Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ফেসবুকের যুগে কেমন ভাষাচর্চা

বিধান রিবেরু
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩১

সারা দুনিয়াতেই দেখা যায় বেশিরভাগ লেখকের পেশা সাংবাদিকতা। সংবাদপত্রের সাথে জড়িত মানুষগুলোকে যেন লেখালেখির জগত আকর্ষণ করে বেশি। বিদেশী ভাষার বিখ্যাত লেখক, যেমন এইচ জি ওয়েলস, ব্রাম স্টোকার,চার্লস ডিকেন্স, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, মার্ক টোয়েন, জর্জ ওরয়েল, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ প্রমুখরা হয় নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করেছেন সংবাদপত্রের হাত ধরে, নয় তো সারাজীবন সংবাদপত্রে লিখে গেছেন, কেউ ছিলেন প্রতিবেদক, কেউ আবার সম্পাদক। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা অজস্র নাম উচ্চারণ করতে পারবো।

বিজ্ঞাপন

সাংবাদিকতা যারা করেন, তারা ভাষা নিয়ে কাজ করেন। তারা ভাষার কলকব্জা নিয়ে কারবার করতে করতে লেখ্যভাষায় বক্তব্য তুলে ধরার রীতি ও কায়দা রপ্ত করেন। ফলে দেখা যায়, অনেকেই কথাসাহিত্য সৃষ্টিতে আকৃষ্ট হন। তাছাড়া, ভাষা শিক্ষার অংশ হিসেবেও যেহেতু তাদের সাহিত্য পড়তে হয়, তাই সাহিত্যিক হয়ে ওঠার এক প্রবল সম্ভাবনার জন্ম হতে থাকে তাদের ভেতর। তাই সাংবাদিকতা করতে করতে যারা লেখক হয়ে উঠেছেন, তাদের ভাষার গাঁথুনি স্বভাবতই চমৎকার হয়। সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের কথাও বলতে হয় আলাদা করে। তারাও পঠনপাঠনের মধ্য দিয়ে ভাষার সৌন্দর্যকে উপলব্ধি ও প্রয়োগে পারঙ্গম হয়ে ওঠেন। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে।

বিজ্ঞাপন

লেখক সাহিত্যের ছাত্র হোক বা না হোক, লেখা প্রকাশের জন্য পনেরো কি বিশ বছর আগেও, পত্রিকা অফিসেই তারা লেখা পাঠাতেন। সেই লেখা সুসম্পাদিত হয়ে ছাপা হতো পত্রিকায়। লেখক তার ভুলত্রুটি বুঝতে পারতেন। অবশ্য সাংবাদিকতার বাইরে থাকা লেখকরা যে শুধু সম্পাদনার মাধ্যমেই ভাষা শেখেন তা নয়, বিপুল পরিমাণে ভালো লেখা পড়েও তারা ভাষার উপর দখল আনেন। নির্ভুল বাক্যে শব্দের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে যে ভাষাচর্চা পত্রিকাতে হয়, সেখান থেকে শুধু নবীন লেখক নন, অন্যদেরও ভাষাজ্ঞান তৈরি হয়। পাঠ্যপুস্তক ও ভালো বইয়ের মতো, সংবাদপত্রও ভাষাশিক্ষার বড় মাধ্যম। তবে গত দশ কি বারো বছরে একধরনের বিপর্যয় ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কারণে। অবশ্য তার ইতিবাচক দিকও আছে। দুটি দিক নিয়েই আমরা এখানে আলাপ করতে চাই।

প্রথমেই ইতিবাচক দিকের কথাটি বলি। ফেসবুক বা ব্লগের মাধ্যমে যেহেতু যে কেউ চাইলেই নিজেদের লেখা প্রকাশ করতে পারছে, তাতে করে এতদিন যে পত্রিকাকেন্দ্রিক ক্ষমতাচর্চা হতো, বা স্বজনপোষণের ব্যাপার ছিলো, তা ছিন্ন হলো এবং অনেক লেখকই মুক্তভাবে লেখালেখি চর্চা শুরু করলেন। বলা যায়, লেখালেখির এক ধরনের গণতন্ত্রায়ন ঘটলো। লেখালেখির মুক্তি মিললো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। নিজের মত ও যুক্তির কথা ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারীরা কোন রকম কর্তনছাড়া প্রকাশ করতে শুরু করলেন। তাতে অন্যরকম বিপত্তিও ঘটেছে। স্বাধীনতা মানে যে, যা ইচ্ছা তাই করা নয়, সেটা আবার অনেকেই ভুলে গেলেন। দেখা গেলো অনেকেই অনর্থক আক্রমণাত্মক রচনা তৈরি করতে থাকলেন। আক্রমণ বা তর্ক করার ভাষাও যে পরিশীলিত ও পরিমিত হতে পারে সেটা অনেকে ধরতে পারলেন না।

যাই হোক, তরুণদের কাছে প্রযুক্তি এক আশীর্বাদরূপে আবির্ভূত হলো। কারণ এর ফলে তাদের আর পত্রিকা অফিসে সম্পাদকের টেবিলে ধর্না দিতে হয় না। যখনতখন যে কোন জায়গা থেকে তারা মনের ভাব প্রকাশ করে দিতে পারছেন। সেসব ছোট ছোট স্ট্যাটাস আবার ইদানিং পত্রিকাতেও ছাপা হয়। পত্রিকায় ছাপা হওয়া স্ট্যাটাসকে আবার উল্টো ফেসবুকে শেয়ার করা হচ্ছে। রেফারেনশিয়াল ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির এক অনন্য উদাহরণ। সেসব স্ট্যাটাস বা শেয়ারের নিচে আবার লোকজন মন্তব্য করছে। সত্যিকার অর্থেই এক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করে সেখানে। তবে এই পরিবেশে যেহেতু কোন সম্পাদনা থাকে না, আমি কন্টেন্ট বা বিষয়ের কথা বলছি না, বলছি ব্যাকরণ বা সিনেটেক্সের কথা, সেহেতু ভুল শব্দ প্রয়োগ, অশুদ্ধ শব্দ, ত্রুটিপূর্ণ বাক্যগঠন ইত্যাদি নিয়েই লেখালেখি চলছে এবং এসব লেখার পাঠক যেহেতু অধিকাংশই তরুণ, তারা এই ভুলভাল ভাষাই শিখে চলেছেন। শঙ্কার জায়গাটি এখানেই।

চলতি বইমেলায় দেখলাম, একজন জনপ্রিয় ইউটিউবারের বই বেরিয়েছে। তার বাংলা ভাষা দেখে যে কোন সচেতন মানুষের কান্না পাবে। আরো বিপদের দিক, এই বিকৃত ও ভুল বাংলার পক্ষে অনেকেই ওকালতি করছেন, বলছেন, ভুল বাংলা লেখা কোন অপরাধ নয়! তারা একুশে ফেব্রুয়ারিকে এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা মনে করেন। তারা ইতিহাস ভুলে গেছেন। তারা ভুলে গেছেন একুশে ফেব্রুয়ারি মানে ভাষা শহীদদের স্মরণ করা। তারা ভুলে গেছেন বাংলা একাডেমির বইমেলাটি তাঁদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই করা হয়। তারা ভুলে গেছেন ভাষার জন্য ভালোবাসা প্রকাশের নিমিত্তেই আয়োজন হয় এই গ্রন্থমেলার। এখন সেই মেলাতেই ভাষার বলাৎকার চলছে, আর কেউ কেউ সাফাই গেয়ে বলছেন, এটি অপরাধ নয়!

বাংলা ভাষা না জানা বা এর যে দুর্গতি সেটির জন্য আমি একেবারেই প্রযুক্তিকে দায়ী করছি না। শুধু বলতে চাইছি, এখনকার তরুণরা যে লেখালেখি করছেন, সেটা মূলত অনলাইন প্লাটফর্মে এবং সেখানে তাদের ভাষা শুদ্ধ করে দেয়ার কেউ নেই। তাই তারা ভাষাটি ঠিক করে শিখতে পারছেন না। না শিখেই লিখে চলেছেন এবং বইপত্রও প্রকাশ করে চলেছেন। আরো পরিতাপের বিষয়, যেহেতু আমাদের প্রকাশনা শিল্পে কোন সম্পাদনা পর্ষদ বলে কিছু নেই, তাই এসব ত্রুটিপূর্ণ বই বাজারে চলে আসছে। লোকজনও সেসব কিনে বাসায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে, বাংলা ভাষা রাজপথ ছেড়ে ডোবার দিকে রওনা দিয়েছে। অবশ্য এজন্য শুধু এই প্রযুক্তিনির্ভর তারুণ্যকে দোষ দেবো না। এজন্য দায়ী সমাজের বড় বড় মাথা ও রাজনীতিবিদরাও।

বাংলাদেশে যদি আজ বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হতো, তাহলে ফেসবুক বা ব্লগে ভুলভাল ভাষা অনেক কম চোখে পড়তো। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকরা যদি মনে করতেন মাতৃভাষাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে আমাদের শিক্ষানীতি, গ্রন্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে, তাহলে এই বিপর্যয় ঠেকানো যেত। তবে বাংলা ভাষার যে বিপর্যয় শুরু হয়েছে, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের ঘর থেকে শুরু করে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়, সরকারি অফিস, আদালত, দোকানপাটের সাইনবোর্ডসহ বিভিন্ন জায়গায়, সেটা বোধহয় আর রোধ করা যাবে না। যদি না নতুন কোন রেনেসাঁ বা জাগরণ হয়।

যতদিন না পর্যন্ত বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ব ও মর্যাদা সমাজ ও রাষ্ট্রের উপরের মহল থেকে যথাযথভাবে দেখানো হচ্ছে, ততোদিন পর্যন্ত রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই মাতৃভাষার মানমর্যাদা নষ্ট হতে থাকবে, এমনকি এক সময় বাংলা ভাষা বিলীন হয়ে গেলেও অবাক হবো না। তবে সেটা হওয়ার আশঙ্কা নেই। দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। এখন যেটি দরকার তা হলো সমাজের উচ্চমহলের বোধ জাগ্রত হওয়া ও সদিচ্ছা পোষণ করা। তাহলেই ভাষা বিষয়ক সচতেনতা সমাজের নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়বে। তখন আর চাইলেও কেউ ভুল ও অশুদ্ধ লিখতে পারবেন না। ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার জায়গাটিকে মজবুত করতে পারলেই শুদ্ধতার চর্চা শুরু হবে। তখন আর কেউ ভাষাকে অবজ্ঞা বা অবহেলা করতে পারবে না। যেনতেন প্রকারে বাংলা লেখার যে নৈরাজ্য শুরু হয়েছে, তা কমিয়ে আনতে ভাষার প্রতি প্রেম ও মমতাকে উস্কে দেয়ার কোন বিকল্প দেখছি না।

লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক ও কথাসাহিত্যিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রবন্ধ ফেসবুকের যুগে কেমন ভাষাচর্চা বিধান রিবেরু সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর