গৌরীর পুনরাগমন
১ অক্টোবর ২০২২ ১৮:৪৭
মূল ফটক পেরুলেই বিশাল বাড়ি। পোড়া ইট আর চুন-সুড়কির তৈরি একহাত দৈর্ঘ্যের পুরুষ্ট দেয়ালের প্রকান্ড দালান। পূব থেকে পশ্চিম দিকটা দেখতে হলে কপালে হাত রেখে দিগন্ত দেখার মতো করে তাকাতে হয়। দু’তলা বাড়ির অসংখ্য কামরা হাট হয়ে খোলা, দরজা জানালার আগল বলতে কিচ্ছুটি নেই আর; মুক্তিযুদ্ধের সময় লুট করে নিয়ে গেছে লুটেরারা। শাবল- গাইতির দোর্দন্ড প্রতাপে দরজা- জানালাগুলো বাড়ি ছাড়া হয়ে গেছে সেই সময়েই। শুধু লুটেরাই বা কেন, পশ্চিমারাও পৈশাচিক কর্ম কম চালিয়েছে! তুলসী দাসের বাবা শশীবাবু, এই বাড়ির শেষ জমিদার; যখন যুদ্ধ বাঁধল, তখন তার বয়স পঁচাশির কিঞ্চিৎ এদিক সেদিক, মৃত্যুশয্যায় শায়িত। তুলসী দাসের একমাত্র পুত্র তখন কোলে, কাঁখের ছোট ছোট পুত্ররা আর পক্ষাঘাত রোগগ্রস্থা স্ত্রী ও মা। অগত্যা অসুস্থ বাবাকে বাড়ি পাহারায় রেখে বৃদ্ধা মাকে কাঁধে তুলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন তিনি। ছেড়েছিলেন এই ভেবে হানাদাররা গেলে ফিরে আসবেন। কিন্তু এ যাওয়া যে রামের বনবাস যাত্রা হবে তুলসী দাস ভাবেননি ঘূণাক্ষরেও। একলা ঘরে সেই বৃদ্ধ বাবাকেও পাকি হানাদাররা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। দেশ স্বাধীনের পরে এসে বাবার রক্ত মাখা শার্টটাই শুধু আবর্জনার স্তুপের নিচে খুঁজে পেয়েছিল তুলসী দাস।
মূল দালান ছাড়াও এই জমিদার বাড়িতে অনেকগুলো ঘর ছিল। দুধের ঘর, ভোগের ঘর, খাবারের ঘর, কাচারি ঘর, দোতলা ঘর, উত্তর ভিটে, দক্ষিন ভিটের ঘর, নানান নামে নাম রাখা। সব ঘরগুলো যুদ্ধের সময়েই হাপিস হয়ে গেছে। যারা দেখেছে, তারা বলেছে, হার্মাদের দলেরা যেন এক একটা দেও-দানব, মুহুর্তের মধ্যে এত বড় বড় ঘরগুলোকে দুর্গা প্রতিমার বিসর্জনের মতো করে হেলিয়ে দিয়েছে। প্রায় বছরখানেক বাদে দেশে ফিরে যেন নিজের বাড়িকেই অচেনা লাগছিল তুলসীর, ঘরের ভিটেয় বাঘ লুকানোর মতো জংগল। হেলায় বেড়ে ওঠা আম-জাম, লিচু কাঁঠালের গাছেদের প্রায় মা হওয়ার বয়স হয়ে গেছে। কোনোমতে দুইটা কামরা সাফসুতরো করে নতুন করে সংসার পাতেন রিক্ত জমিদারপুত্র! বাড়ির পূবে আর পশ্চিমে দুইটা বড় উঠোন, মধ্যিখানে বিশাল পাকা চাতাল, নাটমন্দির। আগে এই নাটমন্দিরের ওপরে ছিল বত্রিশ পায়ার বারো চালার আকাশ ছোঁয়া উচ্চতার ঘর, আজ সেসব নেই, কেবল চাতালটাই তার উদোম বুক চিতিয়ে শুয়ে আছে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে চিড় ধরেছে পাষাণের বুকে। নাটমন্দির লাগোয়া দুর্গা মন্দিরের অবস্থাও তথৈবচ, একেবারেই মূল দালানের মতোই।
আট জমিদারের এই গ্রাম, আশেপাশের দশ গেরামের রাজধানীর মতো, যেন পটে আঁকা। এই গ্রামে একসময় অর্ধশতের ওপরে দুর্গাপূজা হত। হতো এই জমিদার বাড়িতেও। দেবীপক্ষের প্রথমদিন থেকেই প্রতি সন্ধ্যায় নাট মন্দিরে পালা কীর্তনের আসর বসতো, আর পূজোর পাঁচদিন তো পাড়ায় কারোর বাড়ির চুলায় হাঁড়ি বসত না। সবাই জমিদার বাড়ির অতিথি। জাঁকজমক, রাজকীয় আভিজাত্যসহ সব ধরনের চাকচিক্যময় শব্দগুলো এই পাঁচদিন যেন এই বাড়িরই বাসিন্দা হয়ে যেত। সুবলের এইসব গল্প বাবা তুলসী দাসের কাছেই শোনা। তন্ময় হয়ে শুনত আর কিশোর মন তোলপাড় করে, ‘ইশ, আবার যদি নিজেদের বাড়িতে পূজো হতো।’
– বাবা, আমাদের বাড়িতে আর পূজো হবে না… না!
