ক্যান্ডেল রাত্রির দুই কন্যা
২৩ আগস্ট ২০২২ ১৪:৪৩
জানো আপু, আজকে রাতে না আমরা ক্যান্ডেল ডিনার করবো! ভীষণ উৎফল্ল রেহানা। মুখে হাসি।
বড় আপা বিছানায় শুইয়ে পুতুলকে ঘুম পারাচ্ছেন। পাশে আপন মনে খেলছে জয়। বিরক্ত হলেন বড় আপা, চুপ। দেখছিস না, পুতলু কে ঘুম পারানোর চেষ্টা করছি।
বড় আপার বিরক্তিতে কিছু আসে যায় না বেহানার। চঞ্চল মেয়েটি পাশে বসে বড় আপার পাশে বিছনার উপর, ফিসফিসিয়ে বলে বড় আপুর কানের কাছে মুখ নিয়ে, নীচে আন্টি বললেন অন্যরকম ডিনার হবে আজ রাতে। তোমার আমার জন্য এই ডিনারের আয়োজন।
উৎসুক হলেন বড় বোন, তোর কথার মাথামুণ্ডু কিুছই বুঝলাম না। ক্যান্ডেল ডিনার আবার কী?
উৎসাহে আরও চঞ্চল রেহানা, বুঝলে না? ডিনারের টেবিলের উপর বা চারপাশে কোনো লাইট থাকবে না। টেবিলের চারপাশে থাকবে মোম।সেই মোম আমি তুমি আর দুলাভাই জ্বালাবো। সবগুলো মোম জ্বালিয়ে দিলে কী ধরনের আলো হবে! তুমি ভাবতে পারো- কেমন হবে ঘটনাটা? আমি তো ভীষণ উত্তেজিত, ক্যান্ডেলের আলোয় আমরা ডিনার করবো।
হয়েছে, বড় আপা ধমক দেন হালকা গলায়, চুপ থাক।
চুপ কী থাকে রেহানা, জানো আপা যদি রাসেলটা সঙ্গে থাকতো, দারুণ মজা হতো। ওকে নিয়ে আসলে তো খুবই ভালো হতো!
ইউরোপ অসম্ভব সুন্দর মনোহর মহাদেশ পৃথিবীর। পাশাপাশি দেশ বেলজিয়াম ও জামার্নী। মধ্যে আগস্ট। শীত ঝাকিয়ে আসছে। কুচি কুচি বরফ পড়ছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিশোরী বয়স রেহানার। ই্উরোপে প্রথম এসেছে বড় বোন ও দুলাভাইয়ের সঙ্গে। দুলাভাই এম এ ওয়াজেদ মিয়া স্কলারশিপ নিয়ে জামার্নী এসেছেন পরমানু বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার জন্য। ঢাকায় ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ির মালিক ফজিলাতুন নেসা রেণু বড় মেয়ে আর জামাইকে একা সূদূরে ছাড়তে চাননি, মেয়েটার সঙ্গে দুটি শিশু। রেহানার পড়াশুনা থাকলেও মা রেণু আর পিতা শেখ মুজিবের কথায় বোনের সঙ্গে আসতে রাজি হয়েছে রেহানা। এখন মনে হচ্ছে, বড় আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে ইউরোপ এসে ভালোই হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের দেশগুলো একেবারেই আলাদা। সবকিছু কেমন ছবির মতো সাজানো, গোছানো। মানুষগুলো চমৎকার। কোনো ভান বা ভনিতা নেই- সহজ সরল আর উৎসবমুখর।
