শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরীর চিরবিদায়
১০ অক্টোবর ২০২২ ১৫:৪১
শত শত শিক্ষার্থী, সহকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় চিরবিদায় নিলেন একুশে পদকজয়ী প্রবীণ চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী৷ রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল রবিবার দুপুরে তার মৃত্যু হয়। আজ সোমবার সকাল দশটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার মৃতদেহ আনা হয়। চারুকলায় তার মৃতদেহে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালেদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক উপকমিটি- বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ, ঢাকা আর্ট কলেজ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদ ছাত্রলীগ। এছাড়া তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
চারুকলা অনুষদে তার মৃতদেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেন। এ সময় উপাচার্য বলেন, অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরী ছিলেন একজন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে অত্যন্ত সুনামের সাথে দীর্ঘকাল তিনি শিক্ষকতা করেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনার খ্যাতিমান এই গুণী শিল্পী দেশের চারুকলা শিক্ষাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে অসামান্য অবদান রেখেছেন। সৃজনশীল এই শিল্পী দেশে অনেক গুণী শিল্পীর জন্ম দিয়েছেন। চিত্রকলায় অনন্য অবদানের জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বেলা সাড়ে এগারোটায় তার মৃতদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসন, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বলেন, সমরজিৎ রায় নিভৃতচারী একজন মানুষ ছিলেন। যখনি কোনো মেলার বা অসমাম্প্রদায়িক ছবি আঁকতে বলতাম সমরজিৎ দা অত্যন্ত সুন্দর ভাবে সেটি আঁকতে পারতেন। তার যে সৃষ্টি কর্ম তা তার পরবর্তী শিল্পী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে এবং তার জীবনাচরণ সকলের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
শিল্পী হাসেম খান বলেন, সমরজিৎ রায় নামের মধ্যেই একটি আভিজাত্য আছে এবং তিনি সারাজীবন এই আবিজাত্য নিয়ে জীবনযাপন করেছেন। এই আভিজাত্য কোনো অহংকার নয়৷ তার মতো নিষ্ঠাবান শিক্ষক খুব কমই ছিলো। তিনি এখন নেই কিন্তু তার সান্নিধ্যে যারা এসেছেন তারা সবসময় তাকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। একজন ভালো মানুষের খোঁজ যদি কেও নিতে চায়, খুব সহজে বলা যায় তিনি শিল্পী সমজিৎ রায়চৌধুরী।
চিত্রশিল্পী কামাল পাশা বলেন, এদেশের সংবিধানের যে অলংকরণ সেটি তৈরিতে তিনি কাজ করেছেন। আমাদের পবিত্র সংবিধানে তার হাতের ছোঁয়া আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম তৈরিতেও তার অবদান রয়েছে। তার কাজে তিনি আমাদেরকে ধন্য করেছেন, জাতিকে ধন্য করেছেন৷
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, বাংলাদেশের সংবিধান যতদিন থাকবেন শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী ততদিন সকলের মনের মধ্যে থাকবেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করতেন, আমাদের সংস্কৃতিতে ধারণ করতেন। তার প্রয়াণে আমরা শুধু আজকে একজন বড় মাপের শিল্পীকে হারাইনি, একজন মহান শিক্ষককে হারাইনি, একজন বড় দেশপ্রেমিককে হারিয়েছি।
শহীদ মিনারে পরিবারের পক্ষ থেকে তার সন্তান সুরজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, তিনি শুধু আমার বাবা ছিলেন না, আমার বন্ধু ছিলেন, আমার ভালোলাগার জায়গা ছিলেন। আমি আমার সব সমস্যার সমাধান খুঁজতাম আমার বাবার কাছে। বাবার মুখ থেকে আমার সমাধানটুকু খুঁজে নিয়ে আসতাম। তিনি আমাকে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত আশীর্বাদ করে গেছেন। আমার বাবার শূন্যতা আমার জীবনে কখনো পূরণ হবে না৷ এসময় তিনি সকলের কাছে সমরজিৎ রায়চৌধুরীর জন্য আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন৷
শহীদ মিনার থেকে বেলা সাড়ে বারোটায় তার মৃতদেহ সবুজবাগ কালীবাড়ি মহাশ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়৷ সেখানেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রবীণ চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী মূলত রোমান্টিক ধারার শিল্পী ছিলেন। তিনি ঢাকার তৎকালীন চারু ও কারুকলা কলেজ থেকে স্নাতক লাভ করেন ১৯৬০ সালে। কমার্শিয়াল আর্ট বা গ্রাফিক ডিজাইনে স্নাতক অর্জন করলেও দ্রুত তিনি সৃজনশীল চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ১৯৮৩ সালে অনুষ্ঠিত তার প্রথম একক চিত্র-প্রদর্শনীটি সেদিক থেকে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম দিকে তিনি প্রাকৃতিক নিসর্গ, গ্রামীণ জীবন ও নাগরিক বিষয়নির্ভর তেলরং ছবি আঁকতে উদ্যোগী ছিলেন। তখন তার ক্যানভাসে বিন্যাস ছিল খুব জমাট, রং ছিল গাঢ় ও মিশ্র, আঙ্গিক কিউবিস্ট ধারার। সে-সময় তার সমকালীন অন্য শিল্পীরাও অনেকে প্রায় একই আঙ্গিকে শিল্পচর্চা করতেন। পরবর্তী তিন দশকে তিনি নিজেকে ক্রমাগত বিবর্তিত করেছেন, বিষয় নির্বাচনে, রং-ব্যবহারে এবং উপস্থাপনার আঙ্গিকে।
সমরজিৎ রায়চৌধুরী সাদৃশ্যমূলক দৃশ্য-বর্ণনার চাইতে সাংকেতিক আকার বা প্রতীকের দিকে ঝুঁকেছেন বেশি, নানা রকম জ্যামিতিক আকার, ছোট ছোট ত্রিভুজই তার বেশি পছন্দের ছিল, বা চতুষ্কোণ আকারও ব্যবহার করেছেন। এসব আকার বা ফর্মের উৎস হয়তো ঘুড়ি এবং গ্রামের নানা উৎসব অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত নানা আকৃতির রঙিন কাগজের সাজসজ্জা। সরু রশি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা সেই সব কাগজের সজ্জা, ত্রিভুজ-চতুষ্কোণ ও রশি বা সুতার টানা, এগুলোই ছিল সমরজিতের চিত্রকলার কম্পোজিশনের অনন্য প্রেরণা। কখনো ক্যানভাসের নিচের দিকে বা কোনাকুনিতে হালকা রেখায় শিশু-চিত্রকলার আদলে আঁকা নর-নারী ও শিশুদের উপস্থিতি। এ পর্যায়ে তার রং-নির্বাচন ছিল হালকা ও মিশ্র। প্রাথমিক রঙের ব্যবহার কম। ক্যানভাসে বিস্তর খোলা জায়গা রাখতেন, যেন ঘুড়ি উড়াবার জন্য বিশাল আকাশের প্রতীক। অনেকটা এভাবেই ছবিতে তার নিজস্ব আঙ্গিক তৈরি হয়েছিল। তার আরেক ধরনের ছবিতে বিন্যস্ত হয়েছিল কৃষিজমির ব্যবহার, নানা রঙের আয়তাকার বা বর্গাকার ছোট-বড় ক্ষেত্র, ওপর থেকে দেখা দৃশ্য। এসব ছবির সামগ্রিক চরিত্র পল ক্লি’র কোনো কোনো কাজের মতো, তারপরও ভিন্নতা অবশ্যই আছে। গ্রামীণ দৃশ্যাবলি, বিশেষ করে তার শৈশবের স্মৃতি-জাগানিয়া বা নস্টালজিক দৃশ্যাবলি এবং উপকরণাদি অনুপ্রাণিত করেছিল সমরজিৎ রায়চৌধুরীকে। আবার তার নিজের দীর্ঘদিনের আবাস যে ঢাকা শহর, সেই শহরও তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। পুরনো ঢাকার বিষন্ন বাস্তবতা তার ছবিতে আশ্চর্য বর্ণীল ও উচ্ছলতা নিয়ে ধরা দিয়েছে। বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকেই সমরজিৎ রায়চৌধুরী মানব-মানবী ও পাখিনির্ভর ছবি এঁকেছেন। এক্ষেত্রে উপস্থাপনায় ভারী কালো রেখা ও উজ্জ্বল রং ব্যবহার করতেন।
শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরী দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সুপারনিওমারারি প্রফেসর হিসেবে বর্তমানে একনিষ্ঠভাবে শিক্ষকতা করছিলেন ও নানামাধ্যমে তার শিল্পচর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি