ঝ’রে যায় মন
৯ আগস্ট ২০২২ ২০:০৭
অমিত চলে গেল বৃহস্পতিবার। যেদিন ওর জন্ম হয়েছিল, সেদিনটাও ছিল বৃহস্পতিবার। যশোর অঞ্চলে সেসময় কোন পুত্র সন্তান বৃহস্পতিবার জন্ম নিলে, তার নাম হয়ে যেত বিষু। যদিও ডাকনাম রাখা হলো খোকন। কিন্তু, বিষু বলেই ডাকতো কাজীর বেড়ের লোকজন। খন্দকার আহসান হাবিব ছিল আসল নাম। কবি হতে চেয়েছিল অমিত। আহসান হাবিব নামে লেখা ছাপাও হতে থাকল এক সময়। একদিন গেছে প্রখ্যাত কবি আহসান হাবিবের বাসায় ওর কিছু কবিতা পড়াতে। তিনি বললেন, ‘লোকে তোমার সঙ্গে আমায় গুলিয়ে ফেলছে। পারলে নামটা একটু পাল্টে নাও। এতে করে দু’জনেরই সুবিধা।’ প্রবীন কবির আজ্ঞা মাথায় নিয়ে, তরুণ আহসান হাবিব হয়ে গেল অমিত হাবিব। সেইসঙ্গে কবি থেকে সাংবাদিক…
যার কথা বলছি, তিনি সদ্য প্রয়াত দৈনিক দেশ রূপান্তরের সম্পাদক অমিত হাবিব— একদা আমার জীবনসঙ্গী। ‘যখন ভুলে প্রায় গেছি তোমার মুখই’— তখন তাঁর প্রয়াণ আমাকে এক অচেনা সময়ের ভেতর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে চলেছে। অমিতের সঙ্গে আমি আমার বর্তমান অবস্থান নির্ণয় করতে পারছিনা। শব্দের ব্যবহার ও ভাষার বিন্যাস নিয়ে আলাপ ছিল আমাদের অবসর মূহূর্তের অন্যতম সময়। আজ আমি ধন্দে পড়ে যাচ্ছি, ঠিক কোন শব্দ ও ভাষায় আমি আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া জীবন, অমিত আর আমার যৌথ সময়ের বর্ণনা দেবো!
সমাজ ও রাজনীতি বদলের স্বপ্ন নিয়ে জীবন শুরু করছিল অমিত। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার আদর্শে উজ্জীবীত ছিলো। কোন ধরনের প্রচলিত নিয়মে সে বিশ্বাসী ছিল না। যাবতীয় সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একজন মানুষ বলেই একদা তাকে ভালোবেসেছিলাম। এক যুগেরও অধিক কাল আমাদের বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। ফলে আর আমার জানা নেই, সেই চেতনার বদল ঘটেছিলো কিনা তার। ব্যাক্তিজীবন থেকে পত্রিকার পাতা পর্যন্ত ছিলো তাঁর নিয়ম ভাঙার প্রথা। সংবাদপত্রের চিরায়ত ভাষা ও বিন্যাস পরিবর্তন করা ছিল ওর একটা স্টাইল। যতবার নতুন পত্রিকা করেছে, ততবার নিজের স্টাইল নিজেই বিনির্মাণ করেছে। ব্যক্তি অমিতের মৃত্যু বহুকাল আগেই আমার জীবনে ঘটে গেছে। কিন্তু, ওর শরীরী মৃত্যুর পর যখন জানাজা হচ্ছিল নানা জায়গায়, তখন আমার বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছিল। যদি আত্মা মৃত্যুর পর সব দেখার ক্ষমতা রাখে, তবে ও নিশ্চয় হাসছিল এসব দেখে! হয়তো বলছিল, উহু এসব নয়! অন্যকিছু!
আমরা সংসার করেছিলাম কিছুকাল। প্রেম ও বিদ্রোহ করেই বিয়ে করা। অমিত আমাকে প্রেমও নিবেদন করেছিল কবীর সুমনের ‘জাতিস্মর’ গানটি সারারাত ধরে টেলিফোনে বাজিয়ে শুনিয়ে। সেই যে, ‘এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া‘। কিন্তু, সে চাওয়াও নশ্বর হয়ে গেল…। বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি এক সময় মলিন হয়ে গেল। জীবন আমাদের প্রেম কেড়ে নিলেও, দু’জনেই একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটেছে একসঙ্গে। একটা ঘটনাবহুল সময় আমরা অতিক্রম করেছি এক ছাদের নিচে থেকে। এদেশে প্রাক্তন মানেই প্রতিপক্ষ। বিচ্ছেদ মানেই শত্রু হয়ে যাওয়া। কিন্তু, আমাদের ১৪ বছরের বিভাজিত সময়ে কেউ কারো শত্রু হইনি, বন্ধু হয়েও থাকিনি। চেষ্টা করেছি শ্রদ্ধা ও দূরত্ব বজায় রেখে চলতে। এমনকি, এত বছর এক শহরে থেকেও আমাদের কোন দিন আর কথা হয়নি, দেখাও নয়। অনেকটা সিনেমার মতই যেন।
আমাদের প্রেমের রসায়ন যখন কাজ করল না আর, তখন আপনা থেকেই আমাদের সম্পর্কটা একটা বাঁকে মোড় নিল। আমরা উভয়কে ছেড়ে চারপাশের ব্যাপকতায় জড়িয়ে ফেললাম নিজেদের। সন্তান, দু’জনের পরিবার, ওর পত্রিকার জগত, আমার ফিল্ম, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে নিয়ে আমাদের একটা বৃহৎ পরিমন্ডল তৈরি হয়ে গেল। বহু মানুষের আনাগোনা আমাদের ঘিরে, আমরা তাতে নিয়ামক মাত্র। আমাদের বাসা শুধু আমাদের তিনজনের হয়ে থাকল না। ওটা হয়ে উঠল সব্বার। আমাদের দু’জনেরই কর্মময় জীবন। ওর খবরের কাগজ, আমার টেলিভিশন আর ফিল্ম। খুব কাছাকাছি দুই মাধ্যম। ফলে ওর বন্ধুরা আমার আর আমার বন্ধুরা ওর হয়ে উঠল। পরিবারের ক্ষেত্রেও তাই। দু’জনেই দুই শ্বশুরকুলে জনপ্রিয়। সকলি ঠিক আছে, ছন্দে আছে, শুধু আমাদের মাঝের ছন্দটা অনুপস্থিত। রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ থেকে এককালে নাম বেছে নিয়েছিল অমিত। সেই নামের একধরনের সার্থকতার দেখা মিলল আমাদের জীবনে— পথ বেধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/ আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।
অমিত আধুনিক এবং স্রোতের বিপরীতে হাঁটা একজন মানুষ। সব নিয়ম ভেঙেচুরে সয়লাব না হওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি নেই। একদা বিপ্লবের চেতনার প্রয়োগ ঘটিয়েছিল ওর কাজে, খবরের পাতায় পাতায়। ওর জীবনে পত্রিকাই সব, বাকি সব গৌণ। He ate news, slept news, dreamt news… সকালে ঘুম ভেঙে সবার আগে পত্রিকার মুখ দেখা এবং City Edition দেখে ঘরে ফেরা- এই একটা রুটিনই ও জীবনভর পালন করেছে। চা খেতে খেতে প্রতিটা পত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত কারা কি হেডলাইন করেছে, কোন নিউজের কি ক্যাচমার্ক গেল, কারা প্রথম পাতার খবর শেষের পাতায় নিয়ে গেল। কারো ট্রিটমেন্ট মোক্ষম হলে ‘দুর্দান্ত’ বলা এবং ফোন করে সেই পত্রিকার সম্পাদককে ফোন করে জানানো- এসব আমার দেখা। নিউজম্যান বলতে যা বোঝায় তা ছিল ওর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। জীবন কেটে গেছে একটার পর একটা পত্রিকা তৈরির নেশায়। শুধু অমিত নয়, একটা সময় ছিল যখন অমিত এবং ওর সাংবাদিক বন্ধুরা এদেশের সংবাদ মাধ্যমকে পাল্টে আধুনিক রূপ দেবার জন্য নিরলস কাজ করে গেছে। এক্সপেরিমেন্ট করেছে, চ্যালেঞ্জ নিয়েছে।পেশাগত জীবনে তারা ছিল সৎ এবং সাহসী। খুব সম্ভবত নৈতিক সাংবাদিকতার শেষ প্রজন্ম। সেই পাল্টানো সময়টা আমার দেখা। যারা রাজনীতি থেকে পলিসি মেকিংয়ে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। সংবাদপত্রের পেইজ মেকাপ থেকে শুরু করে ট্রিটমেন্ট পর্যন্ত যারা স্টাইলিশ ছিল। তাদের জীবনযাপন, চিন্তাধারাও এর বাইরে নয়। অসাম্প্রদায়িক এবং উদার নৈতিকতা তাদের পাথেয় ছিল। টাকা দিয়ে কেনা যেত না। ভয় দেখিয়েও নয়। অমিত তাদের অন্যতম একজন হওয়ায়, আমি নীতিগত জায়গা থেকেই তার চলার সঙ্গি হিসেবে থেকে গিয়েছিলাম। যাতে একজন সৎ সাংবাদিক নির্বিঘ্নে কাজ করে যেতে পারে।
প্রচারবিমুখ বলতে যা বোঝায় তাই ছিল অমিত। সে তাঁর রাজ্যে রাজ করতে ভালোবাসত। আমার মনে পড়েনা, কোনদিন কাউকে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছে সে। জোর করেও কেউ টক শোতে নিতে পারেনি। ২০০১ এ একুশে টিভি একটা বড় ঘটনা। পুলকদা (পুলক গুপ্ত) ডেইলি ডাকেন অমিতকে কথা বলতে যাবার জন্য একটা সম্পাদকীয় অনুষ্ঠানে। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ভাইও দু’তিনদিন কল দিলেন। তো আমি বললাম, উনাদের সম্মান জানিয়ে হলেও একবার যাও। ভাল না লাগলে আর নাহয় যেও না। রাজি হল সকালের শো’তে যেতে। কারন, সন্ধ্যায় তো ওর নিজের অফিস। আমি প্রবল উৎসাহে দু’টো এক রঙা শার্ট নিয়ে এলাম। তখনকার একুশে টিভির ট্রেন্ড। অমিত গেলো ঠিকই, তবে উইথ রিজার্ভেশন। ফিরে এসে ঘোষণা দিল আর যাবেনা। কারণ, ওটা ওর মাধ্যম নয়। স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। আমি যখন চ্যানেল আই-তে খবর পড়ি, তখন তৃতীয় মাত্রা খুব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। এর উপস্থাপক জিল্লুর ভাই অমিতের বন্ধু। বারকয়েক অমিতকে বলার পর ও যখন রাজি হলনা, তখন আমাকে দিয়ে বলাতেন। কোন লাভ হয়নি। অমিতের কথা, আমাকে কেন টিভিতে গিয়ে কথা বলতে হবে! কথা যা বলার তা তো আমি আমার পত্রিকায় বলছি। শুধু তাই নয়, কোনদিন কোন ফরম্যাল ইনভাইটেশনে যেতনা। সে যত বড় অনুষ্ঠানই হোক। এমনকি কোন রাষ্ট্রীয় দাওয়াতেও নয়। প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াতে সবাই যায়, একমাত্র অমিত ছাড়া। ওর আড্ডা-পার্টি সব হতে হবে বাসায় অথবা চেনা কোথাও। এবং তার সঙ্গিসাথী বলতে ওই সেই অফিসের কলিগ। পদাধিকারবলেই মিডিয়ার কিছু সুযোগ সে পেত, কি জমি, কি প্লট। ওদিকে তার নজরই যেত না। জীবনে প্রেসক্লাবের সদস্যই হলনা। অমিতের উত্তর একটাই, ওকে কেন দলবাজি করতে হবে! ওর সব আকর্ষণ ছিলো প্রতিদিনের পত্রিকার পাতায় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। সব সময় বলত, জীবনে Zeal থাকতে হয়। ফলে, যেখানে Zeal নেই, সেখানে অমিতও নেই। বলাই বাহুল্য, খুব পারফেকসনিস্ট ছিল কাজের ক্ষেত্রে। স্বভাবে রসিক ও সহজ হওয়ায় টিম লিডার হয়ে উঠতে বেশিদিন সময় ব্যয় করতে হয়নি ওকে।
আজ যখন Impersonal হয়ে এই লেখা লিখছি, তখন এই মূহূর্তে ওর ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে থাকবার একটি ঘটনা মনে পড়ল। ২০০০ সালের ঘটনা- আমি কিছুদিন ভোরের কাগজে কাজ করেছিলাম। অন্যপক্ষ আর পাঠক ফোরাম নামের দু’টো পাতার সম্পাদনার কাজ করি আর অমিত তখন প্রধান বার্তা সম্পাদক। সেপ্টেম্বরের দিকে ভোরের কাগজের ক্রাইসিস শুরু হল এবং সিদ্ধান্ত হল ৭০ জন কর্মী ছাটাই হবে। বিশাল কলেবর থেকে ছোট করা হবে পত্রিকা। এমন কি পাতার সংখ্যাও কমে যাবে। কিন্তু, অন্যপক্ষ আর পাঠক ফোরাম থাকবে, সাপ্তাহিকী হিসেবে। আমি বুঝতে পারছি অমিত খুব বেকায়দায় পড়ে গেছে, গম্ভীর হয়ে থাকছে। নিজে থেকেই বললাম, আমি রিজাইন দেই, তাহলে তোমার সিদ্ধান্ত দিতে সুবিধা হবে। ও খুব লজ্জা পেল ঠিক কিন্তু, হাফ ছেড়েও বাঁচল। আমি রিজাইন করে এলাম। বেনজীর ভাই কিছুতেই আমার রিজাইন লেটার এক্সেপ্ট করবেন না। বললাম, আমি চাকরি না ছাড়লে তো অমিত ঘোষণা দিতে পারছে না।
একে অন্যের কাজের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সমর্থন থাকায় ঐ একটা বিষয়ে আমাদের কোনদিন সংঘাত হয়নি। এবং কেউ কারও কাজে কক্ষনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াইনি। বরং সাবধান করতাম। বন্ধু যেমন ছিল অমিতের, শত্রুও তো কম নয়। যাদের যাদের ব্যাপারে সাবধান করেছি, একটা সময় গিয়ে ঠিক তা নিজে প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু, সে তো কারও কথা শোনার লোক নয়। ওর যা মনে হয়েছে সেটাই সত্য। যেকথা আমি তখনও বলতাম, তা এখনো বলছি- এটাই ছিল ওর একিলিস হিল। কাউকে একবার আস্থায় নিলে তার প্রতি অন্ধ থাকা। অনেক সময় বুঝেও কিছু না বলা। অথচ ওর প্রবল লজিকের সঙ্গে এটা যায়না। আমি মনে করি, কোথাও হয়ত একটা ইনসিকিওরিটি কাজ করত। যারা ঘিরে থাকবে তারা যে সকলেই ওর বন্ধু নয়, সেটা জেনেও এড়িয়ে যেত। হয়তো পত্রিকার স্বার্থেই এটা করত।
অমিত ছিলো ক্রিকেটপাগল ও ব্রায়ান লারার ডাই হার্ট ফ্যান। আমি ক্ষ্যাপাতাম, ব্রায়ান লারা ওর মানস পুত্র বলে। একথা শুনে মজা পেত, খুশিও হত। ব্রায়ান লারার খেলাকে ও শিল্প পর্যায়ে গন্য করতো। যুক্তির অভাব ছিলনা লারাকে মহান করে তোলার। তার খেলা থাকলেই ডে অফ নিত। আয়োজন করে খেলা দেখত ছেলে আর আমার দেবরদের সাথে নিয়ে। ওদের গ্রামের বাড়ি যাবার সময় প্রতিবার বাপ-ছেলে মিলে ক্রিকেটের নতুন কিট সঙ্গে নিয়ে যেত। সকাল-বিকাল দু’বেলা চলতো সেই টেস্ট ম্যাচ। আর আমাকে ক্রিকেট খেলা দেখানো ওর একটা মিশনের মধ্যে ছিল। একবার টানা টেস্ট দেখে বললাম, ক্রিকেট ময়দান তো জীবনের মত। একথা শুনে অমিত যে পরিমাণ খুশি হয়েছিল, তা আর কখনো হতে দেখিনি। ওর নিজের জীবনটাও ক্রিকেট ময়দান বানিয়ে ফেলল। এই উইকেট পড়ছে তো, এই বাউন্ডারি! কিন্তু, মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত ক্রিজ ছেড়ে যায়নি। ব্যাটিং করতে করতেই চলে গেল। আমার দেখা ওর একমাত্র ইন্সপিরেশন ব্র্যায়ান লারা। লারার মতোই একের পর এক পত্রিকার রিস্ক নিয়েছে, এবং বলা যায় সফলও হয়েছে। পূর্বাভাস, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, যায় যায় দিন, কালের কন্ঠ, দেশ রূপান্তর— এ সকল পত্রিকাই নিজ নিজ বৈশিষ্টে আলোড়ন তৈরি করা। এর বাইরেও সমকাল আর চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালেও অসফল নয়। সব সময় একটা ট্রেন্ড তৈরির চেষ্টা ও করত। এমন কি তা জীবনেও। তথাকথিত জীবন-যাপনের লোক ছিলনা অমিত। সংসার সে করতে চেয়েছিলো ঠিক। প্রেমে পাগল হয়ে আমাকে বিয়েও করেছিল। কিন্তু, বেশিদিন এক নিয়মে অভ্যস্ত থাকা ওর পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এবং এ নিয়ে ওর সহজ স্বীকারোক্তিও ছিল— বিয়ে সিস্টেমটা ওর জন্য নয়, কিন্তু সমাজে এরচে’ বেটার অপশনও নেই। ওর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট ধারনা নেই বললেই চলে। তবে সে চেষ্টা করেছে নিয়ম ভাঙবার।
মান্না দে খুব ভালোবাসতো অমিত। আমি একদমই নয়। বেশ একটা রসিকতা হত আমাদের মান্না দে’র গানের লিরিক নিয়ে। আমি খুব মিমিক্রি করতাম মান্না দে নিয়ে। বলতাম, ‘এ নদী এমন নদী, জল চাই একটু যদি/ দু’হাতে উষ্ণ বালু দেয় আমাকে‘ গানটি ওকে নিয়ে লিখে গেছে। খুব মজা পেত অমিত এবং জগতের যাবতীয় যুক্তি দাঁড় করাতো সেসব খণ্ডনের। আমি একটা ‘মেইক বিলিভ ওয়ার্ল্ডে’ বাস করি, এই কথাটা অমিতই আমাকে প্রথম বলেছে। বলত তখন যখন আমি কোন বোকামি করতাম। রেগে গিয়ে বলত, লোকে তো নিজের ভালোটা বোঝে, তুমি তাও বোঝো না! আমি আবেগী মানুষ, অমিত যুক্তিবাদী। ফলে আমার অনেক কিছুই ওর জাগতিক মনে হতো না। কথাটা অনেক পরে গিয়ে আমার সত্য মনে হয়েছে। ‘মেইক বিলিভ ওয়ার্ল্ডে’ বাস করি বলেই হয়তো আমি অনেক কলুষের মাঝেও নির্মোহ হয়ে থাকতে পারি। প্রত্যাশা আহত হলে নির্বান নিয়ে নেই। বিচ্ছেদের আগেও বলে গেছে, ‘তুমি মানুষটা অদ্ভুত! আমি আজো তোমাকে চিনতে পারলাম না।’ আমি আর বলিনি যে, আমি ওকে চিনি কিছুটা। চিনেছি বলেই হয়তো কোনদিন পজেসিভ হতে পারিনি। কক্ষনো দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়ই করতে যাইনি। শুধু আগল খুলে খুলে দিয়েছি। কারণ, জানতাম এসবে লাভ নেই। ওকে ওর মতো করে থাকতে দিতে হবে। একটা সময়ের পর আর ঝগড়া হতো না আমাদের। এ নিয়ে ও রেগে যেতো। কেন আমি রিয়্যাক্ট করছি না। একে তো অমিত কোন নিয়ম রক্ষাকারী মানুষ নয়, তার ওপরে সাংবাদিকের জীবন কোলাহলময়। এটা একটা আলাদা যাপন পদ্ধতি। যতদিন ও চেয়েছে, আমি ওর সেই যাপনের অংশীদার হয়ে থেকেছি। যখন আর চায়নি, চলে গেছি। এখন দূর থেকে জীবন স্পষ্ট দেখতে পাই। আমাদের আলাদা কোন জীবনচক্র তৈরি হয়নি। বয়সে বেশি হবার কারণেই হোক আর অপেক্ষাকৃত প্রভাব বিস্তারকারী মানুষ হিসেবেই হোক, আমি ওর নিয়মের জীবনচক্রে ঢুকে পড়েছিলাম। শেষের দিকটায় ওর কাজের পরিধি যত বেড়েছে, ততই ওর চক্র হয়ে গিয়েছিল জীবনানন্দের ভাষায় ‘উশৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল’। আর অপর দিকে ফিল্ম মেকারের দরকার অভিনিবেশ-বান্ধব পরিবেশ, সেখানে নৈঃশব্দ খুব জরুরি, নিরবিচ্ছিনতা পাথেয়। চলচ্চিত্র মোহনীয় হলেও, নির্মাতার জীবন কঠিন নিয়মের কাঠামোয় আবদ্ধ। ফলে, আমাদের দু’জনের জীবনস্রোত সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছিল। এবং তা যথেষ্ট পরিমান টক্সিক হবার আগেই আমরা আলাদা হয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। প্রথম প্রথম ডিভোর্স-এ রাজি হচ্ছিল না ও। প্রায় দুই বছর আলাদা থাকবার পর আমি যখন টের পেলাম ওর এখন আমার থেকে ফরম্যাল মুক্তি খুব জরুরি, তখন আমিই মুক্ত করে দেবার সকল আয়োজন করি। দিনশেষে ঐ একটাই স্বস্তি, আমি কোনদিন ওর বাঁধা হয়ে থাকিনি। জীবন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট সবাই করতে পারে না। সাহস লাগে। অমিত দু’হাত মেলে নিজের মত করে তার জীবন কাটিয়ে গেছে। নিজের জীবনেটা হাতের মুঠোয় রাখতে পেরেছে। তা হয়তো সকলের চাওয়ামতো নয়। জীবন তো নিজের, কাজেই চাওয়াটাও নিজের হওয়া উচিৎ বলেই আমি মনে করি। সবাই যখন অমিতের অকস্মাৎ মৃত্যুর পর খুব আফসোস করছিল, আমি ভাবছিলাম- এ নিয়ে অমিতের তো কোন আফসোস থাকবার কথা নয়।
জুলাই এর ২১ তারিখ অফিসেই ব্রেইন স্ট্রোক করল অমিত। ১২ বছর পর আমি অমিতকে দেখতে গেলাম হাসপাতালে। ‘কবে তুমি গেয়েছিলে, আখির পানে চেয়েছিলে ভুলে গিয়েছি…’ আমিও ভুলেই থাকতে চাইলাম। ওর অসহায় অসুস্থ চোখ আমি দেখতে চাইনি। ঘুমন্ত অবস্থায় কোনমতে উঁকি মেরে দেখা। তারপর থেকেই শুরু হলো আমার অদ্ভুত এক যাত্রা। এ বোধের সঙ্গে আমি পরিচিত নই। রাগ, ক্ষোভ, আফসোস, বেদনা, আঘাত সব হাহাকার হয়ে বাজতে থাকলো। এই ক্ষমা করে দিচ্ছি তো এই সব মনে পড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি ও ক্রমশঃ মরে যাচ্ছে। আমার অবস্থা হয়ে গেলো ‘যে নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত লাগিতেছে আমার শরীরে।’ অমিতের কোন কিছুতে বাধা হয়ে দাঁড়াইনি বলেছি আগেই। এবারে দাঁড়ালাম মনে মনে। চাইলাম- যেন বেঁচে থাকে। সুস্থ হয়ে ওঠে। তুখোর তুবড়ি ছুটিয়ে কর্মময় জীবনে আর একবার চক্কর মারে যেন সে! তা তো হবার নয়। ২৮ এর রাতে নিঃশব্দে চলে গেল অমিত।
সময়ের মতোই ক্ষণস্থায়ী সংবাদ। এখানে শোকের আয়ু বড়জোর একদিন! এখানে শিরোনাম হয়ে থাকবার সুযোগ কম। জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক আর দীর্ঘ সাংবাদিক জীবন হবার দরুন অমিত দুইদিন শিরোনাম হয়ে থেকেছিল। কি বিচিত্র আইরনি! জীবনানন্দ দাশ বরাবর খুব পছন্দের আমাদের। একদা যে জীবন আমরা কাটিয়েছি তার কথা আর না বাড়াই। বরং শেষ করি আজ সেই সময়কে উৎসর্গ করে জীবনানন্দের এক ছত্র দিয়ে—
“আমাকে তুমি খুঁজিয়াছিলে একদিন/ কখন হারায়ে যাই– এই ভয়ে নয়ন মলিন করেছিলে তুমি!/ জানি আমি, – তবু, এই পৃথিবীর ফসলের ভূমি আকাশের তারার মতন ফলিয়া ওঠে না রোজ/ দেহ ঝ’রে, তার আগে ঝ’রে যায় মন তার আগে!”
সারাবাংলা/আরএফ