ইউরোপের পুরো ভ্রমণের ভার জামার্নীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর উপর রেখেছেন শেখ মুজিব। যেহেতু শেখ মুজিবের বড় জামাতা ওয়াজেদ জার্মানী থেকে পড়াশুনা করবে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়তো পরবেই। জামার্নী আসার পর পরই প্রতিবেশী রাষ্ট্র রেলজিয়ামে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হক আমন্ত্রন জানান, ব্রাসেলস বেড়িয়ে যাবার জন্য শেখ মুজিবের দুই কন্যাকে। কিন্তু জামাতা ওয়াজেদের পরিকল্পনা ফ্রান্স বেড়ানোর। যেহেতু তিনটি দেশই পাশাপাশি – জার্মানী, বেলজিয়াম এবং ফ্রান্স, সেই হেতু ফ্রান্সে যাওয়ার আগে ইউরোপের আর একটি মনোহর দেশ বেলজিয়ামে রাষ্ট্রদূতের বাসায় দুদিনের আতিথ্য গ্রহন করাই যায়। রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের সঙ্গে শেখ মুজিবর রহমানের পরিচয় অনেক দিনের। পরিচয়ের একটা মূল্যতো আছেই।
চৌদ্দই আগস্ট রাতে অনিন্দ্য সুন্দর ডিনার সারেন ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, রাষ্ট্রদূত কবি সানাউল হক, রাষ্ট্রদূতের স্ত্রীসহ একসঙ্গে। গল্পে গল্পে মোমের আলোয় ভরে উঠেছিল ডিনারের টেবিল। রেহানার জন্য অন্য ধরনের নতুন অভিজ্ঞতা। ইস, রাসেল যদি আসতো! নিজের মনে বলে রেহানা।
কী খবর মা! রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের স্ত্রী ডিনারের টেবিলে বসে তাকান শেখ হাসিনার দিকে, তোমাকে কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছে? ভালো লাগছে না?
মৃদু হাসেন শেখ হাসিনা, আন্টি ডিনার তো দারুণ আয়োজন করেছেন। আমরা সাধারনত ইলেকট্রিক আলোতে রাতের খাবার খেতে পছন্দ করি। কিন্ত আপনারা আজ মোমের আলোয় এমন আয়োজন করলেন, জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। খুব ভালো লাগছে আন্টি। আর খাবারের মেনুও ভীষণ সুস্বাদু।
রাষ্ট্রদূত কবি সানাউল হক তাকান জামাতার দিকে, তোমার কেমন লাগছে বাবা?
চমৎকার, অন্যরকম অভিজ্ঞতা আংকেল, ওয়াজেদের মুখে মৃদু হাসি।
চারদিকে এতো আনন্দ, জীবনে প্রথম ক্যান্ডের রাত্রির ডিনার উপভোগ করছে শেখ হাসিনা, কিন্তু মনের মধ্যে একটা নিঃশব্দ ঘূনপোকা কুটকুট কেটে যাচ্ছে মনটাকে। আসার সময়ে মা শেখ হাসিনাকে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন। কোথাও গেলে মা একটু গম্ভীর থাকেন, কিন্তু কখনো এমন করে কাঁদেন না। কেনো কাঁদলেন? মায়ের জন্য বুকের মধ্যে একটা কষ্ট দানা বেঁধে উঠতে থাকে বড় মেয়ে শেখ হাসিনার।
রাতের ডিনার শেষ হওয়ার আরও কিছুটা সময় গল্প গুবজ করে যে যার রুমে ঘুমুতে চলে যায়। সকালে উঠেই ছুটতে হবে প্যারিস। অনেক দিনের ইচ্ছে ওয়াজদে মিয়ার প্যারিস দেখার। শ্বশুর শেখ মুজিবুর রহমান নিজের বাড়ির খাওয়ার টেবিলে নিজেই বলেছেন, ইউরোপ যাবে আর প্যারিস যাবে না, সেটা হয় না। প্যারিস হলো সভ্যতার কেন্দ্র। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির পীঠস্থান। সুযোগ পেলে ওদের নিয়ে ঘুরে আসবে।
জি যাবো। সায় দিয়েছিলেন ওয়াজেদ মিয়া।
পনেরোই আগস্ট খুব ভোরে সানাউল হকের বাসায় টেলিফোন বাজে খুব কর্কশভাবে। ঘুমিয়ে থাকা শেখ হাসিনার কানে টেফিলোনের শব্দ তীব্র আত্মযন্ত্রনায় বাজে, মনে হলো এই টেলিফোন কোনো দু:সংবাদ বহন করছে। বাসার অন্যান্যরও ঘুম ভাঙ্গে। কারণ সকালে শেখ পরিবারের সদস্যরা যাবেন ফ্রান্সে। সবার মধ্যে একটা টেনশন আছে। সেই টেনশনের মধ্যে ফোন ধরলেন রাষ্ট্রদূত সানাউল হক। সানাউল হকের স্ত্রী ডাকলেন শেখ হাসিনাকে ফোন ধরার জন্য। নীচের রুমে ফোন ধরে ছিলেন সানাউল হক। শেখ হাসিনাকে দেখে বললেন, তুমি না। জামার্নীর রাষ্ট্রদূত জরুরী কথা বলতে চান ওয়াজেদের সঙ্গে।
শেখ হাসিনা রুমে ফিলে ওয়াজেদকে জানালেন, আমার সঙ্গে নয়। হুমায়ন চাচা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
তাই নাকি? ওয়াজেদ বিছানা থেকে নামেন।
হ্যাঁ, শেখ হাসিনা বিছানায় বসে ঘুমন্ত পুতুলের মাথায় হাত রাখেন, আমার মনে হয় কোনো দু:সংবাদ আসছে।
আমি দেখছি, ওয়াজেদ নিচে নেমে গেলেন।
নীচে টেলিফোন সেটের সামনে রিসিভার রাখা। রাষ্ট্রদূত সানাউল হক খুব চিন্তিতমুখে রুমের মধ্যে পায়চারী করছেন। ওয়াজেদ রিসিভারটা কানে তোলেন, হ্যালো?
আজ ভোরে বাংলাদেশে কু দে তা হয়েছে। আপনারা প্যারিসে যাবেন না। রেহানা হাসিনাকে এ ঘটনা জানাবেন না। আপনারা এখুনি আমার এখানে বনে চলে আসুন- টেলিফোনের ওপাশে জার্মানীর বনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী।
কী উত্তর দেবেন, কী বলবেন- বুঝে উঠতে পারছিলেন না ওয়াজেদ মিয়া।
মাথা ঠাণ্ডা রাখবেন, এখন আপনি শেখ মুজিবের দুই কন্যার অভিবাবক। ভয় পাবেন না, ইউরোপ সভ্য মানুষদের এলাকা। এখানে আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না, টেলিফোনের পাশ থেকে সুরেলা গম্ভীর গলায় বলছেন হুমাযুন রশীদ চৌধুরী।
জি, আমি বুঝতে পারছি, ওয়াজেদ ফোন রেখে উপরে গেলে দুই একসঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কী বলেছেন হুমায়ুন চাচা?
নিজেকে সামলে নিয়ে উত্তর দিলেন ওয়াজেদ মিয়া, তেমন কিছু না বলেন নি তিনি। শুধু বলেছেন প্যারিস যাত্রা বাতিল করে বনে, ওনার কাছে যেতে বলেছেন।
নিশ্চয়ই এমন কোনো দুঘটর্না ঘটেছে, যা আমাদের বলতে চাইছো না- বলেন শেখ হাসিনা।
আসলে আমাকে তেমন কিছুই জানানি তিনি- ভেতরে ভেঙ্গে যেতে যেতে উত্তর দেন ওয়াজেদ মিয়া, আমি কী আর বলবো?
ঠিক আছে, তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত প্যারিস না যাওয়ার কারণ বলবে, ততক্ষণ আমরা এই বাসা থেকে অন্য কোথাও যাবো না, আমি এই বসলাম, শেখ হাসিনা চেয়ারে বসে, নিজের পাশে বসায় শেখ হেরানাকে।
ওয়াজেদ মিয়া বিচলিত, মানুষের জীবনে মুমূর্ষ সময় আসে কিন্তু এই ভাবে? তিনি নিজেও প্রকৃত ঘটনা জানেন না। বনের রাষ্ট্রদূত যেটুক জানিয়েছেন, সেই টুকুই জানেন। অভ্যুন্থান একটা হয়েছে বাংলাদেশে, নইলে এতো সকালে হুমাযূন রশীদ চৌধুরী জানাতেন না। কিন্তু কী হয়েছে, কারা করেছে, কেউ কী মারা গেছেন, গেলে- কে কে? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বেঁচে আছেন? নিজের মনের মধ্যেই প্রশ্নগুলো জ্বলছে দাউ দাউ আগুনে। সেখানে এদেরকে কী বলবেন? আবার ইডেন কলেজের নেত্রীর মতো জেদ ধরে বসেছে শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা- দুই বোনে। নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া বলেন, বাংলাদেশে কী একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে, সেজন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া বন্ধ।
সঙ্গে সঙ্গে দুই বোন একে অপরকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দুই বোনের কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় পুতুল ও জয়ের। ঘুম থেকে উঠে মা ও খালার কান্নায় শিশু দুজনও কাঁদতে শুরু করে। দুই বোন দুজনকে কোলে নিয়ে হাঁটে আর কাঁদতে থাকে। বিমূঢ় বিপন্ন অসহায় ওয়াজেদ মিয়া দাঁড়িয়ে দেখছেন দুই কন্যাকে, যারা রাতে ছিলেন রাজার কন্যা, সকালে হয়ে গেলেন রাস্তার মানুষ!
জামার্নীর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে নীচের ড্রয়িংরুমে ফোনে কথা বলছেন কবি রাষ্ট্রদূত সানাউল হক, চৌধুরী সাহেব আমাকে শুনছেন? সানাউল হকের গলা গম্ভীর।
জী শুনছি, বলুন।
আপনার জিনিষ আপনি নিয়ে যান আমার বাসা থেকে, এখনই। আমি এদের রাখতে পারবো না।
টেলিফোনের ওপাশে হুমাযূন রশীদ চৌধুরী অভিজ্ঞ পোড় খাওয়া মানুষ। জীবনের অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, দেখেছেন মানুষের রূপান্তর। তারপরও বন্ধু বিশিষ্ট ভদ্রলোক সানাউল হকের এই নৃশংস পরিবর্তনে মর্মাহত হলেও সামলে নিলেন, আমিতো ওদেরকে আমার কাছে বনে আসতে বলে দিয়েছি। ওরা আমার এখানে চলে আসলে তো সমস্যা নেই আপনার।
গুড, এখনই নিয়ে যান আপনার মেহমানদের। আমার বাসায় এক মুহুর্তও না-
অন্তত নাস্তাটা শেষ করুক। আর ওদের আসার জন্য আপনি একটা গাড়ি দিন।
আমি কোনো গাড়ি দিতে পারবো না!
একটা গাড়ি না দিলে ওরা কি করে আসবে এতো পথ পাড়ি দিয়ে?
সেটা আমি জানি না। কিন্ত আমার বাড়িতে এক মুহুর্ত এরা থাকুক আমি চাই না। ঢাকার বর্তমান সরকারের কাছে এই খবর পৌছে গেলে আমার সমস্যা হবে। আপনি কী চান, এদের জন্য আমি সমস্যায় পড়ি?
না, আপনার কোনো সমস্যা হোক, আমি চাই না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুণ, দেখি আমি ওদের আনার জন্য গাড়ি পাঠাতে পারি কি না!
সকাল দশটার দিকে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, এম এ ওয়াজেদ মিয়া- কোলে দুটি বাচ্ছা, হাতে কয়েকটি ব্যাগ নিয়ে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বিশিষ্ট কবি সানাউল হকের বাসা থেকে বের হয়ে বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়ালেন পায়ে হেঁটে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর পাঠানো গাড়ির রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন শেখ হাসিনা, কোলে জয়। অঝোরে কাঁদছেন তিনি। হতবাক জয়, আমার হাসিখুশি মা এমন করে কাঁদছে কেনো?
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি