Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রবীন্দ্রনাথের বেদনা যত

মোহাম্মদ আবু সালেহ
৬ আগস্ট ২০২২ ১৯:৩৬

রবীন্দ্রনাথের জীবনে যত মনোবেদনা আছে সেগুলোকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
ক) ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে দুঃখ
খ) লেখক হিসেবে তার প্রতি ব্যক্তিগত আক্রমণ ও ঠাকুরবাড়ির প্রতি আক্রমণের কারণে মনঃকষ্ট
গ) রাজনৈতিক বিশ্বাস ও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে সৃষ্ট মনোবেদনা

রবীন্দ্রনাথ তার জীবনে অনেক দুঃখ সয়েছেন পরিবারের আপনজনের মৃত্যু দেখে। তিনি ৮০ বছর আয়ুষ্কাল পেলেও তার ১৫ ভাই-বোনের মধ্যে বেশিরভাগই অল্প বয়সে মারা যান। মাত্র ৪১ বছর বয়সে তিনি তার স্ত্রীকে হারান। সন্তানদের মধ্যেও বেশিরভাগই অল্প বয়সে মারা যান। বিয়ের পরে তার এক কন্যা মারা যান, এতে তিনি সবচেয়ে বেশি আঘাত পান। সেজন্য কবিতায় তিনি বারবার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চাননি, দূরে সরাতে চেয়েছেন। তিনি কবিতায় উচ্চারণ করেন:

বিজ্ঞাপন

“তবে মৃত্যু দূরে যাও
এখনি দিয়ো না ভেঙে এ খেলার পুরি
ক্ষণেক বিলম্ব করো
আমার দুদিন হতে করিয়ো না চুরি।”

এ দুঃখ-কষ্টকে মেনে নিয়েই তিনি সন্মুখপানে অগ্রসর হয়েছেন। তাই তার গানে তিনি বলেন:

“তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে
কুসুম ঝড়িয়া পড়ে, কুসুম ফোটে
নাহি ক্ষয় নাহি শেষ
নাহি নাহি দৈন্যলেষ
সেই পূর্ণতার পায়ে মন-স্থান মাগে
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু।”

তার সমসাময়িক লেখকদের কাছ থেকে তিনি যে লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন তা বিরল! আপনজনের কাছে দুঃখ পেলে তা অনেক মর্মবেদনার কারণ হয়। তিনি তার বন্ধু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাছ থেকে যে আঘাত পেয়েছেন তা-ও নীরবে সয়ে গেছেন। তার পরিপক্ব চিন্তার কারণেই তিনি প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো আচরণ করেননি। সেসময়কার কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা তার প্রতি যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আক্রমণ করেছেন তা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি।

বিজ্ঞাপন

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া পিরালি দোষে দুষ্ট ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণে এবং ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে তাদের প্রায় একঘরে করে রেখেছিল তখনকার হিন্দু সমাজ। এ বিষয়টিও আমরা আলোচনা করেছি।

ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ স্যার উইনস্টন চার্চিল বলেছেন:

“Politics is as exciting as war and quite as dangerous. In war, you can only be killed once, but in politics, many times.”

ভারতীয় রাজনীতিতেও রবীন্দ্রনাথ একবার দুবার নয়—বহুবার নিহত হয়েছেন। তাকে তিন ধরনের রাজনীতি সামলাতে হয়েছে:

১. মুসলিম জাতীয়তাবাদ
২. হিন্দু জাতীয়তাবাদ
৩. আন্তর্জাতিক রাজনীতি
এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে আমরা তার জবানীতেই জানার চেষ্টা করবো কোন ধরনের আচরণ ও ঘটনা তার মর্মপীড়ার কারণ হয়েছিল।

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর রবীন্দ্রনাথের ভাষণ—

১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের ঘোষণার পরে কলকাতায় বিশাল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কবি তখন কলকাতায় ছিলেন না, তিনি ছিলেন শান্তি নিকেতনে। কলকাতার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সম্প্রদায়, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রবীন্দ্র অনুরাগী শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, ২৩ নভেম্বর ১৯১৩ তারিখে তারা বিশেষ রেলগাড়ি ভাড়া করে শান্তিনিকেতনে গিয়ে কবিকে সংবর্ধনা দেবেন।

এই স্পেশাল ট্রেনের উদ্যোক্তা ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, ডব্লিউ. ই. এস. হল্যান্ড, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, নীলরতন সরকার, যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী, এ রসুল, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও সি. এফ. অ্যান্ড্রু প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ২৩ নভেম্বর কলকাতা থেকে প্রায় ৫০০ জন যাত্রী নিয়ে পতাকা সুশোভিত ট্রেনটি ব্যান্ড পার্টি সহকারে বোলপুর স্টেশনে পৌঁছে। বোলপুর থেকে ব্যান্ড বাজিয়ে তারা পায়ে হেঁটে শান্তিনিকেতনে উপস্থিত হন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবির বন্ধু স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে সভাপতি করা হয়।

এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেই কবি নিবেদিত অভিনন্দনের জবাবে ভাষণে তার অন্তরে দীর্ঘদিনের লালিত পুঞ্জিভূত ব্যথা প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষণের অনুলিপি ২৮ নভেম্বর ১৯১৩ সালে সঞ্জীবনী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তার সেদিনের সেই ভাষণের কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি।

“আজ সমস্ত দেশের নামে আপনারা যে সম্মান দিতে এখানে উপস্থিত হয়েছেন তা অসঙ্কোচে সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি এমন সাধ্য আমার নেই।…

কবি-বিশেষের কাব্যে কেউ বা আনন্দ পান, কেউ বা উদাসীন থাকেন, কারো বা তাতে আঘাত লাগে এবং তারা আঘাত দেন। আমার কাব্য সম্বন্ধেও এই স্বভাবের নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি, এ কথা আমার এবং আমাদের জানা আছে। দেশের লোকের হাত থেকে যে অপযশ ও অপমান আমার ভাগ্যে পৌঁছেছে তার পরিমাণ নিতান্ত অল্প হয়নি এবং এতকাল তা আমি নিঃশব্দে বহন করে এসেছি। এমন সময় কি জন্য যে বিদেশ হতে আমি সম্মান লাভ করলুম তা এখনো পর্যন্ত আমি নিজেই ভালো করে উপলব্ধি করতে পারিনি।…

যাই হোক, যে কারণেই হোক, আজ ইউরোপ আমাকে সম্মানের বরমাল্য দান করেছেন। তার যদি কোনো মূল্য থাকে তবে সে কেবল সেখানকার গুণীজনের রসবোধের মধ্যেই আছে, আমার দেশের সঙ্গে তার কোনো আন্তরিক সম্বন্ধ নেই। নোবেল প্রাইজের দ্বারা কোনো রচনার গুণ বা রস বৃদ্ধি করতে পারে না।”

এ ভাষণে তিনি আরও বলেন—

“অতএব আজ যখন সমস্ত দেশের জনসাধারণের প্রতিনিধিরূপে আপনারা আমাকে সম্মান-উপহার দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন তখন সে সম্মান কেমন করে আমি নির্লজ্জভাবে গ্রহণ করব? এ সম্মান আমি কতদিনই বা রক্ষা করব? আমার আজকের এ দিন তো চিরদিন থাকবে না, আবার ভাটার বেলা আসবে তখন পঙ্কতলের সমস্ত দৈন্য আবার তো ধাপে ধাপে প্রকাশ হতে থাকবে।

তাই আমি আপনাদের কাছে করজোড়ে জানাচ্চি, যা সত্য তা কঠিন হলেও আমি মাথায় করে নেব, কিন্তু যা সাময়িক উত্তেজনার মায়া, তা আমি স্বীকার করে নিতে অক্ষম। কোনো কোনো দেশে বন্ধু ও অতিথিদের সুরা দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরাপাত্র আমার সন্মুখে ধরেছেন তা আমি ওষ্ঠের কাছে পর্যন্ত ঠেকাব, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারব না। এর মত্ততা থেকে আমার চিত্তকে আমি দূরে রাখতে চাই। আমার রচনার দ্বারা আপনাদের যাদের কাছ থেকে আমি প্রীতিলাভ করেছি তারা আমাকে অনেকদিন পূর্ব্বেই দুর্লভ ধনে পুরস্কৃত করেছেন, কিন্তু সাধারণের কাছ থেকে নতুন সম্মানলাভের কোনো যোগ্যতা আমি নতুন রূপে প্রকাশ করেছি একথা বলা অসঙ্গত হবে।

যিনি (প্রভু) প্রসন্ন হলে অসম্মানের প্রত্যেক কাঁটাটি ফুল হয়ে ফোটে, প্রত্যেক পঙ্কপ্রলেপ চন্দনপক্ষে পরিণত হয় এবং সমস্ত কালিমা জ্যোতিষ্মান হয়ে ওঠে, তারই কাছে আজ আমি এই প্রার্থনা জানাচ্চি, তিনি এই আকস্মিক সম্মানের প্রবল অভিঘাত থেকে তার সুমহান বাহুবেষ্টনের দ্বারা আমাকে নিভৃতে রক্ষা করুন।”

[তথ্যসূত্র: প্রশান্তকুমার পাল | ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ | রবিজীবনী, ৫ম খণ্ড (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি.) পৃ. ৪৪৯-৫০]

রবীন্দ্রনাথের ভাষণের অনুলিপিতে তার সমস্ত বক্তব্য স্থান পায়নি। তিনি অত্যন্ত মার্জিতভাবে অভিনন্দন প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সুশোভন ভাষায় তার দীর্ঘকালের বিরোধী ও বিদূষকদের সমালোচনাও করেছেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই— তিনি যে কী নিদারুণ মনঃকষ্টে যুগের পর যুগ কাটিয়েছেন তা তার সমালোচকদের উদ্দেশ্য করে বলা এই বক্তব্যে পরিষ্কার বোঝা যায়। তিনি আরও বলেন, গ্রামের দুষ্টু বালকেরা কুকুরের লেজে ঝুমঝুমি বেঁধে যেভাবে কুকুরকে তাড়িয়ে বেড়ায় তেমনি তাকে সারা জীবন তার সমালোচকেরা এভাবে তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন।

কুকুরের লেজে ঝুমঝুমি বেঁধে তাড়ানো

কুকুরের লেজে ঝুমঝুমি বেঁধে তাড়িয়ে বেড়ানোর বক্তব্য তখনকার পত্রপত্রিকায় স্থান না পেলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন উৎস থেকে জানা যায়। বিশিষ্ট মননশীল লেখক নীরদ সি. চৌধুরী (১৮৯৭ – ১৯৯৯) তার ‘Tagore and the Nobel Prize’ প্রবন্ধে সর্বপ্রথম এ বিষয়টির অবতারণা করেন। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর শিক্ষক কবি মোহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮ – ১৯৫২) রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর ২৩ নভেম্বর ১৯১৩ তারিখের ওই সংবর্ধনা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। তিনি নীরদ সি. চৌধুরীকে বলেন:

“He was very angry and gave unrestrained expression to it. He described how contemptuously Tagore had treated those who had gone to Bolpur to felicitate him, and quoted some words which were never printed. According to him Tagore likened their conduct to that of village boys who tie a tin to the tail of a dog and chase it through the streets with shouts.”

[Source : Nirad C Chaudhury. 1973. ‘Tagore and the Nobel Prize’ Illustrated Weekly of India. 11 March 1973]

নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর চার দিন পরই ১৮ নভেম্বর ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ রোদেনস্টাইনকে যে চিঠি লেখেন তাতেও এর উল্লেখ রয়েছে। তিনি লেখেন:

“The very first moment I received the message of the great honour conferred on me by the award of the Nobel Prize my heart turned towards you with love and gratitude. I felt certain that of all my friends none would be more glad at yhis news than you. Honour’s crown of honour is to know that it will rejoice the hearts of those whom we hold the most dear. But, all the same, it is a very great trial for me. The perfect whirlwind of public excitement it has given rise to is frightful. It is almost as bad as tying a tin at a dog’s tail making it impossible for him to move without creating noise and collecting crowds all along.”

[তথ্যসূত্র : প্রশান্তকুমার পাল | ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ | রবিজীবনী, ৬ষ্ঠ খণ্ড (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি.) পৃ. ৪৫১]

এখানে কবি উল্লেখ করেন, কুকুরের লেজে ঝুমঝুমি বাঁধলে কুকুরের পক্ষে শব্দ বা চিৎকার না করে নড়াচড়া করা অসম্ভব। তার পক্ষেও সমালোচকদের কঠোর সমালোচনা সহ্য করে কোনো উচ্চবাচ্য না করে থাকাটাও প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি এ অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে তিনি সমালোচকদের গঠনমূলক জবাব দিয়েছেন প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে এবং নিজেকে সংশোধন করেছেন কোনো কোনো ক্ষেত্রে। কিন্তু তার মনের কষ্টের কথা এভাবে কোথাও বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই।

একই ধরনের বক্তব্য তিনি ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৪ সালে পাবনায় অনুষ্ঠিত উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে অভিনন্দনের জবাবে প্রদান করেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন,

“বিলাতে রাস্তার দুষ্টু বালকেরা কৌতুক করিবার জন্য কুকুরের ল্যাজে ঝুমঝুমি বাঁধিয়া ছাড়িয়া দেয়। সে যেখানেই চলে শব্দ হয় এবং লোকের দৃষ্টি পড়ে। প্রকাশ্য চলা একরকম বন্ধ করেছি। আমার ভাগ্য দেবতা আমার এক গালে বিলাতী চূর্ণ ও অন্য গালে ভূষার কালী মাখাইয়া স্তুতি নিন্দার সং সাজাইয়াছেন। তাঁহার এই কৌতুকে যোগ দিতে আমার কোনো উৎসাহ নেই। ইহাতে আমাকে ক্লিষ্ট করিয়াছে।”

[তথ্যসূত্র : প্রশান্তকুমার পাল | ১৩৯৯ বঙ্গাব্দ | রবিজীবনী, ৬ষ্ঠ খণ্ড (কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি.) পৃ. ৪৬৯]

কবিকে তার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ ও বিরোধিতা কতটা ক্লিষ্ট করেছে তা এই বক্তব্যে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান। তিনি কতটা আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছিলেন এবং সত্যকে আঁকড়ে ধরেছেন তা তার কবিতায় প্রকাশ করেছেন। তিনি বলতেন, জীবনে কারণে অকারণে ছোটখাটো মিথ্যা বলা যায় কিন্তু কবিতায় কখনো মিথ্যা বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ তার ‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থে ‘রূপ নারানের কূলে’ কবিতায় সেই কঠিন সত্য উচ্চারণ করেছেন এভাবে:

“রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগত
স্বপ্ন নয়।

রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,
সে কখনো করে না বঞ্চনা।

আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন,
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ ক’রে দিতে।”

মানব জীবন স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা অনেক কঠিন। সেই কঠিনকে সবাই ভালোবেসে আলিঙ্গন করতে পারে না। যারা কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে কঠোর সমালোচনাকে নীরবে সহ্য করে সামনের দিকে অগ্রসর হন তারাই সফলকাম হন। কবি বহতা নদীর মতো কেবল সামনের দিকেই অগ্রসর হয়েছেন, তিনি সমালোচকদের বিরোধিতায় কখনো পিছপা হননি। তিনি হয়তো তার বিরুদ্ধাচরণকারীদের ক্ষমা করে দিয়েছেন, কিন্তু তিনি তা ভুলে যাননি; বরং আমৃত্যু তার আবেগের ক্ষতটাকে বয়ে বেড়িয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ চরম আঘাত সয়ে বেদনায় ক্লিষ্ট হয়ে যে সত্যকে অন্তরে লালন করতেন তাকে শেষ পর্যন্ত ভালোবেসে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এ জীবনে আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা করে সত্যের মূল্য লাভ করতে হয়, আর এভাবেই একদিন মৃত্যুর মাধ্যমে সকল দেনা শোধ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। তাহলেই জীবন সার্থক করা সম্ভব।

রবীন্দ্রনাথের হাল না ছেড়ে দেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি

বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথের জীবনে অনেক উত্থানপতন সইতে হয়েছে। তার বাবা, ভাই ও সন্তানদের মৃত্যুও এ সময়েই হয়েছে। তার বিরোধীরাও এ সময়েই সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় একের পর এক লেখালেখিতে তিনি কখনো দমে যাননি। তিনি কখনো প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো আচরণ করেননি। নীরবে সব ব্যথা সয়ে গেছেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকেই তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তারপরও আমরা দেখেছি তার বিরুদ্ধাচরণ থেমে থাকেনি। তার দ্বিতীয় বিয়ের গুজবও এ সময়েই তাকে ব্যথিত করে।

আজকাল যারা প্রেরণামূলক বক্তব্য প্রদান করেন, তারা একটা কথা বলেন, জীবনে জয়ী হতে হলে হাল ছাড়া যাবে না। এই ‘Do not give up attitude’ আমরা রবীন্দ্রনাথের জীবনে সবচেয়ে বেশি পাই। সেই সময়ে ১৯০৭ সালে রচিত তার ‘প্রার্থনা’ কবিতায় খুব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে— স্রষ্টার প্রতি তার আকুতি বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য নয়—বরং বিপদে যাতে তিনি ভয় না করেন— এটিই তার প্রার্থনা। সুখদুঃখ, হাসিকান্না, বিপদাপদ, জন্মমৃত্যু, উত্থানপতন, বাধাবিপত্তি, আলোচনা-সমালোচনা ইত্যাদি জীবনেরই অপরিহার্য এবং অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনে এগুলোর উপস্থিতি অনিবার্য। তাই তিনি স্রষ্টার প্রতি শত বিপদেও বিশ্বাসে যাতে কোনো সংশয় না ঘটে তার প্রার্থনা করেছেন। এ কবিতায় তিনি বলেন:

“বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়॥
সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে,
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি, লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।
আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা–
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।
আমার ভার লাঘব করি নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
বহিতে পারি এমনি যেন হয়।
নম্রশিরে সুখের দিনে তোমারি মুখ লইব চিনে–
দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা
তোমারে যেন না করি সংশয়।”

কবি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে তার জীবনে দুঃখ নেমে আসলে সে দুঃখকে জয় করার এবং অসহায় অবস্থায় যাতে তিনি মনোবল না হারান— সে প্রার্থনা করেছেন। আজকে তার মহাপ্রয়াণের আশি বছর পরও মনে হয় এটি আমাদের জীবনের জন্যও কতটা প্রাসঙ্গিক।

রবীন্দ্রনাথের প্রতি পূর্বধারণাপ্রসূত ভিত্তিহীন অপবাদ

রবীন্দ্র বিদ্বেষের বেশিরভাগই একটা পূর্বধারণাপ্রসূত চিন্তা। তার বিরুদ্ধে একধরনের মিথ তৈরি করা হয়েছে, যার কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। যারা তার বিরোধিতা করেন তারা তার রচনাবলী ও জীবনী না পড়েই কেবল ভাসা-ভাসা ধারণা নিয়ে মন্তব্য করেন। তার সাহিত্যে মুসলমান চরিত্র সৃজন ও তার ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে যে কথাগুলো প্রচারিত—এর বেশিরভাগই উৎসারিত হয়েছে অজ্ঞতা ও গোঁড়ামি থেকে। রবীন্দ্র সাহিত্য যারা পড়েছেন এবং রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে যারা জানেন— তারা একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন—এসব অভিযোগের কোনো রেফারেন্স নেই। তার বিরুদ্ধে সিংহভাগ অভিযোগই শোনা কথা, যার কোনো দলিল নেই।

এতসব অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও তার ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের ‘অক্ষমা’ কবিতায় তিনি জীবনভর যে দুঃখ পেয়েছেন তাকে ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছেন। বিশ্বকবি কবিতায় বলেন:

“যেখানে এসেছি আমি, আমি সেথাকার,
দরিদ্র সন্তান আমি দীন ধরণীর।
জন্মাবধি যা পেয়েছি সুখ-দুঃখভার
বহুভাগ্য বলে তাই করিয়াছি স্থির।”

শত দুঃখ কষ্টের মাঝেও তার স্বাজাত্যবোধের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ‘পরিচয়’ কবিতায়। সব কিছু ছাপিয়ে তিনি আমাদেরই লোক—এটিই তিনি অন্তরে ধারণ করেছেন। আমাদের কাছেও তিনি ভালো মন্দ মিলিয়েই ‘আমাদের লোক’ হয়ে উঠতে পেরেছেন। তার অনেক অর্জন থাকতে পারে, অনেক উপাধি থাকতে পারে, কিন্তু দিনশেষে তিনি আমাদেরই লোক— এটিই তার সবচেয়ে বড় পরিচয় এবং এটিই তার শেষ পরিচয়। আর সে পরিচয়েই তিনি তার কবিতার নিচের পঙক্তিমালার মতোই আমাদের হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যতেও আমাদের হয়ে থাকবেন।

“মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক
আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়,
এই হোক মোর শেষ পরিচয়।”

লেখক: সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ই-স্কুল অব লাইফ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

প্রবন্ধ মোহাম্মদ আবু সালেহ রবীন্দ্রনাথের বেদনা যত সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর