‘বিশ্বায়ন’ আদর্শের অপব্যাখ্যা, ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তৃতি
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ২১:৪৫
বাংলাদেশের ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা প্রথম শ্রেণি থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক সাক্ষরতা শিক্ষা কার্যক্রম ও প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চতম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে ঐচ্ছিক শিক্ষা কার্যক্রম— এই দ্বিবিধ শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে গঠিত। এই শিক্ষাব্যবস্থা সর্বাত্মক এবং দেশব্যাপী বিস্তৃত। বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতিতে ইংরেজি ভাষা হলো বিদেশি ভাষা। এই শিক্ষাব্যবস্থা যে সব আদর্শকে পূঁজি করে প্রতিষ্ঠিত, তার অন্যতম হলো ‘বিশ্বায়ন’। বিশ্বায়নকে যদি ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে নিয়ে কোনো ভাষা শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে সেখানে শুধু ইংরেজি ভাষা নয়, অন্যান্য বিদেশি ভাষাও শিক্ষাব্যবস্থায় ঠাঁই পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে একক বিদেশি ভাষা ভিত্তিক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে এর কুফল দেশের সমাজ ও সংস্কতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, আগামী ২০/৩০ বছরের মধ্যে দেশের প্রায় ৫০ লক্ষ লোকের ১ম ভাষা হবে ইংরেজি, যাদের কাছে বাংলা হবে ২য় ভাষা। এই ৫০ লক্ষ লোক যাদের অধিকাংশের ইংরেজি জ্ঞান হয়তো বেসরকারি বাণিজ্যিক দপ্তরের ৮/১০ রকমের দলিল-পত্র বোঝার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু এই শ্রেণিটি আগামী বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। যাদের ১ম ভাষা বাংলা, তারা এ দেশে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কোণঠাঁসা হয়ে পড়বে। বাঙ্গালি জাতির জন্য বিষয়টি নি:সন্দেহে উদ্বেগজনক। কেননা ইংরেজি ভাষাভাষীগণ দেশের জাতীয় মূল নীতিসমূহকে পাশ কাঁটিয়ে, এ দেশেরই অর্থে দেশে তাদের মতো করে একটি সংস্কৃতি ও জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে নিবে। বলা যায় যে, আগামী ২০/৩০ বছর এ জনগোষ্ঠীটি দেশে একটি শাখাজাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। স্মর্তব্য যে, এই পরিমাণ জনগোষ্ঠী অনেক দেশেই নেই।
স্বদেশে এই যে (প্রথম ভাষা ইংরেজি ওয়ালা) শাখাজাতি গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যে, তার অন্তরালে রয়েছে ‘বিশ্বায়ন’ ধারণাটির অপব্যখ্যা। গত কয়েক দশক ধরে শিক্ষাবিদরা বিশ্বায়ন ধারণাটিকে অপব্যাখ্যা দিয়ে দেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা ও দাপ্তরিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ওকালতি করে যাচ্ছে। কিন্তু আদতে বিশ্বায়ন কোনোক্রমেই সর্বাত্মক ও একক ইংরেজি ভাষানীতিকে সমর্থন করে না। বিষয়টি বুঝানোর জন্য নিম্নে এ সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো। বিশ্বায়ন হল—বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্ত একটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া যার উপযোগিতায় অংশগ্রহণকৃত বিশ্বের দেশ বা অঞ্চলসমূহ তাদের নিজ নিজ জ্ঞান, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, দ্রব্য, পণ্য ও পুঁজি ইত্যাদি বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পর লাভবান হতে পারে এবং সার্বিকভাবে বিশ্বজগৎ লাভবান হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বায়ন কেবলই বুলিসর্বস্ব আদর্শে পরিণত হয়েছে। এতে অংশগ্রহণকারী অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ বা অঞ্চলসমূহ লাভের পরিবর্তে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ একচেটিয়াভাবে এ প্রক্রিয়া থেকে লাভবান হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যেম অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহ অবিরত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের স্বীকার হচ্ছে। যে কারণে বিশ্বায়ন আদর্শটি বাংলাদেশের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই জাতীয় আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। সেজন্য বিশ্বায়ন আদর্শের ভিত্তিতে একটি বিদেশি ভাষা (ইংরেজি ভাষা সমেত) ভাষানীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা প্রয়োজন যেনো বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই জাতীয় জাতীয় চার মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।
বস্তুত: ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে ‘বিশ্বায়ন’ কোনো ক্রমেই বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ বিরোধী কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না। কিন্তু দেশে বর্তমানে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা ও ইংরেজি মাধ্যমের দাপ্তরিক ব্যবস্থার যে তোড়জোড় চলছে, তা বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ বিরোধী চিন্তাধারা প্রসূত। কিন্তু বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিয়ে বিশ্বায়নের নিরিখে দেশে কোনো বিদেশী ভাষা মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা ও দাপ্তরিক ব্যবস্থা চালু করা হলে, সেখানে প্রথমে প্রাধান্য পাবে বাংলা, আর সেখানে এককভাবে বিদেশি ভাষা হিসাবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব থাকবে না। বরং সব বিদেশি ভাষা সমান গুরুত্ব পাবে। বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাও হবে সেই আদলে। কিন্তু দেশের কোনো ভাষানীতি নেই, বিদেশি ভাষা শিক্ষানীতিও নেই। সেই সুযোগে ইংরেজিবিদরা দেশ ও জাতিকে ভুলভাল বুঝিয়ে দেশে একটি শাখাজাতি সৃষ্টি ও প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু করেছে।
উক্ত উদ্যোগ রুখতে ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ হিসাবে বিশ্বায়নকে যথাযথ ব্যাখ্যা সাপেক্ষে একটি ভাষানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে, বিশ্বায়ন ভাষা-রাজনৈতিক আদর্শ বিদেশি ভাষা ও বিদেশবিদ্যা চর্চা সহায়ক ভাষানীতিকে সমর্থন করে। এ হিসাবে বিশ্বায়ন আদর্শ বিদেশবিদ্যা বিষয়ক অধ্যয়ন এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিদেশি ভাষা শিক্ষানীতিকে সমর্থন করে। এটি এমন একটি বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে, যেখানে বাংলাদেশের সাথে যে সমস্ত দেশ বা অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ রয়েছে বা যোগাযোগের প্রয়োজন রয়েছে সে সমস্ত দেশের আঞ্চলিক অধ্যয়ন (অর্থ্যাৎ ইংরেজি আঞ্চলিক অধ্যয়ন) ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিদেশি ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমকে সমর্থন করে। এ আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সমাজ-ভাষাবৈজ্ঞানিক কোন আদর্শ বর্তমান বাধ্যতামূলক ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। বরং এটি একটি ঐচ্ছিক বিদেশি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে। সে অর্থে এটি বাংলাদেশের ভাষা-পরিস্থিতি একক বাধ্যতামূলক ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে সমর্থন করে না।
উক্ত উপায়ে বিশ্বায়নের আলোকে প্রণীত একটি ভাষানীতির নিরিখে একটি বিদেশি ভাষা-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে-দেশের ভাষা পরিস্থিতিকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে, ইংরেজি ভাষা শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগপোযোগী করা সম্ভব হবে। কাজেই বিশ্বায়নের অনাঙ্খিত কুফল থেকে রক্ষা পেতে হলে বিশ্বায়নের মূলবাণীকে আমলে নিয়ে তার আলোকে বিদেশি ভাষানীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন। এই ব্যবস্থায় বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সকল বিদেশি ভাষার পঠন-পাঠন ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিভিন্ন দেশের সাথে কূটনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সংস্কৃতিক সম্পর্ক জোড়দার হবে। একই সাথে দেশে বাংলিশ সৃজন ও বাংলিশ শাখাজাতি সৃজনের প্রক্রিয়া রোধ হবে।
লেখক: পরিচালক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভূতপূর্ব অভ্যাগত অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়, ভূতপূর্ব অতিথি শিক্ষক, টোকিও বিদেশবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়, ভূতপূর্ব গবেষণা ফেলো, জাপান রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউট
সারাবাংলা/এসবিডিই
‘বিশ্বায়ন’ আদর্শের অপব্যাখ্যা- ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তৃতি অধ্যাপক ডক্টর এ.বি.এম.রেজাউল করিম ফকির প্রবন্ধ