপাশে ফ্রিয়ার দিকে মুখ করে বসে পড়ল।

একটি লোক এসে খাবার পরিবেশন করতে থাকে। ফ্রিয়া হয়তো আগেই অর্ডার দিয়েছিল। ফ্রিয়া ও ইরন নিঃশব্দে খাওয়া শুরু করে। কেউ কোনো কথা বলছে না। ফ্রিয়া কী ভাবছে এই মুহূর্তে, ইরনের জন্য অপেক্ষা করে আছে?

ইরন কী বলবে আগেই ভেবে এসেছে। তার মনে একটা গোপন ইচ্ছাও আছে যে, সে ফ্রিয়াকে আর কখনও তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে দেবে না। ভালোবেসে ধরে রাখবে সারাজীবন। আজই সে ফ্রিয়াকে তার বাসায় নিয়ে যেতে চায়। বিয়ের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেই এসেছে। আগামী কালই লাইসেন্সটি হাতে পাবে সে। একপর্যায় ইরন বলতে শুরু করে, ফ্রিয়া আমি সারাজীবনই তোমাকে যে কথাটা বলে আসতে চেয়েছি। আজ তা বলব।
ফ্রিয়া পূর্ণদৃষ্টিতে ইরনের দিকে তাকায়।

আমি জানি তুমি আমাকে কী বলবে। তবুও আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।

আমি যখন একটির পর একটা অংকের মডেল সাজাই। রাতের পর রাত চলে যায় একা একা। আমি তখনও নিজেকে একা ভাবিনি। ক্লান্ত হয়ে যখন বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছি। কবুতরগুলো আমাকে ঘিরে উড়তে থাকে। আমার পাশে তখন কেউ থাকে না। তবুও নিজেকে একা ভাবিনি। কিন্তু যখনই তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে একটু ভালোবাসা পাবার আশায়। আমি তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম সম্পূর্ণ একা অবস্থায়। নিঃসঙ্গ, নির্জন হয়ে যেতে থাকলাম। সেই সঙ্গে প্রকাশ পেতে শুরু করল আমার অসহায়ত্ব, আমার শূন্যতা। এই শূন্যতা ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে আমায়। আমি অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকি। ঠিক এই সময় অন্ধকারে আলোর রেখা হয়ে দেখা দিলে তুমি আমার জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো। এবার আর আমি তোমাকে হারাতে চাই না। আমি ভালোবাসি তোমায় এবং ভালোবেসে যেতে চাই।

ফ্রিয়া, এতক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ইরনের কথা শুনছিল।

ঠিক এমন সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে, যার জন্য ইরন মোটেই প্রস্তুত ছিল না। ফ্রিয়া ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ইরনকে এবং চিৎকার করে বলতে থাকে, আমি তোমাকে কখনই ছেড়ে যাব না। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি।

রেস্টুরেন্টের ভেতর আশেপাশে বসে থাকা মানুষজন অবাক হয়ে তাকায় ভালোবাসায় সিক্ত এই মানুষ দুটির দিকে। ইরন ও ফ্রিয়া সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। দু’জন পরস্পরকে আরও প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরে।

আট.

ইরন তার বাসায় প্রবেশ করছে। পাশেই রয়েছে ফ্রিয়া। সাথেই একটি বিশাল আকৃতির ব্যাগ। ফ্রিয়ার প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র রয়েছে এতে। কার্বোডো এসে ব্যাগটি ভিতরে নিয়ে গেল। ইরনের রান্নার কাজে নিয়োজিত রোবটটিকে এসময় আশে পাশে ঘুর ঘুর করতে দেখা গেল। রোবটটির নাম তিনি আবার ভুলে গেছেন। ইশারায় ডাকলেন রোবটকে।

-এ হচ্ছে ফ্রিয়া। তুমি একে সবকিছু বুঝিয়ে দাও।

ফ্রিয়া ম্যাডাম আপনাকে শুভেচ্ছা। আমি ক্রিকি। স্যারের জন্য রান্না করি। ফ্রিয়া বললো, খুবই ভালো, ক্রিকি। এখন থেকে আমি তোমার স্যারের জন্য রান্না করব। কিন্তু আমি কিছুই রান্না করতে পারি না। তুমি পারবে না আমাকে সব কিছু শিখিয়ে দিতে?

-অবশ্যই পারব, ম্যাডাম।

ইরন ফ্রিয়াকে বললেন, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমার বিশাল বাড়ি। পুরুটা ঘুরে দেখতেও একদিন লাগবে। বাড়ির চারিপাশে প্রচুর গাছপালা আছে। ইচ্ছে করলে সেখানে গিয়ে বসতে পারো। বাইরে সুন্দর চাঁদের আলো। তোমার ভালোই লাগবে।

ইরন লাইব্রেরি ঘরে প্রবেশ করলেন। স্পেস সমীকরণের মডেলটা সমাধান করতে হবে। নতুন পরিস্থিতির জন্য সকল কাজকর্ম বন্ধ রাখার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া এটা জরুরি, খুবই জরুরি। তিনি সমীকরণটি সমাধানের খুবই কাছাকাছি আছেন।

ফ্রিয়া বাগানের মধ্যে হাঁটছে। চারপাশে প্রচুর গাছপালা। এখন কোনো বাড়িতে এতো গাছপালা দেখা যায় না। আকাশে চমৎকার চাঁদ। ফ্রিয়ার হাতে প্রাচীনকালের একটি কবিতার বই, নাম বিচিত্রিতা। ফ্রিয়া একমনে আবৃত্তি করে যাচ্ছে,
কালো অশ্ব অন্তরে যে সারারাত্রী ফেলেছে নিঃশ্বাস।
সে আমার অন্ধ অভিলাষ।
ও যেন রে যুগান্তের কালো অগ্নিশিখা,
কালো কুজ্ঝটিকা…

…ইরন স্পেস সমীকরণ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সেম্পলড টাইম এবং ল্যাপলাস ডুমেইন এর ক্ষেত্রে ঝওঝঙ ট্রান্সফার ফাংশন ব্যবহার করেছেন। সেখান থেকে স্পেস ফর্মকে সংজ্ঞায়িত করেছেন নিয়ন্ত্রিত কনিকল ফর্ম- এর মাধ্যমে। পাশেই কার্বোডো বসে রয়েছে। তিনি কার্বোডোকে বললেন, অতি প্রাচীনকালে একজন মহান বিজ্ঞানী ছিলেন, নাম অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তার আপেক্ষিকতত্ত্ব থেকে তার নিজস্ব সমীকরণের সমাধান নির্ধারণ করেন যা দিয়ে মহাবিশ্বের স্বরূপ ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। তার বিশ্ব অস্থিতিশীল ছিল যা প্রসারিত বা সংকুচিত হতে পারে। প্রসারিত হলেও অসীমের দিকে নির্দেশ করছে, সংকুচিত হলেও প্রথমে সসীম তারপর অসীমের দিকে নির্দেশ করছে। বিগ ব্যাঙের ঠিক পাঁচ সেকেন্ড পর তাপমাত্রা টেন টু দ্যা পাওয়ার নাইন কেলভিন-এ কমে যায় এবং তখন শুধু ইলেকট্রন পজিট্রন নিউট্রিনো এন্টিনিউট্রিনো এবং ফোটন এরাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রাথমিক বিশ্ব যত শীতল হতে থাকে ততই তাপমাত্রা মৌলিক পদার্থ গঠনের জন্য যথেষ্ট হয়ে যায়। প্রায় একশ সেকেন্ড পরে ডিউটেরিয়াম সৃষ্টি হয়। আরেক নিউট্রনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারা ট্রিটিয়াম সৃষ্টি করে। আরেকটা নিউট্রন সংগ্রহ করে সাধারণ হিলিয়াম সৃষ্টি হয়। তখন এটাকে বলা হয় ওপেন ইউনিভার্স। আমি কী বলতে চাচ্ছি তুমি কি বুঝতে পারছ?
কার্বোডো বলল, আপনি এখানে খুব সম্ভবত মহাজাগতিক ধ্রুবকে আনতে চাচ্ছেন। কিন্তু এখানে তো প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

প্রেক্ষাপট একই আছে শুধু মহাজাগতিক ধ্রুবক এক হবে না। ক্যাটাসট্রপি থিউরির কথা মনে পড়ে?

জি, স্যার।

কার্বোডো, আর মাত্র একটা জট। প্রমাণ হয়ে যাবে এই মহাবিশ্ব শূন্যের সমষ্টি। আমি, তুমি কিংবা আমরা সবাই শূন্যের সমষ্টি আর শূন্যের সমষ্টি শূন্য।

ইরন তাকিয়ে রয়েছেন জটটির দিকে। কিন্তু জটটি কী তা ধরতে পারছেন না। হঠাৎ ইরনের মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিতে থাকে। তিনি আগেই নিশ্চিত হয়েছেন যে কেউ একজন আছে যে তার চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করছে। সে যেই হোক ইরন এ মুহূর্তে যে সম্ভাবনার কথা ভাবছেন তা ভয়াবহ। ফ্রিয়াকে কী ইচ্ছে করেই সুপরিকল্পিতভাবেই তার কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু কেন? তার চিন্তা ভাবনা শুধুমাত্র স্পেস সমীকরণ নিয়ে কেন্দ্রীভূত ছিল। এখন সেখানে ফ্রিয়া যুক্ত হয়েছে। সেই সাথে তিনি গত কিছুদিন শুধুমাত্র ফ্রিয়াকে নিয়েই ভেবেছেন। তার মানে কী ইরনের চিন্তা ভাবনা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করাই ছিল উদ্দেশ্য।

ইরনের চোখের সামনে পুরু পৃথিবীটা হঠাৎ অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। তিনি যখন স্পেস সমীকরণ নিয়ে কাজ করছেন এমন সময় রাশার সঙ্গে দেখা হওয়া। দেখা গেল রাশার জন্মদিনে যাবেন না বলেও চলে গেলেন তিনি। আবার একই সময়ে ফ্রিয়া কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার জন্য এই শহরে আসা। এসব কোনো কিছুই কাকতালীয় ঘটনা নয়। সবকিছুই সুপরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে একজন।

তিনি আর ভাবতে পারছেন না। কার্বোডোকে বললেন, ফ্রিয়া কোথায়?

-বাগানে বসে রয়েছে।

-একা?

সঙ্গে ক্রিকি রয়েছে।

-আজই মেয়েটা প্রথম আমার বাসায় এসেছে। অথচ আমি সময় দিতে পারছি না।

-আজ কাজটা বন্ধ রাখলে কী খুব ক্ষতি হবে।

-থাকুক, বন্ধ থাকুক।

-আপনাদের জীবন সুন্দর হোক।

-তোমাকে ধন্যবাদ কার্বোডো।

-আপনি স্পেস সমীকরণ সমাধানের একেবারে শেষ প্রান্তে চলে এসেছেন। অসাধারণ আপনার প্রতিভা।

-হ্যাঁ। আমি কাজটা প্রায় শেষ করে এনেছি।

ইরন হঠাৎ জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফ্রিয়া খুব সুন্দর করে কবিতা আবৃত্তি করছে। ফ্রিয়ার পাশেই ক্রিকি বসে আছে। সে খুব মনোযোগ দিয়ে ফ্রিয়ার কবিতা আবৃত্তি শুনছে। ইরনও খুব মনোযোগ দিয়ে ফ্রিয়ার কবিতা আবৃতি শুনতে লাগলেন।

‘‘ কালো কুজ্ঝটিকা।
অকস্মাৎ নৈরাশ্য আঘাতে
দ্বার মুক্ত পেয়ে রাতে
দুর্দাম এসেছে বাহিরিয়া…

শেষ পর্ব.

এখন প্রায় মাঝরাত। স্পেস সমীকরণের শেষ জটটিও ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে। ইরন ঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছেন প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতির স্বরূপ উন্মোচিত হবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। বলা হয়েছিল ক্ষুদ্রকীটের গোলক ধাঁধা ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। ক্ষুদ্রকীট বলতে কার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এখানে কি মাকড়শার কথা বলা হয়েছে? মাকড়শাও তো ক্ষুদ্রকীট। তাহলে গোলক ধাঁধাকে কী তুলনা করা হয়েছে মাকড়শার জালের সঙ্গে। প্রকৃতি কী মাকড়শার জালের ন্যায় রহস্যে আবৃত্ত করে রেখেছে এই সৃষ্টি জগতকে। কিন্তু, এই মাকড়শা যে জাল বুনে তাও তো এক যুক্তি মেনে চলে। গাছে যে শাখা-প্রশাখা, সেখান থেকে অসংখ্য পাতা কিছুই যুক্তির বাইরে নয়। সবকিছুই একটা সূত্র মেনে চলে। আবার রহস্যকেও তো যুক্তির বাইরে বলা হয়নি। রহস্যের ভেতর থেকেই যুক্তি ধরে এগিয়ে যেতে হবে। যে পথের শেষ প্রান্তে অপেক্ষা করছে প্রকৃতি। ইরন একের পর এক অঙ্ক কষে যাচ্ছেন।

এই প্রক্রিয়া হঠাৎ ব্যাহত হলো। দরজা দিয়ে প্রবেশ করল ফ্রিয়া। এই মুহূর্তে ইরনের খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। ফ্রিয়ার হাতে কফির মগ দেখে তৃষ্ণাটা আরও বেড়ে যায় ইরনের, আমার খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। ফ্রিয়া তার কপালের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো একপাশে সরিয়ে কফির মগটা ইরনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। সেই সঙ্গে বলে, আমারও তাই মনে হচ্ছিল। তাই আমি নিজ হাতে তোমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসেছি। অবশ্য ক্রিকি এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছে।

ভালোবাসা কী অদ্ভুত জিনিস। একজনের মনের কথা আরেকজন কী সহজেই বুঝতে পারে।

ফ্রিয়া মাথা নেড়ে সায় জানায়।

ঘরের হালকা নীলাভ আলোতে ফ্রিয়াকে অপ্সরী বলে মনে হয়। যেন সে এই জগতের কেউ নয়। এই সৌন্দর্যের জন্ম পৃথিবীতে হতে পারে না। এর উৎস হয়তো অন্য কোন জগতে।

হঠাৎ ইরনের মনে হতে থাকে কী দরকার স্পেস সমীকরণ সমাধান করার। এতে অর্থহীন হয়ে পড়বে এই সৃষ্টি জগত। আর কেউ কখনো মাঝরাতে আকাশের মস্তবড় চাঁদটাকে দেখে বলবে না, বাহ্! সুন্দর তো। যখন খুব কফি খেতে ইচ্ছে করবে, কোনো প্রিয় মানুষ তার জন্য ভালোবেসে কফি নিয়ে আসবে না। শূন্য হয়ে যাবে সব কিছু। ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী।

ইরন পরম ভালোবাসায় ফ্রিয়ার একটি হাত স্পর্শ করে। আর অন্য হাতে প্রায় শেষ হয়ে আসা স্পেস সমীকরণের সমাধান। তিনি কী পৌঁছাতে পারবেন প্রকৃতির কাছে। না কী আঁকড়ে ধরবেন ভালোবাসার হাতটি। তিনি কী করবেন এখন!

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ কেউ একজন সাইফ ইমন সাইফ ইমন-এর সায়েন্স ফিকশন ‘কেউ একজন’ সায়েন্স ফিকশন সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২