Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাহিতুল ইসলাম-এর বড় গল্প ‘বদলে দেওয়ার গান’


৩ মে ২০২২ ১৮:৪৫

বিথীর আজ মন খারাপ। সে তার খালামণির সঙ্গে ঝগড়া করেছে। এই খালাকে সে খুব ভালোবাসে। বিথী যখন ছোট, হাই স্কুলেও ওঠেনি, তখন তার মা মারা যায়। তারপর থেকে খালার কাছে মানুষ। একেক সময় মনে হয় খালামণি তাকে নিজের মেয়েদের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু এখন খালামণির সঙ্গে তার যে ব্যাপারটা নিয়ে বিরোধ সেটা মিটবার মতো নয়। এই বিরোধ যদি মায়ের সঙ্গেও হতো, তবু মিটত না। বাবার সাথে হলেও না। কেননা, এই সিদ্ধান্তটা একান্তই তার একার। পৃথিবীর আর কারো না।

বিজ্ঞাপন

বিথী জানে কখনও কখনও খুব একা হয়ে যেতে হয়। কারো কথা শুনতে হয় না। শধু নিজের মনের কথা শুনতে হয়। নয়তো স্বপ্ন পূরণ করা যায় না। সেজন্য সে তার মনের কথা শুনবে। এবং এ ব্যাপারে সে আত্মবিশ্বাসী যে সে পারবেই। সে জানে খালামণি তার ভালো চায়। মা থাকলেও খালামণির মতো একই কথা বলত। এতকাল খালা-খালু তার অভিভাবক থাকলেও তারা তাদের সিদ্ধান্ত বিথীর ওপর কখনও চাপিয়ে দিতে চায়নি। এখন পর্যন্ত জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত সে নিজে নিয়েছে। যেমন কোন কলেজে পড়বে, কী পড়বে, সব। কিন্তু এবার এরা ক্ষেপে গেছে। কিছুতেই বিথীকে গ্রামে যেতে দেবে না। গ্রামে অত শত্রুর মধ্যে গিয়ে মেয়েটা নির্ঘাত মারা পড়বে। এটা ভেবে খালামণি কেঁদেকেটে একাকার। তার এই কান্না খুব যৌক্তিক। বিথী তো তার আরেকটা মেয়েই। তার নিজের মেয়েদের চেয়ে বরং বেশি আদর-যত্নে তাকে মানুষ করেছে সে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে কোথায় এখন ভালো কোনো চাকরি করবে অথবা একটা ভদ্র ছেলে দেখে বিয়ে করে সংসার করবে- তা না। ভূত চেপেছে গ্রামে যাবে। আচ্ছা, সেটাও না হয় মানা যেতো, বিয়ের পর স্বামীর সাথে যেতে পারত। একা একা গ্রামে গিয়ে চেয়ারম্যান ইলেকশন করবে এত্তটুকু একটা পুচকে মেয়ে, এটা মানা যায়? আর তার বাপের শত্রুরা কি তাকে ছেড়ে দেবে? গ্রামের লোকেরাই বা তাকে ভোট দেবে কেন? সে কি কখনও গ্রামে থেকেছে? তাকে কেউ চেনে?

বিজ্ঞাপন

উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন বিথীর বাবা। এক নামে সবাই চিনত শরিফ চেয়ারম্যানকে। সেই চেয়ারম্যানই যখন ক্ষমতার লড়াইয়ে খুন হলো, তার মেয়ে কি সেখানে গিয়ে টিকতে পারবে। বিথীর খালা শেলির মনের মধ্যে কু-ডাক ডাকছে। মা-বাবা হারা এই মেয়েটা কি তাদের অনেক আদরের না? তার সব আবদারই কি তারা পূরণ করেনি? নিজের মেয়েদের চেয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কি তারা বেশি মনোযোগ দেয়নি বিথীর দিকে? তাহলে আজ কেন তাদের কথা শুনছে না মেয়েটা? শেলি জানে তার ভাগ্নিটা ভেতরে ভেতরে খুব জেদি। যা করতে চায় তাই করে ছাড়ে। বিথীকে দেখতে যতই শান্তশিষ্ট মনে হোক না কেন, আসলে সে খুব একরোখা। এই স্বভাবটা ছিল শেলির মায়ের, অর্থাৎ বিথীর নানীর। রক্তের ধারা তো কিছু না কিছু পাবেই। শেলি অবাক হয়েভাবে সেই একই ভঙ্গি বিথীর। একই মানুষ বুঝি অন্যরকম হয়ে ফিরে এসেছে। মা যখন ক্ষেপে যেত তখনও তার চোখ মুখ এমন কঠিন হয়ে যেত।

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর উপজেলার অসুস্থ রাজনীতি আর গ্রামের তখনকার পরিবেশ বিবেচনা করে শরীফ চেয়ারম্যান তার মেয়েকে ঢাকায় তার শ্যালিকার বাসায় নিয়ে আসে। তাদের ওপর দায়িত্ব দেয় মেয়েকে বড় করার। এই মেয়ের জন্য পরবর্তীতে শরীফ চেয়ারম্যান আর বিয়েও করেনি। তাছাড়া উপজেলায় তার ছিল খুব ক্লিন ইমেজ। কোনো রকম নারীঘটিত ব্যাপার, কোনো দুর্নীতি, কোনো লোভ তাকে স্পর্শ করেনি। একটা উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েও সে এসবের উর্ধ্বে ছিল। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিজমা আর নিজের ব্যবসার টাকায় তার খুব ভালো দিন চলে যেত। সে এত উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয় যে লুটপাট করে নিজের আখের গোছাবে। এলাকার মানুষ তাকে এত ভালোবাসত যে তার বিপরীতে অন্য কেউ নির্বাচনে দাঁড়ালে জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হওয়ার মতো অবস্থা হতো। বছরের পর বছর শরীফ চেয়ারম্যান উপজেলার প্রত্যেকটা মানুষের দুঃখ কষ্টে পাশে দাঁড়িয়েছে। চেয়ারম্যানের যেদিন জানাজা হয়, উপজেলার সবচেয়ে বড় মাঠ ঈদগাহ মাঠে মানুষের জায়গা হচ্ছিল না। মানুষ হতবাক হয়ে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না যে শরীফ চেয়ারম্যান মারা গেছে। সব মানুষের মুখ থমথম করছিল রাগ, দুঃখ আর ক্ষোভে।

এত ভালো একজন মানুষ কিনা রাজনীতির নির্মম বলি হলো। শেলিকে খুব ভালোবাসত তার দুলাভাই। তুই করে ডাকত, যেন নিজের বোন। আর শেলির বরকেও যত্ন করত যেন আপন বোনের বর। লোকটাকে কখনও পর বা দূরের মানুষ মনে হতো না তাদের। শরিফ চেয়ারম্যান যেখানে যেত সেখানকার মানুষজনকেই আপন করে নিতে পারত। এটাই ছিল তার বৈশিষ্ট্য। এমন মানুষকে কেউ মেরে ফেলতে পারে সেটা ভাবাই যায় না।

কিন্তু দুনিয়ায় এমন অনেক কিছুই ঘটে যা ঘটার কথা কল্পনাও করা যায় না। এ জন্য কথায় বলে, বাস্তবতা কল্পনাকেও হার মানায়। শরীফ চেয়ারম্যান যে দলের নেতা ছিল সেই দলেই ক্রমশ বাড়ছিল তার প্রতিপক্ষ। তার সততার জন্য এসব লোক দুর্নীতি করতে পারছিল না। তাদের চোখে ছিল চকচকে লোভ। কয়েকজনকে চেয়ারম্যান দুর্নীতির দায়ে পুলিশেও দিয়েছিল। এসব লোক ওত পেতে ছিল। আর ছিল ছিঁচকে চোর, উঠতি কিছু মাস্তান, দাগী আসামী আর চোরাকারবারিরা। প্রত্যেকে যার যার প্রয়োজনমতো এক হয়েছিল। তারপর একদিন রাতের অন্ধকারে শহরে থেকে ফেরার পথে আচমকা খুন করেছিল লোকটাকে। সবাই জানে যারা খুন করেছিল সেই পক্ষই এখন চেয়ারম্যান। ভালো কেউ আর ভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেনি। ফলে, কয়েক বছর ধরে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে লোকগুলো। লুটের মচ্ছব শুরু করেছে যে যার মতো। এতদিন এই খারাপ লোকগুলি শরীফ চেয়ারম্যানের ভয়ে কিছু করতে পারেনি। এখন যেন দ্বিগুণ দুর্নীতি করে তার শোধ তুলছে। এলাকার মানুষ এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। থানা-পুলিশও যেন এদের কেনা। কেউ প্রতিবাদ করলে উল্টো মামলার ভয় দেখায়, রাস্তাঘাটে হয়রানি করে। শরীফ চেয়ারম্যানের পক্ষে যে লোকগুলো ছিল তারা এখন নেতৃত্বের অভাবে মাথা তুলতে পারছে না, সংগঠিত হতে পারছে না।

বিথী গ্রামে খুব কম যেত। তার বদলে তার বাবাই ঢাকায় আসত তাকে দেখতে। মাসে এক দুইবার তো আসতোই। তখন বাবার সাথে তার অনেক কথা হতো। বাবা তার স্বপ্নের কথা বলত তাকে। সারা দুনিয়া প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে। আমাদেরও উচিত পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলা, নাহলে একদিন উন্নত দুনিয়ার সাথে এই দূরত্ব এত বেশি হয়ে যাবে যে তা আর অতিক্রম করা যাবে না। বাবা তার স্বপ্নগুলোর বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছিল। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল। বিথী একা একা বহুদিন ভেবেছে এসব। তারপরই তো সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রামে ফিরে যাওয়ার। বাবার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণ করার। কিন্তু ভয় পাচ্ছে খালা আর খালু। এদের দুজনই তার কাছে বাবা মা। তাই তাদের মনে কষ্ট দিতে তারও সমান কষ্টই লাগে। সে সব কথা খুলে বলেছে খালামণিকে। কিন্তু খালামণি কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। বারবার তার একই কথা তুই ছোট্ট মানুষ, তার উপরে মেয়ে মানুষ, তুই সেখানে গিয়ে কিচ্ছু করতে পারবি না। উল্টো বিপদে পড়বি। বিথী তাদের এত বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স করা একটা মেয়ে মোটেও ছোট নয়। বিথী আরো বলেছে মেয়েরা এসব দায়িত্ব পালন করতে পারে না এসব খুব বাজে কথা। মেয়েদের দায়িত্ব দিলে বরং ছেলেদের চেয়ে ভালো সামলাতে পারে তারা। জার্মানি, নিউজিল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেকগুলো দেশে মেয়েরা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশে পর্যন্ত একজন নারী প্রধানমন্ত্রী সফলতার সাথে রাষ্ট্র চালাচ্ছে আর তোমরা বলো মেয়েরা পারে না। তোমাদের এসব কথার জন্যই মেয়েরা পিছিয়ে থাকে। নয়তো মেয়েদের না পারার কোনো কারণ নেই। খালাকে এসব বলে কনভিন্স করার চেষ্টা করেছে বিথী। কিন্তু খালা অনড়। বিথীও নিজেও অনড়। কারণ বিয়ে আর চাকরি করার জন্য সে জন্মায়নি। তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ওসব নয়। তার আরও অনেক বড় কিছু করার আছে। এবং সে সেটা করে সবাইকে দেখিয়ে দেবে। সে জানে, তখন তাকে নিয়ে সবাই গর্ব করবে। কিন্তু এখন এভাবে সবাই বাধা দিচ্ছে।

বাবা তাকে বলেছিল তার উপজেলাকে সে ডিজিটালি উন্নত করবে। সেটা ছিল তার স্বপ্ন। প্রযুক্তির যত যত ধরন আছে সবকিছুই থাকবে তার উপজেলায়। মানুষ ঘরে বসে সারা পৃথিবীর কাজ করবে। অনলাইনে সরাসরি বিক্রি করবে তাদের পণ্য ও সেবা। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে তার উপজেলার নাম। চাকরির জন্য তাদের ঢাকায় ছুটতে হবে না। বাবা এসব কথা বলেছিল যখন সবেমাত্র প্রযুক্তিগুলো দেশে এসেছে। বাবার দূরদৃষ্টি ছিল খুব। আগে থেকে অনকে কিছু অনুমান করতে পারতেন। তিনি ছিলেন সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ। শুধু তার যে শত্রু বাড়ছে প্রতিদিন সেটা বুঝতে পারেননি। হয়তো সরলপ্রাণ ভালো মানুষ ছিলেন বলেই বোঝেননি। মানুষকে অগাধ বিশ্বাস করতেন বলে বোঝেননি। নয়তো অমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ কেন সতর্ক হয়ে চলাফেরা করবে না?

শরীফ চেয়ারম্যানের চলাফেরা ছিল সাধারণ মানুষের মতো। কেউ বলে না দিলে তাকে চেয়ারম্যান বলে চেনা কঠিন। বিশেষ করে উপজেলা চেয়ারম্যানদের তো নানা ঠাটবাট থাকে। তার সামান্যতম ছিল না সেসব। অতি সাধারণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন কাপড় পরতেন। ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগে থাকত। মানুষজন কোনো কিছুর তদবির নিয়ে আসলে তাদের বোঝাতেন। কোনটা ন্যায্য কোনটা অন্যায্য সেসব এমনভাবে খুলে বলতেন যে মনে হতো কোনো শিক্ষক বাধ্য ছাত্রের ক্লাস নিচ্ছেন। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সম্পদ করাতেও মন দেননি তিনি। শুধু চেয়েছিলেন তার উপজেলার মানুষ স্বনির্ভর আর দক্ষ হয়ে উঠুক। তাদের অভাব দূর হোক। মানুষ নিজের হাতেই তুলে নিক তার নিজের উন্নয়নের চাবি। বাংলাদেশের একটি অগ্রসর জায়গা হিসেবে তিনি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তার উপজেলাকে।

বাবা নেই। কিন্তু তার স্বপ্ন আছে। মানুষ মরে গেলেও তার স্বপ্নের মৃত্যু হয় না। কেউ না কেউ এসে রিলে রেসের মতো স্বপ্নটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। শরীফ চেয়ারম্যানের মেয়ে হয়ে বিথীকেই তার বাবার স্বপ্নপূরণে কাজ করতে হবে। খালামণি আজ বুঝতে পারছে না কিন্তু একদিন হয়তো বুঝবে। সে তার নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজে নিতে চায়। শুধু তাই নয়, উপজেলার মানুষের দায়িত্বও নিতে চায় সানন্দে। কিন্তু বাবার প্রতিপক্ষরা যেভাবে জাঁকিয়ে বসেছে তারা কি সহজে ছেড়ে দেবে তাকে। দখল করতে দেবে হারানো সিংহাসন? বিথী অবশ্য এসব আগে থেকেই ভাবতে চায় না। সে তার লড়াইটা চালিয়ে যাবে। ফল কেমন হবে তা পরের ব্যাপার। তার জায়গা থেকে সে এতটুকু ফাঁকি দিতে রাজি নয়। লড়াইয়ে জেতার জন্য কোনো অসৎ কাজও সে করতে চায় না। সৎ থেকে যা কিছু অর্জন করা যায় সেটাই সে করবে।

বাবার সঙ্গে শেষ দিকে যে কথা হতো সেগুলোই ভাবছিল বিথী। এর মধ্য খালামণি এল। বিথীর লাগেজ গোছানো একদম শেষের দিকে। এখান থেকে স্থায়ীভাবে বাস উঠিয়ে নিচ্ছে সে। এতদিন বাবা মায়ের মতো যাদের ভালোবেসেছে তাদের ছেড়ে যেতে খারাপ লাগছে খুব। খালামণির দিকে সে সরাসরি তাকাতে পারছে না। তার চোখ ছলছল করছে। খালামণিও জোর করে সামলে রেখেছে নিজেকে। খালামণি বলল, ‘তাহলে তুই চলেই যাবি মা?’

‘হ্যাঁ, খালামণি। তোমাদের তো বলেছিই। আমার যেসব স্বপ্ন আছে সেগুলো পূরণ করব। চাকরি করতে চাই না আমি। বাবার স্বপ্নগুলো পূরণ করাই এখন আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।’

‘ঠিক আছে। আমরা তো তোর কেউ না। আমাদের কথা শুনলি না।’

বিথী জানে খালা এখন তাকে ইমোশনালি দুর্বল করার চেষ্টা করবে। কিন্তু এসব টেকনিকে কোনো কাজ হবে না। সে ভেবে রেখেছে। সে বলল, ‘দেখো, তোমরা এমন আচরণ করছ যেন আমি আফ্রিকার জঙ্গলে হারিয়ে যাচ্ছি। আমার গ্রামে যাচ্ছি আমি যেখান থেকে চাইলে তোমরা গিয়ে দেখে আসতে পারবে। আমিও আসতে পারব সময় পেলেই।’

‘হ্যাঁ। জঙ্গলে যাচ্ছিস না বটে, তবে একপাল হিংস্র বাঘ ভাল্লুকের ডেরায় গিয়ে পড়ছিস। ওরা তোর বাবাকে বাঁচতে দেয়নি। তোকেও দেবে না।’

‘এত ভয় পেলে চলে না খালামণি। মানুষ হয়ে জন্মেছি, অন্যায় তো আর সহ্য করতে পারি না। তাছাড়া মরতেও হবে একদিন। তুমি যতই ঘরে বসে থাকো না কেন চিরদিন জীবিত থাকতে পারবে না। আর কোনো সমস্যা হলে তো তোমরা হেল্প করবেই।’

খালা আর কথা বাড়ায়নি এরপর। খালুর চোখও ছলছল করছিল বিথী চলে আসার সময়ে। যদিও সে বলেছে মাঝে মাঝে আসবে। কিন্তু সবাই জানে ব্যস্ত সময়ে একটা দিন বের করা কত কঠিন। হয়তো দেখা হবে, কিন্তু কোনো কোনো বিশেষ দিনে। এই যে এতদিনের আশ্রয় ছেড়ে সে চলে যাচ্ছে তার কি খারাপ লাগছে না। কিন্তু এই খারাপ লাগার চেয়ে জীবন অনেক বড়। জীবনে মানুষের জন্য কাজ করতে পারাটা অনেক জরুরি। সেটার আনন্দ অনেক বেশি। বাবাকে দেখে এই সত্য বুঝতে পেরেছে বিথী। মানুষের জন্য কোনো কিছু একটা করতে পারলে কী ভীষণ তৃপ্ত লাগত বাবাকে। সেই আনন্দটা ছিল বিথীর খুব চেনা। কেননা সে ছোটবেলা থেকে বাবার মুখে সেই অদ্ভুত তৃপ্তি দেখেছে বহুবার। এই আনন্দ নিজের জন্য আসে না। এই আনন্দ আসে মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্য দিয়ে। বিথী এই আনন্দের সন্ধান পেতে চায়। সে মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চায়। খালাতো বোন দুটোও ভীষণ মন খারাপ করেছে। বিথী আপু চলে যাবে এটা ওর কখনও ভাবতে পারেনি। কেননা ছোট থেকেই তাকে দেখছে এরা। বড় বোনের মতো শ্রদ্ধা করেছে, বিথীও এদের নিজের বোনের মতো ভালোবেসেছে। বিথী এদের আদর করে বেরিয়ে এল। তার বাবার ব্যবহৃত গাড়িতে মজনু মিয়া নিতে এসেছে। মজনু তার বাবার ড্রাইভার ছিল। খুব বিশ্বস্ত। বিথী তাকে চাচা বলে। প্রায় ত্রিশ বছর সে এই গাড়ি চালিয়েছে। বিথী সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার বাবার পুরনো সব লোককে ডাকবে। যার যে কাজ ছিল সেটাই দেওয়ার চেষ্টা করবে। ব্যবসা এখন সামলাচ্ছেন সোলায়মান চাচা। তিনিও বাবার সঙ্গে পঁচিশ বছরের বেশি ছিলেন। তাদের সম্পত্তির সব খুঁটিনাটি জানা আছে এই লোকটার। বাবা মারা যাওয়ার পর যাদের ওপর বেশি কাজকর্মের ভার ছিল তারা এখনওপ র্যন্ত ঠিকভাবে সামলেছেন। সঠিক জায়গায় সঠিক লোককে নিয়োগ দিতে পারাও বিরাট দক্ষতার ব্যাপার। বাবা মারা যাওয়ারপর মজনু মিয়া চলে গিয়েছিলেন। কেননা শরীফ চেয়ারম্যানের গাড়িটা তখন পড়েই থাকত। সেটা কেউ ব্যবহার করত না।

২.

গাড়িতে করে আসতে আসতে জায়গাটা চিনতে পারল বিথী। বাসে আসলে স্টেশনে নেমে অনেকটা পথ রিকশায় আসতে হয় তাকে। রিকশায় আসতে গিয়ে এক অদ্ভুত ছেলের সাথে দেখা হয়েছিল এই জায়গাটায়। এখান থেকে দেড় কিলোমিটার মতোগেলে শরীফ চেয়ারম্যানের দোতলা বাড়ি। বিথী সেদিন ছিল রিকশায়। ছেলেটা মোটরসাইকেলের পেছনে ডিম নিয়ে কোথাওযাচ্ছিল। মোড় ঘোরার সময়ে রিকশায় লেগে বাইকটা রাস্তার ঢালে পড়ে যায়। কারো কোনো ক্ষতি না হলেও অনেকগুলো ডিম ভেঙ্গে যায় ছেলেটার। সে বাইকটা ওইভাবে ফেলে রেখে হন্তদন্ত হয়ে বিথীকে ধমক দিতে আরম্ভ করে। বিথী মজা পায় এই দেখে যে সে রিকশাওয়ালাকে কিছু বলে না, তার ওপর ক্ষেপে যায়।

‘কী ব্যাপার? দেখে চলতে পারেন না? দিলেন তো আমার ডিমগুলো ভেঙ্গে!’

বিথী বলে, ‘আমি দেখে চলব কীভাবে? রিকশা কি আমি চালাচ্ছিলাম?’

‘আপনি না চালালে কী হবে? রিকশা তো আপনার ডিরেকশনেই চলছিল।’

‘তো? রিকশা এক্সিডেন্ট করলে রিকশার যাত্রীর দোষ? কী অদ্ভুত কথা!’

‘অদ্ভুত না, আপনি ওকে দেখে শুনে চলতে বললে এটা হতো না।’

‘আমি বলব কেন! দেখশুনে চলাই তো তার দায়িত্ব।’

‘না, আপনার দায়িত্ব তাকে দেখে শুনে নিয়ে যাওয়া।’

বিথী বিড়বিড় করে বলে, ‘ভালো পাগলের পাল্লায় পড়লাম তো!’

কথাটা শুনে ফেলেছিল রাহাত। এতক্ষণে নামটা মনে পড়ল বিথীর। কেননা এই পর্যায়ে ছেলেটা তার নামা বলেছিল। বলেছিল, ‘এই মেয়ে, কী বললেন আপনি? আমার নাম রাহাত। সবাই চেনে আমাকে। আমাকে আপনি পাগল বললেন? আপনার এতবড় সাহস!’

বিথীও তখন ক্ষেপে গিয়েছিল। সে বলেছিল, ‘আরে রাখেন আপনার রাহাত। আমাকে চেনেন আপনি? জানেন আমি কার মেয়ে?’

‘আরে আপনি রাখেন! আপনি কার মেয়ে সেটা আমার জানার দরকার নেই। আপনার সাথে আমার কোনো গণ্ডগোলও নেই। আমার ডিম ভাঙছেন আপনি। ক্ষতিপূরণ দিয়ে চলে যান। আপনার পরিচয় দিয়ে আমার কোনো দরকার নেই।’

‘কী আশ্চর্য কথা বলেন! আমি ক্ষতিপূরণ দিব কেন? রিকশা কি আমি চালাচ্ছিলাম?’

রাহাত বিড়বিড় করে বলল, ‘সেটাই করা উচিত ছিল আপনার।’

‘কী বললেন আপনি?’

‘বলেছি রিকশাওয়ালা যদি ক্ষতিপূরণ দিতে যায় তাহলে তো তার সারাদিনের ইনকাম খরচ হয়ে যাবে। আপনিই দিবেন।’

‘বাহ। দারুণ যুক্তি তো আপনার। করেন মুরগির ব্যবসা আর বড় বড় ডায়লগ দেন।’

‘মুরগীর ব্যবসা না, খামার করি আমি। সমন্বিত খামার। চুরি করি না আপনাদের মতো।’

‘আমাদের মতো মানে? আমি চুরি করি?’

‘করেনই তো। সব বড়লোকই চোর। আমি ওদের দুই চোখে দেখতে পারি না। চুরি না করে বড়লোক হওয়া যায় না।’

‘ভারী অদ্ভুত লোক তো আপনি। উল্টাপাল্টা কথা বলেন সবসময়। এই নেন আপনার ডিমের দাম।’

সে এই ছেলের সাথে তর্ক করে মেজাজ নষ্ট করতে চায় না। তাছাড়া সত্যিই রিকশাওয়ালা যদি ডিমের দাম দিতে যায় তাহলে তার দুই দিনের ইনকাম চলে যাবে। সে একটা এক হাজার টাকার নোট বের করে রাহাতের দিকে দিল। রাহাত বলল, ‘থ্যাংক ইউ। শুধু শুধু এতখানি সময় নষ্ট করলেন। আগে দিয়ে দিলেই হয়ে যেত। আমার সময়ের দাম আছে।’

‘আমারও সময়ের দাম আছে। আজাইরা ঘুরে বেড়াই না।’

‘আপনে একটা কুফা।’

বলতে বলতে মোটরসাইকেলটা উঠিয়ে ঠিকঠাক করে স্টার্ট দিল সে। বিথীও রিকশা করে বাড়িতে চলে এসেছিল সেদিন। আজএই জায়গাটা পার হতে হতে মনে পড়ে বিথীর ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি খেলে গেল। সেদিন বিষয়টা একটু অপমানজনক হলেও রাহাতের সরলতায়, নিজের মতো করে যুক্তি দেওয়ার ক্ষমতায় বেশ মজা লেগেছিল তার।

সেদিনের ঘটনা মনে পড়তেই মজনু চাচাকে বিথী বলল, ‘মজনু চাচা, এই গ্রামে খামার করে একটা ছেলে আছে না রাহাত নাম?’

‘হ্যাঁ, মা। আছে তো। সামনেই তার খামার। কী হইছে মা জননী?’

‘কিছু হয় নাই চাচা। গ্রামে কারা উদ্যমী তরুণ সেই খোঁজ তো নেওয়া লাগবে। কারা কী করতেছে সেটা জানতে হবে না?’

মজনু মিয়া জানে শরীফ চেয়ারম্যান এমন খোঁজখবর রাখতেন সবার। তাই সে অবাক হলো না। শরীফ চেয়ারম্যানের মেয়ের তো এমনই হবার কথা। সে বলল, ‘লেখাপড়া জানা ছেলে আম্মাজান। ঢাকা কলেজে পইড়া গ্রামে চইলা আসছে। ঢাকায় নাকি তার মন টেকে না। একটা খামার করছে হাস-মুগরী, গরু ছাগল মাছ সবই আছে। আবার পুকুরের পাড়ে ফলের গাছও লাগাইছে।’

‘বাহ। ভালো তো।’

‘ভালো না আম্মা। লেখাপড়া করছে চাকরি বাকরি করব। তা না, গ্রামে আইসা খামার করতাছে।’

‘মজনু চাচা, অন্যের অফিসে চাকরি করার চেয়ে নিজের জমিতে খামার করা বেশি ভালো।’

‘সেইটা অবশ্য খারাপ বলেন নাই আম্মা। তয় গ্রামের লোকে কয় চাকরি বাকরি পায় নাই দেইখা গ্রামে চইলা আসছে।’

‘গ্রামের মানুষ অনেক কথাই বলবে মজনু চাচা। সব কথা সবসময় ঠিক না। তারা অনেক সময় না বুঝে কথা বলে।’

‘সেইটাই হইব আম্মা। গরিব মাইনসের বুঝও কম। আন্দাজ নাই বইলাই বেশি কথা কয়। লোকে কয় এই পোলার নাকি মাথায় ছিট আছে।’

মাথায় ছিটের ব্যাপরটা অবশ্য বিথীরও মনে হয়েছে। নইলে রিকশা এক্সিডেন্ট হলে রিকশার যাত্রীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয় এমন কথা কেউ কোনোকালে শুনেছে?

বিথী বাড়িতে আসবে শুনেই বাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক করা হয়েছে। নিচতলায় তার দূরসম্পর্কের এক ফুফু থাকে। বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়িটা দেখে শুনে রাখার জন্য একটা পরিবার দরকার ছিল। ফুফু তার দুই ছেলে নিয়ে এখানে থাকে। ফুফুর স্বামী থাকে সৌদি আরব। বড় ছেলেটা পড়ে সেভেনে আর ছোটটা থ্রী-তে উঠল এই বছর। খুব দুষ্টু এই ছেলে দুটো। বাড়িতে তাদের বড়বোন আসবে এই কথা বলা হয়েছে। তারা সকাল থেকে উত্তেজনায় আছে কখন বিথী আসবে। এমনিতে এই বাড়িতে কোনো মেহমান আসে না। কেউ এলে তাদের আনন্দই লাগে। বিথী ভেবেছে যেহেতু সে একা তাই এরা যেমন আছে তেমনই থাকবে।নিচতলাটা ব্যবহার করবে আগের মতো, আর দোতলটাতে সে থাকবে। তবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার ওপর কারো কর্তৃত্ব সে মেনে নেবে না। খালা-ফুফু শ্রেণির মহিলারা সবসময় কর্তৃত্ব ফলাতে চায়। তাতে হয়তো স্নেহ ভালোবাসা থাকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে মারে। দোতলার ঘরগুলো খুলে পরিস্কার করে রেখেছে কাজের লোকেরা। কাজের লোকজনও ছিল না কিছুদিন আগ পর্যন্ত। বিথী স্থায়ীভাবে থাকবে বলে তাদের খবর দিয়ে আনা হয়েছে। এরা অনেক বছর এই বাড়িতে তার বাবার দেখভাল করেছে। বাবা মারা গেলে আপনজন হারানোর কষ্ট পেয়েছে। এখন বিথী আসার খবরে তারা খুবই খুশি। আমেনা বুয়া তাকে ছোটবেলায় কোলে কোলে বড় করেছে। সেই আমেনা বুয়াকে আনা হয়েছে। মজিদ মিয়া বাগানটা দেখাশোনা করত, পাশাপাশি বাজার-ঘাট করত, তাকে আনা হয়েছে। এই সব বন্দোবস্ত করেছে ড্রাইভার মজনু চাচা। পুরনো লোক হিসেবে সে সবার বাড়িঘর চেনে। মজনু চাচা খুঁজে খুঁজে এদের ফিরিয়ে এনেছে। বিথী জানে নতুন লোকের চেয়ে এরা বেশি বিশ্বস্ত হবে। নতুন লোক হয়ত চৌকশ হবে, কিন্তু তাদের কাছে ষোলআনা বিশ্বস্ততা আশা করা যাবে না। কিন্তু এরা পরীক্ষিত মানুষ, কাজেকর্মে হয়ত তেমন ভালো না, কিন্তু বিশ্বস্ততার জায়গায় এদের চেয়ে ভালো লোক পাওয়া যাবে না। এখন তার বিশ্বস্ত মানুষ দরকার। এরা যে কোনো মূল্যেই হোক মনিবের ক্ষতি হতে দেবে না। বিথীর এখন সব বিশ্বস্ত লোকগুলোকে দরকার। যারা তার বাবার হয়ে কাজ করেছে এবং রাজনৈতিকভাবে যারা বর্তমানে নিষ্ক্রিয়। রাজনীতিতে যারা সক্রিয় থেকেছে তারাই বিরুদ্ধ দলে যোগ দিয়েছে। অথবা বলা ভালো যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু কিছু বিশ্বস্ত লোক আছে যারা বিপক্ষ দলে যোগ দেওয়ার চেয়ে চুপচাপ থাকাটাকেই ভালো মনে করেছে। বাড়িতে যেমন সে পুরনো লোকগুলোকে ফিরিয়ে এনেছে, তেমনি রাজনীতির ময়দানেও তাদের নিয়ে আসবে।

আজ রাতটা বিশ্রাম নেবে বিথী। কোনোকিছুই ভাববে না। একটা দীর্ঘ ঘুমের পর মাথা ফ্রেশ হলে কাল থেকে সে হোমওয়ার্ক শুরু করবে। সবকিছু হবে গোছানো। বিথী এলোমেলো কাজ পছন্দ করে না। তার ঘরটা বেশ বড়। এই ঘর মূলত বাবা ব্যবহার করত। নরমাল সাইজের তিনটা বেডরুমের সমান তার এই মাস্টার বেডরুম। বাবা বলতেন ছোট ঘরে থাকলে মানসিকতাও ছোট হয়ে যায়। সত্য মিথ্যে জানে না বিথী, কিন্তু কথাটা তার ভালো লেগেছিল। ঘরটাতে মোট তিনটা সিলিং ফ্যান লাগে। নয়তো গরমের দিনে বাতাস পাওয়া যায় না সব কোনে। বাবার বেডরুম হলেও মা যেহেতু অনেক আগেই মারা গিয়েছিল, বাবা এটাকে বৈঠকখানা হিসেবেও ব্যবহার করত মাঝে মাঝে। খুব বিশ্বস্ত লোকজন এলে এখানেই ডেকে পাঠাত। দেয়ালজুড়ে মায়ের ছবি বাবার ছবি, তার ছবি। বিথীর ছোটবেলার ছবিই বেশি এই ঘরে। বাবা একা হয়ে গেলে বোধ হয় তার ছবিগুলোই দেখত। বিথী এখন বাবার নিঃসঙ্গতা অনুভব করতে পারে। এত বড় ঘরে সেই নিঃসঙ্গতার বোধ তাকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার কি ঘুম হবে আজ রাতে? ক্লান্ত ছিল সে খুব। খালামণি, খালুর সঙ্গে অনেক সংগ্রাম করে আসতে হয়েছে তাকে। ফলে যে কোনো মানসিক অস্থিরতা তাকে গ্রাস করার আগেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।

৩.

শরীফ চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠোনে আজ ছোটখাট একটা সভা বসেছে। উঠোনের পূর্ব পাশের আমগাছগুলোর নিচে বড় ডেকচিতে রান্না চলছে। আমের দিনে এই গাছগুলো ভরে থাকে হলুদ হলুদ পাকা আমে। ছোটবেলায় সে এই গাছগুলোতে চড়েছে। কাঁচা আম ভর্তা করে খেয়েছে অন্য মেয়েদের সাথে। এখন সেখানে রান্না করছে বাবু বাবুর্চি। মাঝে মাঝে ঢাকনা উঠিয়ে নাড়া দিচ্ছে খাবারে আর তার সুঘ্রাণে এলাকা ভরে যাচ্ছে। বাবু বাবুর্চি খুব নামকরা এই অঞ্চলে। যে কোনো বড় অনুষ্ঠানের রান্নায় তার ডাক পড়ে। মোগলাই খাবারগুলো সে খুব ভালো রান্না করে। সিজনের সময় ঢাকা থেকেও রান্নার ডাক আসে তার। এখান থেকে প্রাইভেট করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর আবার পৌঁছে দেয় তারা। বাবু বাবুর্চি নিজ হাতে তেমন কোনো কাজ করে না। তবে সব কাজ হয় তার নির্দেশে। মসলা থেকে শুরু করে পেঁয়াজের কাটিং কী হবে সেটাও দেখিয়ে দেয় বাবু বাবুর্চি। আজ রান্না হচ্ছে খাসির রেজালা, পোলাও, মুরগীর শাহী রোস্ট আর স্পেশাল পায়েস। আয়োজন তেমন বেশি কিছু না। কিন্তু আজকের আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিথী তার নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করল।

উঠোনের সবাই উপজেলার মান্যগণ্য মানুষ। ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন চেয়ারম্যানও আছে। এদের কথার গ্রহণযোগ্যতা আছে এলাকায়। মাসুদ ব্যাপারী, ইলিয়াস মোল্লা, সাইফুল শেখ, মিলন মণ্ডল, রানু চৌধুরী, দেবাশিস আচার্য আর সলিম খাঁ নিজেদের মধ্য আলাপ আলোচনা করছিলেন। সবাইকে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। বিথী নিজে এসে সবাইকে বসিয়ে নাস্তার ব্যবস্থা করে ভেতরে গেছে। সার্বিক ব্যাপার দেখভাল করছে তাদের ম্যানেজার সোলায়মান চাচা। সবকিছুর ওপর তার চোখ আছে। কোথায় কোন কাজটা হচ্ছে, কে কী করছে সব যেন তার নখদর্পনে। নতুন কেউ এলে তাকে গেট থেকে নিয়ে ভেতরে বসাচ্ছে সে। বিথী সোলায়মান চাচার ওপর খুব ভরসা করে। তার প্রয়াত বাবা শরীফ চেয়ারম্যানও ভরসা করতেন সোলায়মানকে। বেশ উৎসব উৎসব একটা পরিবেশে এখানে সবাই হাসিখুশি। আর বিথী তাদের ডেকেছে কথা বলার জন্য। শরীফ চেয়ারম্যান এদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন। তার মেয়ে হিসেবে বিথীও তাদের খুব প্রিয়। শরীফ চেয়ারম্যান মারা যাবার পর এরা সবাই তাদের শক্তির একটা বড় জায়গা হারিয়ে ফেলেছে। খুনের বিচারটাও এখন আর চলছে না বলা যায়। কেননা প্রতিপক্ষ এখনকার ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থাকে। খুনিরা যে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়, তাতে এরা সবাই খুব ক্ষুব্ধ। কিন্তু এদের তেমন কিছু করার নেই। কেননা খুনিদের জোটই এখন শক্তিশালী। তবে এখানে যারা এসেছে তারা সবাই রাজনীতি করা লোক, কেউ কেউ অবশ্য ময়দান থেকে সরে গেছে। কিন্তু এরা সবাই যে কোনো সময়ে ময়দানে নামার মতো ক্ষমতাশালী এবং দক্ষ মানুষ। এরা ভেবেছে বিথী এদের ডেকেছে বোধ হয় মামলাটা নিয়ে কথা বলার জন্য। কেননা এতদিন মামলাটা কেউ চালায়নি। কোনো তদবির নাকরায় মামলার কার্যক্রম স্থবির। সবাই শরীফ চেয়ারম্যানের স্মৃতিচারণ করছে। মামলাটার অগ্রগতির বিষয়ে কী কী করা যায় তানিয়ে কথা বলছে।

এর মধ্যে বিথী নেমে এল। সে পরেছে নীল রংয়ের একটা শাড়ি। সাদা ব্লাউজ। পায়ে হালকা একটা চপ্পল। ঘরোয়া সাজ। গায়ে সুন্দর সুগন্ধী। শাড়ি পরলে মেয়েদের একটু ভারিক্কি লাগে বয়সের তুলনায়। সে এতগুলো বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা বলবেতাকে একটু ভারিক্কি থাকতে হবে। তাছাড়া তার উদ্দেশ্য কেউ যেন তাকে ছোট না ভাবে। যদিও এদের প্রায় চোখের সামনেই বিথীর জন্ম। বিথী এসে সবাইকে সালাম দিল। তারপর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসল। প্রত্যেককে নাম ধরে ধরে কুশল জিজ্ঞেস করল। সবাই খেয়াল করল মেয়েটা ছোট হলেও কথা বলছে তার বাবার মতো করে। তার বাবাও এভাবে সবাইকে আলাদা আলাদা করে চিনত এবং তাদের পরিবারের খোঁজখবর রাখত। পরিবারের সদস্যদের নামও ছিল তার মুখস্ত।

বিথী বলল, ‘আজকে আপনারা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এসেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি জানি আপনারা আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু এই ভালোবাসা আমি নিজে অর্জন করিনি। আমার বাবাকে আপনারা ভালোবাসতেন আর তার মেয়ে হিসেবে আমাকে ভালোবাসেন। আমার বাবা আপনাদের সব কাজ নিজের কাজ মনে করতেন এবং সে ভাবেই উপজেলার সব মানুষের পাশে দাড়াতেন। আজ আপনারা জানেন আমার বাবা নেই। কিন্তু আমার বাবার কিছু স্বপ্ন ছিল। আমার বাবাসবসময় তার স্বপ্নের কথা আমাকে বলতেন। উপজেলাকে ডিজিটাল বানানোর স্বপ্ন ছিল তার। তিনি সেজন্য কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলো তিনি তার কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। তার মেয়ে হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো তার অসমাপ্ত কাজগুলোকে শেষ করা। আর এজন্য আপনাদের সবার সম্পূর্ণ সহযোগিতা দরকার। আপনারা যদি আমাকে সহায়তা করেন তাহলে আমি তার কাজগুলো শেষ করতে চাই।’

অতিথীরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইল বিথী কী ইঙ্গিত করছে। বিথী সেটা খেয়াল করল। সে বলল, ‘এক কথায় বলতে গেলে আমি আমার বাবার জায়গায় নির্বাচন করতে চাই এবং নির্বাচিত হয়ে এই এলাকার জন্য কাজ শুরু করতে চাই।’

এবার মৃদু গুঞ্জণ শুরু হলো সভায়। বিথী বলল, ‘আপনারা হয়তো ভাবছেন এটা সম্ভব না, আমার মতো অল্পবয়সী মেয়ের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়া অসম্ভব। কিন্তু আমি বলব, চাইলে সবই সম্ভব। যদি আমি আপনাদের সাপোর্ট পাই, আমার বিশ্বাস এটা সম্ভব। আমার বাবা যখন প্রথমবার নির্বাচিত হন, তখন তার বয়স আমার চেয়ে খুব বেশি ছিল না।’

ইলিয়াস মোল্লা বলল, ‘মা জননী, তুমি তো রাজনীতি করো নাই কোনোদিন। তুমি কিভাবে এত বড় একটা পোস্টে ইলেকশন করবা। ইলেকশনে দাড়ায় সব ঝানু লোকজন।’

বিথী বলল, ‘আমি সব হিসেব করেছি চাচা। রাজনীতি করতে হলে ঝানু হতে হয় সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু আমি শুরু না করেই কিভাবে একদিনে ঝানু রাজনীতিবিদ হব? আমি প্রথমবারেই নির্বাচিত হব এটা হয়তো আপনারা বিশ্বাস করতে পারছেন না।কিন্তু আমি আপনাদের উপর আস্থা রাখি। আপনারা এই মিটিংয়ের সবাই যদি আমার জন্য কাজ করেন, আমার ধারণা আমি জিতব। আপনারা যদি আপনাদের স্নেহের হাতটা আমার মাথার ওপর রাখেন তাহলে আমরা জিতব।’

সলিম খাঁ বলল, ‘শুরুতেই নেগেটিভ ভাবা ঠিক না ইলিয়াস ভাই। ওর বাবার কথা এখনও মানুষের মুখে মুখে। আমার মনে হয় বিথী মা পারবে। ইলেকশনের খুব বেশি দেরি নেই। কাজ শুরু করার এখনই ঠিক সময়। আর আমরা সবাই যদি শরীফ ভাইয়ের মেয়ের জন্য কাজ করি, আমার ধারণা ভোটাররা ভরসা পাবে।’

মিলন মণ্ডল বলল, ‘আমারও মনে হয় আমাদের বিথী মা শিক্ষিত মেয়ে। সে এইবার ফাইট দিক। তাছাড়া আমাদের মধ্যে থেকেতো আর কেউ চেয়াম্যান ইলেকশন করবে না। বিথী ইলেকশন করলে আমরা তার জন্য কাজ করব। শরীফ ভাইয়ের যে ভোট ছিল সেটা বিথী মা-ই পাবে। আর আমরা যদি তার জন্য খাটাখাটনি করি তাহলে ভালো ফাইট হবে।’

বিথী বলল, ‘আপনারা সবাই আমার বাবার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। আমার বাবা আপনাদের উপর আস্থা রাখতেন। আমি জানি বিরোধীপক্ষের অনেক প্রলোভন ছিল আপনাদের ওপর, কিন্তু আপনারা তাদের সাথে আঁতাত করেননি। আমি আপনাদের ওপর আস্থা রাখি। এলাকায় ফিরে সবার আগে আমি আপনাদের দাওয়াত দিয়েছি। আপনারা সবাই আজকের এই সভা থেকে যদি আমাকে সমর্থন দেন তাহলে আমি ভোটে লড়ব। এখন আপনারা ভেবে দেখেন অন্যায়ের সাথে থাকবেন না কি ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করবেন। আমরা যদি জিততে নাও পারি তবু আমাদের সান্ত্বনা থাকবে যে আমরা অন্তত আমাদের চেষ্টাটা করেছি। চেষ্টা ছাড়া আমরা কোনোকিছু ছেড়ে দেইনি।’

বিথীর এই কথায় সবার মধ্য প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল। এতক্ষণ যারা মনে মনে ভাবছিল এতটুকু মেয়ে আর কী করবে, তারাও যেন ভরসা পেল। তারও যুক্তি পেল বিথীর পক্ষে কাজ করার। সত্যিই তো, যদি সামান্য সম্ভাবনাও থাকে সেটার জন্যই চেষ্টা করা উচিত। চেষ্টা করলে অন্তত মনের সান্ত্বনা থাকবে। বিথী ছাড়া এই সভায় আরেকজন মাত্র নারী আছে, রানু চৌধুরী। সে প্রথমেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি বিথী মায়ের সঙ্গে আছি। মেয়েরাও যে পারে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। আমি যখন কমিশনার নির্বাচন করি তখনও অনেক বলেছিল যে আমার জামানত বাজেয়াপ্ত হবে, কিন্তু সেটা হয়নি। আমি এখন কমিশনার। বিথী মা আমার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষিত, সে অবশ্যই পারবে।’

এরপর একে একে সবাই বিথীকে সমর্থন জানাল। তারা একমত হলো যে আসন্ন নির্বাচনে বিথীর জন্য তারা কাজ করবে। মানুষকে বোঝাতে পারলে শরীফ চেয়ারম্যানের ভোটগুলো সে পাবে। মানুষ তাদের প্রাণপ্রিয় চেয়ারম্যানের জন্য এটুকু করতে পারলে খুশি হবে। সবাই শুধু মানুষকে বোঝাবে যে শরীফ চেয়ারম্যানের জন্য হলেও তার মেয়েকে যেন তার ভোটটা দেয়। সবাই খুব আন্তরিক এবং বিথী বুঝল তাদের মধ্যে আশা জেগে উঠেছে। ভালো কাজ এবং এলাকার উন্নয়নে তাদের সবসময় পাশে পাওয়া যাবে। মিটিং করার আগে বিথী ভালোমতো খোঁজখবর করেছে এই মানুষগুলো সম্পর্কে। শত্রু দূর থেকে যত ক্ষতি করতে পারে, কাছের মানুষ পারে তার চেয়ে বেশি। এজন্য সে যাদের সঙ্গে কাজ করবে তাদের সবাইকে বিশ্বস্ত হতে হবে। বিথী তার মাকে ছাড়া বড় হয়েছে। চলেছেও অনেকটা স্বাধীনভাবে, তাই বাইরের পৃথিবী থেকে তার শিক্ষাটা খুব ভালো হয়েছে। সে জানে মানুষের সাথে ভালো সম্পর্কের ফলে অনেক কঠিন কাজও সহজে হয়ে যায়। তার মনে হয়েছে নির্বাচনের বেশ খানিকটা কাজ আজকের মিটিংয়ে এগিয়ে গেল। বিথী তার বিরোধী পক্ষের অনেকের সাথেই কথা বলবে, কিন্তু তার সময় এখনও আসেনি। আগে নিজের জায়গাটা ঠিক করে স্থায়ী একটা ভিত্তি গড়তে হবে।

বাবু বাবুর্চীর রান্না খেয়ে আমন্ত্রিতরা খুব খুশি। তাদের মনও ভালো। একটা নতুন উদ্যোম প্রত্যেকের মধ্যে লক্ষ করা গেল। এত সহজে যে বিথী তাদের কনভিন্স করতে পারবে সেটা সে নিজেই ভাবেনি। ভেবেছিল অনেকেই রাজি হবে না। অবশ্য খাওয়ার পর দুই/একজন তাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছে সাবধানে থাকতে। তাদের কথা শুনে মনে হলো তারা নিজেরাও বিরোধীপক্ষের লোকজনের ভয়ে কিছুটা ভীত। বিথী তাদের সাহস দিয়েছে। বলেছে প্রেসের সাথে তার ভালো যোগাযোগ আছে, তার অনেক বন্ধু ঢাকার বড় বড় পত্রিকায় কাজ করে। কোনো দুর্নীতি কোথাও হলে সেটা সারাদেশে জানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া এখন ইন্টারনেটের যুগ, এখন কেউ সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে সহজে পার পাবে না।

সভার লোকদের খাওয়ার পর অনেক খাবার বাড়তি থাকল। বিথী ইচ্ছে করে বেশি খাবারের আয়োজন করেছিল। সে তার বাড়ির আশপাশে অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবারে খাবারগুলো পাঠিয়ে দিল। সে একটা শুভ কাজ করতে যাচ্ছে, সবার দোয়াই এখন কাম্য। আমেনা বুয়া আর মজিদ মিয়ার আত্মীয়স্বজনও এসেছে আজ, কারণ বাড়িতে অনেক কাজ। সবাইকে হাত লাগাতে হবে। তাছাড়া বিরাট ভোজ লেগেছে। সব দিক মিলিয়ে বিথীর মনে হলো আজকের মিটিংটা সফল। সে ভেবে রেখেছে একটা ফেসবুক গ্রুপ থাকবে যেখান থেকে তার জনসংযোগের কাজগুলোর আপডেট নিজেরা পেতে পারে। সিনিয়ররা অনেকেই ফেসবুক ব্যবহার করেন না, তাদের সাথে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ করা হবে আর অপেক্ষাকৃত তরুণদের নিয়ে ফেসবুকে ক্যামপেইন চালাতে হবে। কে কী কাজ করছে প্রতিদিন তার খবর গ্রুপে সবাইকে জানানো হবে। এতে তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে। বিথী ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করতে পারে না। তার সব কাজই হয় গোছানো। সে আজ থেকে প্রকাশ্যে নির্বাচনের কাজ শুরু করল। খালামণি আর খালুকে ফোন করতে হবে, তাদের দোয়া নিতে হবে। তবে সে তাদের এখনই দাওয়াত দেবে না। নির্বাচনে জিতে তারপর সে নিজে গিয়ে তাদের নিয়ে আসবে। খালামণি নিশ্চয়ই তখন আর রাগ করে থাকতে পারবে না। আর সেও বড় মুখ করে যেতে পারবে তাদের আনতে।

(বাকি অংশটুকু উপন্যাস আকারে দ্রুত প্রকাশিত হবে)

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ গল্প বদলে দেওয়ার গান রাহিতুল ইসলাম রাহিতুল ইসলাম-এর বড় গল্প ‘বদলে দেওয়ার গান’ সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২