ফাহিম ইবনে সারওয়ার-এর গল্প ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা’
৩ মে ২০২২ ২০:২৬
বৃহস্পতিবার, আমাদের মানে চাকরিজীবীদের সাপ্তাহিক মুক্তির দিন। অনেকে বলবেন, সেটা তো শুক্রবার! না, ওইদিন কাজ আরও বেশি থাকে। বাজার কর, জুমার নামাজ পড়, দাওয়াতে যাও, ঘুরতে বেরোও! আর কাজ না থাকলেও বা কি! ছুটির দিন কি ঘুরে বেড়ানোর জন্য? ছুটির দিন বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। খাবো, ঘুমাবো, এলিয়ে পড়ে থাকব। তাই আমার কাছে শুক্রবারের চেয়ে বরং মঙ্গলবার বেশি ভালো লাগে। নিউমার্কেট বন্ধ থাকে, রাস্তায় জ্যাম কম থাকে। আরামে অফিস যাওয়া-আসা করতে পারি। সকালে ২০ মিনিট বেশি ঘুমাতে পারি।
আর বৃহস্পতিবার হচ্ছে মুক্তির দিন। সকালটা শুরুই হয় ছুটির মুডে। কাল ছুটি, ভাবলেই প্রশান্তিতে মন ভরে যায়। অনেকটা ঈদের আগের চাঁদ রাতের সন্ধ্যার আনন্দ। তো আমাদের বন্ধুবান্ধবদের যাদের অফিস কাছাকাছি তারা এই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একজোট হই। কারণ রাস্তায় অনেক জ্যাম! দেরি করে বাড়ি ফিরবো, বউ জানে। এই সন্ধ্যাটা আমি স্বাধীন। কারণ সন্ধ্যা ৭টায় বের হলে রাত ৯টার আগে বাসায় ঢুকতে পারবো না। আর রাত ১১টায় রওনা দিলে সাড়ে ১১টায় বান্দা বাসায়। তাই আমরা দামি কোনো কফিশপের আশেপাশে টং দোকানে বসি। যেখানে বিল নিয়ে কোনো চিন্তা নেই, যতক্ষণ খুশি গল্প করে যাও, যা খুশি তা নিয়ে গল্প করে যাও।
আমার বন্ধু জিয়াদের অফিস ছিল পল্টন। গুলশান ওর জন্য দূর হয়ে যায়। তাও আড্ডা দিতে আসতে চাইত প্রায়ই। সবার সাথে দেখা করতে চাইত। আমি বলতাম, চলে আয় কোনো এক বৃহস্পতিবার। তখন আমরা বসতাম ইসমাইলের চায়ের দোকানে। একদিন রাত ৮টায় জিয়াদ এসে হাজির। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে ঠেলে এসেছে। আমাদের আড্ডা ততক্ষণে বেশ জমে উঠেছে। চায়ের ধোঁয়া, সিগারেটের ধোঁয়া দুটোই প্রচুর উড়ছে। প্রথম প্রথম জিয়াদ ঠিক আড্ডায় মিশে যেতে পারতো না। মানে কাকে কি বলবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় ছিল, কোন টপিকে কথা হচ্ছে সেটা অনেক সময় বুঝতে পারত না। তবে ধীরে ধীরে ও আড্ডার ধাঁচটা ধরে ফেললো।
চাকরির কারণে ও খুব একা পড়ে গিয়েছিল। ও কাজ করে একটা ম্যানপাওয়ার এজেন্সিতে। নানা কাজে নানা দিকে ছোটাছুটি করতে হয়। তাই দিনের বেলা সময় কেটে যায়। বিপদে পড়ে অফিস শেষ হওয়ার পর সন্ধ্যায়। কারণ অফিসের কাছাকাছি থাকবে বলে মালিবাগের এক মেসে উঠেছে এক কলিগের সাথে। মেসের বাকি আর কাউকে চেনে না। কলিগও তেমন আড্ডাবাজ মানুষ নন। অনেক বেশি বিষয়ী আর ঘরোয়া মানুষ। ঘরে ঢুকে তিনি পড়ে থাকেন তার মোবাইল নিয়ে।
জিয়াদ বলে, কতদিন ভালো কোনো সিনেমা দেখি না, বই পড়ি না, আমার যে কি বাজে অবস্থা দোস্ত। কোনো আড্ডাতে যেতেই ভয় করে। রিসেন্ট ট্রেন্ড কি চলে আমার কোনো আইডিয়াই নেই। আড্ডায় তাল মিলাতে পারি না। আড্ডার মেজাজ ধরতে পারি না। তোদের আড্ডার ছবিগুলি দেখি আর খুব মিস করি। তাই ভাবলাম চলে আসি। তোদের সঙ্গেও দেখা হবে, আড্ডাও দেওয়া হবে।
আমি হেসে বললাম, আর নতুন কি জিনিস জানবি? আমরা নানা দিকের মানুষ। এলোমেলো আলাপ করি। কখনো চাকরি, কখনো রাজনীতি, কখনো সাহিত্য, কখনো খেলা, কখনো সিনেমা। এর বন্ধু, ওর কলিগ মিলেমিশে একাকার।
জিয়াদ বললো, এটাই তো আমি পাইনা দোস্ত। আমার চারপাশে শুধু এক রকমের মানুষ। বিষয়ী মানুষ। এদের কাছে আছে শুধু জমির আলাপ, কোন ব্যাংকের ডিপিএসে ইন্টারেস্ট বেশি। কোথায় টাকা রাখলে কি লাভ এইসবের আলাপ।
খারাপ কি? এগুলারও তো দরকার আছে। কম টাকায় পেলে শেয়ারে জমি কিনে রাখ। পরে ডেভলপারকে দিয়ে দিলি। সবাই তো এখন তাই করছে।
আরে এগুলো করার সময় আছে পড়ে। আর আমার এত টাকাও নাই। এখন ওইসব করতে গেলে খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাতে হবে। আমি সেই দলে নেই। আপাতত একটু আরাম করে নেই।
এরপর মোটামুটি আমাদের বৃহস্পতিবারের আড্ডায় নিয়মিত হতে থাকে জিয়াদ। ওর ভেতর ভিষণ একটা হতাশা ছিল। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার হতাশা। ও যেখানে আছে সেখানটায় ও খাপ খাওয়াতে পারছে না আবার আমাদের এখানে ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে কিন্তু এটা ওর নিয়মিত জগতের বাইরে আরেকটা জগৎ। যেখানে ওর জ্যাম-ভিড় ঠেলে আসতে হয়। বৃহস্পতিবারে দেরি হয়ে যায় প্রায়ই, তবুও ও প্রায় নিয়মিত আসে। বলে, এখানে এলে নিজেকে খুঁজে পাই। তা পায় অবশ্য। ওকে দেখলে সেটা বোঝা যায়। জিয়াদ অনেক সময় গুলশানে আসার জন্য কাজ জমিয়ে রাখতো। হয়তো মঙ্গলবার এক কাজে গুলশান আসতে হতো। সেটা ঠেলে ও নিয়ে যেত বৃহস্পতিবারে। তারপর অফিস থেকে দুপুরে বেরিয়ে কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় সোজা আড্ডায় হাজির। সেদিন আর অফিসে ফিরত না। আড্ডা শেষ করে সোজা বাসায়। অনেক সময় সবার আগে আড্ডায় চলে আসত। আমরা ওকে দেখে অবাক হয়ে যেতাম! আড্ডার জন্য মানুষ এত পাগল হতে পারে!
আড্ডার জন্য ট্রেন্ডি জিনিসপত্র নিয়েও রিসার্চ করে আপডেট হয়ে আসতো। যেন পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। অল্প দিনেই আড্ডার মধ্যমণি হয়ে উঠল। নেটফ্লিক্সে নতুন কোন মুভি বা সিরিজ এসেছে তার খোঁজ রাখা। নতুন ছবি দেখে এসে সেটা নিয়ে পরের সপ্তাহে আড্ডা। প্রিমিয়ার লিগের খবর, ভাইরাল ইস্যু সবকিছুতেই জিয়াদ আপডেটেড থাকত। এমন অবস্থা হলো যে আমরাই জিয়াদের কাছ থেকে আপডেট নিতাম।
আড্ডার দিকে জিয়াদ প্রচণ্ডভাবে ঝুঁকে পড়ল। একবার তো ঠিক করল বাড্ডার দিকে কোনো মেসে উঠবে। আমাদের আড্ডায় নিয়মিত আসা কয়েকজনের সঙ্গে গিয়ে ওই এলাকায় কয়েকটা বাসাও দেখে আসল।
এরই মধ্যে হঠাৎ জরুরি তলবে বাড়ি গেল জিয়াদ। আসলে আমাদের কাছে বলেছিল জরুরি তলব। ব্যপারটা আগে থেকেই পারিবারিকভাবে ঠিক করা ছিল। জিয়াদ গিয়ে শুধু কবুল বলেছে।
বিয়ে করে এসে পরের সপ্তাহে মিষ্টি নিয়ে আড্ডায় হাজির হলো সে। ভিষণ খুশি! আনন্দটা কিছুটা চেপে রাখতে চাইছে কিন্তু পারছে না। ওর ভেতর থেকে খুশি বের হয়ে আসছে যেন! কৈশোরের প্রেমিকা বহুদিন ঘোরানোর পর যখন প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দিলে কিশোরদের মধ্যে যেরকম খুশি দেখা যায় জিয়াদের মধ্যেও সেরকম খুশি দেখা যাচ্ছে।
‘সব হঠাৎ করে হয়ে গেল…’ আমরা জিয়াদকে কথা শেষ করতে দিলাম না। ‘কিছুই হঠাৎ করে হয় নাই, সব আগে থেকে সেট করা ছিল। ব্যাটা আজাদ ভাই দুই বছর পাত্রী পছন্দ করতে পারছে না আর তুই গেলি আর বিয়ে করে চলে এলি! এত সোজা?’
‘আরে সেটাই তো। আব্বা-আম্মা তো পাত্রী দেখতেছিল। হঠাৎ-ই তাদের সব পছন্দ হয়ে গেল। আমাকে ডাকল মেয়ে দেখার জন্য। আমারও পছন্দ হলো। দেখাদেখির মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দিল। ডিসেম্বরে প্রোগ্রাম করব। সবাইকে তখন আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব। বিয়ে খাওয়াও হবে, আমাদের বাড়িতেও ঘোরা হবে। আগেভাগেই বললাম, যাতে ছুটি নিয়ে কারও কোনো সমস্যা না হয়।’
আমরা ছুটি নিয়ে জিয়াদের বাড়ি গিয়েছিলাম বিয়ে খেতে। বিয়ের পর আস্তে আস্তে আমাদের বৃহস্পতিবারের আড্ডায় অনিয়মিত হয়ে পড়তে শুরু করে জিয়াদ। সে ধীরে ধীরে ভিড়ে যায় তার অফিস কলিগদের দলে। নেটফ্লিক্স, প্রিমিয়ার লীগ বাদ দিয়ে সে মনোযোগ দেয় ডিপিএস, সঞ্চয়পত্র এবং এফডিআর এর দিকে। বউকে ঢাকায় নিয়ে আসবে, নতুন সংসার গোছাতে হবে। ফার্নিচার কিনতে টাকা লাগবে, সেটা কি লোন নিয়ে কিনবে না আস্তে আস্তে টাকা জমিয়ে কিনবে সেটাও এক চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
বৃহস্পতিবারের জন্য আগের মতই উতলা হয়ে থাকে জিয়াদ। তবে গুলশানে না এসে চলে যায় মহাখালি। বাড়ি যেতে হবে, বাস ধরতে হবে, বাড়িতে বউ অপেক্ষায়।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
ইদ ২০২২ ইদ আয়োজন ২০২২ ইদ সংখ্যা ২০২২ ইদুল ফিতর ২০২২ গল্প ফাহিম ইবনে সারওয়ার ফাহিম ইবনে সারওয়ার-এর গল্প ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা’ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সারাবাংলা ইদ আয়োজন ২০২২