– না রে, দুর্গাপূজা রাজসিক পূজা, অনেক খরচা। এখন তো আর আমরা রাজা- জমিদার নেই, ভিখিরি হয়ে গেছি। চাল নেই- চুলো নেই, পূজো আর হয় কী করে। নীল রঙ্গের একটা দীর্ঘশ্বাস তুলসীর বুক চিড়ে বেরিয়ে বাতাসে মিশে যায়।
দমে যায় সুবলের কিশোর মন।
সুবল আর বীরবল, বয়সে খানিক বড়- ছোট হলেও বেড়ে উঠেছে যমজের মতো। শহরে বাবার একটা চাকরি হওয়াতে মায়ের সাথেই চৌকিতে ঘুমায় দুইভাই। সারারাত ঘুমন্ত মায়ের জেগে থাকা হাতে ঘুরতে থাকে হাত পাখা। মা -দাদা ঘুমিয়ে গেলেও সুবলের চোখে ঘুম নেই, রাজ্যের চিন্তা তার মাথায়। ইশ! বাড়িতে যদি পূজো হতো, নতুন জামা- প্যান্ট পেত, অঞ্জলি দিত, ‘ যা দেবী সর্ভূতেষু…’। পালপাড়ায় ধুনুচি বানায়, পোড়াতে গিয়ে কিছু নষ্ট হয়, ফেটে যায়, নষ্ট ধুনুচিগুলো ওরা ফেলে দেয়। ওখান থেকে নিশ্চয়ই কুড়িয়ে আনা যেত, হয়তো পাল কাকুরা কিছু বলবেন না, আর বললেই কী, ধরতে এলে ধুনুচি নিয়ে ভোঁ দৌড়ে পালাত, ধরতে পারলে তো! সেই ধুনুচি এনে ঢাকের তালে নাচতে পারত, দুই হাতে দুই ধুনুচি, আরেকটা মুখে। আচ্ছা! মুখের ধুনুচি থেকে যদি আগুন ছলকে পড়ে? পুড়ে যাবে না তো? গেলে যাক; তবুও নতুন জামায় যেন আগুন না পড়ে। নিশুতি রাতেও কানে কেমন ঢাকের আওয়াজ পাচ্ছে সুবল, ঢাক গুড় গুড়, ঢাক গুড় গুড়, ঢাক গুড় গুড় ঢাক। নেচে ওঠে তার কিশোর মন। মা ঘুমিয়ে যেতেই দাদা বীরবলকে ধাক্কা দেয় সুবল-
– এই দাদা, ঘুমিয়েছিস? ও দাদা, শোন না, একবার এদিকে ফির।
মায়ের ঘুম যেন না ভাংগে, ফিসফিস করে ডাকে সে। ঘুমন্ত বীরবল ভাইয়ের দিকে ফিরে কিন্তু চোখ খোলে না,
– দাদারে, আমাদের বাড়িতে পূজো হবে না? কোনদিনও হবে না! আমরা নিজদের উঠোনে আর কখনোই নাচবো না?
– না হোক, তাতে কী! প্রদীপদের বাড়িতে গিয়ে নাচিস, একই তো। ঘুমের চোখেই অনুচ্চারিত শব্দে বিড়বিড় করে বলে বীরবল।
– তোর কোনো শখ– আহ্লাদ নেই! কথা জমছে না দেখে নিরাশ হয়ে ওপাশ ফিরে সুবলও, ঘুমিয়ে যায় কখন যেন।
কয়েক মাস পর-
পূজো প্রায় এসেই গেছে, বাজারের রহমত টেইলার্সের দোকানে বেজায় ভীড়। এ পাড়া- ও পাড়ার বন্ধুরা কাপড় নিয়ে ভীড় জমায়। পূজোর নতুন জামা- প্যান্টের মাপ দিতে যায়, কেউ কেউ আবার সুবলকেও দেখায়, ‘দেখ এটা টেট্রন কাপড়, তিলা পড়বে না, ভাঁজ ভাংগবে না, ধুয়েই পড়া যায়, এমন ফুল তোলা জামা জীবনে দেখেছিস! আমার বাবা পাঠাইছেন, তোর বাপ কী পাঠাইছে?’ নিজেদের পাকা মন্ডপ থাকতেও পূজা হয় না, এমনিতেই মন খারাপ, তার উপরে বাবাটা যে কী! এখনো কিছুই পাঠাচ্ছে না! না পাঠাক, দরকার হয় অঞ্জলিই দেব না! মনে মনে পণ করে সুবল। চোখ বেয়ে জল নামে তার, হাতের চেটোয় চোখ মুছে বাড়ির পাশের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ও বাড়ির দিলীপ কাকু, সেই পাড়ার রমেশ জ্যাঠা আর তার ছেলে পরিমলদা একই শহরে কাজ করেন, বাবা যেখানে চাকরি করেন। সুবলের চোখ কেবলই দিলীপ কাকু, রমেশ জ্যাঠা আর পরিমালদাকে খুঁজে, এই বুঝি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাক এলো, ‘কই রে সুবল, পুঁটলাটা ধর, তোর বাপে পাঠাইছে।’ নাহ! কোনো ডাক আসে না! চটাং করে একটা থাপ্পড় পড়ে পিঠের ওপর, বেশ ব্যাথাও পায় সুবল- ‘বয়রা পোলা, কখন থেকে ডাকতেছি, কানে শুনছ না! যাহ গৌড়ার দোকান থেকে কেরোসিন নিয়া আয়, বাতি জ্বালাইতে হবে না! সন্ধ্যা তো নেমে গেল।’ মায়ের ঝাঁঝালো তীক্ষ্ণ বকুনি। কেরোসিনের বোতলটা দিলেও কোনো টাকা দেন না মা। বাজারে গৌড়াদার মুদি দোকান, বাকিতে সওদা আনে সুবলরা, খাতায় লিখে রাখে, বাবা টাকা পাঠালে শোধ করে। বাকির অংক বেশি হয়ে গেলে গৌড়াদা অন্য খদ্দেরের সামনে গালিগালাজ করে, ‘এই দিলাম, আজকাই শেষ, তোর মায়েরে কইস টাকা না দিলে বাকি সদাই বন্ধ।’ সুবলের মন খারাপ হয়, কষ্ট পায়, তবুও যায়, যেতেই হয় মায়ের ভয়ে।
পরের দিন স্কুল থেকে ফিরে চারটা ভাত খেয়েই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায় সুবল, আজ শহর থেকে কেউ না কেউ আসবেই, কেমন একটা নিশ্চিত ভাব জমেছে তার কিশোর মনে। মাথা উঁচু করে সূর্যটা দেখে, ডুবতে আর কত বাকি! সন্ধ্যে প্রায় হয়েই এলো, মন খারাপ হয় তার। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে মাটিতে ঘসে বৃত্ত আঁকে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল মাটিতে পড়ে, মাটি তা শুষেও নেয়। মনে মনে ভাবে পূজোতো এসেই গেল, কবে আর পাঠাবে বাবা! তবে কী এবারেও গতবারের মতো পুরোনো কাপড়ে অঞ্জলী দিতে হবে! বন্ধুরা কী বলবে! ফকির, ফকির ভাববে না!
দূরে একজনকে দেখা যাচ্ছে, হাতের আংগুলে জোনাক পোকার মতো সিগারেটের আগুনটা এই জ্বলছে আবার দুলছে। কাছে আসতেই দেখে দশাশই লোকটা দিলীপ কাকু, বাবার বন্ধু।
– কী রে রাস্তায় কী? পড়াশোনা নাই?
– সুবল উত্তর দেয় না।
– এই ধর, তোর বাপে পাঠাইছে। চকিতে আর উৎসাহে চোখ তোলে সুবল। পোটলাটা হাতে নিয়ে এক দৌঁড় দেয়, মা মা, বাবায় পাঠাইছে। দুই ভাইয়ের জন্য একটা করে ইজিয়ার হাফ প্যান্ট আর কোট কাটিং ছাপা জামা, মায়ের জন্য মিল এর শাড়ি এক জোড়া, ঠাম্মার জন্য সাদা থানের শাড়ি। নতুন জামা- প্যান্ট পেয়ে যেন সুবলের আর তর সয় না। কাল সপ্তমী পূজো, সকালেই প্রদীপদের বাড়ি যাবে, অঞ্জলী দিয়ে সেই বন্ধুটার বাড়ি গিয়ে নতুন জামা- প্যান্ট না দেখানো পর্যন্ত যেন শান্তি পাচ্ছে না সে। জলদি জলদি ঘুম দেয়।
সকাল থেকেই নিজেকে রাজা– বাদশাহ ভাবতে থাকে। সোজা পথে না গিয়ে ইচ্ছে করেই কয় বাড়ি ঘুরে নিজের নতুন জামা- প্যান্ট দেখিয়ে তবেই প্রদীপদের বাড়ি যায়। শুধু শুধু জামার বুক পকেটে হাত দেয়, প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটু কাত হয়ে দাঁড়ায়। অঞ্জলী দেওয়ার সময় বড়দের ফাঁক- ফোঁকর গলে একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। না না, ঠাকুর মশাইয়ের শ্লোক ভাল করে শুনতে পাবে বলে নয়, তার ইচ্ছে মা দূর্গাও যেন নতুন পোশাক কাছে থেকে দেখতে পান। দুই হাতে ফুল-বেলপাতা নিয়ে শ্লোক না পড়ে আড়চোখে কার্তিকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, ‘দেখ কে বেশি সুন্দর, তুমি না আমি!’ আড় চোখে মা দুর্গার দিকেও তাকায় সে।
রাতের বেলায় নাচতে যাবে প্রদীপদের বাড়ি। পাড়ার অন্যদের সাথে কথা বলে দলও পাকিয়ে ফেলেছে। এইবার সাথে একটা ভাংগা ব্লেডও লুকিয়ে নিয়ে যাবে। প্রদীপের বাবাটা একেবারে যা তা। ছোটরা নাচতে গেলে ঢাকিদের নামায় না প্রদীপের বাবা, ধুরছাই করে, ‘যা যা পোলাপাইন, যার যার বাইত্তে যা, এখন ঢাক বাজবো না, কাল ভোরে তিথি আছে, ঢাকিরা ঘুমাইবো।’ অথচ বড়রা নাচতে এলে মানা করতে সাহস পান না তিনি। তীর্থের কাকের মতো কতগুলো বাচ্চাসহ সুবল গুটিসুঁটি মেরে বসে থাকে উঠোনের কোণাটায়, মশায় কামড়ায়, তবুও অপেক্ষা করে, খুব কষ্ট পায় তারা, কান্না আসে, প্রদীপের বাবার নামে মা দুর্গার কাছে বিচার দেয়। এবারো যদি এমন করে, চুপি চুপি গিয়ে ব্লেড দিয়ে ঢাকের চামড়ায় এক পোছ মেরে দিবে দৌড়।
এমনই ছিল জমিদার বাড়ির গরীব সুবলদের শৈশবের দুর্গাপূজো। মেঘে মেঘে অনেক বছর গড়িয়ে গেলো। এখন সুবলদের বাড়িতে পূজো হয়, বলা চলে রাজকীয়ভাবেই। সেবার শহর থেকে এক দাদা এলেন গ্রামে, সুবলদের ঘরেই উঠলেন। কী সুন্দর দেখতে দাদাটা! মোটা ফ্রেমের চশমা, স্যুটকেস হাতে হেলেদুলে আসেন তিনি, গলার চেইনটা দেখানোর জন্য ইচ্ছে করেই বুকের বোতাম খোলা থাকে, হাতের আংগুলেও আছে গোটা দুয়েক সোনার আংটি। বাড়ি আসতে রিক্সা থেকে নেমে কিছুটা পথ, না হাঁটলেও চলে, তবে দাদা ইচ্ছে করেই হাঁটেন। গোপাট দিয়ে হাঁটার সময় ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে ‘ঐ কুডু’, বাম দিকে মুখ ঘুরিয়ে ‘কই রে হাসমত’ বলে হাঁক দিতে দিতে আসেন। বাড়ি ঢকতে ঢুকতে দলটা বেশ বড়ই হয়। এরা সবাই দাদার চ্যালা। বাড়ি এসেই চকচকে স্যুটকেসটা সবার আগে মায়ের হাতে দিয়ে প্রণামটা সেরেই বারান্দায় বসে যান, গোল হয়ে মজলিস জমে। এর ফসল ক্ষেতে ওর গরু লেগেছে, তার পুকুরে সে বিষ ঢেলেছে, পূব পাড়ায় কুদ্দুছ চোরা সিঁধ কেটেছে, নানান বিচার চলে, আর চলে ঘন্টায় ঘন্টায় চা। এমনি এক মজলিসে দাদা বজ্রকন্ঠে এলান দিলেন, আসছে বছর এই বাড়িতেই পূজো হবে। তিনি শহর থেকে সব ব্যাবস্থা করবেন, গ্রামের সবাই যেন একটু হাত লাগায়। পেছন থেকে সকলের অজান্তেই সুবল- বীরবল হাঁক দিয়ে উঠে, ‘বলো দূর্গা মা- কী! জয়!’
সে রাতে আর সুবলকে পায় কে! এবার থেকে আর যাবে না প্রদীপদের বাড়ি। নিজেদের বাড়িতেই অঞ্জলী হবে, আরতি হবে, আর ধুনুচী! কত লাগবে! দরকার হয় আগে থেকে টাকা জমিয়ে নিখুঁত ধুনুচি কিনবে। নিকুচি করি- ভাংগা ধুনুচির। অন্য পাড়ার ছেলেরা নাচতে এসে হয়রান হয়ে গেলে জগ ভর্তি জল আর গ্লাস নিয়ে নাচিয়েদের পিছু পিছু চলবে। ধুনুচিতে মুঠো মুঠো ধূপ দিবে, ধোঁয়ায় অন্ধকার করে ফেলবে সারা বাড়ি। হ্যাজাকের আলো কমে গেলে দাদাকে বলবে, ও দাদা পাম্প দে। ভীষণ উত্তেজিত সুবল, তার শীর্ণ শরীরে যেন বল এর জোয়ার এসে গেছে! মুখ থেকে প্রচন্ড বেগে উচ্চস্বরে বেরিয়ে এলো, ‘এই ঢাকি জোরে বাজাও, আরো জোরে।’ মা জেগে ওঠেন, ‘কী রে কি হইছে? ঘুমাস না কেন? সকালে ইশকুল আছে না!’ লজ্জা পায় সুবল, অন্ধকার ঘরে মা যেন না বুঝতে পারেন তাই নিঃশব্দে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরায় সুবল।
সেই থেকে আবার শুরু হয় জমিদার বাড়ির পূজোর বহুকালের রীতি, যা এত বছরেও ভাংগেনি! ও হ্যাঁ, ভেঙ্গেছিল! মধ্যখানে দুই বছর। এক বছর করোনার কারণে, আরেক বছর বাবা তুলসী দাসের চিরপ্রস্থানে। নয়তো এ বছরেও আরেকটা পঞ্চাশ বছরে ঐতিহ্যের কাছাকাছি হয়ে যেত। আর কত বাকি হতে? হাতের কড়ে গুনতে ইচ্ছে করে না প্রৌঢ় সুবলের। গৌরী চলে গেছিল, গৌরী তো আবারো এলো! আনন্দে ক’ফোঁটা জল গড়িয়ে নামে তার গাল বেয়ে।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি